Friday 19 October 2007

একটি স্ব-সাক্ষাতকার

অলৌকিক হাসান। পেশায় ভিডিও এডিটর। পাশাপাশি শখের নাট্যকার ও পরিচালক। বেশ কিছু নাটক/টেলিফিল্ম পরিচালনা করেছেন। অলৌকিক হাসানের ভবিষ্যত ইচ্ছা হলো সুস্থ ও নাচ-গান-মারামারিতে ভরপুর বিনোদনমূলক চলচ্চিত্র নির্মাণের। আমরা বিশ্বাস করি তিনি নিশ্চয়ই সফল হবেন, দেশের একজন জনপ্রিয় চলচ্চিত্রনির্মাতা হিসেবে তিনি বিখ্যাত হবেন। আর তাই সচলায়তনের পক্ষ থেকে আগেভাগেই অলৌকিক হাসানের সঙ্গে মুখোমুখি সাক্ষাতকারের আয়োজন করা হয়েছে। আজকের আমরা তার ছোটবেলার কথা জানতে চাইব।

- কেমন আছেন?
- ভালো। আপনি?
- ভালো আছি। আজকে আপনার ছেলেবেলার কথা জানতে এসেছি।
- বলেন কি! আমার তো এখনো ছেলেবেলা চলছে। বড় হই, তখন না হয় ছেলেবেলার গল্প করব।
- আপনি বড়ই, তবে এসব বলে ছাড়া পাচ্ছেন না।
- হুম। যেভাবে চেপে ধরেছেন, বলতেই হবে মনে হচ্ছে।
- সেই ভালো। আপনি শুরু করুন।
- সেপ্টেম্বরের ১ তারিখ দুপুরবেলায় আমার জন্ম। যথারীতি আব্বা অফিসে। জন্মের সময় আমি দেখতে খুব কালো হওয়ায় আম্মার মন খারাপ হয়েছিল। কারণ আমার দেড় বছরের বড়ভাই ছিলেন খুবই ফর্সা। আব্বা খবর পেয়ে অফিস থেকে ফিরলেন এবং একটা মজার কান্ড ঘটালেন। ১ তারিখ ছিল বলে আব্বার বেতন হয়েছিল। নবজাতকের মুখদর্শন করেই আব্বা পকেট থেকে বেতনের সবগুলো টাকা বের করে আমার শরীরের উপর বিছিয়ে দেন। ময়-মুরুব্বিরা হায় হায় করে উঠেছিল টাকার ময়লা আমার গায়ে লেগে যাবে বলে। আপনিই বলুন, টাকার আবার ময়লা! হা হা।
- ইন্টারেস্টিং। তারপর ?
- এবার আমার জন্মের আগের দুটি ঘটনা বলি, আম্মার মুখে শোনা। যখন পেটে ছিলাম, আম্মা কোনো একদিন সন্ধ্যার সময় ছাদে হাঁটছিলেন। হঠাৎই জোর বাতাস শুরু হয়ে যায়। নিচে নামতে যাবেন এমন সময় আম্মার মনে হলো কেউ যেন তার গালে জোরে থাপ্পড় মারল। আম্মা ভয়ে একদৌড়ে নিচে নেমে আসেন। কিছুদিন পর আম্মা স্বপ্নে দেখলেন, শাদাশুভ্র-জোব্বা পরা-শ্রুশ্রমন্ডিত-লম্বা একজন হুজুর বুকে কোরাণশরীফ নিয়ে খাটের কোণায় দাঁড়িয়ে আম্মাকে ধমক দিয়ে বলছেন, এই মেয়ে, তোর ঘরে কোনো কোরাণশরীফ নেই কেন? ধমক খেয়ে আম্মা ধড়ফড় করে জেগে উঠেন। এখন পর্যন্ত আম্মার দৃঢ়বিশ্বাস তিনি মোহাম্মদ (সঃ) কে দেখেছিলেন। আমি বড় হয়ে এ বিষয়ে বার বার জিজ্ঞেস করে জানতে চেয়েছিলাম উনি দেখতে কিরকম ছিলেন। কিন্তু আম্মা উনার চেহারা মনে করতে পারেন না।
- আপনার জন্মের সঙ্গে কি এ ঘটনার কোনো যোগসূত্র আছে?
- আম্মার ধারণা, আছে। আমার জন্মের ২/৩ দিন পর দুপুরবেলায় আমি খাটে ঘুমিয়ে ছিলাম। আম্মা ছিলেন পাশে, টুকটাক আদর করছেন। হঠাৎই আমি চিৎকার করে জেগে উঠি। সঙ্গে সঙ্গে আমার চোখ দুটো উল্টে ঠেলে বেরিয়ে যাবার যোগাড় হয়। মুখ থেকে গ্যাঁজলা বের হতে থাকে। কালো শরীর আরো কালচে নীল হয়ে যায়। হাত-পা কুঁকড়ে যায়। আম্মা প্রচন্ড ভয়ে চিৎকার করে আশেপাশের লোকজন যোগাড় করে আনেন। কেউ ডাক্তার ডাকতে গেল, কেউ হাত-পা মালিশ করতে লাগল। আম্মা তখন কেঁদেকেঁটে বারবার প্রলাপ বকছেন, তোমরা কেউ একজন হুজুর নিয়া আস। আমি জানি আমার ছেলের কি হইছে। যথারীতি ডাক্তার, বৈদ্য, কবিরাজ, হুজুর, পাড়াপড়শী সবাই বাসায় চলে আসে। খবর পেয়ে বাবাও চলে আসেন। হুজুর পানিপড়া দেয়, ডাক্তার ঔষধ দেয়। বিকেলের দিকে আমার অবস্থা স্বাভাবিক হয়। আম্মা সেদিন সন্ধ্যায়ই বায়তুল মোকাররম থেকে একটা সবুজ মলাটের কোরাণশরীফ কিনে আনান। স্বপ্নের রঙ শাদাকালো হলেও আম্মা ওই হুজুরের কোরাণশরীফের মলাটের রঙ সবুজ দেখেছিলেন। এরপর আম্মা কোরাণশরীফ পড়া শিখতে শুরু করেন। বড় হয়ে জিজ্ঞেস করলে আম্মা আরো বলেছিলেন, ওইদিন সন্ধ্যায় ছাদে যখন তিনি হাঁটছিলেন, তখন হয়তো ঘরে ফেরা কোনো খারাপ জ্বিন তাকে থাপ্পড় মারে। স্বপ্নে আল্লাহ রাসূল স্বয়ং এসে সাবধান করে গেলেও তিনি বুঝেননি। আম্মার ধারণা, আমার জন্মের আগেই যদি তিনি কোরাণশরীফ কিনে রাখতেন তাহলে নিশ্চয়ই এমনটি ঘটত না। আম্মা বলেন, সেই ঘটনার পর থেকেই নাকি আমি সুস্থ স্বাভাবিকভাবে বাড়তে থাকি। আমার গায়ের রঙ ফর্সা হতে থাকে।
- ভয়াবহ ঘটনা তো?
- মোটেই না, বরং ফানি। যদিও আমি এ বিষয়গুলো নিয়ে কখনোই আম্মার সঙ্গে তর্ক করিনি। তার বিশ্বাস তার কাছেই থাকুক। তবে একটা বিষয় মোটেও ফানি ছিল না।
- কি সেটা?
- হাফ মুসলমানি। মায়ের পেটে থাকতেই নাকি আমার অর্ধেক মুসলমানি হয়ে গিয়েছিল। মর্ত্যের হাজম শুধু ফিনিশিংটা দিয়েছেন। বিষয়টা মুসলমানি হওয়ার আগে আমি নিজেও খেয়াল করেছি। হা হা হা।
- আপনি তো দেখি সাচ্চা মুসলমান।
- একদম। একবার সারা ঢাকা শহরে রব উঠল যে, বাচ্চাদের মাথায় শাদা চুল পাওয়া গেলে সে নাকি আল্লাহতায়ালার পেয়ারের বান্দা। আম্মা তখন অনেক খুঁজে পেতে কেমন করে জানি আমার মাথার চুল থেকে একটা শাদা চুল পেয়ে গেলেন। তারপর সেটা ময়ুরের পাখনার সঙ্গে কোরাণশরীফে স্থান পেয়ে গেল। আম্মা আমাকে বরাবরই স্পেশাল ভাবেন।
- আপনার বাবা, বড়ভাই এদের সম্পর্কে কিছু বললেন না।
- আব্বা ছিলেন সরকারি চাকুরিজীবী। আর আম্মা তো পুরোদস্তর গৃহিনী। আমরা তখন সাবলেট থাকতাম মধুমিতা সিনেমা হলের পেছনে বাংলাদেশ ব্যাংক কলোনিতে। তখনকার স্মৃতি আমার হালকা হালকা মনে পড়ে। আর ওই যে বললাম, আমি স্পেশাল, পয়মন্ত। আমার জন্মের পর আব্বার প্রমোশন হয়। আমরা তখন সাবলেট ছেড়ে গোপীবাগ ৫ম লেনের দুইরুম বিশিষ্ট একটা টিনের চৌচালা ঘর ভাড়া নেই, যার মেঝে ছিল মাটির।
- আপনার স্কুলজীবনের কথা বলুন।
- গোপীবাগে আসার পর আমার বড়ভাই রাশেদুল হাসান রিপনকে স্কুলে ভর্তি করে দেয়া হয়। স্কুলের নাম রামকৃষ্ণ মিশন মহাবিদ্যালয়। আমি তখনও খুব ছোট কিন্তু ভাইয়ার খাতাপত্রে, ঘরের মেঝেতে আঁকিবুঁকি করতে করতে সাড়ে তিনবছর বয়সেই আমি অ আ ক খ শিখে ফেললাম। ভাইয়া যখন স্কুলে যেত, আমিও যাবার জন্য ঘ্যান ঘ্যান করতাম। এভাবে কিছুদিন যাওয়ার পর আমার স্কুলে যাওয়ার সুযোগ হলো। হঠাৎ একদিন বাড়িতে কিছু মহিলা এলেন। তারা নতুন একটা স্কুল করেছেন কিন্তু ছাত্রছাত্রী নেই। তাই দলবেঁধে বাড়ি বাড়ি ঘুরে ছাত্রছাত্রী সংগ্রহ করছেন। আমাকে দেখে আম্মাকে খুব করে অনুরোধ করলেন যেন আমাকে ওই স্কুলে ভর্তি করে দেয়া হয়। খরচ তেমন একটা না। আম্মা সুযোগটা মিস করলেন না। আমি ভর্তি হয়ে গেলাম লিটল ডায়মন্ড কিন্ডারগার্টেন স্কুলে বেবি শ্রেণীতে। আমাকে আনা নেওয়া করতে করতে আমার স্বল্পশিক্ষিত আম্মা সে স্কুলের শিক্ষিকা হয়ে গেলেন। তখন বছর প্রায় শেষ হতে চলছিল। রামকৃষ্ণ মিশনে ভাইয়া প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হলে আমাকেও প্রথম শ্রেণীতে ওই স্কুলে ভর্তি করে দেয়া হয়। আমার বয়স তখন চার। সেই থেকে আমরা দুইভাই একসঙ্গেই পড়াশোনা করে এসেছি।
- স্কুলে যেতে আপনার কেমন লাগত? খুব দুষ্টুমি করতেন বুঝি?
- একদমই না। স্কুলে যেতে আমার ভালোই লাগত। দুইভাইকে একসঙ্গে স্কুলে নিয়ে যেতেন আম্মা। ছুটির আগ পর্যন্ত বসে থাকতেন তিনি। মিশন স্কুলকে আমি কখনোই ভুলব না। আমার জীবনে মিশন স্কুলের বিশাল ভূমিকা রয়েছে। কিন্ডারগার্টেনে আমি বড়জোর ২/৩ মাস ছিলাম। রামকৃষ্ণে আসার পর আমি খুবই খুশি হই। দুইটা বড় বড় মাঠ, পুকুর, প্রচুর কৃষ্ণচূড়া, বকুল গাছ ছিল। নিয়মিত ক্রীড়ানুষ্ঠান, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো। আমি স্কুলে বেশি কথা বলতাম না, শান্ত স্বভাবের ছিলাম, তবে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশ নিতাম, পুরষ্কারও পেয়েছি। মিশন স্কুলে ছিল বিশাল লাইব্রেরি। আমার মনে হয় না বাংলাদেশের আর কোনো মাধ্যমিক স্কুলে এতোবড় লাইব্রেরি আছে। লাইব্রেরিটা আমার মনে দাগ কেটে গেল কেন সে ঘটনাটা বলি। ক্লাস টুতে পড়ি মনে হয় তখন। আমি মাঠে খেলছিলাম। হঠাৎই আমার মনে হলো আচ্ছা সবাই ওই ঘরে (লাইব্রেরি বা গ্রন্থাগার টাইপের শব্দ তখনও আত্মস্থ হয়নি) টেবিলে বসে কি লিখে? আমি উৎসুক হয়ে লাইব্রেরিতে ঢুকলাম। ভাবলাম এদের মনে হয় বাসায় বই নেই। এখানে তারা লিখে, বাসায় নিয়ে পড়ে। সিদ্ধান্ত নেই, আমিও তাই করব। শেলফ খুঁজে একটা রূপকথার বই নিয়ে টেবিলে বসে (তখনও টেবিলে থুতনি প্রায় লেগে যায় অবস্থা) খাতায় লিখতে শুরু করি। কিছুক্ষণ পর আমার খেয়াল হয়, আরে, আমি যা যা লিখছি তা তো পড়ে ফেলছি। তাহলে বাসায় নিয়ে কি পড়ব। আমি লেখা বন্ধ করে শুধু পড়তে শুরু করি। ব্যস, এরপর স্কুলের প্রায়দিনগুলোতে আমি সারা লাইব্রেরি খুঁজে গিলতে শুরু করি শিশুতোষ রামায়ণ, মহাভারত, দেবদেবতার বীরগাঁথা। রঙিন ছবিসহ বইগুলো আমার পড়ার তৃষ্ণা বাড়িয়ে দেয়। আমার (আউট বই) পড়ার নেশা সেই থেকে।
