Wednesday 28 November 2007

Pls Help SIDR Victims

জনমত জরিপ @ রংপুরের পথে পথে : ০২

জীবনের প্রথম ছিল বলে প্রথমদিন বেশ কষ্ট হয়েছিল জরিপ করতে। এছাড়াও ছিল আগের রাতের জার্নির ক্লান্তি। কিন্তু একরাত ভালো করে ঘুমিয়ে এবং হালকা অভিজ্ঞতা হয়ে যাওয়ায় দ্বিতীয়দিনের কাজে তেমন কষ্ট হয়নি।

যথারীতি ঘুম থেকে উঠে আমি আর নীলু বেরিয়ে পড়লাম নতুন আরেকটা গ্রামের উদ্দেশ্যে সেই পুরোনো রিকশাওয়ালাকে নিয়ে। পনির ভাইয়ের পেটের অবস্থা আজকে বেশ ভালো। সে মীরাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। আমরা প্রায় দেড়ঘন্টা পরে গ্রামে গিয়ে পৌঁছলাম। এই দেড়ঘন্টা নীলুর সঙ্গে গল্প করে কাটল। আজকে নীলু পড়েছে ঘিয়েশাদা সালোয়ার কামিজ। সুন্দর লাগছিল তাকে।

গ্রামে পৌঁছেই আমরা আগের মতোই রিকশা ছেড়ে দিলাম। প্রথমদিন আমি বা নীলু যেই ইন্টারভিউ করেছি, আরেকজন সেটা শেষ হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতাম। আজকে ঠিক করলাম এভাবে না করে আমরা দুজনেই আলাদা আলাদা করে গ্রামে ঘুরব। এতে একই সময়ে দুইটা ইন্টারভিউ শেষ করা যাবে। ঠিক করা হলো নীলু বেশি বেশি করে মহিলাদের ইন্টারভিউ নিবে, ফাঁকে ফাঁকে পুরুষদের। দুজনে দুদিকে ছিটকে গেলাম।

পদ্ধতিটা বেশ কাজে দিল। খুব দ্রুত ইন্টারভিউ নিতে পারছি। বেশ পটু হয়ে গেছি। প্রথমদিন প্রশ্ন করে নির্লিপ্তগলায় উত্তরগুলো বলে অপেক্ষা করতাম। কিন্তু আজকে গল্পচ্ছলে প্রশ্ন করা এবং উত্তর আদায় করতে থাকলাম। এতে দেখা গেল লোকজন আন্তরিকতার সঙ্গে অংশ নিতে পারছে। কিন্তু একটা বিপদও হলো তাতে। এই গল্পচ্ছলে ইন্টারভিউ তো নেয়া যাচ্ছে, কিন্তু তা শেষ করে উঠতে চাইলে আবার বসিয়ে দিয়ে শুরু করে দেয় রাজনৈতিক কেচ্ছাকাহিনী। উঠিউঠি করলে চা-সিগারেট সাধে। সমস্যা এই পর্যন্ত হলেই হতো। কিন্তু গল্পের একপর্যায়ে আমারও মতামত জানতে চায়। তখন খুব কায়দা করে পাশ কাটাতে হয়।

এবার একটা ভয়ের ঘটনা বলি। ভয়ের ঘটনা কারণ আমি ভয় পেয়েছিলাম। গ্রামে কিছু টাউট টাইপের লোক থাকে। এদের কাজই ঝামেলা পাকানো। তো ওইদিন একটা বাড়ির পাশে গাছতলায় দাঁড়িয়ে এক কৃষকের ইন্টারভিউ নিচ্ছিলাম, হঠাৎই একটা লোক এসে আমার হাত থেকে ফাইলসহ সব কাগজ কেড়ে নিল। আমার হাত থেকে কলম পড়ে গেল। লোকটি ধমক দিয়ে বলল, এ্যাই আপনাদের কে পাঠিয়েছে?

আমি হতচকিত হয়ে গেলাম। আশেপাশে দুয়েকজন লোক দেখা যাচ্ছে। সবাই কি আমাকে মার দেবে বলে একাট্টা হয়েছে? আমি লোকটির দিকে তাকালাম। তেল চপচপে চুলে কায়দা করা সিঁথি করা হয়েছে। কিন্তু পরণের স্যান্ডো গেঞ্জিতে ছেড়া রয়ে গেছে। চেক লুঙ্গি পরা, পায়ে স্যান্ডেল। লোকটির সঙ্গে আমর কথোপকথন ছিল নিম্নরূপ,

- এ্যাই, আপনাদের কে পাঠিয়েছে?
- আমরা ঢাকা থেকে অমুক সংগঠনের পক্ষ থেকে এসেছি।
- কি কাম করতাছেন?
- এই যে সামনে নির্বাচন। এইটা নিয়া আপনাদের চিন্তাভাবনা কি সেটা জানার জন্য। পরে এটা আমরা পত্রিকায় প্রকাশ করব।
- আমারে বুঝ দেন, না? এইটা করতাছেন এরশাদরে জেলে আটকাইয়া রাখার জন্য।
- না না। কি যে বলেন আপনি।

আশেপাশের লোকজন আমাকে ততোক্ষণে সাপোর্ট করা শুরু করছে। দুয়েকজন ওই টাউট লোকটাকে ধমকও দিল আমার সঙ্গে এরকম ব্যবহার করার জন্য। সেসব দেখে একটু সাহস পেলাম। কিন্তু লোকটি তখন বলছে,

- আরে তোমরা বুঝো না। এরা আইছে এরশাদের বিরুদ্ধে রিপোর্ট দেয়ার লাইগা। ঘুইরা ঘুইরা সব জাইন্যা লইতাছে। এরশাদরে আরো জেল দিব।

