Thursday 26 July 2007

'নদী'র নাম সই অঞ্জনা ...

আ আ আ আ আ আ আ ... ...

যতোটুকু সম্ভব মুখ হাঁ করে তারস্বরে চেঁচিয়ে যাচ্ছে একপাল ছেলেমেয়ে। আমিও মুখটা হাঁ করে আছি। গলায় অবশ্য কোনো শব্দ নেই। সে অবস্থায় আমি বাম থেকে ডান, ডান থেকে বামে চোখ ফেরাই। একাগ্রচিত্তে গলা সাধছে সবাই। আমি খেয়াল করতে থাকি কার কার আলজীব দেখা যায়।

নদীর কাছে এসে চোখ থামাই। গলাটা একটু বাড়িয়ে আলজীব দেখার চেষ্টা করি। পারি না, নিরাশ হই। ক্ষান্ত হয়ে আওয়াজ বের করি গলা থেকে। আ আ আ আ ... ...

= = = = =

ওয়ার্কশপ শেষে সবাই সিঙ্গাড়া খাবে ঠিক করে। আমি ধীরপায়ে জটলা থেকে, পরিকল্পনা থেকে সরে যাই। পকেটে আছে তিনটাকা। কলিজা সিঙ্গাড়ার দামও তিন টাকা। খুব বুদ্ধিযুক্ত কাজ মনে হয় না সিঙ্গাড়া খাওয়ায় শামিল হওয়া। বরং বাংলা ফাইভ কিনলেও আরো পঞ্চাশ পয়সা থেকে যাবে।

সিগারেট ধরিয়ে দোকান থেকে একটু সরে দাঁড়িয়ে কষে তিনচারটা টান দেই। লাস্ট তিন ঘন্টা সিগারেট খেতে পারিনি। ছেলেমেয়েরা বেরিয়ে আসছে। উঁকি দিয়ে দেখে দ্রুত হাঁটতে শুরু করি গেটের উদ্দেশ্যে।

= = = = =

চুমুর মতো শব্দ করে দুইটানে সিগারেট শেষ করে ফিল্টারটা মাটিতে পিষে ফেলি। তাকিয়ে দেখি নদী আসছে। চুলগুলে হাত দিয়ে পিছনে সরিয়ে দিই। নদী আরো কাছে আসে। সঙ্গে শাওন।

- কি ব্যাপার, সিঙ্গাড়া খাওয়ায় তো ছিলে না।
- ধ্যাত। ওইসব সিঙ্গাড়া আমার ভালো লাগে না।
- এখানে দাঁড়িয়ে আছ যে? বাসায় যাবে না?
- হ্যা। চল।

শাওন, নদী সহ হাঁটতে থাকি। ওরা কি নিয়ে যেন কথা বলছে। আমার কানে কিছুই যায় না। আমি নদীর ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে থাকি। একবার সরু হয়, আরেকবার প্রসারিত হয়, মাঝে মাঝে দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে। নদীর দাঁতগুলো দেখার চেষ্টা করি। সোডিয়ামের মৃদু আলোয় গোণা যায় না। ধ্যাত, আমি চেষ্টা বাদ দিই। তারচেয়ে বরং আগামীকাল নদীর চোখের পাঁপড়ি গুণব।

= = = = =

শাওন একটু পর বিদায় নিয়ে চলে যায়। এতোক্ষণ চুপচাপ থাকা আমি কথা বলতে শুরু করি।

- তোমার নাম তো বেশ সুন্দর। নদী।
- হ্যা। সবাই তাই বলে।
- তোমার দেশের বাড়ি কই?
- ময়মনসিংহ।
- ওইখানে নদী আছে ?
- না। নদ আছে। ব্রহ্মপুত্র।
- ও ওইটা ময়মনসিংহে নাকি?
- হুমম।
- আমার বাবা একবার ময়মনসিংহ গেছিল। ওইখানকার মন্ডা খুব মজার হয়।
- ওইটা আসলে মুক্তাগাছা। একই কথা, অনেকে ময়মনসিংহের মন্ডাও বলে।
- তুমি গল্প লেখো ?
- মাঝে মাঝে লিখি তো।
- কোথাও ছাপা হয়েছে?
- যায়যায়দিনে পাঠিয়েছিলাম। ওরা ছাপায় না।
- আমারটা ছাপিয়েছে।
- ওমা তাই নাকি! কোন সংখ্যায়?
- চিঠি সংখ্যায়।
- আমারটা ডাস্টবিনে ফেলে দিছে মনে হয়।

আমি হাসি। যায়যায়দিনের প্রতি অসীম কৃতজ্ঞতায় মন ভরে যায়। মনে মনে প্রার্থনা করি, কখনোই যেন নদীর কোনো লেখা যায়যায়দিনে ছাপা না হয়। মুখে বলি,

- না না। লেখতে থাকো, ছাপা হবেই।
- আর হইছে। আচ্ছা আমি যাই।

রোকেয়া হলের কাছাকাছি টিচার্স কোয়ার্টারে আসতেই নদী বিদায় নিতে চায়।

- এখান দিয়ে কোথায় যাও? হলগেট তো আরো দূরে।
- হলগেট বন্ধ। কোয়ার্টারের ভিতরে একটা ভাঙ্গা দেয়াল আছে। আমি লুকিয়ে ঢুকে পড়ি। এতো রাত পর্যন্ত বাইরে থাকার পারমিশন নাই।
- আচ্ছা যাও। আগামীকাল দেখা হবে।

= = = = =

সোহরাওয়ার্দী পার্কের ভিতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ভাবি, আগামীকাল ওয়ার্কশপে গ্রুপিং হবে। এনিহাউ ওর গ্রুপে থাকতে হবে। গ্রুপ প্রোডাকশনে চামে ওর হাত ধরে ফেলব। সিদ্ধান্ত নিয়েই বেশ খুশি খুশি লাগল। কিন্তু পরক্ষণেই ... হায় হায় !

এক সপ্তাহ হয়ে গেল অথচ ওর হাতের আঙ্গুলগুলো তো ভালো করে খেয়াল করলাম না। ধ্যাত ...

Wednesday 25 July 2007

ভারতের দিনগুলো : শেষ পর্বের দ্বিতীয় কিস্তি (দেবযানীকে দেখব বলে ... )

এ্যালবামের পাতাগুলো ঝাপসা হয়ে গেছে। তারপরও একটা করে পাতা উল্টাচ্ছি আর বন্ধুদের ছবিগুলো দেখছি। যেন এখনই আমাকে এ্যালবামটি ফেরত দিতে হবে, তার আগে যতোটুকু পারা যায় মুখগুলো হৃদয়ে গেঁথে ফেলতে চাইছি। একপর্যায়ে আর পারলাম না, এ্যালবামের পাতাগুলো ভিজে যাচ্ছে। চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে। সিক্ত আমি, এ্যালবামটা বন্ধ করে দিই। জীবনে এদের সঙ্গে আর হয়তো দেখা হবে না। প্রিয়জন ছেড়ে দূরে যাওয়া আসলেই খুব কষ্টের। আমি চোখ মুছে একটু এলিয়ে বসি ...

... আমি দেবযানীর কাছে যাচ্ছি। ট্রেনটাকে খুব আপন মনে হলো। ঝিকঝিক শব্দে আমাকে ছুটিয়ে নিয়ে যাচ্ছে দেবযানীর কাছে। আমি ভাবতে চেষ্টা করলাম দেবযানীর মুখটা। আশ্চর্য একদমই মনে পড়ছে না। নিজের উপর বিরক্ত হলাম। এটা কি হচ্ছে? দেবযানীকে প্রথম দেখার স্মৃতি হাতড়ালাম। ঝাপসা হয়ে ধরা দিল দেবযানী। আমি তাতেই খুশি।

ভাবতে লাগলাম দেবযানীর কথা। আমাকে দেখে নিশ্চয়ই খুশি হবে। স্টেশনে আসার কথা রিসিভ করতে। আচ্ছা ও কি ড্রেস পড়বে? দেবযানী একটু মোটাসোটা মেয়ে। একটু কি শুকিয়েছে? না থাক, ওকে একটু মোটাতেই বেশ মানায়। ও পরীক্ষার কথা বলছিল। প্রিপারেশন ভালো হচ্ছে কিনা কে জানে। ওকে বাংলাটা ভালো করে শেখাতে হবে। শুধু বলতে পারলেই কি হয় নাকি? বাঙালির মেয়ে বাংলাটা লিখতে পারে না - হতেই পারে না। বাঙালির সন্তান জীবনে প্রথম অক্ষরটি লিখবে - অ।

কিসব আবোল-তাবোল ভাবছি আমি ! ধ্যাত, দেবযানী তো আমার শুধুই বন্ধু। সেটাকে আরো খাঁটি করে তুলতে হবে। শুধু একবার দেখা আর দুটো চিঠি পেয়েই এতো কিছু ভাবার কোনো মানে হয় না। তবে আমি নিজেই বুঝতে পারছি দেবযানীর সঙ্গে দেখা হবার জন্য বেশ মুখিয়ে আছি আমি।

ঘুমানোর চেষ্টা করছি। কিন্তু ঘুম আসছে না। দীর্ঘ চারমাস পর দেশে যাব। একটু ভয় ভয় লাগছে। মধ্যবিত্ত বাবার এতোগুলো টাকা খরচ করে `এডিটিং' শিখলাম, কাজ করে খেতে পারব তো? শঙ্কা জাগে মনে। `নাটক করা ছেলে এবার কিসব ছাইপাশ শিখে এসেছে' - বলে ত্যাড়া মন্তব্য করার মতো লোকের অভাব নাই। ধ্যাত, আগে যাই তো বাংলাদেশে।

আমি আবার দেবযানীর কথা ভাবতে লাগলাম। আমি কোথায় থাকব সে ব্যাপারে কিছুই বলা হয়নি দেবযানীকে। আমাকেও দেবযানী নিজে থেকে কিছু বলেনি। আমি গল্প বানাতে শুরু করি। দেবযানীরা হলো আদর্শ ফ্যামিলি। একভাই - একবোন আর বাবা-মা। আমি ভাবতে লাগলাম আমাকে নিশ্চয়ই দেবযানীর ছোটভাইয়ের সঙ্গে থাকতে হবে। আচ্ছা মধ্যরাত পর্যন্ত দেবযানীর সঙ্গে যদি গল্প করি ওর বাবা-মা মাইন্ড করবে না তো ? মনে হয় না। ওর বাসায় কি সিগারেট খাওয়া যাবে ? দেবযানী খুব একটা অপছন্দ করে মনে হয় না। আমি আর রোমেল যখন সিগারেট খাচ্ছিলাম তখন তেমন কিছু মনে করেনি দেবযানী। আমি ভাবতে থাকি, গভীররাতে আমি আর দেবযানী বসে গল্প করছি। গল্পের মাঝপর্যায়ে আমরা দুজনই হাত ধরে থাকি। কিন্তু কেউই খেয়াল করি না। গল্প যেন ফুরায় না। আমাকে ঠেলে ঘুমোতে পাঠায় দেবযানী ...