- দুর্গাপূজার জন্য তো রামকৃষ্ণ মিশন বিখ্যাত। আপনি পূজোর সময় কি করতেন?
- আসলে পূজোর সময় স্কুল ছুটি থাকত। আমি ওই স্কুলে পড়া অবস্থায় কখনো পূজো দেখিনি। তবে হিন্দু ছাত্রদের জন্য হস্টেল ছিল। ওইখানে মাঝে মাঝে যেতাম, আমাদের প্রসাদ খেতে দিত। মিশন স্কুলে মা কালীর প্রতিমা ছিল। ওটাকে ভয় পেতাম প্রথম প্রথম, পরে অবশ্য তা কেটে গেছে। নামে হিন্দু হলেও স্কুলে ধর্মসংক্রান্ত কোনো বাড়াবাড়ি আমি কখনো দেখিনি। বরং ফ্রি হাসপাতাল ছিল, সেখানে ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে গরীবদের ফ্রি চিকিৎসা হতো। আমরা কৃষ্ণচূড়ার মুকুল দিয়ে কাটাকাটি খেলতাম, বকুল ফুল দিয়ে মালা গাঁথতাম। মাঝে মাঝে স্কুলের বড় মাঠ ছেড়ে ব্রাদার্স ইউনিয়নের মাঠে খেলতে যেতাম।
- স্কুলজীবনের দুইএকটি ঘটনার কথা বলুন।
- ভাইয়া একবার অঙ্কে একশতে একশ মার্ক পেয়েছিল। তো ছুটির পর ভাইয়া আম্মার কাছে দৌড়ে আসছে আর চিৎকার করছে, আম্মু আমি একশতে দুইশ পেয়েছি। খাতার উপর ১০০/১০০ দেখে ভাইয়া ভেবেছিল ১০০ মার্কের পরীক্ষায় টিচাররা তাকে ২০০ মার্ক দিয়েছে। বার্ষিক পরীক্ষার পর আমাদের মৌখিক পরীক্ষা হতো। তখন আমাকে জিজ্ঞেস করা হলো, বটগাছ কোথায় দেখা যায়? আমি ঝটপট উত্তর দিলাম, শিশুপার্কে। অথচ সঠিক উত্তর ছিল নদীর তীরে বটগাছ দেখা যায়। আমি ভুলে গিয়েছিলাম কারণ বার্ষিক পরীক্ষার পর আব্বা আমাদের শিশুপার্ক দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল। ওইখানে বটগাছ দেখেছিলাম। টিচাররা অবশ্য আমার উত্তর সঠিক ধরে নিয়েছিল। আরেকবার, তখন বোধহয় ক্লাশ ৩/৪ এ পড়ি। হঠাৎ করে স্কুল ছুটি হয়ে গেল। আমরা তো ব্যাপক খুশি। খবর নিয়ে জানা গেল, কোথায় জানি ইন্দিরা গান্ধী নামে কে একজন মারা গেছে। আমাদের আর পায় কে। স্কুলছুটি, সেটাই বড় ব্যাপার। মিশন স্কুলে সপ্তাহে একদিন গানের ক্লাশ হতো। আমাকেও যেতে হয়েছিল সেখানে। কচিকণ্ঠে আমরা গাইতাম, মায়াবনবিহারিণী হরিণী অথবা আলো আমার আলো ওগো। আমার চরম বিরক্ত লাগত। দল বেঁধে এই গান গাওয়ার বিষয়টা এনজয় করতাম না। তবে কিভাবে কিভাবে জানি আমি ওই গানের ক্লাশ থেকে মুক্তি পেয়েছি তা মনে করতে পারি না। এখন খুব আফসোস হয়। আমার গলায় সুর একদমই নেই। যেসব মেয়েরা আমার সঙ্গে ফোনে কিংবা মুখোমুখি ঝগড়া করে চলে গেছে, ঠিক সেইসব মুহুর্তগুলোতে আমি যদি দুয়েকটা গান গেয়ে ফেলতে পারতাম, তাহলে তারা চলে যেত না। এমনও হয়েছে, মধ্যরাতে কথা বলছি, ওপাশ থেকে গান গাওয়ার অনুরোধ এলো, আমি ইনিয়ে বিনিয়ে আরেকদিকে চলে যাই। হয়তো আরো ঘন্টা দুয়েক কথা বলার প্ল্যান ছিল, আধঘণ্টার পরেই ওপাশ থেকে বিদায়ের ঘন্টা বাজে। আচ্ছা, যে লোক গাইতে পারে না, মেয়েরা তার কাছ থেকে গান শুনতে চাইবে কেন? ভেবে দেখুন তো কি জ্বালা।
- নারীমন বোঝা ঈশ্বরেরও সাধ্যির বাইরে। যাহোক, আপনার ছোটবেলার বন্ধুদের কথা বলুন।
- রামকৃষ্ণ মিশনে ক্লাস ফোর পর্যন্ত পড়েছি। তো বন্ধু বলতে তখন ক্লাসের ছেলেরাই। তাদের অনেকের নাম, চেহারা এখন মনে করতে পারি না, একমাত্র মেহেদী ছাড়া। মেহেদী বোধহয় ক্লাস টুতে রামকৃষ্ণে এসেছিল। মাঝখানে একবছর আলাদা ছিলাম। তারপর কলেজ পর্যন্ত একসঙ্গেই পড়েছি। একেবারে ছোটবেলার বন্ধু বলতে এই মেহেদীর সঙ্গেই আমার এখন পর্যন্ত যোগাযোগ রয়েছে। ব্যাটা আমার আগে বিয়ে করেছে, এখন লন্ডনে থাকে। গোপীবাগে থাকার সময় এলাকার কারো সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব তেমন হয়নি। আম্মা ঘর থেকে বের হতে দিতেন না। এলাকায় নিত্য মারামারি লেগে থাকত। এছাড়া আমাদের বাসার আশেপাশে বস্তি ছিল। আম্মার ভয় ছিল আমি বস্তির ছেলেদের সঙ্গে মিশে খারাপ হয়ে যাব। তারপরও মাঝে মাঝে বের হলে ওই বস্তির ছেলেগুলোর সঙ্গেই খেলতাম। গোপীবাগ বাজারে বেশ কয়েকটা ক্লাবঘরে সারাদিন ক্যারাম খেলা হতো পয়সার বিনিময়ে। আমি মাঝে মাঝে সেখানে দাঁড়িয়ে খেলা দেখতাম। পরে অনেক বায়না করে বাসায় একটা ক্যারামবোর্ড কিনেছিলাম। আর স্ট্যাম্প জমাতাম। স্কুলে বন্ধুদের সঙ্গে স্ট্যাম্প অদলবদল করতাম।
- তার মানে ছেলেবেলায় আপনার বন্ধুসঙ্গ তেমন যুৎসই ছিল না?
- না ছিল। কিন্তু গোপীবাগ এলাকায় থাকতে নয়। ওই যে বললাম, বস্তির ছেলেগুলো। ঘর থেকে বের হতে পারলে ওদের সঙ্গেই ঘুরতাম। একবার হলো কি, ওদের মধ্যে অনেকেই কাগজ কুড়াতো। তারপর বিক্রি করে ২/৩ টাকা পেত। তো আমারও শখ হলো কাগজ কুড়ানোর। আমিও একদিন বেরোলাম ওদের সঙ্গে। প্রায় দুইতিন ঘন্টা কাগজ কুড়ালাম। কিন্তু আমার থলে প্রায় পুরোটাই খালি। ওরা যে দক্ষতায় ডাস্টবিন থেকে কাগজ কুড়িয়ে ফেলত, আমি সেটা পারতাম না। নোংরার ভয়ে আমি সেখানে যেতাম না। জীবনে প্রথমবার কাগজ কুড়িয়ে ৫০ পয়সা পেয়েছিলাম। এরপর থেকে বাসার পুরোনো কাগজ, পুরোনো খাতা এগুলো ফেলতাম না। সেগুলো জমিয়ে এবং কাগজ কুড়িয়ে আরেকদিন ২ টাকা পেয়েছিলাম। ওরা খায় বলে আমিও আরেকদিন ওদের সঙ্গে মুগদা ঝিলপাড় থেকে জংলী শাক তুলতে গেলাম। তবে আম্মার ভয়ে বাসায় নিয়ে যাইনি। আমাদের ওইখানে একটা মেথরপট্টি গড়ে উঠেছিল। সেখানে রেললাইনের ব্রিজের তলে নোংরা ড্রেন ছিল। আমার বস্তির বন্ধুরা ব্রিজ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে গোসল করত। আমার সাহস হতো না আম্মার ভয়ে। তবে মাঝে মাঝে মেথরপট্টিতে গিয়ে শূকর দেখে আসতাম। আমার বস্তির বন্ধুরা খুব গালাগাল দিত। আমি ভয়ে সেগুলো উচ্চারণ করতাম না। আম্মা শুনলে স্রেফ জবাই করে ফেলবে। কিন্তু একদিন আমার বড়ভাই মনের ভুলে বাসায় ‘বাল’ শব্দটি উচ্চারণ করে ফেলে। সেদিন আম্মার রুদ্রমূর্তি কে দেখে! সুই নিয়ে এলো ঠোঁট সেলাই করে দেবে বলে। এবং সত্যি সত্যিই ভাইয়ার ঠোঁটের উপর সুইঁয়ের হালকা খোঁচা দিয়ে রক্ত বের করে ফেলল। আম্মা কাজটা করেছিল যেন আমরা ভয়ে আর কখনো খারাপ কথা না বলি।
- তাহলে আপনি খেলাধুলা করার সুযোগ পাননি তেমন একটা।
- খুব পেয়েছি কিন্তু তখন পর্যন্ত না। প্রথমত বাসায় খেলার জিনিসপত্র খুব একটা ছিল না। কারণ কোনো খেলনাই বেশিদিন রাখতে পারি না। নাটবল্টু খুলে ভেঙে ফেলি। তাই আব্বা-আম্মা খেলনা কিনে দেবার ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করত। আমরা ততোদিনে টিনের ঘর ছেড়ে ওই এলাকারই একটা দোতলা বাড়ির এক রুম ভাড়া নেই। আমরা খুশি হয়েছিলাম কারণ ওই বাড়ির ছাদ ছিল। তখন প্রচুর ঘুড়ি ওড়ানো হতো। যদিও আমরা সেটা করতে পারিনি। সেইসময় ঘুড়ি ওড়াতে গিয়ে ৩টা ছেলে ছাদ থেকে পড়ে মারা গিয়েছিল। তাই ঘুড়ি সংক্রান্ত যে কোনো বিষয়ে আম্মার প্রবল আপত্তি ছিল। খেলাধুলা বলতে রামকৃষ্ণ স্কুলে টিলো-এক্সপ্রেস, ছোয়াঁছুয়ি, বোমবাস্টিং খেলতাম। আমারা বন্ধুর পুরো নাম ছিল মুন্সী মেহেদী জামান। কি মুন্সী মিলাদ পড়াইবা - বলে মেহেদীকে খেপিয়ে সারামাঠ দৌড়াতাম। সেটাও একপ্রকার খেলা ছিল। এছাড়া ঘরে ভাইয়ার সঙ্গে খেলতাম। আর আম্মা মাঝে মাঝে বেরোতে দিলে বাসার সামনে মাঠে টুকটাক ফুটবল খেলতাম। আবাহনী তখন বোধহয় কোনো কাপ জিতেছিল। ‘সালাহউদ্দিন, আবাহনী’ চিৎকারে বিশাল মিছিল হলো। আমি সেই থেকে আবাহনীর সাপোর্টার হয়ে গেলাম। যেমনটা ব্রাজিলের সাপোর্টার পেলের জীবনকাহিনী পড়ে। আর একটা বিষয় ভালো লাগত যখন খালার বাসায় বেড়াতে যেতাম। আমার স্পষ্ট মনে আছে ৫ টাকা রিক্সা ভাড়ায় আমরা গোপীবাগ থেকে অতীশ দিপংকর সড়ক (তখন এতো প্রশস্ত ছিল না, রাস্তার দুই পাশের খাদে অনেক ছাপড়া ঘর ছিল) হয়ে গোড়ান টেম্পুস্ট্যান্ড পর্যন্ত যেতাম। খুব এনজয় করতাম জার্নিটা। খালার বাসায় গেলে খালাতো ভাই কল্যাণের সঙ্গে খেলতাম, দেয়াল চড়তাম। পাশের বাসার বাথরুমে ঢিল মারা, পেয়ারা চুরি করা, খেলা বলতে এগুলোই। তবে গোপীবাগে থাকতে আমার মধ্যে একটা খারাপ বিষয় জন্ম নিল। আমি মারামারি করতে শিখে গেলাম। বন্ধুদের সঙ্গে মতান্তর হলে আমি হুটহাট মারামারি লেগে যেতাম।