লোকটার এইসব কথা আশেপাশের কারোরই বিশ্বাস হলো না। ওদের চাপাচাপিতে সে কাগজপত্র, ফাইল আমাকে ফেরত দিল। তারপর জিজ্ঞেস করল,

- আপনের লগের ওই মাইয়াডা কি আপনার বউ?
- জ্বি না। আমার বোন।
- ও আইচ্ছা। এর লাইগ্যাই চেহারায় এতো মিল।
- জ্বি।
- দেইখেন উল্টাপাল্টা কিছু কইরেন না।


লোকটা চলে গেলে সেযাত্রায় মুক্তি পেলাম। তবে আমি কিন্তু প্রথমে ভড়কে গিয়েছিলাম। অবশ্য ভবিষ্যতে এরচেয়েও খারাপ অবস্থায় পড়েছি। সেটা আরেক পোস্টে আলাপ করা যাবে।

প্রশ্নপত্রে একটা প্রশ্ন ছিল এরকম যে, আগামীকাল ভোট হলে আপনি কাকে ভোট দেবেন? এই প্রশ্ন শুনে উত্তরদাতা আমতা আমতা করত। কিন্তু প্রশ্নের উত্তর তো আমার চাই। বিশেষ করে এ প্রশ্নটায় অনেক বোঝাতে হতো। অনেক সময় উত্তরদাতার অন্যান্য উত্তর যাচাই করে একটা উত্তর ধরে নিয়ে সেটা নিশ্চিত হওয়ার জন্য আরো কিছু প্রশ্ন করে সিওর হতে হতো। কিন্তু কোনোভাবেই গলার স্বরে কোন দলের পক্ষে বিষয়টি চলে যায় কিনা সেটা খেয়াল রাখতে হতো। পরে অবশ্য খুব ভালো করেই এ প্রশ্নটার উত্তর আদায় করতে পারতাম। খেয়াল করেছি খুবই ক্যাজুয়ালি প্রশ্নটা করে ফেললে উত্তরদাতা আরো ক্যাজুয়ালি উত্তর দিয়ে দিতেন। অনেকে বলতেন, কিভাবে বলব ভাই, ভোটের আগের দিনও তো মাইন্ড চেঞ্জ হইতে পারে। সেক্ষেত্রে তাদের বলা হতো, আপনি আপনার মাইন্ড চেঞ্জ করবেন কিনা সেজন্য আপনাকে আরো ১০ মিনিট সময় দিলাম। এখন বলুন। তখন উত্তরদাতা কিছুক্ষণ চিন্তা করেই বলে দিতেন। ১০ মিনিট সময়ও নিতেন না। এরকম বিভিন্ন তরিকায় উত্তরটা জেনে নিতাম। তবে এইটার একটা বিপদও ছিল। ধরেন অনেকের মাঝে একজন উত্তর দিচ্ছেন। দেখা গেল আশেপাশে বিএনপির লোকজন বেশি থাকায় উত্তরদাতা বিএনপির নাম বলল। পরে অনেকক্ষণ পর আমাকে আরেক জায়গায় পেয়ে বলল, ভাই ওইসময় বিএনপি বলছি। আমি কিন্তু আসলে আওয়ামী লীগরে ভোট দিমু। আমরা শুধুমাত্র উত্তরদাতার নাম জানতে চাইতাম, ঠিকানা নিতাম না। তখন নাম খুঁজে শিট বের করে ঠিক করে নিতাম।

কিছু কিছু ইন্টারভিউ নেয়ার পর আমরা বাসায় গিয়ে সেগুলো ছিঁড়ে ফেলে দিতাম। কেউ কেউ ফাজলামো করার জন্য একেকটা প্রশ্নের জন্য আলতু ফালতু উত্তর সিলেক্ট করতেন। যেমন, তিনি বিএনপি সাপোর্ট করেন, পছন্দ করেন আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে কিন্তু আগামীকাল ভোট হলে জামাতকে ভোট দেবেন। এছাড়াও আলাদাভাবে কিছু লেখার জায়গা থাকলে সেখানে আজে বাজে কমেন্ট করত। আমরা সেসব প্রশ্নপত্রে খুব কৌশলে একটা চিহ্ন দিয়ে রাখতাম যেন পরে ফেলে দেয়ার জন্য সহজেই খুঁজে পাই।

তারপরও এসব ঝামেলার মাঝে বেশ জরিপ করে যাচ্ছি। গ্রামের বিশুদ্ধ বাতাসে হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে গেলে কোনো গাছের ছায়া কিংবা বাড়ির দাওয়ায় বসে জিরিয়ে নিতাম। বাংলা ফাইভের ধোঁয়া উড়িয়ে লোকজনের সঙ্গে গল্প করতাম। তখন আর জরিপ প্রসঙ্গ থাকত না, তাদের জীবনের গল্প শুনতাম। নীলু আলাদাভাবে ইন্টারভিউ করছে, মাঝে মাঝে তার সঙ্গে দেখা হতো। যে বাড়ির দাওয়ায় বসে সিগারেট খাচ্ছি, দেখা গেল ইন্টারভিউ শেষ করে ওই বাড়ি থেকে নীলু বেরিয়ে আসছে।

এবার একটা হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া ঘটনা বলি। দুপুরে আমি আর নীলু আবার একত্র হয়েছি। এক বাড়িতে নীলু তখন সবেমাত্র ইন্টারভিউ শেষ করেছে। আমরা আরেকদিকে যাব তখন গৃহকর্তা দুপুরের খাবারের কথা বলল। আমাদের তখন খাওয়ার ইচ্ছা বা সময় কোনোটাই ছিল না বলে লোকটাকে নিরুৎসাহিত করার চেষ্টা করি। কিন্তু লোকটি না শুনতে চাইছে না। তাই এড়িয়ে যাওয়ার জন্য বললাম, আচ্ছা যদি সময় পাই তাহলে খেতে আসব। মনে মনে কিন্তু সিদ্ধান্ত নিলাম আসব না।