... ভাবতে ভাবতে নিজেই লজ্জা পেলাম। ইনস্টিটিউটে থাকতে এই চারটা মাস দেবযানীকে একদমই মনে পড়েনি। এমনকি ট্রেনে উঠেও দেবযানীর মুখটা অনেকট কষ্টে মনে করতে হয়েছে। অথচ এই আমিই কিন এখন দেবযানীকে নিয়ে লাভস্টোরি ভাবছি। তারচেয়ে বরং ঘুমিয়ে যাই।

আমি সত্যি সত্যিই ঘুমানোর আয়োজন করলাম। কাঁথা বের করে জড়িয়ে নিলাম। পরদিন ১১টায় ট্রেন বারাণাসী পৌঁছবে। দেবযানী স্টেশনে আসবে। দেখামাত্র কি বলব আমি? দেবযানীই বা প্রথম কি বলবে? এই যাহ। ওর জন্য তো কোনো গিফট নেয়া হলো না। কি ছোটোলোকি কারবার। আমাকে কার্ড পাঠাল, নিয়ম করে দুইটা চিঠিও পাঠাল। আর আমি কিনা কিছুই নিলাম না তার জন্য। নিজেকে কষে চটকানা দিতে ইচ্ছে করল।

মানুষ ঘুমাতে যায় খুব আরাম করে। আমি ঘুমিয়ে গেলাম নিজের উপর একরাশ বিরক্তি নিয়ে।

ভারতের দিনগুলো : শেষ পর্বের প্রথম কিস্তি

ইনস্টিটিউটে বেশ ভালোভাবেই দিন কাটছে। প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত ক্লাশ করি। তারপর স্থানীয় 'আট্টা' মার্কেটে আড্ডা মারতে যাই। মাঝে মাঝে বিলিয়ার্ড খেলি, যতো না খেলার উৎসাহে, তারচেয়ে বেশি সুন্দরী মেয়েদের দেখার লোভে। কেএফসি অথবা ম্যাকয়ের মুরগীর ঠ্যাং চিবোতে চিবোতে হস্টেলে ফেরা। মঙ্গলবার হলেই তো কেল্লফতে। কমনরুম জুড়ে প্রচন্ড হল্লা করে টিভি-৬ দেখতে বসে যাওয়া।

দেবযানীকে একদম ভুলে গেছি। এখন অন্তরজুড়ে রাধিকা। খুবই সুন্দরি মেয়ে। ক্লাশের বিরতিতে একটু হাঁটাহাঁটি করা, মাঝে মাঝে হাত ধরা বেশ চলছিল। ওদিকে শ্বাশতীর পাত্তা একদমই গেছে ইনস্টিটিউটে। প্রেম-ভালোবাসার মধ্যে নেই- এরকম ঘোষণা দিয়ে শ্বাশতী ঝুলে পড়ল কাশ্মীরের ছেলে অমিতাভের গলায়। সেই থেকে শ্বাশতী হয়ে গেল সবার চক্ষুশূল। সবার একই কথা, কি দরকারটা ছিল তোর বলার প্রেম করবি না। শ্বাশতীর দোষ এই একটাই। তার সে কি প্রেম! একসঙ্গে না হলে খাবে না, অমিতাভের ক্লাশ শেষ না হওয়া পর্যন্ত শ্বাশতী কোথায় নড়বেই না। সবারই খুব বিরক্তিকর লাগছিল বিষয়টা।

সিমলার ছেলে রজনীশ ছিল আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু। দেদারসে খরচ করত। অন্যান্য ইন্ডিয়ান ছেলেদের মতো কিপটা না। আমি, রাধিকা, রজনীশ মিলে বেশ আড্ডা দিতাম। এরকম একদিন ক্যান্টিনে আড্ডা মারছি, হঠাৎই সুরেশ স্যারের ডাক পড়ল। আমার নাকি চিঠি এসেছে। অবাক হলাম, আমাকে কে চিঠি লিখবে। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ ছিল তখন।

সুরেশ স্যারের রুমে গিয়ে চিঠি নিয়ে এলাম। দেবযানী লিখেছে। সঙ্গে একটা নিউইয়ার কার্ড। চিঠি খুলে পড়তে শুরু করলাম। কাকের ঠ্যাং, বগের ঠ্যাং স্টাইলে চিঠি লিখা। দেবযানী আসলে বাংলা লিখতে পারে না। অনেক কষ্ট করে আমার জন্যই সে এ চিঠিটা লিখেছে। বারাণাসীতে আমাকে দাওয়াত দিয়েছে সে। কোনো এক ফাঁকে যেন যাই বেড়াতে। আমিও মনে মনে ঠিক করলাম যাব একদিন।

একদিন ক্যান্টিনে এক ছেলের সঙ্গে তুমুল লেগে গেল আমার। বাংলাদেশ প্রসঙ্গে কথা হচ্ছিল। কথায় কথায় সঞ্জয় বলল, বাংলাদেশ জাস্ট ফর ইন্দিরা গান্ধী। আমার তো মেজাজ সপ্তমে চড়ে গেল। তাকে বুঝাতে চাইছিলাম, ইন্ডিয়ার সহায়তার জন্য আমরা কৃতজ্ঞ, কিন্তু এটা ভাবলে চলবে না যে স্বাধীনতার জন্য আমরা তোমাদের (ইন্ডিয়া) মুখাপেক্ষী হয়ে ছিলাম। যাহোক, ঝগড়া হাতাহাতির পর্যায়ে যাওয়ার আগেই অন্যান্যরা থামিয়ে দিল।

কিভাবে যে চারমাস কেটে গেল বুঝতে পারিনি। প্রোডাকশন টাইম চলে এলো। সবাই খুব সিরিয়াসলী প্রোডাকশন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। শ্বাশতী খুব ভালো অভিনয় করেছে। সবাই তাকে এপ্রিশিয়েট করলাম। এবং যথারীতি শ্বাশতী অমিতাভের প্রোডাকশনে সবচেয়ে ভালো অভিনয়টা করল। সার্টিফিকেট যেদিন দেয়া হলো, ওইদিন রাত্রে আমরা সবাই মিলে উদ্দাম পার্টি দিলাম। মদ, গাঞ্জা, ভাঙ কোনো কিছুরই অভাব ছিল না সেদিন। রাধিকা-শ্বাশতীকে নিয়ে প্রচন্ড নাচানাচি করলাম।

পার্টি শেষ হয়ে এলো। পরদিনই হস্টেল খালি হয়ে যাবে। কে কোথায় চলে যাবে, তার কোনো ঠিক নেই, আবার কি কখনো দেখা হবে, কেউ বলতে পারে না। সবার খুব মন খারাপ। পানীয়ের কারণে অনেকেই কাঁদতে শুরু করেছে। আমি একমাত্র বাংলাদেশী ছেলে হওয়াতে সবাই আমার কাছেই বেশি আসছিল। ওদের কারো কারো হয়তো দেখা হবে, কিন্ত আমার সঙ্গে নাও হতে পারে। রাধিকা সেদিন আমাকে অনেকক্ষণ জড়িয়ে ধরে রেখেছিল। সারাক্ষণ রাধিকার সঙ্গে ছোঁক ছোঁক করা আমি ওইদিন একেবারেই নিরস হয়ে ছিলাম।

আমার প্ল্যান ছিল কোর্স শেষে বাংলাদেশ যাবার আগে নেপাল ঘুরে যাব। কিন্তু আমার নেপালী রুমমেটের দিল্লিতেই একটা চাকরি ঠিক হয়ে যাওয়াতে সে প্ল্যান বাদ দিতে হয়। কই যাওয়া যায় চিন্ত করছিলাম। তখনই ফোন করলাম দেবযানীকে। বললাম, আমি আসছি। দেবযানী বলল, চলে আয়।

পুরান দিল্লি স্টেশন থেকে মালদহ এক্সপ্রেসে দিল্লি-বারাণাসী এবং তার তিনদিনপর বারাণাসী-কলকাতা টিকেট কেটে ফেল্লাম। ট্রেনে উঠে মন খারাপ হয়ে গেল। চোখের কোণে পানি চলে এলো। এইসব বন্ধুদের সঙ্গে হয়তো আর দেখা হবে না। হয়তো কি, আসলেই তো দেখা হলো না। আমি চোখের পানি মুছে ট্রেণ ছাড়ার অপেক্ষা করতে থাকি।

দেবযানীকে জানিয়ে দিয়েছি কখন পৌছব। দেবযানী বলেছে, আমার জন্য সে স্টেশনে অপেক্ষা করবে।

ভারতের দিনগুলো (পর্ব ০৫) : এ.এ.এফ.টি

আমার ইনস্টিটিউট ছিল দিল্লীর নয়ডা বলে একটা জায়গায়। ধরা যাক কাওরান বাজার (দিল্লী) থেকে সাভার (নয়ডা) যতোদূর। নয়ডা ছিল একটা ফিল্ম সিটি।জি, টি-সিরিজ, ঈগল, লক্ষী সহ আরো অনেক নামীদামী স্টুডিও ছিল ওইখানে। আমার স্টুডিওটির নাম ছিল এশিয়ান একাডেমী অফ ফিল্ম এন্ড টেলিভিশন। এর প্রথম বাংলাদেশী ছাত্র ছিল ইউরেকা, তারপর আমি, তারপর কামাল (ক্যামেরাম্যান)। পরে শুনেছি আরো অনেকেই ওইখান থেকে কোর্স করে বাংলাদেশের মিডিয়ায় কাজ করছে।

ইনস্টিটিউটের প্রথম দিনেই আমি একটা সিল খাইলাম। ক্লাশ শুরুর আগে আগে আমরা হস্টেলের মোট ৭ জন মিলে চা খাচ্ছিলাম। চা খাওয়ার শেষ পর্যায়ে ক্লাশে যাবার তাগাদা আসলে সবাই তাড়াহুড়ো করে চা শেষ করল। আমাকে বলল, বিলটা দিয়ে দিতে। বলা হলো ক্লাশ শেষে সবাই আমাকে টাকা দিয়ে দিবে। প্রতিকাপ ৩ রুপী করে আমি ২১ রুপী পরিশোধ করে ক্লাশে চলে গেলাম। কিন্তু ক্লাশ শেষে ওই টাকা আর ফেরত পাইনি। আমি নিজেও কারো কাছে চাইনি। ভাই আপনার চা বাবদ ৩ রুপী পাই, দিয়ে দিন - এটা আমি জনে জনে কিভাবে বলি? তাই আমি তখনো এ ঘটনাকে সিল খাওয়া ভাবতে পারিনি। বাংলাদেশে থাকতে কতোই তো বন্ধুবান্ধবকে চা-সিগারেট খাইয়েছি নিজের পয়সায়। কিন্তু দিন পনেরো পর বুঝতে পেরেছি যে ওটা একটা সিল ছিল। এরকম চামে চামে অন্যের উপর চালিয়ে দেয়ার মানসিকতা হস্টেলের সব বন্ধুদের মাঝেই দেখেছি। একজন ছাড়া, সিমলার রজনীশ।

এডিটিং ক্লাশটা এনজয় করা শুরু করলাম। একেবারে নতুন জিনিশ। আর রাধিকার পাশে তো বসার আনন্দ আছেই। ফট ফট করে ইংরেজি বলে রাধিকা। আমার গরিবী ইংরেজি আর খায়েঙ্গা যায়েঙ্গা হিন্দি নিয়ে রাধিকার সঙ্গে সমানবেগে কথা চালিয়ে যেতে লাগলাম। দিনসাতেক পর তার উপকার পেলাম। টিফিন ব্রেকে রাধিকা আর তার স্বামীর জন্য অপেক্ষা করে না। আমরা একসঙ্গে ক্যান্টিন যাই। রাধিকা কফি বানিয়ে খাওয়ায় (ওর ব্যাগে সবসময়ই নেসক্যাফে থাকত)।

নিজের গর্ব করছি না কিন্তু দিন পনেরো পর আমিই যে সবচেয়ে ভালো এডিটিং শিখছি সেটা ক্লাশে প্রমাণ হয়ে গেল। সবাই কোনো না কোনো ভাবে আমার কাছে কিছু জানতে চাইত। ইনস্ট্রাক্টর তো বলেই ফেলল, ক্যায়া হে কাম্মু। তু তো আচ্ছা নিকলা রাহে।

আমার সঙ্গে সঙ্গে অনুরাগ টোমার (এখন জি-নিউজের রিপোর্টার) এবং রাধিকাও ভালো করতে লাগল। রাধিকার সঙ্গে সম্পর্ক আরো সহজ হয়ে গেল। আমি রজনীশ, অনুরাগ, রাধিকা মিলে একসঙ্গে আড্ডা মারতাম। ইন্ডিয়ান বিভিন্ন মিডিয়া সেলিব্রেটি আমাদের ক্লাশে আসত। তাদের কথা শুনতাম। শোলে ছবিটার কথা জানলাম। এই ছবিটা ডিরেক্টর এতোই শুটিং করেছিলেন যে তিনি সবকিছু আওলে ফেলেছিলেন। পরে তার এডিটর তাকে স্টুডিওতে আসতে মানা করে দেন। এবং নিজে এডিট করে পরে ডিরেক্টরকে খবর দেন। পরে আবার তারা দুইজন মিলে হালকা কারেকশন করে ছবিটা রিলিজ দেন।

