Monday 31 December 2007

যেমন গেল ২০০৭



শিরোনাম দেখেই বুঝতে পারছেন কি বলতে চাইছি। এ ধরণের লেখার চেষ্টা এবারই প্রথম। সাধারণত বছর শেষ হবার পর কয়েকটি ঘটনাকে একটু উলটে পালটে দেখে আবার ভুলে যাওয়াটাই ছিল বছর শুরুর প্রথম রুটিন। কিন্তু আজকে মনে হলো কিছু লিখি। এই ২০০৭ সালেই আমার ব্লগিং জীবন শুরু। তাই ভাবলাম অন্যান্য ব্লগারদের সঙ্গে শেয়ার করা যাক আমার ২০০৭ বছরটি।



২০০৭ সালের প্রথম দিনেই আমার লেখা ও পরিচালিত একটি নাটক অন-এয়ার হওয়া দিয়ে বছর শুরু হয়। দেশের বাইরে এই প্রথম এবং একেবারেই আনাড়ী কিছু অভিনেতা অভিনেত্রীদের দিয়ে নির্মিত নাটকটি বেশ সাড়া ফেলে। যদিও মানের বিচারে আমার পূর্ববর্তী কয়েকটি নাটকের চেয়ে এই নাটকটিকে বেশি গুরুত্ব দেই না। তবু অতি সীমাবদ্ধতার ভেতরেও কাজ উদ্ধার করতে পেরেছিলাম, যা আমার আত্মবিশ্বাস বাড়িয়েছে।



প্রথম জীবনে সাংবাদিক হতে চেয়েছিলাম। সেমতে কাজ শুরু করেও ছিটকে গেছি টিভি/ফিল্ম মিডিয়ার প্রতি দুর্বার আকর্ষণের জন্য। সাংবাদিক হবার স্বাদ কিছুটা ঘোলে মিটেছে ২০০৭ এর ফেব্রুয়ারিতে। ভাষা দিবসের শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণের বিষয় নিয়ে একটি রিপোর্ট করি। শহীদ বেদীতে ফুল ও ব্যানার সহযোগে আসা বিভিন্ন সংগঠনের বানান ভুলের বিষয়টি রিপোর্টে তুলে ধরা হয়। এসব সংগঠনগুলোর মধ্যে ছিল বাংলাদেশ হাইকমিশন, প্রথম সারির রাজনৈতিক দল ও বিভিন্ন আঞ্চলিক সংগঠন। এছাড়াও ছিল লন্ডনের আরেকটি বাংলাভাষী টিভি চ্যানেল। প্রচন্ড সমালোচিত এবং প্রশংসিত হই এ রিপোর্টের কারণে।



২০০৭ সালের মার্চ মাস আমার জীবনে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ১২ মার্চ থার্ড আই প্রথম পরিচয় করিয়ে দেয় সামহোয়ারের সঙ্গে। ভার্চুয়াল জগতে এতো বাংলা শব্দ, লেখা, মতের সমাহার পেয়ে অত্যন্ত খুশি হই। দিন/রাতের বেশ কিছু সময় ব্যয় হতে থাকে ব্লগিংয়ের পেছনে। নিজেকে লেখক কখনোই ভাবিনি, কিন্তু সামহোয়ারে লিখতে গিয়েই হোঁচট খাই। বেশ কিছু ভালো ব্লগারদের ভিড়ে ছাগুদের ম্যাতকারে বিরক্ত হয়ে বন্ধ করে দেই লেখালেখি। শুরু হয় ছাগু পোন্দানো। রাজাকার বিরোধী আন্দোলনে অনেকেরই সাথী হই, অনেককে সাথে পাই। এখনো চলছে এই রাজাকার ঠ্যাঙ্গানো এবং চলবেই। তবে এ মাসেই বহু আকাংখিত ড্রাইভিং লাইসেন্স পেয়ে যাই। রবার্ট ব্রুসের মতো কঠিন অধ্যাবসায়ে পর পর ৪ বার ফেল করে পঞ্চমবারে ড্রাইভিং লাইসেন্স মিলে। একটা গাড়িও কিনে ফেলি। সে আরেক বিরাট যন্ত্রণার ইতিহাস।