কাজ করতে করতে কখন যে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেছে টের পাইনি। এইদিন কাজ খুব তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেল। আমরা ফিরছি রিকশা নিয়ে (রিকশা যথারীতি আগেরদিনের মতো ব্যবস্থাপনায় ছিল), ওই লোকটি আমাদের থামাল। বলল, আপনেরা খাইতে আইলেন না যে। আমি তো মুরগী রান্না করছি। আমরাও কেউ খাই নাই।

এই কথা শুনে কেউ খেতে না গিয়ে পারে? আমরাও লজ্জিত ভঙ্গিতে, ভুলে গিয়েছিলাম ভাব নিয়ে খেতে চললাম। খাওয়া দাওয়া শেষ করে নীলু আর আমি দুজনেই কুণ্ঠিত ছিলাম। বেচারা এমনিতেই গরিব। মুরগী হয়তো ওই একটাই ছিল। মেহমান খাওয়ানোর নামে দিছে জবাই কইরা। আহারে, এমন আতিথেয়তা বাংলাদেশ ছাড়া আর কোথায় মিলে?

শহুরে সভ্য আমরা দুইজন খাওয়া দাওয়া শেষ করে লোকটির হাতে বেশকিছু টাকা জোর করে গছিয়ে দিলাম। যদি পারে তবে আরেকটি ডিমপাড়া মুরগী কিনে নিক। এই ঘটনাটা আমাকে খুব তোলপাড় করেছে। 'বাংলাদেশ আতিথেয়তায় সেরা' কথাটির ব্যবহারিক প্রমাণে আমি মুগ্ধ হয়ে যাই। এই আতিথেয়তা আরো অনেক জায়গাতেই পেয়েছি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অবশ্য বাড়াবাড়ির পর্যায়েও চলে যেত।

কাজ শেষ করে আমি আর নীলু ফিরছি। সাথে ক্যামেরা ছিল না আমাদের কারোরই। তাই একটা অসম্ভব সুন্দর দৃশ্য আমি ধরে রাখতে পারিনি। কিন্তু মনের ক্যামেরায় (অবশ্য সেটা ভিডিও) আজীবন থাকবে। দৃশ্যটি হলো, একটা ধানক্ষেতের আইলে একটা গাছ, সেথায় এক বৃদ্ধ খালি গায়ে বিশ্রাম নিচ্ছে, গামছা নাড়িয়ে বাতাস করছে নিজেকে। আর পাশেই একটা বাছুর জিভ দিয়ে তার পিঠ চেটে দিচ্ছে। ওয়াও, আমরা রিকশাটা থামিয়ে দেখতে থাকি। প্রায় ৩/৪ মিনিট পর বাছুরটি কৃষকের পিঠ চাটা বন্ধ করে। মুগ্ধ হয়ে আমরা দৃশ্যটি দেখলাম।

সেদিনই আমরা ৪ জন গাইবান্ধার ধাপ এলাকায় চলে যাই। এখানেও পনির আর মীরা তাদের আরেক সহপাঠিনীর বাসা খুঁজে বের করে। ধাপ এলাকাটা আমার ভালোই লাগল। একটা রাস্তা আছে যার দুপাশে সারি সারি ফার্মেসীর দোকান। আমরা ওই রাস্তারই আশেপাশের কোনো একটা বাড়িতে ছিলাম। ধাপ থেকে একটা 'সাপ্তাহিক চলতিপত্র' (তখন মাত্র বেরিয়েছে) আর নীলুর জন্য 'অহরহ' (বিজ্ঞান পত্রিকা, এখন আছে কিনা জানি না) কিনলাম। ধাপের বাড়িটা খুব সুন্দর ছিল। মফস্বলের ছোট ছিমছাম দোতলা বাড়ি। সামনে খেলার মাঠ। আমরা বাড়িটার ছাদে আড্ডা মারলাম। নীলুর সঙ্গে সখ্যতা আরো গড়ে উঠল। এখন আমি তার হাতও ধরতে পারি। সে বাড়িতে রাতের খাবারটাও খুব ভালো হলো।

পনির ভাইয়ের কিসব থিসিস নাকি জমা দিতে হবে। তাই পরদিনই রাতের ঢাকার টিকেট কেটে ফেললাম। টিকেট পাওয়া যাচ্ছিল না এতো অল্প সময়ে। তখন দুইটা বাস রংপুর লাইনে ভালো ছিল। একটা হলো কিষাণ (যেটায় এসেছিলাম), আরেকটা আগমনী। আমরা আগমনী বাসের শেষ চারটা সিট পেলাম। ঠিক হলো পরদিন রংপুর শহরের কিছু জায়গা ঘুরে বাসে উঠে পড়ব।

তখনও বুঝতে পারিনি আগমনী বাসের এই জার্নিটা আমার জন্য কিসের আগমনী বার্তা নিয়ে আসছে।

Tuesday 27 November 2007

জনমত জরিপ @ রংপুরের পথে পথে : ০১

আমাদের যাবার কথা ছিল পীরগঞ্জ। সংসদীয় আসনে এটি রংপুর-৬। যতোদূর মনে পড়ে এরশাদের নির্বাচনী এলাকা। অংপুরের ছাওয়াল তো এমনি এমনিই পাস করবে অথচ এই আসনটি কিভাবে মার্জিনাল হলো আমি বুঝতে পারি না।