এ.এ.এফ.টিতে মোট চারটি কোর্স ছিল। এ্যাকটিং, ক্যামেরা, এডিটিং, ডিরেকশন। কিন্তু আমাদের প্রত্যেকেরই ৪/৫ দিন করে সবগুলোরই ক্লাশ করতে হয়েছিল। ইনস্টিটিউটের সবচেয়ে ভুয়া কোর্স ছিল এ্যাকটিং। পোলাপাইনের পয়সা নষ্ট হইছে বইলা আমার মনে হয়। আমার খুবই কম থিয়েটার চর্চার জ্ঞান দিয়ে বরং ওদের অনেক কিছুই শিখিয়ে দিয়েছি। আমরা হাসাহাসি করতাম যখন কিনা ওরা তলোয়ার ফাইট, ঘোড়ায় চড়া এসব শিখত। ওরা ছিল আমাদের স্নেহের পাত্র। তবে অভিনয় শিখতে আসা কলকাতার মেয়ে শ্বাশতীকে সবাই স্নেহ ছাড়াও আরো অনেক কিছুই দিতে চেয়েছিল।

শ্বাশতী থাকত গার্লস হস্টেলে। বলতে অনেক বড় শুনায় কিন্তু গার্লস হস্টেলটি ছিল দুই রুমবিশিষ্ট। তার একটি ফাঁকা আরেকটিতে শ্বাশতসহ আরো একটি মেয়ে থাকত (অফিসের স্টাফ)। দেখতে তেমন সুন্দরি না শ্বাশতী কিন্তু রাধিকার স্বামীপ্রবর থাকাতে শ্বাশতীই হয়ে উঠেছিল সবার আরাধনা। আমিও একটু হালকা চাম নিতাম। ভাবতাম বাঙালি বলে সুযোগটা বোধহয় আমারই প্রথম আসবে।

কিন্তু শ্বাশতী প্রথমেই সবাইকে ক্লিয়ার করে দিল যে এখানে প্রেম-ট্রেম করতে আসেনি। সবাই তার বন্ধু, সুতরাং প্রেম-ট্রেমের চিন্তা কারো থাকলে বাদ দিতে হবে। শ্বাশতীর এরকম ঘোষণাই ভালোই হলো। প্রেমের চিন্তা বাদ দিয়ে সবাই তার 'সবচেয়ে ভালো বন্ধু' হবার চেষ্টা কর। এরমধ্যে গুজরাটের বিশাল বেশ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

আমি একদিন হতবাক হয়ে গেলাম যখন শ্বাশতী সন্দেহের সুরে জানতে চাইল যে বাংলাদেশে হিন্দু আছে কিনা? আমি অনেক যুক্তিতর্ক ও অনেক প্রতিষ্টিত হিন্দুব্যাক্তিদের নাম শুনিয়ে বললাম এরা ছাড়াও মোট জনসংখ্যার ১৫% হলো হিন্দু। তখন শ্বাশতী জানাল সে একবার বাংলাদেশ যেতে চেয়েছিল কিন্তু তখন তার বাবা-মা মানা করেছিল এই যুক্তি দিয়ে। ওইখানে নাকি সে নিরাপদ থাকবে না। আমি সঙ্গে সঙ্গে শ্বাশতীকে আমন্ত্রণ জানিয়ে রাখলাম। বললাম, তুমি শুধু বর্ডার ক্রস করো। তারপর সেখানে থেকে তোমাকে নিয়ে যাওয়া এবং বর্ডার পৌছে দেয়া পর্যন্ত সব খরচ এবং দায়িত্ব আমার। শ্বাশতী হেসে উঠল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, বাংলাদেশ সম্পর্কে আর কি জানো ? শ্বাশতী বলল, বাংলাদেশ অনেক ধনী (কলকাতার তুলনায়)। তোমাদের লিভিং স্ট্যান্ডার্ড অনেক হাই। তোমরা অনেক খরচ কর। এই যেমন তোমাকে দেখে বুঝি। খুবই অতিথিপরায়ণ । প্রচুর মাছ পাওয়া যায় তোমাদের ওইখানে। এবং প্রচুর বন্যা হয়। এতোসব জানো কিভাবে জানতে চাইলে সে বলল, কলকাতায় বাংলাদেশী হাইকমিশনে সে নাকি মাঝে মাঝে যেতো সানন্দ পত্রিকায় ছাপানোর জন্য বাংলাদেশ সংক্রান্ত খবর কালেক্ট করতে।

শ্বাশতী আমাকে জিজ্ঞেস করল, তুমি কি জানো কলকাতা সম্পর্কে? আমি বললাম অনেক কিছুই জানি। তোমাদের দেশে আসার আগে তোমাদের অনেক রাস্তা আর মোড়ের নাম জানি। সিনেমা হলের নাম জানি। তোমাদের ভাঁড়ের চা আমরা ঢাকাতেই কল্পনা করে খেয়ে ফেলি। তোমাদের সাহিত্য আমরা অনেক পড়ি। অনেকেই এজন্যে গর্ব করে। শ্বাশতী খুশি হলো। বাহ অনেক কিছুই তো জানো।

আমি মুচকি হাসি। বলি না আরো জানি যে তোমরা খুব কিপটা। আতিথেয়তায় প্রাণ থাকে না। তোমরা স্বার্থটাই খুব বেশি বুঝো। ...

ভারতের দিনগুলো (পর্ব ০৪) : অবশেষে দিল্লী

দেবযানীর সঙ্গে বেশ জমে গেল মধ্যদুপুরে। রোমেলও বেশ খাতির করে নিয়েছে। শুধু রোমেলের বন্ধুটা একটু চুপচাপ। দুপুরে ভাত খাওয়ার সময় দেবযানী বাড়ি থেকে আনা পটলের একরকম তরকারিও সেধেছিল আমাদের। যদিও আমরা কেউ খাইনি। সবাই ঠিকানা অদলবদল করলাম। দেবযানী আসলে থাকে বারাণাসীতে। শুনে আমি বেশ মজা পেলাম। ওকে বললাম, কোনো একদিন নিশ্চয়ই যাব। দেবযানীও আমন্ত্রণ জানিয়ে রাখল। দেশে থাকতে শুনেছিলাম বারাণাসীতে নাকি অতি উৎকৃষ্ট প্রকারের বাঈজী নাচ হয়। দেখার খুব শখ ছিল। অবশ্য দেবযানীকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করিনি।

বারাণাসী চলে এলে দেবযানী নেমে পড়ে। বেশ করে টা টা দিলাম ওকে। জানালা দিয়ে অনেকক্ষণ মুখ বাড়িয়ে ছিলাম। আর কি কখনো দেখা হবে? সন্ধ্যার দিকে আলীগড় চলে এলো ট্রেন। রোমেল বিদায় নিল আমার কাছ থেকে। ঠিকানা আগেই নিয়ে রেখেছিলাম। বললাম, ফোন করব তোকে। দিল্লী থেকে মাত্র দেড় ঘন্টা দূর। চলেও আসতে পারি।

রোমেল চলে গেলে একদম একা হয়ে গেলাম। আক্ষরিক অর্থেই একা। খায়েঙ্গা, যায়েঙ্গা টাইপের হিন্দিদৌরাত্ম নিয়ে আমি পড়ে গেলাম মুশকিলে। এতোক্ষণ বুঝতে পারিনি ভিনদেশী অঞ্চলে আছি আমি। আমার বুকে ভয় ধরিয়ে কালকা থামল পুরোনো দিল্লী স্টেশনে। রাত তখন হয়তো আটটা হবে। কিছুই চিনি না। শুধু জানি পাহাড়গঞ্জ যেতে হবে। একটা অটো ঠিক করে চলেও এলাম। তবে রাতের অন্ধকারে বুঝতে পারিনি পুরোনো দিল্লী দেখতে কেমন?

বেশ ভালোই খাওয়া হলো দিল্লীকা লাড্ডু। ৩৫০/৪৫০ টাকার নিচে রুম পাচ্ছি না। আর আমার মাত্র এক রাতের জন্য দরকার। কেননা পরদিনই তো ইনস্টিটিউটে চলে যাব। ওইখানে হস্টেলে থাকব। যাই হোক ২৫০ টাকায় একটা রুম পেয়ে উঠে গেলাম। খুব তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে গেলাম আমি সেইখানে।

পরদিন ইনস্টিটিউটে গিয়ে ভর্তি হই। একজন ইনস্ট্রাক্টর আমাকে সবকিছু ঘুরিয়ে, দেখিয়ে নিয়ে গেল এডিটিং রুমে। এডিটিং মেশিনগুলো দেখে আমার পছন্দ হলো না (এইপ্রথম আমি এডিটিং মেশিন দেখছি, ঢাকায় থাকতে দেখিনি)। আমি ভাবছিলাম কমপিউটার জাতীয় কিছু হবে। ভয়ে ভয়ে বললাম, মেশিনগুলো তো খুব পুরোনো মনে হচ্ছে। এগুলো কাজ করে? ইনসট্রাক্টর আমার কথা শুনে হিন্দিতে বলে উঠল, কেয়া বাত কোরো ইয়ার! এ্যায়সা ঘটিয়া মেশিনমে কাম সিখো তো বেসিক স্ট্রং হো যায়েগা। সামঝা ?

আমি উসখুশ করে বেরিয়ে আসি। পুরো টাকাটাই পানিতে গেল ভাবতে ভাবতে ক্যান্টিনে গিয়ে বসি। একটা ছেলে এগিয়ে আসে। নাম হলো সা'দ। ফয়েজাবাদের ছেলে। ক্যামেরার কোর্সকরতে এসেছে। পরিচয় হতেই বলল, চল কিছু খেয়ে আসি।

কেএসসি-তে গেলাম। ঢাকাতে তখনো এতো বড় আর চেইন কোনো ফাস্টফুডের দোকান ছিল না। এতোসব চেইন শপ দেখে মাথাটা হালকা ঘুরাল। টাইট জিনস আর টি-শার্ট পরা মেয়েদের দেখে তিষ্ঠাতে না পেরে একটা সিগারেট ধরিয়ে ফেল্লাম। যাইহোক খাওয়া দাওয়া শেষে স্বাভাবিকভাবেই আমি বললাম, বিলটা আমি দেই। দেখলাম সা'দ অতি স্বাভাবিকভাবেই বিষয়টা মেনে নিল। বিল দিয়ে বেরিয়ে এলাম।

রাতে হস্টেলে আরো অনেকের সঙ্গে পরিচয় হলো। হরিয়ানা রাজকুমার, দিল্লীর ভাষ্কর্য, নেপালের গৌতম আর ধীরাজ। গুজরাটের বিশাল, কানপুরের মুকুল। কিন্তু পরদিন পরিচয় হলো কলকাতার শ্বাশতী আর দিল্লীর রাধিকার সঙ্গে।

রাধিকা ছিল সবচেয়ে সুন্দরি (আসলেই সুন্দরি) এবং সে ছিল এডিটিংয়ে। আমার রোল ১ আর রাধিকার ২। আমাদের নিয়ম ছিল সবাই রোল নম্বর অনুযায়ী বসবে। নিয়মটা এজন্যে যে, যখন 1 নম্বর মেশিন চালাবে তখন তার ডানপাশে ২ নম্বর আর বাম পাশে ১০ নম্বর (কেননা ব্যাচে ১০ জন ছাত্র ছিল) বসবে। যখন ২ নম্বর কাজ করবে তখন তার ডানপাশে ৩ নম্বর আর বাম পাশে ১ নম্বর বসবে। আর একারণেই ক্লাসে আমি আর রাধিকা সবসময়ই পাশাপাশি বসতাম। তবে ব্রেকের সময় রাধিকা চলে যেত। ওর হাজব্যান্ড ইয়াতিন (ভাগবান, বাবুল ছবির চিফ এ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর) তখন ডিরেকশনের ক্লাস করতো। রাধিকা তার জন্য অপেক্ষা করত। এই ফাঁকে আমি তখন শ্বাশতীকে খুঁজতাম। কলকাতার মেয়ে শ্বাশতী। আমি ধরেই নিয়েছিলাম শ্বাশতীর সঙ্গে আমার একটা ইটিসপিটিস হয়ে যাবেই। কেননা ও-ও হস্টেলে থাকত। তখন দিল্লীতে প্রচন্ড শীত।আমি নিশ্চিত ছিলাম শ্বাশতীর নিশ্চয়ই কোনো এক শীতের রাতে আমায় দরকার হবে ...

... তখন পর্যন্ত কিন্তু দেবযানীকে আমার একদমই মনে পড়েনি ...