- একদম খারাপ কথা। মারামারি করা মোটেই ভালো না। কি বলেন?
- অবশ্যই। কিন্তু ওইসময় এরকম মনে হতো না। গোপীবাগ থাকতে কড়া শাসনের মধ্যে থাকতাম। নিয়মিত স্কুল যেতাম। পাশের বাড়ির মহিলা হুজুরের কাছে আমপারা, সিপারা, কোরাণ পড়তে যেতাম। আমি ক্লাস থ্রিতে থাকতে প্রথম কোরাণ খতম করি। খুব ভারি ছিল বলে মাঝে মাঝে রাস্তায় কোরাণশরীফ আমার হাত থেকে পড়ে যেত। আম্মা তখন মসজিদে চাল দিত যেন আমার গুণাহ না হয়। আমাদের বাসায় টিভি ছিল না। আমরা পাশের বাসায় টিভি দেখতে যেতাম। ফ্লোরে একগাদা পিচ্চি পোলাপানদের সঙ্গে বসে বসে টিভি দেখতাম। একদিন ওই বাড়ির মহিলা খারাপ ব্যবহার করায় আম্মা জিদ করলেন টিভি কিনবেন। কিছুদিন পরেই আমাদের বাসায় শাদাকালো ফিলিপস ২০ ইঞ্চি টিভি কিনি। ছয়নয় চ্যানেল মিলিয়ে ছায়াছন্দ দেখার কি যে মজা তখন। গোপীবাগ থাকতে আমার সবচেয়ে ভালো লাগার স্মৃতি আমার মুসলামানির অনুষ্ঠান। প্রচুর গিফট পেয়েছিলাম। তারমধ্যে বিভিন্ন খেলনা, টেবিলল্যাম্প, হাতঘড়ি এসব ছিল। এরমধ্যে আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছিল কলমঘড়ি উপহার পাওয়াতে। বাড়ির ছাদের পুরোটাই প্যান্ডেল করে ৪০০ লোককে খাওয়ানো হয়েছিল। দেশের বাড়ি থেকে সমস্ত আত্মীয় স্বজন এসেছিল। সে এক এলাহী আয়োজন। ক্লাস ফোর পাস করে যখন ফাইভে উঠব তখন আমরা গোপীবাগ এলাকা ছেড়ে সবুজবাগে এসে উঠি। রামকৃষ্ণ ছেড়ে দিব, বস্তির বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হবে না। আমার মন খারাপ হয়ে যায়।
- সবুজবাগে নিশ্চয়ই প্রচুর বন্ধু হলো।
- হুম। আমার প্রচুর বন্ধুবান্ধব হতে লাগল। বন্ধুদের তালিকায় মেয়েরাও যোগ হতে লাগল। তবে নিয়তির বিধান কে বোঝে। সবুজবাগেও বস্তি ছিল। সেখানকার দুয়েকটা ছেলের সঙ্গেও আমার বন্ধুত্ব হয়ে গেল। সবুজবাগে আমাদের বাসাটা বড় ছিল। দোতলায় দুইটা রুম, বড় রান্নাঘর ছাড়াও একটা ব্যালকনি ছিল আর তার পাশ বেয়ে একটা নারকেল গাছও ছিল। আমরা দোতালায় থাকতাম। আমাদের পাশের বাড়িতে থাকত কাঁকন আর মন্টি। এছাড়াও ছিল ভোলন, সবুজ, শিপলু, বাদল, হেলেন ভাই, নান্টু ভাই, প্রবাল ভাই, লিটন ভাই। সবুজবাগে আমার খেলাধুলার নেশায় পেয়ে বসল। আমি প্রচুর ব্যাডমিন্টন, দাঁড়িচা, সাতচারা, ফুলটোক্কা, কানামাছি, লাটিম (ঘরকোপ আর বেল্লাপাড়) ফুটবল খেলতে শুরু করলাম। খেলার ফাঁকে সময় হলে দৌড়ে থান্ডার ক্যাটস দেখতে ছুটে যেতাম। পাড়ার প্রায় সবারই টিভি থাকলেও আমরা নান্টু ভাইদের বাসায় দলবেঁধে দেখতাম। আমাদের পাড়াটা ছিল কানাগলি। তাই পাড়ার সব পরিবারের মধ্যে কেমন একটা আত্মীয়ের মতো বন্ধন ছিল। আমরা ছেলেমেয়েরা একসঙ্গে খেলতাম। কেউ কিছু মনে করত না। আমগাছ, নারকেল গাছ ছিল। শবেবরাতের রাতে পাড়ার বড়ভাইরা নারকেল চুরি করত। আমরা সঙ্গ দিতাম। রিকশা নিয়ে সবুজবাগের বস্তির ছেলেদের সঙ্গে রাতে জরি মেখে ঢাকা শহর ঘুরলাম। বিশেষ বিশেষ দিনে তখন রাত ৭/৮টা পর্যন্ত বাইরে থাকার অনুমতি পেতাম। কিন্তু দুপুরবেলায় ঘুমানোর জন্য আম্মা দরজায় তালা মেরে রাখত। তখন বের হতে পারতাম না। সবচেয়ে মজা লাগত যখন কারেন্ট চলে যেত। আমরা ছেলেমেয়েরা বের হতাম পাড়ায়। হাঁটাহাঁটি করতাম, গান গাইতাম, অন্ধকারেই ছোঁয়াছুঁয়ি খেলতাম। হটপ্যাটিসওয়ালা আসত, আমরা কিনে খেতাম। ততোদিনে আহমদবাগের আদর্শ হাইস্কুলে ভর্তি হয়ে গেছি। ঝিলের পাড়ে স্কুল। বড়শি দিয়ে মাছ ধরা শিখলাম। আমার চেহারা দেখতে নাকি অনেকটা চাকমাদের মতো। আর সবুজবাগে ছিল বৌদ্ধমন্দির। ওখানে অনেক বন্ধু জুটে গেল। বৌদ্ধমন্দিরের পুকুরের ঝাপাঝাপি চলত। সকাল দশটায় পুকুরে নামতাম। এক ঘন্টা দাপাদাপি করে পরের আধাঘন্টায় রোদে দাঁড়িয়ে প্যান্ট শুকিয়ে বাসায় গিয়ে স্কুলড্রেস পরে সোজা স্কুলে। ক্লাস শুরুর আগে দাঁড়িচা খেলে তবেই স্কুলে ঢুকতাম। এছাড়াও ক্লাস ফাইভে পড়ার সময় আমরা দুইভাই পল্টনে কচিকাঁচার আসরে ছবি আঁকা শিখতে যেতাম। প্রথমে মোমের রঙে, পরে তুলি দিয়ে। প্রথম প্রথম আম্মা নিয়ে যেতেন, পরে গৃহশিক্ষক নিয়ে যেতেন। একবার হলো কি, কচিকাঁচা বিল্ডিংয়ের দোতালায় লাইব্রেরি ছিল। আমি ওইদিন ছবি তাড়াতাড়ি এঁকে কাউকে কিছু না বলে দোতালায় গিয়ে গল্পের বই পড়া শুরু করলাম। প্রায় ঘন্টাখানেক পর আমার টিচার আমাকে খুঁজে পেল। প্রচন্ড ক্ষিপ্ত হয়ে তিনি আমাকে বিল্ডিংয়ের আড়ালে নিয়ে গিয়ে মারধোর করতে থাকল। আমিও মেজাজ ঠিক রাখতে না পেরে টিচারের গালে থাপ্পড় বসিয়ে দিই।
- আপনি তো ভালোই দস্যিপনা করতেন।
- না, আমি মোটেই সেরকম ছিলাম না। দেখতে খুবই শান্তশিষ্ট ছিলাম, শুধু মারামারি একটু করে ফেলতাম। আমার মুখে অসংখ্য খামচির দাগ এখনো রয়ে গেছে মারামারির কল্যাণে। তবে ইন্টারপাস করার পর এই মারামারি করার ব্যাপারটা একদমই চলে গেছে। হয়তো মাঝে মাঝে দু’একবার করেছি। সবুজবাগে আমার আরেকটা ভাই জন্ম নেয়। কিন্তু আমার মন খারাপ হয়ে যায় ভাই জন্ম নিয়েছে শুনে। আমি খুব করে চাইছিলাম আমার যেন একটা বোন হয়।
- আপনার লেখালেখির শুরুটা কবে থেকে?
- সেটা আরো পরে। আমি তখন খুব করে পড়ছি। এলাকার হাবিব বুকস দোকানে সেবাপ্রকাশনীর বই ছাড়াও অন্যান্য গল্পের বই ১ টাকায় ভাড়া পাওয়া যেত। আমি যেন সোনার খনি হাতে পেলাম। যেনতেন প্রকারে ১ টাকা যোগাড় করা চাই। বাসায় কেউ বেড়াতে এলে আম্মার অনুপস্থিতিতে আমি লুকিয়ে আস্তে করে চাইতাম, আমাকে ১টা টাকা দিবেন? আমি গল্পের বই পড়ব। আচ্ছা বলেন, কেউ তখন টাকা না দিয়ে থাকতে পারে? টাকা পেয়েই আমি দৌড় দেই হাবিব বুকসে। গোগ্রাসে গিলতে শুরু করি কুয়াশা, বনহুর, থ্রিলার, ক্লাসিক। পুরো হাবিব বুকস পড়ে শেষ করে ফেললাম। ততোদিনে মতিঝিল মডেল হাইস্কুলে ভর্তি হয়েছি ক্লাস সিক্সে। মেহেদীও রামকৃষ্ণ ছেড়ে ওখানে ভর্তি হয়েছে। ব্যাটাও বই পড়ে প্রচুর। আমার আরেকটা সোর্স পাওয়া গেল। এছাড়াও পাড়ার নান্টু ভাইও অনেক বই পড়তেন। নান্টু ভাইয়ের বড় আপা বেবি আপা আমাকে প্রথম বড়দের (?) বই পড়তে শেখায়। অতি নির্জলা কিন্তু সেইসব প্রেমকাহিনী পড়ে আমি তখন শিহরিত হতাম। লিমা প্রকাশনীর সুইটহার্ট, মাইলাভ বইগুলো বাসায় লুকিয়ে পড়তে হয়েছিল।
- হুমম বেবী আপা। কিন্তু আপা ছাড়া আর কেউ, এই ধরেন পাড়ার ছোটবোন অথবা বন্ধু ছাড়াও আরো বেশি কিছু হতে চায়, মানে বুঝতেই পারছেন ...
- খুব বুঝতে পারছি। কিন্তু ওই সময় পর্যন্ত তেমন কিছুই ঘটেনি। ক্লাস সেভেন পর্যন্ত মেয়েদের সঙ্গে খেলাধুলা করেছি। আমার শুধুমাত্র কাঁকনের কথাই মনে আছে। আমাদের পাশের দোতালায় থাকত। তবে কোনো কোনো দিন খেলতে আসত না। এখন বুঝি কেন? ভালোবাসাবাসির কথা যদি ধরেন তাহলে ছোটবয়সের প্রথম ভালোলাগা ছিল বাঁধন নামে আমার এক দূরসম্পর্কের আত্মীয়কে। প্রেমের নির্দশন স্বরূপ আমি খাতাপত্রে, বইয়ের কোণায় খুব ছোট করে লিখে রাখতাম বাঁধন ছিড়ে পালাল পাখি। আজ পর্যন্ত মুখ ফুটে বলা হয়নি। দুই সন্তানের মা বাঁধন নিশ্চয়ই এখন খুব ভালো আছে। ছেলেমেয়ের মধ্যে প্রেম, বিয়ে, যৌনতা, জন্মরহস্য এসব বিষয়গুলো সম্পর্কে প্রথম জ্ঞানলাভ করি মাদ্রাসা পড়–য়া বন্ধু বাদলের কাছ থেকে। এর পূর্বে আমার ধারণা ছিল বাবা-মা আমাদের আল্লাহর কাছে চেয়েছেন এবং আল্লাহ রাতের বেলায় টুপ করে বিছানায় রেখে এসেছেন। বাদলই প্রথম আমার এ ভ্রান্ত ধারণা ভেঙ্গে দেয়ার চেষ্টা করে। আমি যখন কিছুতেই বিশ্বাস করছি না, তখন সে মহানবীর উদাহরণ টানে। আমার আর মানতে বাধা থাকে না। মাদ্রাসা পড়ুয়া বাদল কি আর তার (মহানবী) সম্পর্কে মিথ্যা বলবে? যাহোক, সবুজবাগে আমার মারামারির অভ্যাস আরো বেড়ে যায়। আম্মাকে এ নিয়ে প্রায় শালিশ করতে হতো। আম্মা আগে আমাদের মারতেন তারপর শালিশ করতেন। আর একটা বাজে অভ্যাস ছিল স্যান্ডেল হারিয়ে ফেলার। মাগরিবের আযান পড়ল, খেলাও শেষ। আমি স্যান্ডেল ফেলে খালি পায়ে বাসায় ফিরলাম। এইসব করতে করতে আর পড়তে পড়তে আমি প্রথম কবিতাটা লিখে ফেলি ক্লাস সিক্সে থাকতে - স্বাধীনতা নিয়ে।