বাসস্ট্যান্ডে নেমে প্রথমেই নাস্তা করে নিলাম। সারারাত বাসজার্নির পর সকালের নাস্তাটা ভালোই লাগে। মাংস, ভাজি আর ডিম সহযোগে পরোটা খেয়ে ফেললাম গোটা চারেক। তারপর চা-সিগারেট খেয়ে পনির ভাইকে বললাম, চলেন হোটেল ঠিক করি। পনির ভাই আশ্চর্য হয়ে বলল, কিসের হোটেল? যাব তো পীরগঞ্জে। রংপুরে হোটেলে থেকে প্রতিদিন আসাযাওয়া করতে পারব না। পীরগঞ্জ এখান থেকে অনেক দূর।

খোঁজখবর নিয়ে একটা লোকাল বাসে উঠে পড়লাম। সম্ভবত ৩০ মিনিট পরেই পীরগঞ্জ পৌঁছে গেলাম। পনির আর মীরা পীরগঞ্জেই খুঁজে পেতে বের করে ফেলল তাদের জাহাঙ্গীরনগরের এক সহপাঠীর বাসা। বাসায় সামনে যেতেই এক ভদ্রলোক সম্ভাষণ জানিয়ে ভেতরে নিয়ে গেলেন, থাকার জায়গা দেখালেন। আমি খুবই অবাক হলাম। পরে জানতে পেরেছিলাম যে, পনির ভাই আগেই জানতেন তিনি পীরগঞ্জ আসবেন আর তাই সহপাঠীকে বলে তাদের বাসায় থাকার ব্যবস্থা করে রেখেছেন। আমিও খুশি হলাম। অনেকগুলো টাকা বেঁচে যাবে।

যে কোনো আসনে যাওয়ার আগে ওই আসনের ইউনিয়নগুলো সম্পর্কে খোঁজখবর নেয়া হতো। ভোটের ব্যবধান সবচেয়ে কম হয়েছে যেসব ইউনিয়নে সেগুলোর কয়েকটা গ্রামে জরিপ করতে হবে। আমাদের মোট প্রশ্নপত্র ছিল ৪০০টি। অর্থাৎ প্রত্যেকর ভাগে ১০০টি করে। প্রথমদিনের জন্য আমরা প্রত্যেকেই ৫০টি করে প্রশ্নপত্র (কিছু এক্সট্রা) নিয়ে বের হলাম। পনির ভাই আর মীরা এক গ্রুপে এবং আমি আর নীলু আরেক গ্রুপে। পনির ভাইয়ের হাতে ৩০০ টাকা দিলাম সারাদিনের খরচের জন্য। দুইটা রিকশা আগেই ঠিক করা ছিল। আমি আর নীলু বেরিয়ে পড়লাম। রিকশায় যেতে যেতে নীলুর সঙ্গে গল্প শুরু হলো। আমার চেয়ে এক ব্যাচ সিনিয়র এবং জাবির ভূতত্ত্ব বিষয়ে পড়ছে। থাকে ফজিলাতুন্নেসা (২ নং) হলে। নীলু মোটা পাওয়ারের চশমা পড়ত। একটু খাটো ছিল সে।

নীলুও এই প্রথম সার্ভে করছে। সবচেয়ে অবাক করা যে বিষয়টি হলো বাসে উঠার আধাঘন্টা আগে নাকি পনির ভাই নীলুকে বলেছে, চল রংপুর ঘুরে আসি। অমনি নীলু রাজি হয়ে গেছে। দৌড়ে হল থেকে ছোট ব্যাগে কিছু কাপড়চোপড় নিয়ে বাসে উঠে পড়ে। এই ঘটনা শোনার পর নীলুকে একটু পাগলা কিসিমের মনে হলো। এভাবে হুট করে কেউ বেরিয়ে পড়ে নাকি! যাই হোক, আস্তে আস্তে নীলুর সঙ্গে জমে গেল। প্রথমে আপনি আপনি করলেও পরে তুমিতে নেলে এলো সম্বোধন।

সদর এলাকায় কিছু জরিপ শেষ করে আমরা গ্রামের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। রিকশা চলছে তো চলছেই অথচ গ্রাম পাচ্ছি না। রিকশাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করতেই বলে, এইতো আর একটু দূরে। প্রায় একঘন্টা পর বিরক্ত হয়ে বললাম, ভাই সত্যি করে বলেন তো আর কতোক্ষণ লাগবে?

রিকশা তখন একটা বিশাল ধানক্ষেতের (ধান ছিল না তখন) পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। রিকশাওয়ালা দূরে আঙ্গুল দেখিয়ে বলল, ওই যে। দেখলাম অঙ্গুলি নির্দেশিত দিকে অনেকগুলো বাড়িঘর দেখা যাচ্ছে। আমি রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখি রাস্তাটা অনেক দূরে গিয়ে গ্রামের সঙ্গে মিশেছে। রিকশায় চড়ে রাস্তা ধরে গেলে নির্ঘাত আরো আধাঘন্টা লাগবে। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম ধানক্ষেতের মাঝখানে দিয়ে হেঁটে গ্রামে যাব। অর্থাৎ বিষমবাহু ত্রিভুজের ছোট বাহু ধরে গ্রামে পৌঁছাব। নীলুকে বলতেই সেও রাজি হয়ে গেল। রিকশাওয়ালাকে বললাম, আপনার রিকশায় আর চড়ব না। আমরা ওই গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে হেঁটেই যাব। আপনি শুধু আমাদের খুঁজে নেবেন। না পেলে গ্রামের লোকজনদের জিজ্ঞেস করবেন।

নীলু আর আমি ক্ষেতের মাঝখান দিয়ে হাঁটছি। এবড়োথেবড়ো মাটির চাকে হাঁটতে বেশ অসুবিধা হচ্ছিল। আমার পায়ে কেডস ছিল বলে তেমন সমস্যা হচ্ছিল না, কিন্তু নীল বেশ স্লো যাচ্ছিল।