ভারতের দিনগুলো (পর্ব ০৩) : কালকামন্থন

ঝিকঝিক ঝিকঝিক গান বাজিয়ে পুরো কম্পার্টমেন্টকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে ট্রেনটি। উহ-আহ শব্দে পাশ ফিরে আবার ঘুমিয়ে পড়ার মতো কিছু হকারের 'এই চায়ে, কফি' ছাড়া কোনো আওয়াজ ভেসে আসছে না। এমনকি জানালার পাশের বার্থে গুটিশুটি মেরে শুয়ে থাকা দেবযানী নাকও ডাকছে না। হিমহিম ভাব, শীত লাগছে। রোমেলের দিকে তাকালাম। বেচারা তার বন্ধুর পায়ের কাছে ঝিমুচ্ছে। আমি হালকা ধাক্কা দিয়ে জাগানোর চেষ্টা করলাম। উঠল না। থাক, ঘুমাক। আমি একটু ঘুমিয়ে নিই। ঘন্টা ২/৩ পরে নাহয় আমার বার্থে রোমেলকে ঘুমাতে পাঠাব-এই ভেবে সবচেয়ে উপরে আমার বার্থে উঠে পড়লাম।

কিন্তু ঘুম আসছে না। ঠাণ্ডা লাগছে। ব্যাগ থেকে লুঙ্গিটা বের করে চাদরের মতো করে জড়িয়ে নিলাম শরীরে। ভাবতে শুরু করলাম ভবিষ্যতের কথা। এডিটিং যে শিখতে যাচ্ছি, জীবনে কতোদূর যাব তা নিয়ে? ফিক করে হেসে ফেললাম আপন মনেই। বাবা-মার কথা মনে পড়ল। সায়েনেস পড়ুয়া ছেলে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হবে এমনটাই আশা ছিল তাদের। কিন্তু ছেলে কিনা এডিটিং শিখছে! মজা লাগল ভেবে বাবা-মা কস্মিনকালেও ভাবেনি ছেলে এরকম একটা পেশা বেছে নিতে পারে। পুরোনো সব কথা মনে পড়তে লাগল ...

ইন্টারের রেজালট খারাপ ছিল না। কিন্তু মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষার দিন - ৭ বছর পড়াশোনা করে, ২ বছর ইন্টার্নি করে, পাড়ার ফার্মেসীতে প্রতি সন্ধ্যায় নিয়ম করে বসে দুই-চার-সাত রোগী মেরে অথবা ভালো করে ৪০ বছর বয়সে অর্থ-যশ-খ্যাতি আসে-এটা যখন আমার এক বন্ধু মনে করিয়ে দিল তখন মেডিকেলের পরীক্ষা না দিয়ে আবৃত্তি সংগঠনের পরীক্ষা দিয়ে বাসায় ফিরলাম। বুয়েটে ঢুঁ মারা আমার কপালে নাই (অতো মার্ক আবার ছিল না)। তাই ঠিক করলাম ভর্তি হতে না পারি তবে মাঝে মাঝে আহসানউল্লাহর কেন্টিনে গিয়ে খেয়ে আসব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা খুবই খারাপ হলো। হুমায়ুন আহমেদের কাছে স্বরচিত গল্প লিখেও যখন এডমিশন রেজালেট নিজের নাম দেখলাম না তখন একটু মুষড়ে পড়লাম। ইস...ইন্টারের পরের তিনমাস জীবন চিনতে না গিয়ে যদি একটু বইয়ে মুখ গুঁজে থাকতাম .... একপর্যায়ে ভাবলাম কম্পিউটার সায়েনস পড়া যেতে পারে সিলেটের শাহজালালে। কিন্তু সিলেটে মাছের দাম বেশি এই যুক্তিতে বাবা-মা আমার সিলেটগমন ঠেকিয়ে দিলেন। এদিকে আমি কোনো হেজিপেজি কলেজে 'অমুক বিষয়ে অনার্স করছি' এইরকম দম্ভ করতে পারব না ভেবে একপর্যায়ে ঠিক করলাম তবে আর পড়াশোনাই বা করি কেন ?

দিলাম পড়াশোনা ছেড়ে। এদিক ওদিক ঘুরি। বন্ধুদের প্রচুর সময় ও পরামর্শ দিই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুদের কাছ থেকে জেনে নিই ওদের বান্ধবিদের কথা। রাতে বাসায় ফিরে তাদের কথা নিজের কল্পনায় সুন্দর করে লিখি। লেখাগুলো গল্প হয়ে উঠে। পাশের বিলিডংয়ের রবিকে পড়তে দিই। বন্ধু রবি খুব উৎসা হ দেয়, বাহ! খুব সুন্দর লেখা তো - তোকে দিয়েই হবে - এরকম লেখা কিন্তু খুব বেশি লেখা হয়নি - চালিয়ে যা দোস্ত, তুই সেরা লেখক হবিই। রবির প্রশংসায় আমি লজ্জিত হই না। যেন জানি এরকমটাই হওয়া উচিত। আমি লেখালেখি বাড়িয়ে দিই। ব্যস্ত হয়ে ঢুকে পড়ি গ্রুপ থিয়েটার চর্চায়।

ইন্টার থেকেই যায়যায়দিন রেগুলার পড়া হতো। ভাবলাম লেখালেখির একটা নিয়মিত জায়গা দরকার। সাংবাদিক হলে কেমন হয়? আমার গ্রুপ থিয়েটারের কমর্ী নদীও তার প্রিয় পত্রিকা যায়যায়দিন পড়ে। আমি আর নদী একসঙ্গে লেখা পাঠাই। আমারটা ছাপা হয়, নদীর হয় না। আমি যেন আরো উৎসাহী হই। নদীর চোখে সেরা পুরুষ হবার জন্য আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি যায়যায়দিনের-ই-ই-ই সাংবাদিক হবো। নদী আমাকে নিয়ে গর্বিত হবে, নদীর বান্ধবিরা আমার জন্য নদীকে ঈর্ষা করবে (হায়রে সে দিনগুলো) ...

এই চায়ে, কফি - হকারের ডাকে কালকাগর্ভে ফেরত আসি। চাররুপী দিয়ে কফির পেয়ালা হাত বাড়িয়ে নিই। চুমুক দিতেই শীত যেন আরো বেড়ে গেল। লুঙ্গিটা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে দেবযানীর দিকে তাকাই। আচ্ছা এই মেয়েটার সঙ্গে কি আমার প্রেম হয়ে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা আছে ? ধ্যাত....আপন চিন্তাই ফিরে যাই আবার।

যায়যায়দিনে হঠাৎই চোখে পড়ে ডেমক্রেসিওয়াচের বিজ্ঞাপন। স্মাট হবার আশায় ইংলিশ-কমপিউটার শিখতে শুরুকরি। কিন্তু যায়যায়দিনের সাংবাদিক হওয়া আর হয়ে উঠে না। লাইফস্টাইল ক্লাসে পৃথিবীর বিভিন্ন মুভির কথা বলেন শফিক রেহমান। কিন্তু তার সাপ্তাহিক আর দৈনিক হয় না। তবে ডেমক্রেসিওয়াচে চাকরি হয়। অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে আয়োজন করে ফেলি গণতন্ত্র উৎসব। গণতান্ত্রিক ধারায় আয়োজন করে ফেলি যায়যায়দিনের প্রথম লেখক সম্মেলনও। শফিক রেহমানকে জিজ্ঞেস করি, স্যার কবে হবে দৈনিক ? শফিক রেহমান পালটা প্রশ্ন করে, ডিগ্রি পাস করেছ? তাছাড়া তোমার যে লেবাস প্রেসিডেন্টের ইন্টারভিউর জন্য পাঠালে তো তোমাকে ঢুকতেই দিবে না।

সায়েনেসর ছাত্র আমি চটজলদি ডিগ্রি পাসকোর্সে ভর্তি হয়ে যাই। এফসিএ শফিক রেহমান দুইদিন খুব করে ডেবিট-ক্রেডিট বুঝিয়ে দেন। ওনার মুখে পড়াশোনার কথা শুনতে ইচ্ছা করে না দেখে বন্ধুদের সঙ্গে একাউন্টিংয়ে ব্যাচ পড়ি। এলিফ্যান্ট রোড থেকে ১৫০০ টাকার জুতো দরদাম করে ৪৫০ টাকায় কিনে বুক ফুলিয়ে ডেমক্রেসিওয়াচে বাবার টাই পড়ে অফিস করি। কিন্তু মালা খুব রাগ করে। জুতোটা পড়লে নাকি আমি ওর চেয়ে একটু বেশি লম্বা হয়ে যাই।

আমরা মোট১৩ জন বন্ধু ডিগ্রি পরীক্ষা দিয়েছিলাম। অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে একমাত্র আমি তৃতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হই। (বাকি ১২ জন ফেল করে)। কিন্তু ওদিকে অপেক্ষার বাপ ভেঙ্গে যেতে থাকে। বন্ধু মানিকের পরামর্শে ফোরামের কোর্স করা শুরু করি। কাজ নেই সাংবাদিক হওয়ার। এরচেয়ে ভালো ফিল্মমেকার হই। কিন্তু তাতেও বোর হয়ে যাই। চষতে শুরু করি সারা বাংলাদেশ। ডেমক্রেসিওয়াচের সার্ভেতে নিয়মিত হয়ে যাই। বেঁধে দেয়া পয়সা বাঁচিয়ে নৌকা ভ্রমণ করি, দিনাজপুরের আম কিনি, চাপাইনবাবগঞ্জের রেলস্টেশনে ফেনিস খাই, ক্লান্ত হয়ে বাসে নিপুর কাঁধে ঘুমিয়ে ঢাকা ফিরে আসি, বাসের ছাদে বসে গোপার উড়ে যাওয়া চুল আবার গুছিয়ে দিই, খাগছড়ির পাহাড়ের বাংলোয় মধ্যরাতে জেগে বসে থাকি যদি পাশের রুমে একা থাকা আরজু ডাক দেয় । কিন্তু না হই সাংবাদিক, না হই ফিল্মমেকার। ওদিকে নদীও কোনো যোগাযোগ করে না। অরূপ নামে একটি ছেলের সঙ্গে তার বিয়ের কথা চলছে।

ইউরেকার সঙ্গে পরিচয় হয়। জাহাঙ্গীরনগরের ছাত্র ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট ছিল সে। ভালো বক্তা। একদিন আমাকে সুন্দর করে বুঝিয়ে বলল, এবার চলেন এডিটিং শিখি। আমি গোঁধরে থাকি ক্যামেরাম্যান হব বলে। আমার কমপিউটার দক্ষতা আর কালারসেনস ভালো বলে সার্টিফিকেট দিয়ে ইউরেকা বলে, বিয়ে বাড়ির ভিডিওকরা কমে গেছে। কারণ সবাই প্যাকেজ নাটক শুটিং করছে। কিন্তু সেগুলো জোড়া দেবার লোক নেই। এমনিতেই শেষ ট্রেনের যাত্রী আমরা। তাড়াতাড়ি ইন্ডিয়া চলেন। আমি রাজি হয়ে যাই।

যায়যায়দিন তখন দৈনিক হচ্ছে। সাংবাদিকদের ওয়ার্কশপ চলছে। আমি প্রতিদিন ওয়ার্কশপ এটেন্ড করি আর দিন গুণতে থাকি ইন্ডিয়া যাবার। পরিচয় হয় মাহবুব আজীজ (সমকাল) আর ফাহিমের (এনটিভি) সঙ্গে। ভালো এই দুই বন্ধুকে ফেলে আমি একাই রওনা দিই। ডেমক্রেসিওয়াচের কলিগ এলানা হান্টার আমার হাতে বিয়ার তুলে দেই। বন্ধু মিলন (অভিনেতা) পথ এগিয়ে দেয় অনেকটা ...