এপ্রিল মাস হলো আমার সবচেয়ে প্রিয় মাস। সারা বছর অপেক্ষা করি এই মাসের ১৪ তারিখের জন্য, পহেলা বৈশাখের জন্য। এদিন বাংলাদেশের সব মেয়েকেই আমার খুব সুন্দর লাগে। সারা দেশ আনন্দে ভাসে। আর এ অতি প্রিয় মাসেই আমি চাকরি হারাই। কারণ খুব স্পষ্ট। জামাত বিরোধীতা ও ধর্মের অতি ব্যবহারের অপকার নিয়ে কথা বলায় দ্বিতীয় স্তরের ম্যানেজমেন্টের রোষের শিকার হই। ১৪ এপ্রিল দেশে থাকার চেষ্টা করি, চাকরি হারানোয় সে প্ল্যান বাদ দেই। দেশে যাওয়া হয় না, কেননা ভিসা সেপ্টেম্বরে শেষ। তখন তো একেবারেই চলে যাব। চাকরি হারানোর মাসে গাড়ি দাবড়ে লন্ডন শহর ঘুরে বেড়াই। সহানুভূতি দেখিয়ে বন্ধুরা তেলের পয়সা দেয়। বার ২/৩ ক্যাবিং করলাম (পরিচিত গন্ডীর মধ্যেই)।



মে মাসে বাসা চেঞ্জ করার পর ১৩ তারিখ আবার চাকরি ফেরত পাই। ওইদিন লন্ডনে বৈশাখী মেলা উদযাপিত হচ্ছিল। বাংলাদেশের বৈশাখি মেলার দিন চাকরি হারিয়ে লন্ডনের বৈশাখি মেলার দিন চাকরি ফিরে পাওয়া কাকতালীয় ঘটনাটা বেশ চমকপ্রদ। কিন্তু চাকরি হারিয়ে এবং এরপরে গাড়ি সংক্রান্ত জটিলতায় আমি প্রচন্ড অর্থকষ্টে পড়ি।



জুন মাসে সচলায়তনে যোগ দেয়া ছাড়া আগস্ট পর্যন্ত আর কোনো উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেনি। লন্ডনে ১২ বছর পর খুঁজে পাওয়া স্কুলজীবনের দুই বন্ধুর সঙ্গে 'কি করা যায় না যায়' অথবা 'বাড়ি কিনব না নতুন কোনো ব্যবসা করব' এই টাইপের আলোচনায় আড্ডার সময়গুলো বেশি কেটেছে।



তবে সেপ্টেম্বর আমার জন্মমাস বলে এপ্রিলের পর এই মাসটা আমার খুব ভালো লাগে। বাংলাদেশে থাকতে সেপ্টেম্বর মাসের ওয়েদারটাও খুব ভালো থাকত। এ মাসে আমার লন্ডন থাকার ব্যবস্থা (ভিসা) পোক্ত হয়।



অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত পুরোটাই নিরামিষ গেছে। বছরের শেষে ডিসেম্বর মাস প্রচন্ড ব্যস্ততায় কেটেছে। এ বছর দেশে যাওয়ার জন্য প্রচুর প্ল্যান করেছি আবার বাতিল করেছি সময় ও পয়সা দুইটা সমন্বয় করতে না পারায়। নতুন বাসায় উঠেছি, রুম গুছিয়েছি। বন্ধু/কলিগরা দেখে আশ্বস্ত হয়েছে। বলেছে - আমি সভ্য হয়েছি।



তবে বছর জুড়েই অন্যান্য প্রবাসীর মতো আমিও বাংলাদেশ মিস করেছি। মিস করেছি সেখানকার মিডিয়াকে। নাটক বানানো ক্ষুধা বেড়েছে কিন্তু মেটানোর সময় হয়ে উঠেনি। সারা বছরই মা-র সঙ্গে ফোনালাপের একটা নির্ধারিত বিষয় ছিল 'আমার বিয়ে' সংক্রান্ত। সেটার এখনো কোনো সুরাহা হয়নি। এ বছর বাবা রিটায়ার করেছে। নিজের কাঁধে আরো একটু দায়িত্ব বেড়েছে। লন্ডনে বন্ধু বান্ধব বেড়েছে, বেশ কয়েকজন মেয়ে বন্ধুও (অন্য কোনো জটিলতা নাই) জুটেছে এবং অতি স্বাভাবিকভাবেই তাদের সঙ্গে আমার ঝগড়াটাই বেশি হয়েছে।