গ্রামে পৌঁছেই আমরা জরিপ শুরু করলাম। আমি কাউকে ইন্টারভিউ করতে থাকলে নীলু পাশে দাঁড়িয়ে থাকত। নীলু করলে আমি দাঁড়িয়ে থাকতাম। নীলু কোনো বাড়িতে ঢুকে মহিলাদের ইন্টারভিউ নিলে আমি ঘরের দাওয়ায় বসে থাকতাম। এভাবে হেঁটে হেঁটে, বাড়ি বাড়ি ঘুরে ইন্টারভিউ নিচ্ছিলাম। হঠাৎ দেখি দূরে একটা রিকশা দাঁড়িয়ে আছে। কাছে যেতেই রিকশাওয়ালা আমাদের দেখে হেসে বলল, আমি জানতাম আপনেরা এই রাস্তা ধইরা আইবেন। তাই আগেই আইসা বইসা আছি। আমরা বললাম, বসে থাকুন তাহলে।

জীবনের প্রথম সার্ভে করছি। পুরা গলদঘর্ম হয়ে পড়েছি। গ্রামের লোকেরা আমাদের সামনে সারাক্ষণই কথা বলছে। যখনই বলি, আসেন একটা ইন্টারভিউ নিই, তখন সরে যায়। সবাই এ ওরে ঠেলে। হয়তো কাউকে বোঝাচ্ছি, ব্যাটা তখন নীলুর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কেবলার মতো হাসছে। মহা মুসিবত। এসব করতে করতে দুপুর হয়ে গেল। পেটে প্রচন্ড খিদে। ক্রমাগত সিগারেট খেয়ে আমার বাংলা ফাইভের স্টক শেষ। বাধ্য হয়ে বিড়ি টানতে শুরু করলাম। অনেক দূর হেঁটে গ্রামের বাজার থেকে (নিতান্তই গরিবী বাজার আর ওইদিন হাটবার ছিল না বলে মাত্র ১টা দোকান খোলা ছিল) কিছু বিস্কিট আর চা খেয়ে নিলাম।

আবার কাজ শুরু হলো। এবার একটু স্পিডি হলাম। এনিহাউ দিনের মধ্যে ৫০টা পেপার শেষ করতে হবে। এদিকে আরেক মুসিবত হলো গ্রামের ছোট ছোট ছেলেপিলে। সারাক্ষণই পিছনে লেগে রয়েছে। নীলু হয়তো কোনো বাড়ির ভেতরে গেছে, আমি বসে বসে সিগারেট খাচ্ছি। নীলু বেরিয়ে এলেই চিৎকার করে উঠে, ওইত্তো মাইয়াডা আইছে। একজন আরেকজনের সঙ্গে ফিসফিস করে, অই, অরা কি জামাই-বউ? শার্ট-প্যান্ট ধরে টান দেয়। কারো হয়তো ইন্টারভিউ নিচ্ছি, কি লিখি দেখার জন্য ঝুকতে ঝুকতে পিঠেই উঠে গেল। মাঝে মাঝে খুব বিরক্ত লাগত। কিন্তু সামলে নিতাম।

এবার গ্রামটা সম্পর্কে বলি। নাম ভুলে গেছি কিন্তু খুব গরিবী একটা গ্রাম। লক্ষ্য করলাম, গ্রামের বাড়িগুলোর উঠোন কিংবা আশেপাশের কোথাও কোনো সবজির চাষাবাদ নেই, কচুঘেচুও নেই। এসব সবজি, কচুঘেচু তো ‍ফেলে দেয়া বিচি থেকে এমনিতেই হওয়ার কথা। গাছপালাও তেমন নেই। বাড়িগুলো সব মাটির তৈরি। এবং ঘরতৈরির মাটি যেখানে থেকে খুঁড়ে আনা হয়েছে সেটা যথেষ্ট গভীর হলেও কোনো পানি জমে নেই। অথচ আমার গ্রামের বাড়িতে (ফেনী) দেখেছি, সামান্য গভীর হলেই মাটির তল থেকে পানি উঠে আসে। বৃষ্টিও খুব হয় না মনে হয়। গ্রামে বাজার বলতে (আগেই উল্লেখ করেছি) একটাই। তাতে হাতে গোণা ৩/৪টা দোকান। গ্রামের মানুষগুলো সহজ-সরল। গ্রামের মহিলারা খালেদাকে রাণী বলে জানে। সেটাও মেনে নিয়েছি। কিন্তু আমি কখনো ভাবতেই পারিনি, বাংলাদেশের কাউকে হরতাল কি, এইটা বোঝাতে হবে।

প্রশ্নপত্রে হরতাল সম্পর্কিত একটা প্রশ্ন ছিল। এক বয়স্ক লোকের কাছে এটার উত্তর জানতে চাইতেই সে আমাকে পাল্টা প্রশ্ন করল, হরতাল কি? আমি একটা ধাক্কা খেলাম। সামলে নিয়ে বোঝাতে চেষ্টা করলাম, এই ধরেন বনধ কিংবা দোকান পাট বন্ধ থাকে কিংবা অনেক মিছিল হয়, ভাংচুর হয়। বয়স্ক লোকটি প্রবলভাবে মাথা নাড়িয়ে বলল, না-না। আমগো এহানে এসব কিছু হয় না। গাড়ি সবসময়ই চলে। ওই যে দেহেন চলতাছে।

তাকিয়ে দেখি দূরে দুইটা মহিষের গাড়ি যাচ্ছে। আমি লোকটার দিকে তাকাই। তার সরলতায় হাসব না কাঁদব বুঝতে পারছি না। হরতাল সম্পর্কিত প্রশ্নের উত্তরে কি লিখব এখন আমি?