...ট্রেনের কম্পার্টমেন্টে মৃদু আলো। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি অন্ধকার কাটতে শুরু করছে। রোমেলের কথা চিন্তা করে জলটি নেমে আসি। ঘুম থেকে জাগিয়ে রোমেলকে পাঠিয়ে দিই আমার বার্থে। দেবযানীর দিকে তাকাই। চাদরের ফাঁক দিয়ে ওর মুখের একপাশ দেখা যাচ্ছে। মন্দ লাগছে না। সকালে ওর সঙ্গে জম্পেশ করে আড্ডা দিতে হবে। ভোর ছয়টা বাজে। কালকা এক্সপ্রেস তখনো সমান তেজে চলছে। স্মৃতিরোমন্থন করতে করতে সময় গুণতে ভুলে গেছিলাম। স্মৃতি রোমন্থন ? থাক, এর নাম দিলাম আমি কালকামন্থন।

ভারতের দিনগুলো (পর্ব ০২) : কালকা এক্সপ্রেস

সামনের আসনে বসা দুইজন বাংলাদেশী ছেলেটির একজন আমি সুজন কিনা যখন জানতে চাইল আমি হোঁচট খেলাম। ভাবতেও পারিনি কেউ আমার ডাকনাম ধরে ডাকতে পারে। এমনকি ছেলেটিকে প্রথম দেখায় চিনতে পেরেছি তাও না। ছেলেটি আবারও জিজ্ঞেস করল, তুমি মতিঝিল মডেলে পড়তা না? আমি মাথা নেড়ে হ্যা বললাম। ছেলেটি বলল, আরে শালা। আমি রোমেল। চিনস নাই।

আমি সঙ্গে সঙ্গে রোমেলকে চিনে ফেল্লাম। ও যে এতো শুকিয়ে গেছে ভাবিনি। রোমেল খুব ভালো ক্রিকেট খেলত। মনে আছে একবার ধর্মশিক্ষকের পাঞ্জাবির পিছনে কালিকমের কালি আড়াআড়িভাবে ছিটিয়ে দিয়েছিল। খুব দুষ্ট ছিল। আমি জিজ্ঞেস করি, তুই কই যাস? দিল্লী?

- না। আলীগড়ে পড়ি। ইন্টার পাস করেই চলে এসেছি। তুই কই যাস?
- দিল্লী। এডিটিংয়ের উপর ডিপ্লোমা করতে।
- এডিটিং কি।

আমি এডিটিং কি বুঝিয়ে বললাম রোমেলকে। রোমেলের পাশের ছেলেটির সঙ্গেও পরিচয় হলো। আমি জিজ্ঞেস করি, তুই এরকম চোরের মতো একবার উঠে আরেকবার বসছিস কেন?

- আরে দোস্ত। দুইজন মানুষ কিন্তু টিকেট কাটছি একটা। টিটি আসার আগেই যেন বাথরুমে যেতে পারি। বুঝস না আরেকটা টিকিট কাটতে পারি নাই।
- টিটি কখন আসবে তুই জানস?
- হ। আসাযাওয়া করতে করতে ধারণা হয়ে গেছে।
- রাতে ঘুমাবি কই?
- আর ঘুম। তাছাড়া তুই তো আছিস। তোর বার্থে ঘুমাবো।
- ঘুমানোর কি দরকার। গল্প করেই রাত কাটিয়ে দিতে পারব। ইঙ্গিতে আমি জানালার পাশের মেয়েটির দিকে দেখালাম।

ট্রেণ প্রচণ্ড গতিতে ছুটে চলছে। রাত বলে বাইরের কিছুই টের পাচ্ছি না। রোমেল বলল আমরা এখন বিহার ক্রস করছি। আমি জানালায় মুখ গলিয়ে কিছুই টের পেলাম না। রোমেল জানাল আলীগড় পৌছাবে সন্ধ্যার দিকে। তার দেড় ঘন্টা পর ওলড দিল্লী।

মেয়েটি চুল বাতাসে উড়ছে। মনে আছে লাল রঙ্গের ড্রেস পরা ছিল সে। আমরা কিছু হালকা খাবার খেলাম। কিন্তু অবাক করার বিষয় আমাদের সঙ্গে কোনো পানি ছিল না। আমি আর রোমেল বলাবলি করছিলাম পানি কিভাবে খাওয়া যেতে পারে। রোমেল মেয়েটির কোকের দিকে তাকিয়ে বলল, ইস মেয়েটা যদি একটু কোক দিত। আমি বললাম, হুম। এতো বড় বোতল। আমরা একটু খেলে কি হয়। রোমেল তুই একটু চেয়ে দেখ না। মেয়েটা তো মোটামুটি সুন্দরি। না করবে না।

তখনই মেয়েটা অবাক করে বাংলায় বলে উঠল, কোক খাবেন? নিন না।

আমরা হতবাক হয়ে যাই। মেয়েটা বাংলা বোঝে। সাথে সাথে রিকল করা শুরু করলাম কোনো খারাপ কিছু কি বলেছি? রোমেল কোকের বোতলটা হাত বাড়িয়ে নেয়।

মেয়েটার সঙ্গে আলাপ হলো। দেবযানী, অবশ্য হিন্দিতে নাকি দেবইয়ানি বলে। থাকে এলাহাবাদ (অমিতাভ বচ্চনের এলাকায়)। বাবা-মা কলকাতার কিন্তু হিন্দিভাষী এলাহাবাদে থাকার কারণে বাংলা বলতে পারে, লিখতে ও পড়তে পারে না।

ভালোই হয়েছে। মেয়েটার সঙ্গে প্রায় ঘন্টা দুয়েক আলাপ করলাম। বাংলাদেশ সম্পর্কে মেয়েটা আগে থেকেই জানে। ওর ইউনিভার্সিটিতে বাংলাদেশী মেয়ে আছে কয়েকজন। এদিকে রাত আরো গভীর হয়ে যাচ্ছে। সবাই ঘুমানোর আয়োজন করছে। আমি রোমেল উঠে গিয়ে দরজার কাছে গেলাম সিগারেট খাবো বলে। ওখান থেকেই দেখলাম দেবযানী ঘুমানোর আয়োজন করছে। ছোট একটা জায়গায় গুটিশুটি মেরে মেয়েটি ঘুমিয়ে পড়ল। ট্রেন দুলছে। আমিও ভবিষ্যত চিন্তায় আচ্ছণ্ন হয়ে পড়লাম। দিল্লী যাওয়া, এডিটিং শেখা ....

ভারতের দিনগুলো (পর্ব ০১) : কলকাতা

জীবনে স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেছি। আমাকে ফিল্মমেকার হতেই হবে। ফোরামে ফিল্মের উপর শটকোর্সকে সম্বল নিয়ে আর গ্রুপ থিয়েটার চর্চার রসদ আমাকে এ সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে। বন্ধু ইউরেকার পরামর্শে ফিল্মমেকার হওয়ার জন্য প্রথমে এডিটিং কোর্সে ভর্তি হলাম দিল্লীর একটি মিডিয়া স্কুলে। ৯৮-এর সেপ্টেম্বরে এডমিশন নেয়ার জন্য রওনা দেই বেনাপোল-কলকাতা হয়ে দিল্লীর পথে। জীবনে এটাই ছিল আমার প্রথম বিদেশ যাত্রা। একদম একাকী।

সারারাত বাসজার্নি করে সকালে বেনাপোল পৌছাই। পকেটে প্রচুর টাকা। এনডোর্স করা টাকা ছাড়াও বাংলাদেশী ২০০০০ টাকা ও ডলার ১০০০। কাস্টমস পার হওয়ার সময় খুব ভয় লাগছিল। যদি চেক করে। আমার সঙ্গে একটি ইন্ডিয়ান ফ্যামিলি ছিল। সঙ্গে ৩ বছরের বাচ্চা। ইন্ডিয়ান কাস্টমস যখন আমার নাম ধরে ডাকছিল আমি সঙ্গে সঙ্গে ওই বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে আদর করা শুরু করলাম। শুনেও না শোনার ভান করলাম আমাকে যে ডাকছে। দুই-তিনবার ডাকার পর আমি হঠাৎই যেন খেয়াল করছি এ ভঙ্গিতে তাকাতেই কাস্টমস অফিসার আমাকে জিজ্ঞেস করে, আপনিই তো? আমি বাচ্চাটিকে কোল থেকে নামিয়ে বলি, জ্বি আমিই।

কাস্টম অফিসার - ওই বাচ্চাটি কে?আমি - ও আমার সঙ্গে ঢাকা থেকে আসছিল। ওরা ইন্ডিয়ান। বাচ্চাটিকে আদর করছিলাম। তাই ডাকছেন যে শুনতে পারিনি।

কাস্টম অফিসার আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে পাসপোর্ট ফেরত দিয়ে চলে যেতে বলে। আমি হাঁপ ছাড়ি। আমার পাশেই তখন এক বাংলাদেশীকে চরম সার্চ করা হচ্ছে। আমি বাচ্চাটিকে আদর করে একটু সহানুভূতি আদায়ের চেষ্টা করে সফল হওয়ায় মুচকি হাসি। গ্রুপ থিয়েটার চর্চা বিফলে যাইনি। বোধহয় এডিটিংও ভালো শিখতে পারব। হা হা হা।

কাস্টম-ইমিগ্রেশন চেক করে বের হয়ে আসি। ইমিগ্রেশনে অবশ্য ১০ টাকা দিতে হয়েছিল। যাই হোক পরিচয় হয়ে যায় কিছু বাংলাদেশীর সঙ্গে। একটা ট্যাক্সি ভাড়া করে রওনা দিই কলকাতার উদ্দেশ্যে। আমার ভাগে ১৭০ রুপী পড়েছে ট্যাক্সিভাড়া হিসেবে। নিউমার্কেটের পাশে হোটেল প্যারাডাইজে চেক ইন করে ব্যাগ কাঁধে (একটাই ছিল) বেরিয়ে পড়ি। যমুনা সিনেমা হলে (এখন বন্ধ) দিল সে ছবি চলছিল। টিকেট কেটে ঢুকে পড়ি। বলিউডে আমার প্রথম প্রেম ছিল মনীষা। তাই আর দেরি না করে দিল সে ছবি দেখতে শুরু করি।

পরদিন ডালহৌসির ফরেন কাউন্টারে গেলাম ফরেন কোটায় ট্রেনের টিকেট কাটতে। নিজেকে ফরেন ভাবতে ভালোই লাগছিল। কিন্তু কপাল খারাপ। টিকেট পেলাম 6দিন পর। প্রতিদিন হোটেলে ২০০ রুপী করে গুণতে হবে ভেবে মনটাই খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু আমি জানতাম না ২০০ রুপী বেশি দিলেই বিভিন্ন ট্রাভেলস থেকে টিকেট কাটা যায়।

ঘুরতে শুরু করলাম স্বপ্নের কলকাতা। জীবনে প্রথম দেখছি কিন্তু অনেক রাস্তাঘাটের নাম আগে থেকেই জানি। মেট্রো সিনেমার নিচে দাঁড়িয়ে অনেক অপেক্ষা করলাম কিন্তু সুনীলের নীরা এলো না। চৌরঙ্গীতে দাঁড়িয়ে ভাবলাম কফি হাউজে একবার যেতেই হবে। একবার কি দাদাদের আনন্দবাজার পত্রিকা অফিসে যাব না ?

আমাদের গ্রুপের অশোকদা তখন কলকাতায় ছিলেন। উনি বাংলাবাজারের বইয়ের প্রকাশক। যোগাযোগ করে উনার সঙ্গে এক হোটেলে উঠে গেলাম। কফি হাউজের পরের গলিতেই সেই ট্রাভেল লজটি ছিল। অশোকদা আমাকে নিয়ে গেলে আনন্দবাজার পাবলিকেশনেস। বইয়ের গুদামঘরে বইয়ের উপর বসে একটা উপন্যাস শেষ করে ফেল্লাম। সেই ফাঁকে অশোকদা তার ব্যবসায়িক কাজ সেরে নিলেন।

পরদিন কফি হাউজে গেলাম। পকেট থেকে বাংলা ফাইভের (আমার প্রিয় ব্র্যান্ড, এখন নাকি বাংলাদেশে খুব একটা পাওয়া যায় না) প্যাকেট বের করে টেবিলে রাখলাম। একট ধরালাম। চারিদিকে প্রচন্ড কেওয়াজ। কিন্তু ভালোই লাগছিল। ভবিষ্যত সুনীল, শীর্ষেন্দুতে ভরা চারিদিক। ভাবলাম এভাবে বসে না থেকে কারো সঙ্গে পরিচিত হওয়া গেলে ভালোই হতো। কিন্তু কার সঙ্গে পরিচিত হবো? কোনো মেয়ে হলে ভালো হয়।

দুরু দুরু বুকে একটা টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলাম। একটা ছেলে আর একটা মেয়ে বসে কথা বলছে। কাছে গিয়ে বললাম, ভাই আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি। দেখলাম আপনারা গল্প করছেন। আপনাদের সঙ্গে কি কথা বলতে পারি?