তবে সবকিছুর উপর আমি ব্লগকেই বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভাবছি। খুব অল্প সময়ের মধ্যে (এখনও এক বছরও হয়নি) ব্লগে এতো পরিচিত হয়ে গেছি, এতো ভালো ভালো মানুষের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি, মাঝে মাঝে অবাকই লাগে।



সবাইকে নতুন বছর ২০০৮ এর শুভেচ্ছা।

Friday 21 December 2007

জনমত জরিপ @ পরবর্তী যাত্রার প্রস্তুতি এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

রংপুর থেকে ফিরে সেদিন আর অফিস যাইনি। বাসায় প্রশ্নপত্রগুলো আরো একবার রিচেক করে পরদিন সকালে অফিসে গেলাম। আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা আগেরদিনই বিভিন্ন জেলা থেকে চলে এসেছে। আমি কাগজগুলো জমা দিয়ে একাউন্ট্যান্টের কাছে গেলাম। রিপোর্ট করলাম আমি একদিন বেশি কাজ করেছি তই পয়সাও একদিনের বেশি দিতে হবে। এটা নিয়ে কিছুক্ষণ বাতচিত চলল। পরে চপল ভাইয়ের (সার্ভে এনালিস্ট, এখন আমেরিকায়) সহায়তায় আমি চারদিনের পয়সা পেলাম। ২৫০ টাকা প্রতিদিন করে ৪ জনের জন্য মোট ৪০০০ টাকা। টাকাগুলো হাতে পেয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম পনির আর মীরাকে তিনদিনের পয়সা দিব। শুধু নীলুকে চারদিনের পয়সা দিব।

বিভিন্ন জনের অভিজ্ঞতার কথা শোনা হলো। এরমধ্যে দুইটি গ্রুপের কথা জানা গেল যারা আদৌ সার্ভে করতে যায়নি। তারা ঢাকাতেই ছিল অথচ কাগজ পূরণ করে দিয়েছে। এইটা খুবই লজ্জাজনক একটি কাজ হয়েছে। আমি ইন্টারেস্টেড ছিলাম জানতে, যেসব গ্রুপে মেয়েরা ছিল সেসব গ্রুপে ইন্টারেস্টিং কিছু ঘটেছে কিনা। দেখলাম তেমন কোনো গল্প নাই। বরং আমার গল্প শুনে বন্ধুরা হতবাক। কেউ কেউ বলে বসল, 'দোস্ত, নীলু তোকে প্রচন্ড লাইক করেছে। প্রেম করলে কইরা ফালা।' বন্ধু জাহিদ তো বলেই বসল, 'দোস্ত নীলুকে বলিস পরের সার্ভেতে ওর কোনো বান্ধবিকে নিতে।'

আমি 'ধ্যাত' বলে ধমক দিলেও মনে মনে হালকা একটু লাড়া কিন্তু ঠিকই খেলাম। 'দূরে কোথাও' নামে একটা গল্প লিখে ফেললাম। ছাপা হলো একটি সাপ্তাহিক পত্রিকায়। নীলুর সঙ্গে যোগাযোগ হলো। টাকা পয়সা দিয়ে বললাম মীরা আর পনিরকে না জানাতে। নীলু আমার গল্প পড়ে অভিভূত হয়ে গেল। টানা একসপ্তাহ তার ডিপার্টমেন্টের নোটিশবোর্ডে গল্পটি ঝুলিয়ে রাখল।

এদিকে নীলুর সঙ্গে বেশ ভাব হয়ে গেল। প্রতি বৃহস্পতিবার আমি জাহাঙ্গীরনগর যেতে শুরু করলাম। পল্টনে অফিস হওয়াতে আমি ওসমানী উদ্যান থেকে উঠতাম। প্রথম প্রথম গেস্ট হিসেবে ৩টাকা দিয়ে যেতাম। পরে যাতায়াতের মাত্রা বেড়ে যাওয়াতে ১টাকা করে দিতে শুরু করলাম। মামুরা টের পেত কিনা জানি না, তবে কোনোদিন প্রশ্নের সম্মুখীন হইনি। এছাড়াও জাহাঙ্গীরনগরের অনেকের সঙ্গেই তখন পরিচয় ছিল।