- এতো বিষয় থাকতে স্বাধীনতার মতো এতো কঠিন বিষয় বেছে নিলেন কেন?
- প্রভাবটা নানার ছিল। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধের গল্প শুনতাম তার কাছ থেকে। এছাড়া আম্মা-মামারা আমাদের দুইভাইকে নানার বিভিন্ন বীরত্বগাঁথা শোনাতেন। তার মোড়লগিরি, যুদ্ধের কথা এসব শুনতে শুনতে আমি স্বাধীনতার বিভিন্ন বিষয়ের উপর আগ্রহী হই। আমার সেই বয়সের আদর্শ ছিলেন আমার নানা। ডিসেম্বরের ছুটিতে আমরা গ্রামে বেড়াতে গেলে নানার দাড়ি টেনে টেনে গল্প শুনতাম। তবে মজার কথা হলো, ওই কবিতাটাই আমার প্রথম এবং শেষ কবিতা। দ্বিতীয় আরেকটি কবিতা লিখতে চেয়েছিলাম ক্লাসে বসে বসে। তখন পাশের ছেলেটা দাঁড়িয়ে বলল, আপা, ও না কবিতা লেখছে। আপা বললেন, কবিতা লেখতে হয় গাছতলায় গিয়ে লেখো, ক্লাসে নয়। সেই থেকে কবিতা লেখা ছেড়ে দিলাম। তার বদলে পড়ার ঝোঁকটা আরো বেড়ে গেল।
- আপনি আর লেখালেখিই করলেন না?
- ছেলেবেলায় আর না। এরপরের যাবতীয় লেখালেখি আমি ইন্টারপাস করার পরে শুরু করি। ততোদিনে আমার ঘর পালানো রোগ হয়েছে। নজরুল ইসলামের জীবনী পড়ে আমি প্রচুর প্রভাবিত হই। ধরেন আম্মা মারল, আমি চিন্তা করলাম, কি লাভ এ সংসারে থেকে। ঘর পালিয়ে কই নজরুল তো মারা পড়লেন না। আমিও বেশ কয়েকবার ঘর পালালাম। সকালে রাগ করে ঘর ছেড়ে পালিয়ে দূরে দূরে চলে যেতাম। খুব ক্ষিধে পেত। একবার হাঁটতে হাঁটতে মাদারটেক ছাড়িয়ে রাজারবাগ ছাড়িয়ে কাঁচপুর ব্রিজের কাছাকাছি চলে গিয়েছিলাম। ক্ষিধের জ্বালায় বড়ই গাছে ঢিল মেরে কাঁচা বড়ই খেয়েছিলাম। প্রতিবারই আমি ঘর পালালে আম্মা আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী জড়ো করে কান্নাকাটি করতেন। আর আমি সন্ধ্যা হলে ক্ষিধের জ্বালায় পাড়ার আশেপাশে ঘুরঘুর করতাম যেন কেউ আমাকে জোর করে ধরে বাসায় নিয়ে যায়। প্রেস্টিজ বলে একটা কথা আছে না। নিজ থেকে বাসায় ফিরি কি করে। ততোদিনে সিগারেট ফুঁকতে শিখেছি, মানে মুখে ধোঁয়া নিয়ে হুশ করে ছেড়ে দেয়া, ভেতরে নিতে পারতাম না। ক্যাপস্টান বলে একটা সিগারেট ছিল। ওইটা খেয়েছি। তারপর বস নামেও একটা ছিল। সিজার খেয়েছি, ক্যানন খেয়েছি। আমার খুব একটা ভালো লাগত না। পান মুখে নিয়ে খেলে নাকি সিগারেট হেভি লাগে। ট্রাই করলাম, মজা পেলাম না। আব্বা সিগারেট খান, একদিন সেখান থেকে চুরি করে দিনের বেলায় টয়লেটে বসে সিগারেট খাচ্ছিলাম। হঠাৎ দরজায় নক। খোলার সঙ্গে সঙ্গেই কানের নিচে আম্মার বিশাল চটকনা বসিয়ে দিলেন, টয়লেটে বসে সিগারেট খাও? আমি খুব আশ্চর্য হলাম, বুঝল কিভাবে? পরে আবিষ্কার করলাম টয়লেটের জানালা দিয়ে রোদ এসে দরজার ফাঁক দিয়ে তীর্যকভাবে ঘরের মেঝেতে পড়ত। আমার সিগারেটের ধোঁয়া সেই তীর্যক রোদে একটা ধোঁয়াটে আবহ তৈরি করেছে। আম্মা টয়লেটের বাইরে থেকে ছেলের কীর্তি ধরে ফেলেছেন। অবশ্য সিগারেট আমার খুব একটা ভালোও লাগত না, তাই ছেড়ে দিলাম। শরীর রক্ষায় মনোনিবেশ করলাম। দুই ভাই মিলে প্রতিদিন সকালে কমলাপুরের ইঞ্জিন ওয়ার্কশপে জগিং, ব্যায়াম এবং বিকেলে কুংফু শেখা শুরু করলাম। যে কোনো প্রকার ডিগবাজি, রেললাইনের ফাঁকে দুই পা সমান্তরালে ছড়িয়ে দেয়া, গাছ, দেয়াল বেয়ে উঠে যাওয়া এসব কোনো ব্যাপারই থাকল না। ডিগবাজির অনেকগুলো আমি এখনও দিতে পারি।
- হা হা, কুংফুম্যান। এবার আপনার গ্রামের বাড়ির কথা তো কিছু বলেন।
- আমার গ্রামের বাড়ি ফেনী জেলার বিজয়সিংহ গ্রামে। এইটা আমার দাদাবাড়ি। নানাবাড়ি হলো লেমুয়া। আমরা প্রতিবছর খালাতো ভাইবোনসহ গ্রামে যেতাম। দাদাবাড়িতে থাকা হতো কম। দুয়েকদিন থেকেই নানাবাড়ি ছুটতাম। সবাই মিলে ডাব, সুপারি, খেজুর রস সাবাড় করতাম। নানাবাড়ি ছিল বিশাল। বিয়ের আগে মা খুব দস্যি ছিলেন। নানাবাড়ির প্রতিটা আমগাছের মা আলাদা আলাদা নাম দিয়েছিলেন। আমের ভারে গাছের ডাল ভেঙে পড়তে দেখেছি আমি নিজের চোখে। মামারা তখনো কেউ বিয়ে করেননি। তাদের সঙ্গে বাজারে যেতাম, বিভিন্ন জিনিস খেতাম। চৌধুরীর নাতি হিসেবে কিছু টাকাপয়সাও উপহার পেতাম। একবার হলো কি, দাদাবাড়িতে কোনো এক কারণে বড় ভাইয়ের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কিতে বড় ভাইয়ের হাত ভেঙে গেল। ফেনী শহরে নিয়ে চিকিৎসা করানো হলো। কিন্তু আম্মার মন তো মানে না। পরদিনই তিনি আমাদের নিয়ে ঢাকায় চলে এলেন। ডাক্তার দেখানো হলো এবং দেখা গেল ভুল প্লাস্টার করানোর কারণে ভাইয়ার ভাঙা হাতে পানি জমে গেছে। আম্মার তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্তে ভাইয়ার হাতটা বেঁচে গেল। এছাড়া নানাবাড়ির সবচেয়ে মজা ছিল কলাগাছের ভেলা বানিয়ে সেটায় চড়ে পুকুরে ভেসে বেড়ানো। নানা কলাগাছ কাটতে দিতেন না বলে হিন্দুবাড়ির কলাগাছ রাতের অন্ধকারে মামারা সহ কেটে ফেলতাম। তারপর ওইটা দিয়ে ভেলা বানাতাম। নানাবাড়ির চারপাশে সব হিন্দুদের বাড়ি ছিল। আর কোনো মুসলমান বাড়ি ছিল না। ফলে গ্রামে গেলে তাদের সঙ্গেই খেলতাম। সারাবছর অপেক্ষা করতাম ডিসেম্বর মাস এলে খালাতো ভাইবোনরা মিলে গ্রামে যাব। হরেক রকমের পিঠা, পুলি ... উপস।
- তারপর?
- এবার মতিঝিল মডেল হাইস্কুল নিয়ে কিছু বলি। ক্লাস সিক্সে আমি ও বড়ভাই এখানে ভর্তি হই। অনেক বড় স্কুল, অনেক ছাত্র। ক্লাস সিক্সে আমার শাখাটা ছিল মসজিদ ঘরের পাশে। আমার একটু নামাজ-কালামের দিকে ঝোঁক গেল। পড়াশোনাটাও সিরিয়াসলি করতে থাকলাম। আউট বই পড়ার অভ্যাস আগের মতোই রয়ে গেল, খেলাধুলাটাও। সবুজবাগ থেকে স্কুলে যাওয়াআস করতাম কমলাপুর রেলওয়ের স্টেশনের মধ্যে দিয়ে। স্কুলছুটির পর স্টেশনের মাঠে (রেললাইনগুলোর মাঝের ফাঁকা জায়গায়) ফুটবল খেলতাম। ক্লাস সিক্সে পড়াশোনায় বেশ সিরিয়াস হলেও আবাহনী-মোহামেডান ফুটবল ম্যাচের জন্য স্কুল পালিয়ে পরেরদিন প্রচুর মার খেয়েছিলাম। আমাদের হেডমাস্টার ছিলেন ইয়াকুব আলী। এরকম স্মার্ট কোনো হেডমাস্টার বাংলাদেশের আর কোনো স্কুলে কখনোই ছিল না এ ব্যাপারে আমি ড্যাম শিওর। পাতলা হোয়াইট শার্ট, ঘিয়ে রঙের প্যান্ট পরে, কালো জুতো পরে আর মাথার শাদা চুলগুলো ব্যাকব্রাশ করে যখন করিডোর ধরে হেঁটে যেতেন, আমরা ভয়ে ভয়ে নাক উঁচিয়ে পারফিউমের গন্ধ শুঁকতাম। তো ওই সিক্সে পড়া অবস্থায় আমার আরো একটা প্রতিভার সন্ধান পাওয়া গেল।
- সেটা কিরকম?
- বাংলা ক্লাসে একবার স্যারের কি মনে হলো আমাদের সবাইকে দিয়ে ‘দইওয়ালা’ রিডিং পড়ানো শুরু করলেন। কিন্তু সেটা অভিনয় করে পড়তে হবে। আমি অমল চরিত্রটা টেনে টেনে, সুর করে, ঢং করে, অভিনয় করে পড়লাম। স্যার খুশিতে আমার ডায়েরিতে ১০/১০ দিলেন। সেই থেকে অভিনয়ের প্রতি একটা সুপ্ত বাসনা আমার মনে চাড়া দিল।
- তাহলে আপনি অভিনেতা হলেন না কেন?
- সেটা অনেক কষ্টের কাজ। তাই ওপথে না গিয়ে এখন অভিনয় করাই সবাইকে।
- তারপর?
- ক্লাস সিক্সে ভালো রেজাল্ট করে আমি সপ্তম শ্রেণীতে ক শাখায় চান্স পেলাম। টিফিনে নামাজ পড়ি, ফ্রিসবি খেলি আর স্কুলছুটির পর কমলাপুরে ফুটবল খেলে বাসায় ফিরি। তখন স্কুলে বাইরে থেকে বড় বড় কিছু ছেলে আসত। তারা আমাদের বিভিন্ন নবীর জীবনী পড়তে দিত। আমি পড়তাম। এখন বুঝি তারা ছিল শিবিরের হারামি। আমার মগজ ধোলাই হয়ে গেল। আমি পারলে তাহাজ্জুদের নামাজও পড়ি। বাসায় কোরাণ আবার পড়া শুরু করলাম। পাড়ার মসজিদেও জামাতে নামাজ পড়তাম। ছেলেদের দেয়া বিভিন্ন ফর্মে সই করা শুরু করলাম। তবে এতোসব কিছুর পরও আউট বই পড়া কিন্তু ছাড়িনি। সেবা ছাড়িয়ে হুমায়ুন আহমেদ এবং পশ্চিমবঙ্গের লেখকদের বই হাতে নিতে শুরু করেছি। মাসুদ রানা, ওয়েস্টার্ণ অদম্য গতিতে এগিয়ে চলেছে। কিন্তু ধীরে ধীরে আমার পড়াশোনার ক্ষতি হতে লাগল। বলা যায় আমার আর স্কুলের পড়াশোনা ভালো লাগছিল না। বাসায় ইত্তেফাক রাখা হতো। আমি খেলার খবর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তাম। সুনীলসহ বিভিন্ন লেখকের মোটা মোটা বইগুলো পড়ে মাথা ঘুরতে লাগল। আল্লাহ, খোদা, সৃষ্টিরহস্য, ধর্ম এগুলো নিয়ে ভাবতাম। আস্তে আস্তে নামাজ পড়া কমতে থাকল। কোরাণ পড়া অর্ধেক এসে থেমে গেল। আমি পরীক্ষায় খারাপ করে অষ্টম শ্রেণীতে গ শাখায় উত্তীর্ণ হলাম।