আমাকে সম্পূর্ণ অবাক করে দিয়ে ছেলেটি বলল, না ভাই। পারেন না। আমরা একটু জরুরি আলাপ করছি।

আমি খুব স্মার্টলি বললাম, না না ঠিক আছে।

অপদস্থ হয়ে ফিরে আসতেই ছেলেটি আবার ডাক দিল। বলল, আমার পূর্বপুরুষ আগে রংপুরে ছিলেন শুনেছি। আপনি বাংলাদেশ থেকে এসেছেন কিন্তু সত্যিই আমরা একটা সিরিয়াস প্রবলেমে আছি। নাহলে আপনার সঙ্গে গল্প করা যেতো।

আমি মেয়েটার দিকে তাকিয়ে দেখি গম্ভীর হয়ে বসে আছে। বুঝলাম প্রেম বিষয়ক কোনো সংকট হবে। সুড়সুড় করে নিজের জায়গায় গিয়ে বসে পড়লাম। পাশের টেবিলে তাকিয়ে দেখি একটা ছেলে (বয়ঃসন্ধিকালের) কানে ওয়াকম্যান দিয়ে কাগজে কি যেন লিখছে। উঠে ছেলেটির কাছে গেলাম। হাত বাড়িয়ে পরিচিতি হলাম। এবার আশাহত হলাম না। ছেলেটিও পরিচিত হয়ে আমাকে বসতে বলল।

জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম ছেলেটি কবিতা লিখছিল। আমি তো আবিষ্কারে মহাখুশি। নির্ঘাত এ ছেলে শক্তি চট্টোপাধ্যায় হবে। আমি বললাম কলকাতা তো কিছুই চিনি না। চল আমাকে ঘুরিয়ে দেখাও।

ছেলেটির সঙ্গে কলকাতা ঘুরতে বের হলাম। ভিক্টোরিয়া মেমরিয়ালে গিয়ে চক্ষু চড়কগাছ। ছেলেমেয়েরা অপেন কিসিং করছে। শিহরিত হলাম আমি। শক্তিকে বিদায় করে সন্ধ্যায় গেলাম রবীন্দ্রসদনে। ফোয়ারার পাশে ছেলেমেয়েদের ঘনিষ্ঠতা দেখে ভিক্টোরিয়া মেমরিয়ালকে তুচ্ছ মনে হলো। ব্যস আমার রুটিন হয়ে গেল সারাদিন যেখানেই থাকি না কেন সন্ধ্যায় ঠিকই রবীন্দ্রসদনের ফোয়ারার তলায়।

দেখতে দেখতে ছয়দিন পার হয়ে গেল। ছয়দিন আমার মোট খরচ হলো ৫০০০ রুপী। প্রথম বিদেশ ভ্রমণ আর স্বপ্নের কলকাতা দেখার খায়েশ। মন একটু খারাপ করেই হাওড়ায় গিয়ে কালকা এক্সপ্রেসে উঠলাম। আমার সামনে দুইজন বাংলাদেশী ছেলে। সারাক্ষণই চোরের মতো আচরণ করছে। ট্রেণ ছাড়ি ছাড়ি করার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে একটা মেয়ে এসে জানালার পাশের সিটে বসল। আমার মন ভালো হয়ে গেল। মেয়েটির সঙ্গে তার বাবা এসেছিল। হিন্দিতে কথা বলছিল তারা। একটা ইয়া মোটা কোকের বোতল ধরিয়ে দিল বাবা মেয়েটিকে। মেয়েটিও বিদায় টিদায় নিল বাবার কাছ থেকে। ট্রেন চলতে শুরু করল। আমিও নড়েচড়ে বসলাম। ২২ ঘন্টার জার্নি। মেয়েটার সঙ্গে ভাব জমাতে হবে। ট্রেন চলছে পুরোাদমে। উদ্যাম বাতাস। আমি উশখুশ করছি। হঠাৎই দুই বাংলাদেশী ছেলেটির মধ্যে একটি ছেলে আমাকে জিজ্ঞেস করল, এ্যাই তুমি সুজন না? আমার মুখ হাঁ হয়ে গেল।

ওটা মেয়ে গাংচিল। ছেলে গাংচিল এতো নিচ দিয়ে ওড়ে না।

পড়ন্ত বিকেল। সমুদ্রের তীরে আগত পর্যটকরা অপেক্ষা করছে সূর্য ডোবার। কেউ কেউ ক্যামেরা নিয়ে প্রস্তুত। উঠতি বয়সের তরুণেরা ঘোড়া (গাধাসদৃশ) দৌড়াচ্ছে। দূরে কিছু মেয়েরা হল্লা করছে। আর সবকিছু ছাপিয়ে শোনা যাচ্ছে সমুদ্রের গর্জন। শোঁ শোঁ শব্দ।

সবার থেকে একটু দূরে ঝাউগাছের আড়ালে বালুর উপর বসে আছে ছেলেটি ও মেয়েটি। মেয়েটি একমনে সমুদ্র দেখছে। ছেলেটি একটি কাঠি দিয়ে বালুতে আঁকিবুকি করছে। মেয়েটি আকাশ পানে তাকায়। কিছুণ পর মুখ নামিয়ে জিজ্ঞেস করে ছেলেকে, কার ছবি আঁকছ? ছেলেটি আঁকতে আঁকতে বলে, তোমার।

মেয়েটি মুখ বাড়িয়ে দেখে। ফিক করে একটু হেসেও ফেলে। তারপর আবার সমুদ্রের দিকে তাকায়। সমুদ্র যেন একটু বেশিই গর্জন করছে আজ।

সূর্য ডুবতে শুরু করেছে। সৈকতের সবার মধ্যেই যেন ফূর্তির জোয়ার। ছবি তোলায় ব্যস্ত সকলে। কিন্তু ছেলেটি তখনো মেয়েটির ছবি আঁকছে।

মেয়েটি গালে হাত দিয়ে সূর্যাস্ত দেখছিল। হঠাৎই বলে উঠল, দেখো দেখো ওই যে গাংচিল। ছেলেটি মুখ তুলে তাকায়। বলে, ওটা মেয়ে গাংচিল।

মেয়েটি অবাক হয়, তুমি কি করে বুঝলে ?ছেলে গাংচিল এতো নিচ দিয়ে উড়ে না। ছেলেটি ছবি আঁকায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

সূর্য প্রায় ডুবুডুবু। শেষ মুহূর্তের ছবি তোলার জন্য সবাই ব্যস্ত। ছেলেটিরও ছবি আঁকা শেষ। দুজনে উঠে দাঁড়ায়। বালুতটে আঁকা নিজের ছবি দেখে মেয়েটি খুব খুশি হয়। এগিয়ে গিয়ে ছেলেটির গালে আলতো চুমো খায়। এই প্রথম ছেলেটি হাসে। মেয়েটির হাত নিজের হাতে নেয়। ঠিক করে আগামীকালও ওরা ঠিক এ জায়গাতেই দেখা করবে।

এদিকে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। ডুবে যাওয়া সূর্যের লীলাভ আলোয় ঘর চিনে ফিরতে শুরু করেছে সবাই। প্রচন্ড বাতাস, সমুদ্রের গর্জন। বালুতটে আঁকা মেয়েটির ছবি বাতাসে মুছে যায়।

পরদিন। ছেলেটি এসে অপেক্ষা করে। আজকে ওর হাতে একটা গোলাপ ফুল। ফুল নিয়ে পায়চারি করতে থাকে ছেলেটি। কিন্তু মেয়েটি আসে না। অনেকণ অপেক্ষা করে ছেলেটি। বালিতে বসে ছবি আঁকতে থাকে। দূরে উড়ে যাওয়া গাংচিল গুণতে থাকে। তারপরও মেয়েটি আসে না। ছেলেটি অনেকণ অপেক্ষা করে চলে যায়।

তার পরদিনও ছেলেটি আসে কিন্তু মেয়েটি আসে না।

পরদিনও না।

তার পরদিনও না।

মেয়েটি আর এলোই না।

ছেলেটি কিন্তু প্রতিদিনই এসে অপেক্ষা করে।

হায়রে! ছেলেটি জানবে কি করে যে মেয়েটির বাবা বাসা চেঞ্জ করেছে এবং মেয়েকে অন্য কিন্ডারগার্টেনে ভর্তি করে দিয়েছে।


নোটিশ : এটা আমার কোনো গল্প না। অনেক অনেক বছর আগে রহস্যপত্রিকায় এ গল্পটি (বিদেশী গল্প) পড়েছিলাম। হুবহু মনে নেই, নিজের মতো করে আবার লিখলাম। ভালো কথা এই গল্পটাই আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার সময় লিখে এসেছিলাম।

সম্ভাবনার মৃত্যু ঘটুক : ০৩ (শেষ পর্ব)

ক.
টো টো কম্পানির ম্যানজের পদটা বাগিয়ে নেয় ছেলেটি। নাটকের গ্রুপে হল্লা করে, হাতে কয়েক প্রকারের বালা পড়ে মাথায় লম্বা চুল রাখে, হেঁড়ে গলায় কোরাস গায়। কিন্তু এসবের জন্য পয়সা কোথায়? ম্যানেজারের পদটা তো অনারারি।

খ.
বাংলাদেশ চষতে শুরু করে ছেলেটি। জনমত জরিপের কাজে প্রত্যন্ত অঞ্চলের ছাপড়া ঘরে দুধের সরসহ চা, টিমটিমে ল্যাম্পোর আলোয় গ্রামের বাজারে জিলিপী, ন্যাতোনা বিস্কিট আর বাংলা ফাইভের অভাবে নাম না জানা বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে গ্রামের সহজসরল লোকগুলোর মাঝে জীবনের অন্যরকম অর্থ খুঁজে পায় ছেলেটি। গ্রামের সবচেয়ে অভাবী পরিবারটি যখন আতিথেয়তার নামে একমাত্র মুরগীটি জবাই করে ফেলে, তখন ছেলেটির জীবনে 'চাহিদা' নামক বিষয়টি গৌণ হয়ে পড়ে। গেজেটেড অফিসার বাবা বলতেন, শোন ছেলে, সরকারি বেতনস্কেলে সর্বনিম্ন বেতন (সেইসময়ে) মাত্র ৩৪০০ টাকা। তোরা তো অনেক সুখেই আছিস।

ছেলেটি মুরগীর ঠ্যাং চিবোতে চিবোত বাবার কথা ভাবে, হুমম। সর্বনিম্ন বেতনভোগীরা ঈদ করে, পোস্ট অফিসে হয়তো মাসে ৫ টাকা করে সঞ্চয়ও করে। প্রাচুর্য্যের দরকারটা কি?