প্রশ্ন এবং উত্তরগুলোর কোডিং শেষ করে ডাটা এন্ট্রির কাজ শুরু হয়ে গেল। সেখানেও পয়সা। প্রতিটি প্রশ্নের ডাটা এন্ট্রির জন্য ১০ পয়সা করে। কিন্তু আমার টাইপিং স্পিড খুবই বেশি হওয়াতে এখানেও আমি অনেক টাকা ইনকাম করে ফেললাম। একমাস পরে সাপ্তাহিক পত্রিকায় রিপোর্ট প্রকাশ হলো। সাংবাদিক সম্মেলনে ঘোষণা হলো নির্বাচনের ঠিক একমাস আগে আরেকটি সার্ভে শুরু হবে।

এনজিওটিতে তখন আরো অনেক ছাত্রছাত্রী বেড়েছে। তাই সিদ্ধান্ত হলো পরের সার্ভেতে জাহাঙ্গীরনগরের ছাত্রছাত্রীদের অংশগ্রহণ কমানো হবে। এটা শুনে আমি তো খুবই দুঃখিত। নীলুকে নিব কিভাবে? নীলুকে বলে রেখেছি এবং সেও যেতে আগ্রহী। বন্ধু জাহিদের পরামর্শে নীলু তার এক বান্ধবীকেও রাজি করিয়েছে।

চপল ভাইয়ের শরাণাপন্ন হলাম। চপল ভাই পরামর্শ দিলেন এমন একটা জেলা পছন্দ করতে যেখানে বর্তমান ছাত্রছাত্রীরা যেতে চাইবে না। আমার আইডিয়াটা খুবই পছন্দ হলো। নরমালি আমিও একটা ব্যকওয়ার্ড জায়গা খুঁজছিলাম যেখানে কেউই যেতে চাইবে না। লিস্ট খুঁজে আমি পিরোজপুর (মঠবাড়িয়া) পছন্দ করলাম। কেননা এর আগে যারা ওই জায়গায় যারা গিয়েছিল তারা জায়গাটার খুবই দুর্নাম করেছে। আর তাতেই আমি আরো উৎসাহী হয়েছি। নীলুকে বলতেই মুখ গোমড়া করল,

- পিরোজপুর! এতোদূরে কেন যাব?
- আরে কি যে বলো না। দূরে তো ভালোই।
- চিনি না তো। তুমি চিনো?
- আমি কি করে চিনব? গিয়েই চিনে নেব।
- না ভরসা পাচ্ছি না।
- আরে ধুর, আমি আছি না। চলো যাই।
- উহু। তুমি কি সামলাবে আমার জানা আছে।
- গেলে চলো। নাহলে নাই।
- আচ্ছা পরে জানাব।

আমি মেজাজ খারাপ করে চলে আসি ওইদিন জাহাঙ্গীরনগর থেকে। আমার উপর ভরসা করতে পারছে না। কিন্তু পরের বৃহস্পতিবারে নীলু কনফার্ম করে সে পিরোজপুর যাবে, সাথে তার আরেক বান্ধবি সুমি।

ঠিক হলো আমি, নীলু, সুমি আর বন্ধু জাহিদ যাব। একটা বড় গ্রুপ তৈরি হলো দক্ষিণাঞ্চলের জন্য। সবাই মিলে ঠিক করলাম খুলনা পর্যন্ত (বাগেরহাট আর পিরোজপুর) তিনগ্রুপ একসঙ্গে যাব। মোট ১২ জনের জন্য সম্ভবত খালেক এন্টারপ্রাইজের টিকেট কাটা হলো। সবাই রাত নয়টায় গাবতলী থেকে উঠবে। আমি শুধু নীলু আর সুমিকে নিয়ে জাহাঙ্গীরনগরের প্রান্তিক থেকে উঠব। জাহিদ আগে থেকেই বাসে থাকবে।

যাত্রার দিন ছিল প্রচন্ড ঝড়। আমি আটটার সময়ই জাহাঙ্গীরনগর চলে এলাম। ২ নম্বর হলে নীলুকে কল দিয়ে দেখি সে নাই। কই গেল? গেলাম সুমির বাসায় (টিচার্স কোয়ার্টার, প্রান্তিক ঘেষা)। সুমিকে জিজ্ঞেস করতে বলল, নীলু তো ব্যাগ গুছিয়ে রেখেছে। আছে হয়তো আশেপাশে। আপনি অপেক্ষা করেন।