- আপনি যেভাবে বললেন আমি ভাবলাম আপনি পরীক্ষায় বুঝি ফেল করলেন।
- ছাত্র হিসেবে ফেলনা ছিলাম না। আমি শুধু পাসের চেয়ে একটু বেশি নম্বর পেলেই খুশি। টিচাররা বলতেন, লন্ডন, আমেরিকা যাইতে পার, নোয়াখালি গিয়া থাইমা যাও কেন? অষ্টম শ্রেণীতে উঠার পর আমার আরেকটা বাতিক শুরু হলো। বন্ধু রুহুলের পাল্লায় পড়ে বাংলা ছবি দেখা শুরু করলাম। ২০/২৫ টাকা দিয়ে টিকেট কেটে ছবি দেখা খুব কষ্টের ছিল। রুহুল আমাকে সে কষ্ট থেকে মুক্তি দিল। ৮/১০ টাকা দিয়ে স্টলের টিকেট কাটতাম। পরে সুযোগ বুঝে টিকেটচেকারদের চোখ ফাঁকি দিয়ে পিছনের সিটে চলে আসতাম। ভাইজান, দায়ি কে, ছেলে কার, মাড়কশা, বজ্রমুষ্ঠী, গর্জন ... উফফ কিসব ছবি। হা হা হা। মুগ্ধ হয়ে দেখতাম। এর আগে আব্বা-আম্মার সঙ্গে ছবি দেখতে যেতাম। মনে আছে সবুজসাথী ছবি দেখে কান্না পেয়েছিল। ছোটবেলায় আংশিক রঙিন ছায়াছবিগুলোর প্রতি আমার আগ্রহ ছিল। অপেক্ষা করতাম স্ক্রিণে কখন মারামারি শুরু হবে। বাসায় ফিরে ভাইয়ার সঙ্গে সেগুলো প্র্যাকটিস করতাম। তো রুহুলকে সঙ্গে পাওয়ায় ছবির প্রতি প্রেম আবার জাগল। সঙ্গী হিসেবে পেলাম মুকুল আর দিদারকে। একবার অভিসারে ছবি দেখতে গিয়ে টাকা কম পড়ে গেল। একটা ছেলে এগিয়ে এসে ধার দিল। আরেকবার রাজমনিতে ছবি দেখব, কিন্তু সেই সমস্যা, টাকা কম। ছবি শুরু হওয়ার আগে আগে মুকুল বলল, কি আর করা। নোটবই কিনব ভেবেছিলাম। থাক, ছবিটা আগে দেখে নিই। বলেই চোরা পকেট থেকে ২০ টাকা বের করে। আমার এই বাংলা ছবি দেখার অভ্যেস লন্ডনে আসার আগ পর্যন্তও ছিল। সমালোচকরা যতোই ছবির মান খারাপ বলুক না কেন প্রতি শুক্রবার আমরা বাংলা ছবি দেখতাম। লিমা, সাবিহা, কবিতা, সোনিয়াদের ছবিও মিস হতো না। ফলাফল পরীক্ষায় আরো খারাপ। নবম শ্রেণীতে ঙ শাখায় এই মহারাজার স্থান হলো।
- এরপর নিশ্চয় বলবেন না যে আপনি এসএসসিতে ফেল করেছেন।
- তা বলব না। তবে অষ্টম শ্রেণীতে পড়ার সময় একটা খারাপ কাজ করে ফেলি। তখন আমরা কদমতলায় চলে গেছি। ফুটবল খেলি খুব ভালো। পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে ২/১ জায়গায় ম্যাচ খেলতেও গেছি। সেখানে রিজভী নামে একটা ছেলে থাকত যে কিনা আমাদের স্কুলেই পড়ত। আমরা একসঙ্গে স্কুলে আসা যাওয়া করতাম। পাড়ার ফুটবলটা পালা করে সবার বাসাতে থাকত। এই ফুটবল রাখা নিয়েই রিজভীর সঙ্গে আমার ঝগড়া লেগে গেল। আমি ঠিক করলাম রিজভীকে আমি মারব। সেদিন ওর সঙ্গে স্কুলে যাব না বলে দিলাম। কিন্তু বাসায় ফিরে স্কুলড্রেস পরে তক্কে তক্কে থাকলাম। রিজভী স্কুলে যাওয়ার জন্য রাস্তায় নামতেই আমিও তার পিছু নিলাম। কমলাপুর আসতেই আমি রিজভীকে ডেকে এককথা দুইকথায় পকেট থেকে ছুরি বের করে কানের পাশে মেরে দিই। মুহূর্তেই রিজভীর কান বেয়ে রক্ত বের হয়ে শাদা শার্ট লাল হলো। আমি ভয়ে ছুরি ফেলে স্কুলে চলে যাই। পরে রিজভী বিচার দেয়ায় ইয়াকুব স্যার আমাকে জোড়া বেত দিয়ে খুব করে মেরেছিলেন। ওই ঘটনার পর থেকে আমি বোধহয় আর কখনো মারামারি করিনি।
- মাইগড। খুব ডেয়ারিং কাজ করেছেন তো দেখি।
- হুম। একদমই ঠিক হয়নি। ওইদিন মাথার ঠিক ছিল না। সেই রিজভী এখন লন্ডনে থাকে। মাঝে মাঝে দেখা হয়। আমরা কেউই অস্বস্তিতে ওই প্রসঙ্গটা তুলি না। রিজভী - তুই যদি এ লেখা পড়িস তবে মাপ করে দে আমাকে।
- তারপর?
- নবম শ্রেণীতে সায়েন্স একটু কঠিন লাগায় পড়াশোনায় মনোযোগ দেয়া শুরু করি। তবে ফুটবলে আরো বেশি মনোযোগ চলে যেত। আমরা বাসা বদল করে মায়াকানন চলে গেলাম। সেখানে জুনিয়র কিছু ছেলেদের সঙ্গে মিলে মৈত্রী সংঘ নামে একটা ক্লাব করলাম। একটা ভাঙা দোকানঘরে লাইব্রেরির কাজ শুরু করলাম। লজেন্স কিনে বিক্রি করতাম। সাইকেল ভাড়া করে চালাতাম। মুগদা ঝিলে গোসল করতাম। এলাকাটা ছিল ডেভেলপিং। নতুন রাস্তা হচ্ছে। আমরা সেখানে মার্বেল খেলতাম। তখন দেখতাম ৭/৮ জন হুজুরটাইপের লোকজন জামাতে ইসলামীর ব্যানার নিয়ে হেঁটে যেতেন। ওই হুজুরগুলোর মধ্যে একজনের বাড়িতে পেয়ারাগাছ ছিল। আমরা পেয়ারা পাড়তে গেলে খুব হইচই করত। আমরা তিতিবিরক্ত হয়ে ভাবতাম শালা শান্তিতে একটু চুরিও করতে দেবে না। তাই বন্ধুরা সিদ্ধান্ত নিলাম ওই হুজুর ব্যাটাকে শায়েস্তা করতে হবে।
- শায়েস্তা করতে পেরেছিলেন?
- পেরেছিলাম। নতুন রাস্তা করতে গেলে প্রথমেই একগাদা বালি ফেলা হয়। মায়াকাননের এরকম একটি রাস্তায় মার্বেল খেলতাম। বন্ধুরা মিলে সেই বালির রাস্তা খুঁড়ে ময়লা এনে ভরিয়ে, উপর দিয়ে পাতলা প্লাস্টিক বিছিয়ে, তার উপর হালকা বালি দিয়ে, গর্তটার চারপাশ ঘিরে আমরা দাঁড়িয়ে থাকলাম। হুজুর ব্যাটা শাদা জোব্বা পরে যখন রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল আমাদের দেখে সোজা রাস্তার মাঝখান দিয়ে হাঁটতে থাকল। এবং কিছুক্ষণ পরেই তার এক পা ডেবে গেল সেই ময়লা পানির গর্তে। আমরা খুশিতে চিৎকার করে দৌড়ে পালিয়ে গেলাম। আপনি এটাকে জামায়াতের প্রতি আমার প্রথম আক্রমণ হিসেবে ভাবতে পারেন। যদিও ওসব কিছু না ভেবেই আমরা কাজটা করেছিলাম।
- তা না হয় ভেবে নিলাম। কিন্তু আমি খুব বোর হয়ে যাচ্ছি। এতোবড় একটা ছেলেবেলায় আপনার কোনো মেয়েবন্ধুর কথা পেলাম না।
- কবি এখানেই নিরব। আমি কলেজে উঠার আগ পর্যন্ত মেয়েদের সাথে মিশতে লজ্জা পেতাম। আমার মনোযোগ ফুটবল আর গল্পের বইয়ের প্রতি বেশি ছিল। তারপরও মায়াকাননে শম্পা নামে একটা মেয়েকে ভালো লাগত। সত্যি বলতে কি আমার খুব ঘন ঘন বিভিন্ন মেয়েদের পছন্দ হতো। আমি তাদের নিয়ে নিজের মনেই ভাবতাম। একটাতে স্থির থাকতাম না। নারী-পুরুষের কেমিস্ট্রিটা বোঝার পর আমি আসলে তাদের সামনে যেতে লজ্জাই পেতাম। নারীসংক্রান্ত আমার সমস্ত বাঁদরামি কো-এডুকেশনের কলেজে পড়ার সময় শুরু হয়। যদিও শৃঙ্গার নামে লাল মলাটের একটি মোটা বই আমি নবম শ্রেণীতে থাকা অবস্থায়ই পড়ে ফেলেছিলাম।
- বুঝেছি। কলেজে পড়ার আগ পর্যন্ত আপনি নিজের মনেই ডুবে ডুবে জল খেতেন।
- কি জানি। যেসব মেয়েদের আমার পছন্দ হতো তাদের তো সরাসরি বলার সাহস রাখতাম না। বন্ধুদের অনেকেই তখন দুয়েকটা প্রেমট্রেম করে। তাদের নিয়ে গল্পও করে। স্কুলের বন্ধুরা তো আরো অনেক ভয়ানক গল্প করত। আর মেয়েদের কাছে গেলে যে আমি পাত্তা পাব সেই আত্মবিশ্বাসও ছিল না। স্কুলজীবনে আমার চেহারা একদমই বাচ্চা বাচ্চা টাইপের ছিল। তাই ডুবে ডুবে জল খেতাম অর্থাৎ আমার ভাবনাতেই আমি মেয়েদের সঙ্গে প্রেমট্রেম যা কিছু করার করতাম। ও হ্যা, ডুবে ডুবে জল খাবার কথা যখন বললেন তখন একটা ঘটনা বলি।
- এইতো মুখ খুলতে শুরু করলেন। বলুন বলুন ...
- আরে না, এটা মেয়েসংক্রান্ত কিছু না। আমি একবার পুকুরে ডুবে গিয়েছিলাম, সেই ঘটনা।
- তাই নাকি। বলুন তো।