গ.
৪৮টি জেলা ঘুরে ছেলেটি স্থির হয়। কোথায় তাকে পিস্তলের মুখোমুখি হতে হয়, কোথায় পাড়ার রংবাজ, কোথায় ডিসির হাত কচলানো, ত্যালোনা দেঁতো হাসি পেয়ে ছেলেটি মজা পায়। ঘর হইতে শুধু দুই পা ফেলিয়া ছেলেটি ক্ষান্ত হয় না। নৌকা, বাস, ট্রাক, টেম্পো, রিকশা, সাইকেল, হোন্ডা, মহিষ-গরুর গাড়ি, ট্রলার, স্টিমার, চান্দের গাড়ি পরিভ্রমণ করে ছেলেটি ভাবে উড়োজাহাজে চড়লে পারলে মন্দ হতো না।

ঘ.
চরমভাবে বিতর্কিত শফিক রেহমান খুব প্রিয় ছিল ছেলেটির। 'এ্যাই ছেলে, তুমি কি সপ্তাহে ২০০০ বাংলা শব্দ লিখো'? ছেলেটি না-সূচক মাথা নাড়ায়। 'তুমি কি গাড়ি ড্রাইভ করতে পার?' ছেলেটি বিষ্মিত হয়। 'তোমার গার্লফ্রেন্ড আছে?' ছেলেটি লজ্জিত হয়। 'ফ্লাট বুকিং দেবার জন্য তোমার প্রথম কিস্তি জমাতে পেরেছ?' ছেলেটি ভুরু কুঁচকে যায়। 'সাংবাদিকতা করবে, তোমার যা লেবাস, কনফারেন্স রুমে তো ঢুকতেই দিবে না।' ছেলেটি মাথা নিচু করে স্যান্ডেলের ছেঁড়া ফ্লিপটা পায়ের আঙ্গুল দিয়ে লুকোতে চায়। শফিক রেহমান বলে, দেখো, সবুজে শ্যামলা বাংলাদেশের সবুজ গাছ আর নাই। দেশের বাইরে যাও। দেখে এসো, বাংলাদেশের চেয়ে কতো সবুজ লালন করে তারা। ছেলেটির চোখ চিকমিক করে।

ঙ.
টিভি স্টেশনে চাকরি করে ছেলেটি। হ্যান্ডসাম স্যালারি। বন্ধুরা ঠ্যারে ঠ্যারে তাকায়। প্রাইভেট ইউনি পড়ুয়া বন্ধুরা (অনেকে তখনো পড়ছে) আফসোস করে। একদিন ছেলেটি একটা মারুতি কিনে ফেলে। এবার গাড়িতে করে ঢাকা শহর দেখে সে। সবকিছু ভালো লাগতে থাকে তার। ব্যাংকে পয়সা জমে। শেরাটনের মেলা থেকে হুট করে একদিন একটা ফ্লাটও বুকিং দিয়ে ফেলে ছেলেটি। পাশে থাকা মেয়েটি বলে, ৮০০ বর্গফুট তোমার আমার জন্য অনেক বড় হয়ে গেল।

চ.
৪৮টি জেলা ঘুরে যে 'চাহিদা' জিনিসটি ছেলেটির জীবনে গৌণ হয়ে পড়েছিল তা যেন একটু একটু ফিরে আসে। মধ্যবিত্ত ছেলেটি আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়ে এসবে। এটা না হলে নয়, ওটা করতে হবে। ছেলেটি মাঝে মাঝে হাঁপিয়ে উঠে। সব ছুঁড়ে ফেলতে গিয়েও বাধা পায়। মধ্যবিত্তের চাহিদার শিকল অনেক শক্ত। শরীরে দাগ বসে যায় একটু প্রতিবাদী হলেই ...

Saturday 14 July 2007

সম্ভাবনার মৃত্যু ঘটুক : ০২


ক.
লিটল ডায়মন্ড কিন্ডারগার্টেনের ক্ষুদ্র পরিসর ছাড়িয়ে একদিন মা-র কনে আঙ্গুল ধরে ছেলেটি রামকৃষ্ণ মিশন স্কুলে ক্লাশ ওয়ানে ভর্তি হয়। ছেলেটির মনে আছে দুই বছরের পিঠাপিঠি বড়ভাই এনিয়ে খুব অভিমান করেছিল। ছোট ভাইয়ের সঙ্গে একই ক্লাশে পড়া তার অহমিকায় লেগেছিল। ঘ্যান ঘ্যান করে বারবার তার মা-কে বলছিল, ও তো ছোট। আমি কেন তার সঙ্গে পড়ব? মা আমল দিত না। তাই মাঝে মাঝে চিমটি কেটে ছোটভাইকে বলত, তোর সঙ্গে আমি থাকব না দেখিস।

নিয়তির কি পরিহাস! বড়ভাই সত্যিই সঙ্গে থাকল না। সেই ঘটনার অনেক বছর পরে ২০০৫-এ ছেলেটিকে ছেড়ে চলে গেল সে। এখন সে আকাশে ভাসতে ভাসতে ছেলেটিকে উপহাস করে, দেখলি তো, তোর সঙ্গে আমি আসলেই থাকলাম না ...

খ.
ছেলেটির গল্পের বই পড়া নেশা হয়ে গেল। যা পায় তাই পড়ে ফেলে। দোকানের সাইবোর্ড থেকে শুরু করে রামকৃষ্ণ মিশনের লাইব্ররির সমস্ত কমিকস সে গিলে ফেলে। বাবা বকে, মা কান ধরে মুচড়ে দেয়, ছেলেটির পড়ার টেবিলের বিভিন্ন ঘুপচিতে কিশোর থ্রিলার আরো বেশি জমতে শুরু করে। একদিন পরীক্ষার আগের রাত্রে গল্পের বই পড়ার রেশ ধরে ছেলেটির বাবা রাগে সাদাকালো ফিলিপস টিভিটি ভেঙ্গে ফেলে।

ছেলেটি এরপর থেকে স্কুলে গিয়ে নিয়মিত জেনে নিত, কবে কোন নাটক অথবা ইংরেজি সিনেমায় কি কি দেখিয়েছিল।

গ.
তবে বেশিদিন দেরি হয় না। ন্যাশনালের রঙ্গিন টিভি চলে আসে বাসায়। পড়ালেখার পাশাপাশি ছেলেটির খেলাধূলায় প্রচন্ড আগ্রহ জন্মে। ফুটবলটা সে ভালো খেলত, তখন ক্রিকেটের চল ছিল না। স্কুলে যাবার আগে ও ছুটির পরে কমলাপুর রেলস্টেশনে প্রতিদিন সে ফুটবল খেলে। দল গঠন করে নাম দেয় 'মৈত্রী সংঘ'।

ঘ.
৪টা লেটারসহ স্টারমার্ক নিয়ে মেট্রিক পাস করে ছেলেটি। আপাত শান্ত ছেলেটি কলেজে পরিচিতি পায় দুরন্ত হিসেবে। খেলাধূলা চুলোয় উঠেছে। কো-এডুকেশন কলেজে মেয়েদের সঙ্গ এখন ছেলেটার অতিপ্রিয়। মেয়েরাও বন্ধু হিসেবে ছেলেটির উপর বেশ নির্ভর করে। আর এ সুযোগে ছেলেটিরও কখনো আইসক্রিম, বাংলা ফাইভ, গুলিস্তান পর্যন্ত আসার ভাড়া ম্যানেজ হয়ে যেত। পুরান ঢাকার বড়লোকের মেয়েগুলা আসলেই খুব ভালো ....

ঙ.
কলেজ জীবনের মাস্তির কারণে অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে মেট্রিকপাস করা ছেলেটি এবার ছয় মার্ক কম পেয়ে দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হয়। বন্ধুরা টপাটপ বিভিন্ন জায়গায় ভর্তি হয়ে যাচ্ছে। বড়লোক বন্ধুগুলো কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ করে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি, মেডিকালে ভর্তি হয়ে যাচ্ছে। তাদের সঙ্গে গিয়ে ছেলেটি নর্থসাউথ দেখে, শিকদার মেডিকেল দেখে। বন্ধুরা চা-সিগারেট খাওয়ায়। বন্ধুরা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হবে এই খুশিতে ছেলেটি ছয় নম্বর বাসের হ্যান্ডেল ধরে বাসায় ফিরে।

রাতে বাবাকে ভয়ে ভয়ে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি আইএসটি-তে ভর্তি হওয়ার ইচ্ছার কথা জানায় ছেলেটি। বাবা চিৎকার করে উঠে, কোথায় পাব চল্লিশ হাজার টাকা। যা, ঠেলাগাড়ি চালিয় খা। ছেলেটি কাঁচুমাচু করে, ম্রিয়মান হয়ে যায়।

মধ্যবিত্তের ক্ষোভ সে ঝাড়ে, ঢাকা ইউনিভার্সিটির ভর্তিপরীক্ষায় গল্প লেখে, মেডিকালের পরিবর্তে আবৃত্তি সংগঠনে।

সেই বাবা যখন ফোন করে ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করে, কেমন আছিস তুই? হার্টের অস্ত্রোপচার হওয়া বাবার মধ্যবিত্ত সন্তান তখন বলে, এই তো ভালো, তোমার শরীর কেমন ?

Monday 9 July 2007

ছাগু বিষয়ক দুইটি গল্প


১ম গল্প

একদা এক ছাগু বেহেশতে গমন করিল। সেথায় ঘুরিতে ঘুরিতে এক হূররে দেখিতে পাইল ছাগু। ইহা দেখিয়া তাহার কামভাব হঠাতই জাগ্রত হইয়া উঠিল এবং সৃষ্টিকর্তার কাছে আব্দারকরণে তাহাকে কাম-কর্ম সম্পাদনের অনুমতি প্রদান করা হইল। তাহার কিছুক্ষণ পরেই ছাগুর আরও একটি হুর-রে দেখিয়া পুনরায় কামভাব জাগিয়া উঠে এবং সে যথারীতি সৃষ্টিকর্তার কাছে এ বিষয়ে আব্দার করিয়া অনুমতি আদায় করিল। সৃষ্টিকর্তা গরজ করিলেন না, কারণ ৭০টি হুর হইল ছাগুর গিয়া আপার লিমিট।যাহা হোক, কামপর্ব সমাপ্ত হইবার পর ছাগু মহাচিন্তিত হইয়া পড়ে। কিরূপে ছাগু তাহার নি:সৃত বীর্য অর্থাত মাল পরিষ্কার করিবে ? চারিদিকপানে চাহিয়া ছাগু কোনো উপায় খুঁজিয়া পায় না। অবশেষে বেহেশতের এক উদ্যানে আসিয়া ছাগু বেজায় খুশি হইয়া উঠে। সেখানে সে দেখিতে পায় এক ঘোছা ঘাস। ঘাস দেখিয়া ছাগু তাহার ত্রি-ঠ্যাং লইয়া আগডুম বাগডুম ভঙ্গিতে 'জিআরই' 'জিআরই' চিতকার করিয়া ছাগুনৃত্য শুরু করে। এই ঘাস ছাগু খাইবে না বীর্য মুছিবে। অবশেষে ছাগু বীর্য মুছিবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। আফটার অল বেহেশত বলিয়া কথা। যাহা ভাবা, তাহা কাজ চিন্তা করিয়া ছাগু যেই না একগোছা ঘাস টানিয়া ছিড়িয়াছে অমনি কে জানি তাহার গালে প্রচণ্ড জোরে কষিয়া এক চড় বসাইয়া দিল। ছাগু প্রচন্ড ব্যাথা পাইয়া চমকিত হইয়া দেখে আশু ক্রোধান্বিত হইয়া তাহার দিকে তাকাইয়া আছে।

ছাগু খুব কষ্ট পাইয়া আশুরে জিজ্ঞাসা করিল, ''চড় দিলেন কেন আশু ভাই ?''

আশু কয়, ''দ্যাখ ছাগু। ফ্রি (মুফতে) পাইয়া পরপর দুইটা হুরকে লাগাইয়াছিস তাহা ঠিক আছে। কিছুই বলি নাই। কিন্তু এখন আমার বাল টানিয়া ছিড়লি কেন, তাহা আগে বল?''

ছাগু কিছু না বলিয়া দুই গালে হাত বুলাইয়া 'জিআরই জিআরই' উচ্চারণ করিতে করিতে উক্ত স্থান হইতে প্রস্থান করিল।



২য় গল্প

তখনও ছাগু পৃথিবীতে বর্তমান। মারা যাইবার পর বেহেশত লভ্য হইবে কি হইবে না, সে বিষয়ে নিশ্চিত না হওয়ায় ছাগু একপ্রকার টেনশন লইয়া দিন গুজরান করিত। অত্যধিক মাত্রায় টেনশন করিতে গিয়া তাহার শরীরে ব্যামো বাসা বাঁধিল, বিছানা লইল ছাগু। ডাক্তার মহাশয় আসিয়া তাহার চিকিতসা শুরু করিলেন। নানাবিধ পরীক্ষা করিয়া ডাক্তার সিদ্ধান্তে উপনীত হইলেন এবং ঘোষণা করিলেন, অদ্য হইতে ছাগুকে তাহার সমস্ত আহারকার্য পশ্চাতদেশের ফুটো দিয়া সম্পাদন করিতে হইবে। এবং তাহাতেই তাহার ব্যামো নিবারণ সম্ভব হইবে। ডাক্তার মহাশয়ের সিদ্ধান্ত শুনিয়া ছাগু অতিশয় বিমর্ষ হইল। পশ্চাতদেশের ফুটো দিয়া সে অন্য কার্য সম্পাদনে অভ্যস্ত ছিল এবং এ বিষয়ে সমস্ত দায়িত্ব সে তাহার হুজুরে আওলা হোসেইন ও তাহার এ-টিমকে দিয়াছিল। তারপরও আরোগ্যলাভের আশায় ছাগু ডাক্তারের পরামর্শ মানিয়া চলিবার অভিপ্রায় ব্যক্ত করিল।

ইহার পরে পৃথিবীতে আরো বেশ কয়েকবার সূর্য উদিত ও অস্ত গিয়াছে। ছাগু নিয়ম করিয়া নিয়মিতভাবে তাহার পশ্চাতদেশের ফুটো দিয়া খাদ্যবস্তু গ্রহণ করিতে থাকিল এবং নিজে কিঞ্চিত সুস্থ বোধ করিল। কিন্তু একদিন, 'জিআরই' বিষয়ক কিছু কার্যাবলী সম্পন্ন করিবার জন্য ছাগুর গুলশানে যাওয়ার প্রয়োজন ছিল। সে নিমিত্তে ছাগু বাসস্টপে দাঁড়াইয়া ছিল বাসের প্রতীক্ষায়। কিন্তু দীর্ঘক্ষণ পরেও বাসের দেখা মিলছিল না। ছাগু বিরক্ত হইয়া উঠিয়াছিল এবং ক্রমাগত দুইপায়ের উপর নাচিতেছিল। অর্থাত কিছুক্ষণ একপায়ের উপর ভর করিয়া পরমুহূর্তে আরেক পায়ের উপর ভর করছিল। দূর হইতে দেখিয়া ভ্রম হয় যেন ছাগু নৃত্য করিতেছে।

এই ছাগুনৃত্য দূর হইতে বেশকিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করিয়া সেই ডাক্তার ছাগুর কাছে আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, ''তুমি এরকম দুইপায়ের উপর দাঁড়াইয়া নৃত্য করিতেছ কেন?''