আমি আবার হলগেটে ফিরে এলাম। ঝড় বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আমি আবারও কল দিলাম নীলুকে। হয়তো হলের অন্য কোনো রুমে আছে, এখন রুমে ফিরতে পারে। কিন্তু হতাশ। নীলু নেই। প্রচন্ড বাতাস আর বৃষ্টির মধ্যে আমি কোনোমতে ট্রান্সপোর্টে দাঁড়িয়ে আছি। রাত বাজে পৌণে নয়টা। সাড়ে নয়টায় প্রান্তিকে বাস আসবে।

রাত নয়টার দিকে আরেকবার গেলাম হলগেটে। গেটের কাছে দাঁড়িয়ে আছে এমন সময় কিছু খালা (হলের আয়া) হুড়মুড় করে ভেতর ঢুকতে লাগল। আমি নীলুর কথা জিজ্ঞেস করতেই বলল, আফা তো বিকালেই বাইরে গেছে। আমি টেনশন নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। এমন সময় সুমি এলো, হাতে ব্যাগ।

- নীলুর কোনো খোঁজ পেলে?
- এখনো আসেনি? আমি তো আরো ব্যাগ নিয়ে চলে এলাম।
- ভালো। তুমি একটু খোঁজ নেও তো অন্য কোনো রুমে আছে নাকি।
- দেখছি।
- আচ্ছা শোনো নীলু যদি না যায় তুমি যাবে তো?
- না ভাইয়া। নীলু না গেলে তো আমি যাব না।

আমি চরম বিপদ দেখলাম। দুইজন মিলে সার্ভে করব কেমনে? ঘড়িতে অলরেডি সোয়া নয়টা। অস্থিরভাবে পায়চারি করছি। বৃষ্টিতে প্রায় ভিজে গেছি। সিগারেটও ধরাতে পারছি না। দমকা হাওয়া আর বৃষ্টি পড়ছে মুষলধারে। লম্বা লম্বা গাছগুলো নুয়ে পড়ছে মাটিতে ঝড়ের দাপটে। আমি মনে মনে প্রার্থনা করতে থাকি গাবতলী থেকে বাস যেন দেরিতে ছাড়ে।

অনেকক্ষণ পর হলগেটের ওপাশ থেকে এক খালা বলে উঠল, আর মামা যে ভিজতাছেন, ভিতরে আইয়া বসেন।

গেট খুলে দিলে আমি ২ নম্বর হল (ফজিলাতুন্নেসা)-এ ঢুকলাম। অন্ধকার, কারেন্ট ছিল না। আমি বামের গেস্টরুমের দিকে এগোলাম। দরজা ঠাহর করে সেদিকে এগোলাম। দরজা দিয়ে ঢুকতেই হোঁচট খেলাম। একটা চেয়ার দরজার মুখেই। আমার হাতপা ব্যথা করছিল। আমি সেই চেয়ারটিতে বসে পড়লাম। অপেক্ষা করতে লাগলাম নীলুর জন্য।

সম্ভবত ঠিক পনের মিনিট পরেই একটি মেয়ে হন্তদন্ত হয়ে ঢুকল। চেঁচিয়ে বলল, খালা গেস্টরুমটা খুলে দাও। আমার আব্বা এসেছেন। শুনেই আমি তড়াক করে লাফিয়ে উঠলাম। গেস্টরুম খুলতে বলছে তাহলে আমি কোন রুমে বসে আছি?

চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই বুঝলাম এইটা সম্ভবত টয়লেট। একটা বেসিন কি দেখতে পাচ্ছি? ততোক্ষণে খালা গেস্টরুম খুলে দিল। আমিও ওই মেয়েটার বাবার সঙ্গে গেস্টরুমে গিয়ে বসলাম। পুরো মেজাজ খারাপ। খালা এসে মোমবাতি জ্বালিয়ে দিয়ে গেল। ঘড়িতে তখন সাড়ে নয়টা। এসময়টাতেই প্রান্তিকে বাস আসার কথা। কি করব? নীলুর আশা ছেড়ে দৌড়ে যাব প্রান্তিকে?