- মায়াকাননে একটা পুকুরে আমরা দুইভাই গোসল করতাম প্রায়ই। সাঁতার পুরোপুরি পারতাম না। সেজন্য খালি গ্যালন পেটের নিচে নিয়ে দুইহাত বৈঠার মতোন বেয়ে বেয়ে মাঝপুকুরে চলে যেতাম। মাঝে মাঝে গ্যালন ছেড়ে দিয়ে সাঁতারের চেষ্টা করতাম। না পেরে হাচড়ে পাচড়ে আবার গ্যালন ধরে ভেসে থাকতাম। ওইদিন দুপুরবেলায় মাঝপুকুরে এমন করছি হঠাৎই হাতের ধাক্কায় গ্যালন দূরে সরে গেল। আমি যতোই আঁকড়ে ধরতে চাই, গ্যালন ততোই দূরে সরে যায়। একপর্যায়ে হাতের নাগালের বাইরে চলে গেল। পুকুরে তখন আমি একা ছিলাম। আমি চিৎকার করে ভাইয়াকে ডাকি। ভাইয়া অল্পবিস্তর সাঁতার পারত। তারপরও আরেকটা গ্যালনটা নিয়ে সাঁতরে আমার কাছাকাছি আসে। আমাকে জাপটে ধরতে গেলে আমিও ভাইয়াকে জাপটে ধরি। ঢেউয়ের ধাক্কায় ওই গ্যালনটাও দূরে সরে যায়। ভাইয়া কোনোমতেই আমাকে ধরে রাখতে পারে না। জাপটাজাপটিতে দুইজনই ডুবতে থাকি। ভাইয়া আমাকে ছেড়ে দিয়ে জাফরকে চিৎকার করে ডাকতে থাকে। ও-ও আমাদের সঙ্গে পুকুরে ছিল। কিছুক্ষণ আগে উঠে সে একটু দূরে রোদে দাঁড়িয়েছিল। জাফর সম্পর্কে একটু বলে নিই। কিছুদিন হয় বাবা-মার সঙ্গে গ্রাম থেকে শহরে এসে স্যাটেল হয়েছে। আমাদের চেয়ে দ্রুত গাছ বাইতে পারে, একঢিলে আম পাড়তে পারে এবং মারাত্মক ডুবসাঁতার দিতে পারে। এগুলো আমাদের জন্য কোনো ব্যাপার না, কিন্তু ওকে হিংসার করার প্রধান কারণ হলো, ওর একটা টিউব ছিল। ও প্রায়ই মাঝপুকুরে সেই টিউব ফুলিয়ে তাতে চড়ে ভাসত। যাহোক, এদিকে আমি ডুবে যেতে থাকি, পানি খেতে থাকি, এবং ততোক্ষণে লাল-নীল-সবুজ অনেক রঙ দেখে ফেলেছি। এর পরের ঘটনা আমার ভাইয়ার মুখে শোনা। ভাইয়ার চিৎকার শুনে জাফর মুহূর্তেই ব্যাপারটা বুঝে ফেলে। প্রথমেই সে টিউবটা ছুড়ে মারে পুকুরে। তারপর নিজে ডাইভ দিয়ে ডুব সাঁতার দিয়ে পুরা মাছের মতো সাঁতরে ১ মিনিটেই আমার কাছে চলে আসে। পানির নিচে আমার জ্ঞান তখনো আছে। আমি অনুভব করতে পারি আমার চুল ধরে কেউ একজন টেনে তুলছে। জাফর আমাকে পানির উপর টেনে টিউবের উপর তুলে দিল। বলতে পারেন এখন আমি দ্বিতীয় জীবন কাটাচ্ছি।
- আপনার মা জানতেন বিষয়টা?
- মাথা খারাপ। আমরা দুইভাই কেউই বিষয়টা বলিনি। বললে পানির তলে না, আম্মার হাতের তলেই বোধহয় মারা যেতাম। তবে আব্বা একবার আমার দস্যিপনা দেখেছিলেন।
- কি করেছিলেন আপনি ?
- নব্বইয়ের গণ অভ্যুত্থান চলছে তখন। আমি ক্লাস টেনে পড়ি। আমার কাছে সেটা মুক্তিযুদ্ধ। সবুজবাগ বৌদ্ধমন্দিরের সামনের অতীশ দীপংকর সড়কে তখন আমরা ব্যারিকেড ব্যারিকেড খেলি। আর্মির জিপ এলেই ইঁদুরের মতো চিঁ চিঁ দৌড়ে গলিঘুপচিতে আত্মগোপন করি। থাকি কিন্তু তখনো মায়াকাননে। রেললাইনের কাঠের স্লিপার তুলে এনে পাড়ার বড়ভাইদের নির্দেশমতো রাস্তায় আগুন জ্বালিয়ে দিই। আগুনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করি। কনস্ট্রাকশনওয়ালা বিল্ডিং থেকে ঢালাইয়ের তক্তা খুলে সেটার পেরেকগুলো সোজা করি রাস্তায় শুইয়ে রাখি। ওপরে মাটি বা কিছু একটা বিছিয়ে দিই। উদ্দেশ্য হলো আর্মির গাড়ি এলে যেন টায়ার পাংচার হয়ে যায়। টায়ার জ্বালিয়ে দিই। সে এক ধুন্ধুমার কান্ড। একদিন মায়াকাননের সামনের রাস্তায় ব্যারিকেড দিচ্ছিলাম হঠাৎ আর্মির একটা জিপ দ্রুত চলে আসে কাছাকাছি। আমি দৌড়ে রাস্তার পাশে মেসবাড়িতে ঢুকে পড়ি। কারো একজনের রুমে ঢুকে আত্মগোপন করতে যাচ্ছি এমন সময় সবাই আমাকে ঠেলে বের করে দিতে চাইছে। আমি অবাক হয়ে কারণ জিজ্ঞেস করি। যেটা জানা গেল তা হলো, আমরা সারাদিন ধরে যেসব ব্যারিকেড দিই, ভোররাতে এসে আর্মিরা এই মেসবাড়ির লোকদের তুলে সেগুলো পরিষ্কার করায়। তাই তারা আন্দোলনকারীদের প্রতি তিতিবিরক্ত। আমাকে ঠেলে মেসবাড়ি থেকে বের করে দেয়া হলো। বেরিয়েই একটা জলপাইয়ের সামনে পড়ে যাই। সঙ্গে সঙ্গে ঘুরেই উল্টোপথে দৌড় দিই। আড়চোখে দেখি জলপাই বন্দুক তাক করেছে আমার দিকে। আমি আরো জোরে দৌড়ে ঝিলে ঝাঁপ দিয়ে পড়ি। তখন মনে হচ্ছিল এই বুঝি গুলি এসে আমার পিঠে লাগল। অল্পজানা সাঁতার আর হাঁচড়ে পাঁচড়ে কোনোমতে কবরস্থান দিয়ে বাসার দিকে যাচ্ছি দেখি আব্বা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি এমনভাব করলাম যেন হাঁটতে গিয়ে পা পিছলে ঝিলে পড়ে গেছিলাম।
- কিন্তু গুলি তো খেলেন না।
- খেলে কি আর এই ইন্টারভিউ দিতে পারতাম? অভ্যুত্থানের প্রায় শেষের দিকের দিন ছিল তখন। জলপাইরাও মানুষ মেরে ক্লান্ত হয়ে গেছিল। ওই জলপাইটা বন্দুক তুলেছিল অথচ গুলি কেন তুলেছিল জানি না। তবে আমার বড়ভাই ছিড়া গুলি না কিসব বলে ওগুলো খেয়েছিল। তার পিঠ মোটামুটি ঝাঝড়া হয়ে গেছিল। আরো একটা ঘটনা ঘটেছিল নব্বইয়ের অভ্যুত্থানের সময়।
- কি সেটা?
- তখন পাড়ার ভিডিও দোকানগুলোতে ভিডিও গেমস খেলার চল ছিল। এরকম কারফিউর সময় আমি এক বন্ধুর সঙ্গে দোকানে গেম খেলছিলাম। রব উঠল, আর্মি আইতাছে। সাথে সাথে শাটার ফেলা দেয়া হলো দোকানের। কিন্তু আর্মি ঠিকই বুঝে ফেলল দোকানটা খোলা ছিল। বাইরে থেকে শাটার তোলার আওয়াজ আসতেই আমি ডেস্কের তলে লুকিয়ে পড়ি। আর্মি সবাইকে বের করে নিল। আমার ভাগ্য ভালো ডেস্কের তলে চেক করেনি। আমার বন্ধুকেও বের করে নিল। তারপর তারা দোকানের তালা মেরে দিল। আমরা ভিতরে বসে শুনতে পাচ্ছি আর্মিদের হুংকার আর বাকি সবার আর্তচিৎকার। আমার কলিজা হিম হয়ে গেল। শালা ছুটির ঘন্টা আমার জীবনে ঘটে গেল? এভাবে ঘন্টা তিনেক কাটল। তারপর হঠাৎ বাইরে থেকে আমার বন্ধুর গলার আওয়াজ শুনি। আর্মিরা তাকে বের করতেই সে দৌড়ে পালিয়ে গিয়েছিল। পরে এই বন্ধুই ভিডিও দোকানের মালিকের কাছ থেকে ডুপ্লিকেট চাবি নিয়ে এসে আমাকে মুক্ত করেছিল।
- তারপর?
- এইতো। প্রিটেস্টে এক সাবজেক্টে ফেল করলাম। ভাবলাম পড়াশোনা সিরিয়াসলি করতে হবে। সেইসময়ে বাবা সরকারি কোয়ার্টার পেলেন আজিমপুরে। ই টাইপ-অনেক বড় বাসা। ৩/৪ টা রুম, বারান্দা। আম্মা খুব খুশি হলেও আমরা হলাম না। আজিমপুর যেতে ইচ্ছে হলো না। বাবার সরলতার কারণে ও সরকারি দীর্ঘসূত্রিতার কারণে একসময় খবর পেলাম ওই বাসা আব্বারই আরেক কলিগ নিজের নামে এলোকেশন করে নিয়েছেন। আব্বার যেন একটু আত্মসম্মানে লাগল। আমার অতিশান্ত আব্বাজান একটু খেপে গেলেন। বিভিন্ন সরকারি পর্যায়ে লেখালেখি করে কোয়ার্টার আদায় করলেন। কিন্তু আজিমপুরে নয়, মতিঝিলে। বড় বাসা নয়, এফ টাইপের ২ রুমের বাসা। আমরা সেই বাসায় উঠে গেলাম। আম্মার জন্যও সুবিধা হলো। কেননা আম্মা তখন রাজনীতি শুরু করেছেন। মতিঝিল থেকে সবুজবাগ যেতে তার কষ্ট তেমন হবে না।
- আপনার আম্মা রাজনীতি করতেন?
- আওয়ামী লীগের রাজনীতি করতেন সবুজবাগ এলাকায়। বর্তমানে মতিঝিল থানা মহিলা আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি। সেইসময় আম্মার রাজনৈতিক বক্তব্যগুলো আমি লিখে দিতাম। এতোক্ষণ তো আমার ছেলেবেলার অনেক কথাই শুনলেন। প্রায়ই আম্মার প্রসঙ্গ এসেছে। আমি আম্মা সম্পর্কে আরো একটু বলতে চাই।
- অবশ্যই। আপনি বলুন।
- আমার আম্মা ছিলেন নানার ছোটমেয়ে। খুবই দস্যি ছিলেন তিনি। হিন্দুবাড়ির মন্দির থেকে আম, কলা চুরি করা থেকে শুরু করে গাছগাছালির নামকরণ সবই করতেন তিনি। আমার বড়খালা বিয়ের পর থেকে ঢাকায় থাকতেন। সেই খালার কাছে আম্মা বিয়ের পূর্বে মাঝে মাঝে এসে থাকতেন। তখন থেকেই তার স্বপ্ন ছিল তিনিও বিয়ের পর ঢাকায় এসে সেটল হবেন। আম্মার যখন বিয়ে হলো তখন বেশ কিছুদিন দাদাবাড়িতে ছিলেন। আব্বা ঢাকায় চাকরি করতেন, ছুটিছাটায় গ্রামে যেতেন। তখন আম্মা বারবার আব্বাকে তাগাদা দিতেন ঢাকায় নিয়ে যাবার জন্য। অবশেষে বিয়ের কিছুদিন পরেই আব্বা আম্মাকে ঢাকায় নিয়ে এলেন। তখন দাদাবাড়ির অনেকেই ফোড়ন কেটেছিল, হিতি ঢাহায় কিল্লাই যাইত, আন্ডা বেক বুঝি। বাইস্কোপ চাইত আর ঘুরি বেড়াইত আরি। আন্ডা হোলাহাইন কি গ্রামে থাই মানুষ অয় ন? সবকিছুকে তুচ্ছজ্ঞান আম্মা ঢাকায় এলেন। আমার মনে আছে, ছোট দুই শিশুকে কোলে নিয়ে তিনি স্কুলে যেতেন। আমি একেবারেই হাঁটতে চাইতাম না। বারবার বলতাম, আম্মা রিক্সায় চড়ব। তখন আমাদের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না। আম্মা বলতেন, রিক্সা কেন? বাবা তুমি গাড়িতে চড়। এরচেয়ে দামি গাড়ি আর নেই। বলেই মা আমাকে কোলে নিয়ে নিতেন। বড়ভাই মাঝে মাঝে ঘ্যান ঘ্যান করত। মা তখন দুইজনকে কোলে নিতেন। রাস্তা দিয়ে একজন মহিলা দুইশিশুকে কোলে নিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন, হয়তো পথচারীরা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকত। গোপীবাগ এলাকায় প্রায়ই মারামারি হতো। স্কুল ছুটি হয়েছে, পথিমধ্যে মারামারি শুরু হয়ে গেল, আম্মা আমাদের কোলে নিয়ে দৌড়ে বাসায় ফিরতেন। হয়তো তখন শাড়িতে পা জড়িয়ে গেছে, হোঁচটও খেয়েছেন অনেক, কিন্তু আমরা টের পেতাম না। আব্বা ছিলেন