আরেকটি প্রশ্ন ছিল এরকম যে, আপনার সংসদ সদস্য গত ৫ বছরে এলাকায় কি কি কাজ করেছে। এই প্রশ্নের উত্তরে কেউ হয়তো সংসদ সদস্যের ভালো ভালো কাজ বলতে শুরু করল, অমনি পাশ থেকে কেউ কেউ বলে উঠল, এ্যাহ। এইডারে ভালা কাজ কয়? হেয় যে ওইদিন এই খারাপ কামডা করল। ব্যস, গেল আমার ইন্টারভিউ, ঝগড়া শুরু হয়ে গেল দুইপক্ষে। অনেক কঠিন হয়ে যেতো এমন পরিস্থিতি সামলাতে।

সবচেয়ে অপ্রীতিকর যে প্রশ্নটির সম্মুখীন আমি আর নীলু (এবং পরবর্তীতে অন্যান্য জেলাতেও) হয়েছি সেটা হলো, আমাদের এসব করে কি লাভ? কয় টাকা পাই কিংবা আমরা কাদের হয়ে কাজ করছি? এক্ষেত্রে শুধুমাত্র রংপুরেই (যেহেতু প্রথম সার্ভে) আমার উত্তর দিতে প্রথম প্রথম জড়তা হতো। পরে অবশ্য পটু হয়ে গেছি। যাহোক, উত্তরটা এমন হতো যে, আমরা ছাত্রমানুষ, দেশে নির্বাচন আসছে। আমরা অমুক সংগঠন চাই যে আপনারাই আপনাদের প্রার্থী নির্বাচন করুন। এজন্য সঠিক তথ্য পাওয়ার জন্য সেই সুদূর ঢাকা থেকে আপনাদের কাছে ছুটে এসেছি। মাত্র নমিনেশন দেয়া হয়েছে, বাতিলের সময় আছে। তাই আপনারাই ঠিক করবেন কোন প্রার্থী কতোটা ভালো। ভোট দেয়ার জন্য আপনার সচেতন হওয়া প্রয়োজন। আমরা ছাত্রমানুষ, খাইখরচা পাই। আর এই যে দেশ ঘুরছি, আপনাদের সঙ্গে কথা বলছি এটাইতো অনেক বড় পাওনা।

হা হা হা। এসব কথা একটু গুছিয়ে বললেই সহজসরল মানুষগুলো মাথা নাড়িয়ে বলত, হ ঠিক ঠিক। আমি মনে মনে হাসি, আহারে, আর কয়দিন পরেই বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাকর্মীচ্যালাচামুন্ডা এসে, এদের আরো একবার ভেলকি দেখিয়ে যাবে।

প্রচন্ড টায়ার্ড হয়ে আমি আর নীলু প্রথমদিনের কাজ শেষ করলাম। রিকশায় উঠে বসতেই কোমরে ব্যথা টের পেলাম। রিকশা এবার আমাদের অন্য পথে নিয়ে যেতে লাগল। কিছুদূর যেতেই বিশ্বরোডে উঠে পড়লাম। বড় বড় বাসট্রাক হুশহাশ করে পাশ দিয়ে বেরিয় যাচ্ছিল। খুব ভয় করলেও প্রচুর বাতাসে রিকশা ভ্রমণ ভালোই লাগছিল। নীলুর সঙ্গে গল্প শুরু করলাম। তার হলজীবনের কথা, বন্ধুদের কথা, জাবির কথা। আমি তখনো জাবি যাইনি। ক্যাম্পাসের কথা শুনে ভালো লাগল। জানলাম পনির আর মীরা কিছুদিন পরেই বিয়ে করবে। মীরার বাবা ময়মনসিংহের জাতীয় পার্টির সাবেক এমপি। রিকশাওয়ালার সঙ্গেও গল্প করলাম। আমি আর নীলু ঠিক করলাম তার বাসায় যাব। রিকশাওয়ালাকে বলতেই সায় দিল।

সন্ধ্যা হয়ে রাত নেমে গেছে। রিকশাওয়ালার বাড়িতে গেলাম। বেড়ার ঘর। একটা ছেলে আছে তার। খুব অল্প সময় ছিলাম কিন্তু এরমধ্যেই রিকশাওয়ালা নাবিস্কো গ্লুকোজ বিস্কুট আর শরবত পরিবেশন করল। বুঝতে পারলাম সদরে ঢোকার মুখেই যে কনফেকশনারীর সামনে সে থেমেছিল, বিস্কুট কেনার অপকর্মটি তখনই সেরেছে। রিকশাওয়ালার ছেলেকে বখশিশ দিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম।

রাত ৮টায় বাসায় ফিরলাম। পনির আর মীরা আগেই ফিরেছে। বাড়ির মালিককে জিজ্ঞেস করলাম, রিকশাওয়ালাকে কতো দিব? বললেন, ৬০ টাকা দিয়ে দিন। টাকার পরিমাণ খুব কম হয়ে যায় দেখে আমি বাইরে এসে ৮০ টাকা দিয়ে বললাম আগামীকালও যেন সে আসে। বাড়ির মালিক যখন জানতে পারলেন আমি ৮০ টাকা দিয়েছি, অবাক হয়ে বললেন, কি করেছেন, আমি তো সন্ধ্যা পর্যন্ত ৪০ টাকায় ঠিক করেছিলাম। রাত করে ফেলেছেন তাই ২০ টাকা বখশিশ সহ ৬০ টাকা দিতে বললাম।