ছাগু ডাক্তার সাহেবকে সালাম জানাইয়া বলে, ''জ্বি না, আমি নৃত্য করিতেছি না। আপনার পরামর্শ মোতাবেক আমি নিয়মিতভাবেই পশ্চাতদেশের ফুটো দিয়া খাদ্য গ্রহণ করিতেছি। আর এই মুহূর্তে আমি চুইংগাম চিবাইতেছি। তাই আপনার কাছে এটাকে নৃত্য বলিয়া ভ্রম হইয়াছে।''

ডাক্তার অতিশয় আনন্দিত হইলেন। তিনি এই প্রথম একজন পাইলেন যে তাহার পরামর্শ অক্ষরে অক্ষরে মানিয়া চলিতেছে। ডাক্তার মনে মনে 'ছাগু ছাগু' বলিয়া সেস্থান প্রস্থান করিলেন।

Monday 2 July 2007

সম্ভাবনার মৃত্যু ঘটুক : ০১


ক.
সেপ্টেম্বরের প্রথম দিনে যখন জন্ম হলো ছেলেটার, বাবা তখনও অফিসে। সরকারি কাগজে কলম চালাচ্ছেন, জানতেন না তার পুত্রসন্তানের জন্ম হয়েছে। মোবাইল যুগ তখন ছিল না। কেউ আগ্রহভরে সরকারি ফোনে তাকে যে খবরটা জানিয়ে দেবে এমনটিও ঘটেনি। অফিসে ওইদিন বেতন হয়। ধীরে সুস্থে বেতনের টাকাগুলো নিয়ে অফিস ছুটির পর বাবা ঘরের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। এলাকায় ঢুকতেই খবর পান তিনি আরেকটি পুত্রসন্তানের জনক। বাবা খুশি হন। ঘরে ঢুকেই পকেট থেকে সবগুলো ময়লা টাকার বান্ডিলগুলো ছেলের উপর ঢেলে দেন। মুরুব্বি গোছের দাদি-নানিরা হা হা করে উঠেন। সদ্যভূমিষ্ঠ সন্তানের ছোট্ট শরীরে এখনোই কেন এতো চাপ ?

খ.
ছেলেটা যেন পয়মন্ত। ঢাকা শহরে সাবলেটে থাকত তারা। পরে দুইরুমের একটি ছোট্ট টিনের ঘরে উঠে গেল। সমস্যা শুধু একটাই, সপ্তাহে একবার ঘরের মাটির মেঝেটা লেপতে হতো। সেটারও দিন ফুরায়। পাশের দোতালা বিল্ডিংয়ে টু-লেট পড়তেই ওরা দোতালার একটা এক রুমের ফ্লাটে উঠে যায়। ছেলেটা ততোদিনে বড় হয়েছে অনেক। বিল্ডিংয়ে থাকার মজা সে বুঝে। যদিও কমন বাথরুম আর কমন রান্নাঘরের জ্বালাটা সে বোঝে না। বাবা সরকারি অফিসে কিভাবে যাওয়া আসা করেন তাও সে বোঝে না।

গ.
ছেলেটি স্কুলে যাওয়া আসা করে। দুই বছরের বড় ভাইজানের খাতায় আঁকিবুকি আঁকতে আঁকতে সে স্কুলে যাওয়ার মতো পন্ডিত হয়ে যায়। দুইভাইয়ের একসঙ্গে মুসলমানি হয়। ওই দোতালা বাড়ির ছাদে বিশাল প‌্যান্ডেলে ঠিক কতোজন লোক সেদিন খেয়েছিল ছেলেটির এখন মনে নেই। তবে তার দিব্যি মনে আছে, অনেক উপহার সে পেয়েছিল। সবচেয়ে অবাক করা উপহারটা ছিল কলমঘড়ি। এই প্রথম ছেলেটি বোধহয় বিজ্ঞানের এমন ব্যবহারে পুলকিত ও আশ্চর্য হয়েছিল।

ঘ.
পাশের বাসায় টিভি দেখতে যেতে হতো ছেলেটির। মাঝে মাঝে মা বাধা দিলেও টিভি দেখার সুযোগটা ছিল। মেঝেতে বসে টিভি দেখতে দেখতে ছেলেটি মুগ্ধ হয়ে যেতো। টিভির একেবারে সামনে বসে একটু ঘাড় উঁচিয়ে দেখতে হলেও তাতে কোনো আপত্তি ছিল না তার। ছেলেটির মনে আছে, একবার আয়না নামে একটি সিরিয়াল নাটক দেখে ভয় পেয়ে বাকিপথটুকু দৌড়ে বাসায় ফিরেছিল ছেলেটি। তারপরও ছেলেটি মা-ভাই সহ মাঝে মাঝে টিভি দেখতে যেতো।

ঙ.
কিন্তু কি আশ্চর্য। একদমই বিশ্বাস হয় না। এমন ঘটনাও পৃথিবীতে ঘটতে পারে ? একদিন সকালে ছেলেটিকে তার মা বলছে, আজকে তারা নাকি টিভি কিনতে যাবে। ছেলেটি কাকে জানাবে এই সুখের কথা। তার যে তেমন বন্ধু নেই। পিঠাপিঠি দুই ভাই সারাদিন আলাপ করতে থাকে টিভি এলে তারা কোথায় রাখবে, কি করবে ? বিকালবেলায় খুব সুন্দর করে সেজেগুজে পুরো ফ্যামিলি বায়তুল মোকাররম যায় জাদুর বাক্স কিনতে। ছেলেটি এখনো মনে করতে পারে, ফিলিপসের টিভি কিনে আনার পর অনেকেই বলেছিল, 'ন্যাশনাল টিভি কিনলে ভালো করতেন। ওইটা অনেক লাস্টিং করে।' ছয়-নয় চ্যানেল মিলিয়ে ছেলেটি ছায়াছন্দ দেখে, টারজান দেখে। আশেপাশের অনেক বাসা থেকে অনেকে আসে। এখন আর ছেলেটিকে ঘাড় উঁচিয়ে টিভি দেখতে হয় না। খাটের এককোনায় বসে সে টিভি দেখতে পারে।

ছেলেটি এখন বুঝতে পারে, তখন থেকে সে মধ্যবিত্ত হতে শুরু করেছিল ...

আমার একটা 'নদী' ছিল ...

খুব নিরাশ হয়ে আই.ই.আর ভবনের বারান্দায় এসে দাঁড়াই। বাইরের দিকে তাকাতেই মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল। সন্ধ্যা থেকে ঝরতে থাকা বৃষ্টির এখনো থামার কোনো নাম গন্ধ নেই। অথচ আমাকে যেতে হবে নীলক্ষেতে। রাত বাজে ৯টা। বেশি দেরিও করা যাবে না। স্ক্রিপ্টটার ফটোকপি করে এখনই রফিককে ফেরত দিতে হবে। ধ্যাত্তরি ...

হইচই শুনে আমি ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাই। রিহার্সালের পরের 'খানিক আড্ডা' শেষ করে ছেলেমেয়েরা বেরিয়ে আসছে। রফিক আমার কাছে আসে।

- কি ব্যাপার। তুমি এখনো যাওনি?- কিভাবে যাব? যা বৃষ্টি। কোনো রিক্সাও তো পাচ্ছি না।- নীলক্ষেত যেতে রিক্সা লাগে নাকি? চল আমিও যাই।

আমি সোডিয়াম লাইটের দিকে তাকিয়ে বৃষ্টির তোপ বোঝার চেষ্টা করি। বৃষ্টির ধারাগুলো সোনালী হয়ে গেছে। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলে নেশা হয়ে যায়। সোনালী নেশা। আমি শার্টের একটা বোতাম খুলে কলারটা মাথায় তুলে দিই। রফিককে বলি, চল যাই।

রফিক দু'পা এগোতেই থেমে যায়। কেউ যেন ডাকছে তাকে। আমি কলারসহ ঘাড়টা ঘুরিয়ে দেখি নদী দ্রুতপায়ে ছুটে আসছে। আমি তাকিয়ে থাকি। আমার ভয় ধরে। বৃষ্টির পানিতে সিঁড়িটা পিচ্ছিল হয়ে আছে। নদীর পা পিছলে যেতে পারে। আমার সারা শরীর টানটান হয়ে যায়। অজানা আশংকায় আমি প্রস্তুত হই। ঘাড়ের রগগুলো টানটান হয়ে যায়। বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে কলারের মধ্যে হঠাতই গরম অনুভব করি। অথচ আমাকে সম্পূর্ণ অবাক করে নদী সাবলীলভাবে রফিকের সামনে এসে দাঁড়ায়।

- নীলক্ষেত যাচ্ছ নিশ্চয়ই। আমার জন্যও স্ক্রিপ্টের ফটোকপি নিয়ে এসো। নদী দ্রুত কথাগুলো বলে। হাঁপায়। আমার শিরা-ধমনী স্থির হয়ে আসে। সংকুচিত দু'চোখ পুরোপুরি মেলে আমি নদীর দিকে তাকাই। বৃষ্টির ফোঁটা সুযোগ ছাড়েনি, নদীর চোখ-মুখ-ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়েছে। আমি তাকিয়ে দেখি নদী এখন অনেক সুস্থির। রফিকের সঙ্গে হাত নাড়িয়ে কথা বলছে। আমি কলারটা উঠিয়ে নীলক্ষেতের পথে উঠে পড়ি ...

... ঘটনাটি আজ থেকে ১১/১২ বছর আগে। নদীকে প্রথম কোথায় দেখেছি, ভাবতে গেলে এই ঘটনাটাই আমার প্রথম মনে পড়ে। সেই নদী বনানীর চারতলা বিল্ডিংয়ে প্রতিদিন অফিস করে। থিয়েটার তো কবেই ছেড়েছে। ফোন করলে নদী কলকলিয়ে উঠে, জানো? পুরো অফিসটা আমিই সামলাই। বস তো প্রায়ই দেশে থাকে না।

আমি ফোনের ওইপ্রান্তে হাসি। নদীকে নিয়ে আমি কখনো এতোটা আশাবাদী ছিলাম না। পুরো অফিস সামলানোর মতো দক্ষতা আমি ওর মাঝে কখনোই দেখিনি। কেমনে দেখি, নাম তো নদী ... শুধু বয়ে যাবে। সামলাতে হবে কেন ওকে ? এই যে আমি ভেসে গিয়েছিলাম, কই আমাকে তো কখনো সামলায়নি ... এসব কথা মনেই পড়েনি ওর ...

... অফিসের পাশাপাশি নদী এখন তার ছেলে সামলায়, স্বামী সামলায়, শ্বশুর-শাশুড়ি সামলায়। আর বিদেশ-বিভুঁইয়ে বিভ্রান্ত আমি খোঁজ রাখি না, নদী কিভাবে তার মন সামলায় ...