উন্নাসিক, সম্পূর্ণ অবৈষয়িক একজন মানুষ। মাঝে একবার আমাদের তিনমাসের জন্য গ্রামে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। আম্মা সেখানে থেকে আবার ঢাকায় ফিরে আসেন। তার প্রচন্ড ইচ্ছা ছিল আমাদের ঢাকায় মানুষ করবে, ভালো স্কুলে পড়াবে। আম্মা তিলতিল করে পয়সা জমিয়ে আমাদের সংসারে সুখ এনেছেন। আমাদের প্রয়োজনে যেরকম শাসন করেছেন, মেরেছেন তেমনি আদর সোহাগও করেছেন। আমার আম্মা হলেন পৃথিবীর সেরা রাঁধুনি। তিনি পারেন না এমন কিছুই নেই। কি সেটা মিষ্টি, দই অথবা ঝাল অন্য কিছু। আতিথেয়তায় কখনো তার কার্পণ্য দেখিনি। আজকে বড়াই করার মতো অনেক উপাদান হাতের কাছে আছে, সবকিছুই আম্মার কারণে। ছোটবেলায় যতোই দুষ্টুমি করি না কেন কখনোই আম্মাকে জানাতে চাইনি। আমার স্বর্ণালী ছোটবেলা পুরোটাই তার হাতে তৈরি। লজ্জা পেতাম বলে আম্মাকে বলতাম, তুমি আমাদের সঙ্গে আর স্কুলে যাবা না। আমরা তো বড় হয়ে গেছি। সেই মা এসএসসি পরীক্ষার সময় আমাদের নিজে পরীক্ষাকেন্দ্রে দিয়ে এসেছেন। আমরা তখন না করতে পারিনি। দাদাবাড়িতে গেলে সবাই বলত মাস্টরের ছেলে। আর নানাবাড়িতে গেলে আমরা হয়ে যেতাম নাসিমের ছেলে। ওইটাই তখন বড় পরিচয় হয়ে যেত আমাদের। একরুমের সাবলেট থেকে তিনি তার সংসার শুরু করেছেন। মনে আছে, আইসক্রিম খাবার বায়না করতাম ঘনঘন। আম্মা কিস্তিতে ফ্রিজ কিনে ফেললেন। আমাদের আইসক্রিম বানিয়ে খাওয়াতেন। ফেনী অঞ্চলের লোকজন মধ্যপ্রাচ্যে জীবিকার উদ্দেশ্যে যাওয়া আসা বেশি করেন। আম্মা নাক সিঁটকে বলতেন, ধুর। আমার ছেলেরা লন্ডন আমেরিকা যাইব। এই লন্ডনে বসেই যখন আমার ছেলেবেলা লিখছি তখন শুধু আম্মার কথাই মনে পড়ছে। আম্মা আমাকে ভালো বুঝতেন। আমার যাবতীয় সৃষ্টিশীল কাজে তিনিই প্রথম উৎসাহ দিয়েছেন। কঠিন শাসন আর কোমল সোহাগে তিনি গড়ে দিয়েছেন আমার স্বর্ণালী ছেলেবেলা ... স্যরি, আমি বেশি আবেগী হয়ে গেলাম হঠাৎ করে।
- না না ঠিক আছে। আপনি বলতে থাকুন।
- আর কিছু বলার নেই। আমার মনে হয় আমার ছেলেবেলার কথা বলা শেষ। এসএসসি পাশ করার পরপরই ছেলেবেলা শেষ হয়ে বলেই আমার ধারণা। আমি স্টারমার্ক আর ভাইয়া প্রথম শ্রেণীতে এসএসসি পাস করি। আমরা দুইভাইয়ের একসঙ্গে পড়াশোনাও সেখানে শেষ হয়ে যায়। দুইজনে ভিন্নভিন্ন কলেজে ভর্তি হই। ঘর ছেড়ে বাহিরপানে টান বেড়ে যায় বেশি। ছোটবেলার চেয়ে আমি আরো দুরন্ত হয়ে উঠি এসএসসি পাশ করার পর।
- কি বলছেন। এতোক্ষন ছেলেবেলা শুনে তো মনে হলো আপনি তখনও কম দুরন্ত ছিলেন না।
- সেটা মনে হতে পারে। কিন্তু আমি দুষ্টুমি করলেও ক্লাস টেন পর্যন্ত অতো বেয়াড়া ছিলাম না। আমি বাসায় আম্মাকে সাহায্য করতাম। আপনি অবাক হবেন আম্মার কাছ থেকে দেখে দেখে আমি বাটিক কিংবা টাইডাইয়ের কাজ পারতাম। আম্মা কেটে রাখলে সেলাই মেশিনে আমি ব্লাউজও সেলাই করতে পারতাম। বাসায় মেহমান এলে আমি চা বানিয়ে খাওয়াতাম। সেই আমি লন্ডনে আড়াই বছর ধরে আছি, অথচ এখনো রাঁধতে পারি না। আমি ছোটবেলায় গোছানোই ছিলাম বেশ। তবে দুষ্টুমি যা যা করতাম সেটা কেউ বুঝতে পারত না। বলতে পারেন মিচকা শয়তান ছিলাম। খালাতো ভাই কল্যাণ মিলে খুব দুষ্টুমি করতাম। গোড়ানে জাকের পার্টির মাহফিল থেকে স্যান্ডেল চুরি করা অথবা ঈদের দিন শিশুপার্কে ছেড়া টিকেট দিয়ে রাইড চড়া এসব ফাজলামো করতাম। এইতো ...
- না না। এতো তাড়াতাড়ি শেষ করলে তো হবে না।
- শেষ তো করতেই হবে। আচ্ছা তবে দুটো ঘটনা বলে নিই। ঘটনাগুলো করুণ কিংবা মজার কিংবা ভয়াবহ কিংবা গুরুতর। প্রথমটা হলো, আমি একবার ম্যানহোলে পড়ে গিয়েছিলাম।
- হা হা হা। তাই নাকি? খুলে বলুন।
- আমার খেয়াল নেই। হয়তো এসএসসির আগে আগেই ঘটনাটা ঘটেছিল। আমি ও বন্ধু পারেক হেঁটে যাচ্ছি। তখন প্রায় ম্যানহোলের ঢাকনা চুরি হয়ে যেত। হাঁটতে হাঁটতে আমি সেটা খেয়াল করেছিলাম। ম্যানহোলের কাছাকাছি আসতেই আমি সেটা টপকে যেতে একটা ছোট লাফ দেই। কিন্তু মাপে ভুল হয়ে যাওয়ায় আমার এক পা ম্যানহোলে ঢুকে যেতেই আমি ব্যালেন্স করার চেষ্টা করি। কিন্তু সামলাতে না পেরে আমার দুইপা ম্যানহোলের ভিতর চলে যায়। আমি সঙ্গে সঙ্গে দুইহাত দুইদিকে ছড়িয়ে নিজেকে ঠেকাই। পরে বন্ধু পারেক আমাকে উঠায়। হোসপাইপ দিয়ে পানি ছিটিয়ে আমার শরীর থেকে সমস্ত বিষ্ঠা সরানো হয়। আমি সেদিন দুইটা লাক্স সাবান গায়ে ঘষে শেষ করেছিলাম।
- স্যরি, আমি ঘটনা শুনে বেশ মজাই পেলাম। তার মানে, পরের ঘটনাটা নিশ্চয়ই ভয়াবহ।
- বলা যেতে পারে।
- কি সেটা?
- আমি একবার গণপিটুনী খেয়েছিলাম।
- মাইগড। বলেন কি? কারো পকেট মেরেছিলেন নাকি?
- না, সেই মারামারি।
- খুলে বলুন তাড়াতাড়ি।
- তখন কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি। কলোনিতে থাকি। সেসময় সিনিয়রিটি জুনিয়রিটি নিয়ে গ্রুপে গ্রুপে মারামারি হতো। বন্ধুবান্ধবের কেউ কেউ তখন সো-কলড রংবাজ কিংবা মাস্তান। আমি এসবের ধারেকাছেও ছিলাম না। তারপরও পাকে জড়িয়ে যাই। সবুজবাগের একটা জুনিয়র ছেলে বেয়াদবি করেছে, জাস্ট মুখে একটু সাবধান করে দেয়া হবে। যেহেতু ওই ছেলের সঙ্গে আমার ভালো সম্পর্ক, তাই তার বাসা থেকে আমাকে ডেকে দিতে হবে। আমি সেই কাজটা করে দিই। কিন্তু সেদিন বোঝানোর সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটাকে একটু রগড়ে দেয়াও হয়। ঘটনার কয়েকদিন পর আমি সবুজবাগে গেলে ওই ছেলের কয়েকজন বন্ধু আমাকে ঘেরাও করে। ওই ছেলেকে মারার কারণ জানতে চাই। ছেলেগুলো জুনিয়র হয়ে আমাকে চার্জ করছে বলে আমার মেজাজ খিচড়ে যায়। আমি প্রচন্ড গালিগালাজ করি। একাই চিৎকার চেঁচামেচি করে পাড়া মাথায় তুলি। এই সবুজবাগে আমি এতোদিন থেকে গেছি, কে কি করবে আমার। ছেলেগুলো আমার তিড়িংবিড়িং দেখে চলে যায়, আমি বৌদ্ধমন্দিরে আমার বন্ধুদের কাছে যাই। ঘন্টাখানেক পরে বেরোতেই দেখি সামনে অপরিচিত পাঁচজন ছেলে। বলা নেই কওয়া নেই, ঠাস করে একটা চটকনা মেরে বলল, রংবাজি োদাও। অই তুই থাকস কই যে ছেলেটা প্রথম হিট করল আমাকে তার চেহারাটা চিনে রাখি। পাঁচজনের সঙ্গে আমার হাতাহাতি লেগে যায়। ওইদিন কমলাপুর স্কুলের এসএসসি পরীক্ষার্থীদের ফেয়ারওয়েল ছিল। আমি তাকিয়ে দেখি প্রায় ৫০/৬০ জনের একটা গ্রুপ ঢেউয়ের মতো বড় রাস্তার ঢাল বেয়ে বৌদ্ধমন্দিরের দিকে আসছে। কারো হাতে লাঠি, কারো হাতে ইট। আমি সাবধান হয়ে যাই। হাতাহাতি বন্ধ করে শরীর ঢিলা করে দেই। এবার আর আঘাত নয়, আত্মরক্ষা। আমি অন্যদের হাত-পায়ের মাইর ঠেকানোর চেষ্টা করি না। সমানে কিল-ঘুষি-লাথি-চড় খেয়ে চলছি। কিন্তু খেয়াল রাখছি কেউ আমাকে লাঠি কিংবা চেইন কিংবা ইট কিংবা অন্যকিছু দিয়ে মারে কিনা। আমি শুধু ওইগুলোই ঠেকিয়ে যাচ্ছি। শরীরের মাইর শরীর সইবে। কিন্তু অন্যকিছুর বেকায়দা আঘাত আমার জীবন শেষ করে দিতে পারে। আমার কুংফুজ্ঞান (আত্মরক্ষার কৌশল) এদিন কাজে লেগেছিল। প্রায় ১৫ মিনিট চলল এই অবস্থা। এরমধ্যে পরিচিতি সিনিয়র ভাইয়েরা এসে আমাকে ওই অবস্থা থেকে উদ্ধার করে কমলাপুর স্টেশন পর্যন্ত দিয়ে আসে। কিন্তু আমি আর সেই পাঁচজন ছেলেকে দেখিনি।
- ঘটনা তো বেশ সিরিয়াস। মুরুব্বিদের দোয়ায় আপনি তো বেঁচে ফিরেছেন।
- তা বলা যায়। পরে এই ঘটনা নিয়ে মারামারি-পাল্টা মারামারি হয়েছিল। যে ছেলেটা আমাকে প্রথম মেরেছিল তাকে আমি রেলওয়ে হাসপাতালে একদিন পেয়ে যাই। সেদিন তাকে মেরেছিলাম। ওই ছেলেদের ছোটভাইয়েরা এসএসসি পরীক্ষা দেবে। কেন্দ্র ছিল টিএন্ডটি কলেজ। ঘোষণা দেই একটারেও পরীক্ষা দিতে দিব না। পরে পাড়ার কমিশনারকে নিয়ে এসে আমাদের কাছে মাপ চেয়ে যায়।
- যাক, ভবিষ্যতে এরকম ঘটনার সম্মুখীন হবেন না আশা করি।
- তা আর বলতে। এখন আমি অনেকটাই কুল ম্যান ... হা হা হা ...
- অনেক ধন্যাবাদ অলৌকিক হাসান। আপনার মজাদার ও স্বর্ণালী ছেলেবেলা আমাদের বলার জন্য।
- আপনাকেও ধন্যবাদ। সেইসঙ্গে সচলায়তনকে ধন্যাবাদ। নিজের ছেলেবেলা বলার সুযোগ করে দেয়ার জন্য। সম্পাদক আরিফ জেবতিককে ধন্যবাদ উদ্যোগের জন্য। আর সকল ব্লগার কিংবা পাঠকদেরও শুভেচ্ছা। ভালো থাকবেন সবাই।