এনিয়ে আর কথা বাড়ালাম না। প্রচন্ড টায়ার্ড ছিলাম। পনির ভাইয়ের কাছ থেকে কাগজপত্র, টাকা পয়সার হিসেব বুঝে নিলাম। তার নাকি হঠাৎই ডায়রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছিল। যে বাড়িতেই গেছে একবার করে সেটার টয়লেটও পরিদর্শন করে এসেছে। এই নিয়ে সবাই বেশ কিছুক্ষণ হাসাহাসি করে রাতের খাবার খেয়ে উঠলাম। শুরু হলো দলনেতা হিসেবে আমার দায়িত্ব।

৪ জনের ২০০ টি প্রশ্নপত্র নিয়ে আমি চেক করতে শুরু করলাম। প্রতিটা প্রশ্নপত্রে আসন, থানা, ইউনিয়ন, গ্রাম লিখতে হলো। কোথাও কোনো প্রশ্ন বাদ পড়েছে কিনা চেক করতে হলো। বাদ পড়ে থাকলে তার আগে পিছের উত্তর মিলিয়ে সম্ভাব্য একটা উত্তর টিক দিয়ে পাশে ফুটনোট লেখা অথবা সেটা অমীমাংসিত প্রশ্ন হিসেবে চিহ্নিত করা ইত্যাদি হাবিজাবি করতে করতে রাত ১২টা বেজে গেল। পিঠ ব্যথা করছে। সারাজীবনেও এতো হাঁটিনি। কাগজপত্র গুছিয়ে চটজলদি ঘুমাতে চলে গেলাম।

Monday 26 November 2007

জনমত জরিপ @ প্রারম্ভিক

একটা এনজিওতে কমপিউটার আর ইংরেজি শিখতাম। সাল ১৯৯৫। তাতে ইংরেজি তো কিছুই শিখিনি বরং কমপিউটারে গেমস খেলতে খেলতে পুরো কীবোর্ড মুখস্থ হয়ে গেল। বাংলা আর ইংরেজি টাইপিংয়ে এতো দক্ষ হয়ে গেলাম যে ১৯৯৭ সালের পর থেকে আজ পর্যন্ত ফোন নম্বর, বাড়ির ঠিকানা, ছোটখাট চিরকুট ছাড়া আর কোনো কিছুই কলম দিয়ে কাগজে লিখিনি। সেসব অন্য কথা। তো আমার এই টাইপিং স্পিডের কারণে কোর্সের শেষে আমি ওই এনজিওতে টাইপিস্টের চাকরি পেয়ে গেলাম। যেহেতু এনজিও, আদর করে বলা হলো অফিস এক্সিকিউটিভ।

তবে আজকের পোস্টের বিষয় অন্য। জনমত জরিপ। কোর্সের শেষের দিকে আমাদের বলা হলো জরিপ করতে হবে সারাদেশব্যাপী। তারই রিহার্সাল হিসেবে আমরা ঢাকা শহরে একটা সার্ভে সম্পন্ন করলাম। তখন ১৯৯৬ সাল। সারাদেশ নির্বাচনমুখী। রাজনৈতিক দলগুলো নমিনেশন দিয়ে দিয়েছে। তো আমাদের এই নির্বাচনী জরিপ করতে হবে। সে মোতাবেক, আমাদের প্রস্তুতি হিসেবে কিছু ছোটখাট ওয়ার্কশপও করানো হলো। আমরা যারা নতুন তারা খুব গম্ভীর হয়ে জরিপ সংক্রান্ত মারপ্যাঁচগুলো শেখার চেষ্টা করে গেলাম। আমি খুব কষ্ট করে কয়েকটা জিনিস মনে রাখার চেষ্টা করলাম। যেমন,

0. বয়সের ক্ষেত্রে যদি প্রথমজন ১৮-২৫ হয়, তবে দ্বিতীয়জনের বয়সশ্রণী যেন ২৬-৩৫ হয়।
0. পেশার ক্ষেত্রেও তাই, পরপর একই পেশার কাউকেই যেন ইন্টারভিউ না নেয়া হয়।
0. গ্রামে যেন ডান পাশের এক বাড়িতে ইন্টারভিউ সেরে তার ৩/৪ টা বাড়ি পর বাম পাশের কোনো বাড়ির কারো ইন্টারভিউ নিই।
0. বাজারে, চা-র দোকানে ইত্যাদি জমায়েতপূর্ণ জায়গায় যেন একটাই ইন্টারভিউ নেয়া হয়
0. প্রশ্ন বলার পর তার কখগঘ উত্তরগুলোর কোনোটাতেই যেন আলাদাভাবে জোর না দেয়া হয়।
0. কেউ সময় দিতে চাইবে না। প্রথমে এড়িয়ে যেতে চাইবে, সেটা যেন নিজ দক্ষতায় ম্যানেজ করে নিই।

যাহোক, আরো কি কি সব জানি শিখিয়েছিল, আমার কিছুই মনে নেই। তবে যে বিষয়টা আমি খুব তাড়াতাড়ি বুঝে নিয়েছি তা হলো আমাদের হাতখরচ কতো দেয়া হবে। আর অতি উৎসুক হয়ে ছিলাম এটা জেনে যে আমাদের সঙ্গে মেয়েরাও যাবে। জীবনে এই প্রথম মেয়েদের সঙ্গে ঢাকার বাইরে যাব। এর আগে শুধু ফারহানাকে মাঝে মাঝে বুড়িগঙ্গার ওপারে পৌঁছে দিতাম অথবা সদরঘাট থেকে গুলিস্তান আসার পয়সা থাকত না দেখে ইতির সঙ্গে সিদ্দিকবাজার পর্যন্ত রিক্সায় আসতাম।