এই ভাবনার ঠিক পাঁচ মিনিট পর নীলু হলে ঢুকল। গেটের কাছে খালাকে জিজ্ঞেস করল, আমার কাছে কেউ এসেছিল? খালা আমাকে দেখিয়ে দিল। আমি তখন মেজাজ খারাপ করে বললাম, জলদি ব্যাগ নিয়ে এসো। বাস চলে আসছে।

নীলু দৌড়ে হলের দিকে চলে গেল। আমি তখন ঠান্ডায় আর টেনশনে কাঁপছি। এখন যদি গিয়ে যদি বাস না পাই? ১৯৯৬ সাল। বাসে আমাদের গ্রুপের কারোরই তখন কোনো মোবাইল ছিল না।

Saturday 8 December 2007

জনমত জরিপ @ রংপুর থেকে ঢাকা

আগের পর্বে উল্লেখ করেছিলাম রাতেই আমরা আগমনী বাসে রংপুর থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিই। কিন্তু এখন লিখতে বসে, স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মনে হচ্ছে আসলে আমরা ভোরের বাসটিতেই রওনা দিয়েছিলাম। ওটা ধরেই লিখতে শুরু করলাম ...

এবার বাসে আমাদের সিট ছিল শেষের ৪টি। এরশাদের কল্যাণে বৃহত্তর উত্তরাঞ্চলের রাস্তাগুলো বেশ মসৃণ হওয়াতে আমাদের অসুবিধা হচ্ছিল না। কিন্তু যতোই ঢাকার দিকে এগুচ্ছিলাম, বুঝতে পারছিলাম ঝাকানাকার পরিমাণ বাড়তেই থাকবে।

আমি আর নীলু যথারীতি পাশাপাশিই বসেছিলাম। রাতের বাসে রংপুর গিয়েছিলাম বলে কিছুই দেখতে পাইনি। তাই এবার মন ভরে রাস্তার দুপাশের সৌন্দর্য্য দেখতে দেখতে যাচ্ছি। জার্নি আমার বরাবরই পছন্দ। এতে আমি কোনো ক্লান্তি অনুভব করিনা। আমি দেখেছি জার্নির সময়ই আমি অনেক ভালো ভালো চিন্তা করতে পারি। আমার মধ্য কিটিবিটি (ক্রিয়েটিভি) জেগে উঠে। অনেকের আবার টয়লেটে এ ব্যাপারটা ঘটে। কোথায় যেন পড়েছিলাম কোন এক লেখিকার নাকি সঙ্গম শেষ হবার ঠিক পরমুহূর্তেই ব্যাপারটি ঘটে।

সৌন্দর্য্য নাকি বেশিক্ষণ উপভোগ করা যায় না। তাই বোর হবার আগেই নগরবাড়ি ঘাটে পৌঁছে গেলাম। হাতপা ঝাড়তে ফেরিতে বেশ কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করলাম, ভাত-মাংস খেলাম। ইচ্ছে ছিল কান পরিষ্কার করে নিব। কিন্তু অসাবধাবশত যদি ফুটো করে দেয় সে ভয়ে আর দ্বিতীয় চিন্তা করিনি।

নগরবাড়ি থেকে বাসে আবার রওনা শুরু করলাম। বড়রাস্তায় উঠতেই পনির বলল, আচ্ছা আমাদের টাকাপয়সার হিসেব তো করা হলো না।

আমি বললাম, আমি ঢাকায় গিয়ে অফিসে রিপোর্ট করব। তারপর আপনাদের প্রতিদিনকার হিসেবে যা পাবেন তা দিয়ে আসব।
- সেটা তো দিবেই। কিন্তু আমি বলছি, আমাদের খরচের যে টাকা দিয়েছিল ওটা তো পুরো খরচ হয়নি।
- না তা খরচ হয়নি।
- গুড। তাহলে এখন ৪ ভাগ করে ফেল।
- কিন্তু খরচ তো হয়নি। তাহলে অফিসে ফেরত দিতে হবে না?
- কিসের ফেরত! হোটেলে থাকলে তো খরচ হতোই। ভাবো না কেন আমরা হোটেলেই থেকেছি।