এটি একটি কল্পিত সাক্ষাৎকার। এবং সম্পূর্ণ লেখাটি আমার প্রিয় মা কে উৎসর্গ করা হলো।

Monday 1 October 2007

আমার 'মাস্টর' বাবা ...

- এ্যারে, হোলা ইয়া কন রে ?
- চিনেন ন? আন্ডা মাস্ঠরের হোলা।
- হাছানি? হোলা দি বড্ডা অই গ্যাছে। তো মাস্ঠর বাইত আইছে কবে?
- কাইল্ল্যা আইছে।
- ভাতিজা কি খাইবা? ছা না পান্টা?
- জ্বি না। কিছু খাব না।

ছোট আমি লজ্জায় না বলি। ফুফাতো ভাইদের সঙ্গে টুকটুক করে বাজারে ঘুরে বেড়াই। তখনও জানি না বাবাকে মাস্টার কেন বলা হয়।

একটু বড় হয়ে বাবাকে জিজ্ঞেস করে মজার তথ্য জানি। বাবা যখন মেট্রিক পাস করে তখন গ্রামের সবাই তাকে মাস্টার ডাকা শুরু করে। বাবার আগে গ্রামে আরেকজন মেট্রিকপাস করেছিল। পরে সে গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষক হিসেবে জয়েন করে। সবাই তাকে মাস্টার বলত। সে ধারাবাহিকতায় মেট্রিক পাসের পর বাবাকেও মাস্টার ডাকার চল শুরু হয়ে যায়। অথচ এই মেট্রিকপাস করতে গিয়ে বাবাকে কম ঝামেলা করতে হয়নি।

অতো বেশি ইংরেজি কেন পড়তে হবে - এই ধারণায় বাবাকে মেট্রিক পরীক্ষা দেওয়াতে উৎসাহ দেয়া হয়নি। আমার দাদা-দাদী তখন বেঁচে ছিলেন না। তাই বাবারও কারো কাছে আব্দারের জায়গা ছিল না। বাবার ফরম ফিলাপের পয়সা জোগাড় হচ্ছিল না। কিন্তু বাবার খুব ইচ্ছা ছিল মেট্রিক পরীক্ষা দিবে। সেই সময় বাবার দূরসম্পর্কের এক খালা বাবাকে একটা বুদ্ধি দিলেন। নতুন ঘর উঠানোর জন্য তখন দাদাবাড়িতে চাচারা টিন কিনে রেখেছিলেন। বাবা একরাতে সেইগুলো চুরি করে বেচে দিয়ে সোজা চট্টগ্রামের মিরসরাই চলে গেলেন। মেট্রিক পরীক্ষা দিয়ে তবেই ফিরলেন। আমার বাবার সারাজীবনে এটাই প্রথম এবং শেষ সাহসী কর্মকান্ড।

আমার বাবা বিয়েপূর্বক খুব অল্পসময়ের জন্য প্রেম করেছিলেন। মা-র সঙ্গে বিয়ে ঠিক হবার পর বড়মামাকে বাবা পড়াতেন। তখন মা-র সঙ্গে মাত্র এনগেজমেন্ট হয়েছে। সে সময়ে মা-র সঙ্গে নাকি একটু প্রেম প্রেম সময় কেটেছিল। মা আমাদের গল্প করতেন, তোর বাবা যখন ঢাকায় চলে আসবে তখন আমি একটা বড় পেয়ারা দিয়েছিলাম যেন যাত্রাপথে খায়। তোর বাবা সেটা না খেয়ে ঢাকায় নিয়ে আসে। পরে অফিসের সমস্ত কলিগদের ছোট ছোট ভাগ করে ওই পেয়ারাটা খাইয়েছিল।

বাবা হলেন চরম শান্ত স্বভাবের একটা মানুষ। মা-র হাজারো চেঁচামেচিতে কখনো রা করতেন না। অবৈষয়িক বাবা ঘুষটাও খেতে পারেন না। তার কলিগদের বাড়ি-গাড়ি হয়ে যায় অথচ তার সরকারি কোয়ার্টারের এলোকেশন ক্যানসেল হয়ে যায়। আমার মাস্টর বাবা এসবে বিরক্ত হন না।

একবার বাবা খুব রেগে গিয়েছিলেন। পরীক্ষার আগের রাতে আমি কিশোর থ্রিলার বইয়ের তলায় লুকিয়ে পড়ছিলাম। মা-র হাতে ধরা পড়ে যাই। অমনি মা-র চিৎকার চেঁচামেচিতে সারা বাড়ি মাথায় উঠল। আমার শান্ত বাবাও খেপে গেলেন। দুমদাম মার দিলেন আর পিড়ি দিয়ে টিভিটা ভেঙে ফেললেন। ওইদিন প্রচন্ড ভয় পেয়েছিলাম।

সেই শান্ত বাবাই আরো একবার ভয় পাইয়ে দিয়েছিল আমাকে। ১২ এপ্রিল ২০০৫। ওইদিন রাত ১১টায় আমার লন্ডন ফ্লাইট। জীবনে এই প্রথম বিমানে চড়ব। ঘুম থেকে সকাল ৯টার সময় উঠে বারান্দায় গিয়ে দেখি বাবা পেপার পড়ছেন। আমি আমার রুমে চলে আসি। কিছুক্ষণ পর মা এসে বলে, দেখতো তোর বাবা জানি কেমন করছে। আমি দৌড়ে যাই। বাবা তখন বুকে হাত ঘষতে ঘষতে বলছে, আরে না। আমার কিছুই হয়নি। মা সন্দেহের সুরে বলে, হার্ট এ্যাটাক না তো? আমি তড়িঘড়ি করে বাবাকে সোহরাওয়ার্দী নিয়ে যাই।

বাবাকে হাসপাতালের বারান্দায় মাটিতে শুইয়ে রাখা হয়েছে। কোনো সিট নেই। আমি দিশেহারা হয়ে যাই। আমার বাবা মাটিতে আর আমি যাব লন্ডনে। ডাক্তাররা একগাদা পরীক্ষা করতে দিয়েছে। আমি পাগলের মতো ছুটছি। লন্ডনের মায়রে বাপ। টিকেট ক্যানসেল করতে হবে। কিন্তু কেমনে? বাবা তখনও কথা বলতে পারে। কাছে ডেকে বলে, তুই চলে যাস। আমার কিছুই হয় নাই। আমি বলি, তুমি কথা বোলো না তো।

এরপর ব্যস্ত হয়ে পড়ি আমার মোবাইল ফোন নিয়ে। নানান জায়গায় ফোন করে পরবর্তী ২ ঘন্টার মধ্যে সব সিস্টেম করি। প্রচুর আত্মীয়-স্বজন আর বন্ধুবান্ধব দিয়ে হাসপাতাল ভরে ফেলি। বাবাকে সিটে তুলি। বিকেল হয়ে যায়। ডাক্তাররা বলেন, মাইল্ড স্ট্রোক হয়েছে। মাত্র ৪টা সেল কলাপস করেছে। ঠিক হয়ে যাবে। বাবার কাছে যাই। বাবা নরম স্বরে বলে, তুই লন্ডন যা। আমি ঠিক হয়ে যাব।

গত ৯ আগস্ট ২০০৭ বাবা রিটায়ার্ড করেছেন। গতবছর বাবার হার্টের অস্ত্রোপচার হয়েছে। এখন অনেকটাই সুস্থ আছে। সারাজীবন নরম বাবা এখন আরো নরম হয়ে গেছে। ঢাকায় থাকতে বাবাকে আমি জিন্স আর রঙ্গিন টি-শার্ট জোর করে পড়াতাম। ছোটভাইকে বলেছি সবসময় বাবাকে কৌতুক শুনাতে। যেন প্রতিদিনই তিনি কিছুক্ষণের জন্য হাসেন।

বাবা একবার বলেছিলেন, সরকারি স্কেলের সর্বনিম্ন স্যালারি পাওয়া লোকেরাও ঈদ করে, পোস্ট অফিসে টাকা জমায়। কতো এমএ বিএ পাস ছেলে আমার কাছে পিয়নের চাকরি করতে আসে। তোরা কেন পড়াশোনা করস না? ঠেলাগাড়ি চালাইয়া খাইতে হইব।

বাবার এখন সময় কাটে পেপার পড়ে আর ছোটভাইয়ের সঙ্গে গল্প করে। মা-কে বলেছি বাবাকে নিয়ে মাঝে মাঝে গ্রামে যেতে। মা ঝামটা মেরে উঠে, রাখ তোর গ্রাম। তোর বাবা তো প্ল্যান করছে গ্রামে বাড়ি বানাইব।

আমি হাসি। বাবার অবস্থান বুঝতে পারি। ইংরেজি পড়তে গিয়া বাবু হয়ে শহরে স্যাটেল হয়েছে। কিন্তু বাবার সবসময় গ্রামে মন পড়ে থাকে। আমি খেয়াল করেছি বাবা গ্রামে গেলে মন ভাল থাকে। আমার ইচ্ছা আছে শেষ বয়সে বাবা যেন গ্রামে বেশ সময় কাটাতে পারে তার জন্য একটা ছোট বাংলো টাইপের বাড়ি করব। দেখি কতোদূর কি করা যায় ....