এবার আমাদের জিজ্ঞেস করা হলো কে কোন জেলায় যাব। সারা বাংলাদেশের ৩০০টি আসনের মধ্যে মার্জিনাল আসনগুলো বেছে নেয়া হয়েছিল। অর্থাৎ যে আসনগুলোর মাঝে বিজয়ী ও পরাজিত প্রার্থীর মধ্যে ২০০-৩০০০ ভোটের ব্যবধান রয়েছে। সে মোতাবেক যে কয়টি আসন বা জেলা সিলেক্ট করা হয়েছে তারমধ্যে রংপুর হলো সবচেয়ে দূরবর্তী জেলা। আমি চট করে সেটাই বেছে নিলাম। ততোদিনে আমি চাকরি করি বিধায় আমার একটা আলাদা দাপট তৈরি হয়ে গিয়েছিল। আমাকে দলনেতাও নির্বাচন করা হলো। অথচ তখন পর্যন্ত জানি না আমার গ্রুপের অন্য সদস্যরা কারা? আমি জানতে না পেরে একাউন্টসে গিয়ে টাকা পয়সা তুলে রংপুর যাওয়ার ৪টা টিকেট কিনে ফেলি।

এই এনজিও-র একেবারে গোড়ার দিকে আরেকটা সার্ভে হয় সেখানে জাহাঙ্গীরনগরের ছেলেমেয়েরা অংশ নিয়েছিল। আমরা কোর্সে ছাত্রছাত্রী ছিলাম ৪০ জনের মতো। তাই এবারও জাহাঙ্গীরনগরের ছাত্রছাত্রীদের ডাকা হলো। আমার সঙ্গে পরিচয় হলো জাবি-র এক ছাত্রের সঙ্গে। অফিস থেকে বলা হলো, সেই আমার গ্রুপের বাকি ৩ জনকে ম্যানেজ করে দেবে। আমি সেই ছাত্রের (নাম ভুলে গেছি) কাছে জানতে চাইলাম আমার গ্রুপের অন্য সদস্যদের ব্যাপারে। সে আমাকে পাল্টা প্রশ্ন করল, আপনি আজ রাত্রে রওনা দেবেন না? টিকেট কেটেছেন?

আমি হ্যা বলার সঙ্গে সঙ্গে বলল, তাহলে আমাকে তিনটা টিকেট দিয়ে দিন। আপনার গ্রুপের বাকিরা প্রান্তিক থেকে উঠবে। আপনি বাস ড্রাইভারকে বলে রাখবেন জাহাঙ্গীরনগরের প্রান্তিকে যেন বাস থামায়, লোক উঠবে। আমি নলা সব বুঝে তার হাতে তিনটা টিকেট তুলে দিলাম।

কোর্সমেটরা কে কোথায় কখন যাচ্ছে, তাদের সদস্য কারা এসব খোঁজ নিতে নিতে দেখি, হায় আল্লাহ, অনেকের গ্রুপে দেখি কোনো মেয়েই নেই। তবে যে বলল, প্রতি গ্রুপেই ১জন হলেও মেয়ে থাকবে। আমার গ্রুপেও কি তাহলে ...
____________________________

রাত ৯টায় বাস ছাড়ল গাবতলী থেকে। আমি বাসের একবারে সামনের চারটা টিকেট কেটেছিলাম। প্রায় আধাঘন্টা পর বাস প্রান্তিকে থামতেই একটা ছেলে ও দুইটা মেয়ে উঠে এলো। আমি বসেছিলাম ড্রাইভারের পিছনে জানালার সিট ছেড়ে। দেখলাম, একটা ছেলে আর একটা মেয়ে গেটের কাছের সিটদুটোয় বসে গেল। আর অন্য মেয়েটা সুড়সুড় করে আমার পাশে এসে বসল। ধারণা করলাম টিকেটের গায়ে সিট নাম্বার দেখেই তারা ধারণা করে নিয়েছে। ছেলেটা সিটে সুস্থির হয়ে বসে বলল, আমার নাম পনির, আর ও হচ্ছে মীরা।
আমার পাশের মেয়েটা বলল, আমার নাম নীলু।

আমি দাঁত কেলিয়ে সবাইকে সম্ভাষণ জানালাম। জরিপের কাজটা সম্পর্কে একটু ধারণা দিতে চাইলাম। ছেলেটা বলে উঠল, ওসব আমরা অনেক করেছি। আপনি চাইলে সকালে বুঝিয়ে দিয়েন। এরপর হালকা কিছু কথাবার্তা বলে পনির আর মীরা দুজনেই ঘুমানোর আয়োজন শুরু করল। বাসের সুপারভাইজার তখন সবাইকে ফান্টা আর স্যান্ডউইচ দিচ্ছিল। আমি আর নীলু ফান্টা নিলাম শুধু। নীলুর সঙ্গে কথা বলা শুরু করলাম। কিন্তু বেশিদূর এগোনো গেল না। জড়তা রয়েই গেল।
____________________________

বাস ছুটছে আরিচার দিকে। রাত তেমন বেশি হয়নি। অথচ আশ্চর্য পুরো বাসটিই ঘুমিয়ে গেছে। পনির আর মীরা তো সেই কবেই! পাশ ফিরে দেখি নীলুও চোখ মুদে আছে। আমি ফান্টায় চুমুক দিই। শীত শীত করে উঠে। হালকা অন্ধকারে বাসের গর্জন আর বাতাসের শব্দ ছাড়া আর কিছুই নেই। আরেকবার ফান্টায় চুমুক দেই। টুং করে শব্দ হতেই খেয়াল করে দেখি নীলুর পায়ের কাছে আধখাওয়া ফান্টার বোতল। একটু দুলছে, আমি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি বোতলটার দিকে। দুলে উঠে পড়ে যেতে গেলেই যেন খপ করে ধরে ফেলতে পারি সেলক্ষ্যে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি, তাকিয়ে থাকি, তাকিয়েই থাকি ...

পরদিন সকালে রংপুর বাসস্ট্যান্ডে আমার ঘুম ভাঙ্গে।