আমি গম্ভীর ভঙ্গিতে মাথা নাড়িয়ে সায় দিলাম। তারপর বাকিটাকা গুলো ৪ভাগ করে সবাইকে দিয়ে দিলাম। আমি অবশ্য চেয়েছিলাম টাকাগুলো অফিসে ফেরত দিব। মনে হচ্ছিল জোচ্চুরি করে অফিসের টাকাটা মেরে দিচ্ছি (পরে অবশ্য এ সংক্রান্ত যাবতীয় শংকা আমার আর ছিল না, অফিসে আর কখনোই আমি জরিপ সংক্রান্ত কোনো টাকাপয়সা ফেরত দিইনি)।

ঘুম ঘুম পাচ্ছিল। মানিকগঞ্জের কাছাকাছি চলে আসছে বাস। নীলুর দিকে তাকিয়ে দেখি অহরহ পড়ছে। আমি ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। আসলে ঘুমের চেয়ে কম, তন্দ্রার চেয়ে বেশি।

বেশ কিছুক্ষণ পর টের পেলাম আমার সারা মুখেচোখে হাতের পরশ। সারাগাল বুলিয়ে ঠোঁটের কোণ ঘেষে হাত চলে যাচ্ছে চুলে। আমি চমকে উঠলাম। স্বপ্নে কোনো পরীটরী দেখছি না তো। বেশকিছুক্ষণ এই হাতের পরশ অনুভব করে আমি পরীটাকে চিনতে পারলাম, নীলু। কিন্তু কারণটা কি? আমারে এতো সোহাগ করছে কেন?

বৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু ঠান্ডা তেমন না। বাসের বেশ কয়েকটা জানালা খোলা। রংপুরের ডাইরেক্ট বাসের বেশিরভাগ যাত্রিই নির্জীব হয়ে আছে। দ্রুতগতিতে পার হয়ে যাওয়া বাইরের অতিসবুজ গাছগুলো (বৃষ্টির কারণে) বাতাসকে ঠেলে বাসের ভিতরে ঢুকিয়ে দিচ্ছে। চোখ বন্ধ করে আমি টের পেলাম নীলু যেন আরো একটু ঘেঁষে বসল আমার সাথে।

ঘটনা যাই ঘটুক, আমি চোখ খুলছি না। কিছুক্ষণ পর অনুভব করি আবার চোখেমুখেচুলে হাত বুলাচ্ছে নীলু। বাস তখন মানিকগঞ্জ ছেড়ে এসেছে এবং প্রচন্ড ঝাঁকুনি হচ্ছে। তারপরও আমি চোখ খুলছি না, যদি নীলু আর হাত না বুলায়। এভাবেই চলছিল কিন্তু হঠাৎই বাসটা চরম ঝাঁকুনি খেলো। মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল। চোখ খুলে ফেললাম। না খুলে উপায় ছিল না। এমন ঝাঁকুনিতে, খোদার কসম, খোদ শয়তানও চোখ বন্ধ করে ঘুমের অভিনয় করতে পারত না।

আমি তাকিয়ে দেখি নীলু তখনও অহরহ পত্রিকা মুখের সামনে ধরে আছে। বাতাসে তার কানের পাশের চুলগুলো উড়ছে। আমি বললাম, হাই।
- বাবা যা ঘুমালে না।
- হুম। কিন্তু বাসের ঝাঁকুনিতে তো ভেঙ্গে গেল।
- ভালোই হয়েছে আর ২০ মিনিট পরে নেমে যাব।
- ঢাকা চলে এসেছি নাকি।
- ঢাকা না। ইউনিভার্সিটি নেমে পড়ব আমরা সবাই। পনির ভাইকে জাগাও।

যা শালা। কই আমি ভাবলাম আবার একটু ঘুমানোর ভান করব। আফসোস করে পনির ভাইকে ডেকে তুললাম। নীলু কাছ থেকে হলের নাম, রুমের নম্বর সব জেনে নিলাম। প্রান্তিক আসতেই সবাই নেমে পড়ল।

গাবতলী আসার আগ পর্যন্ত আমি নীলুর এ আচরণ নিয়ে অনেক ভাবলাম। রংপুরে যে কয়দিন ছিলাম, কখনো তো নীলুকে দেখে কিছুই বুঝতে পারিনি। তবে নীলু কি আমার প্রেমে পড়েছে? মনে হয় না। কিন্তু নীলু কেন এরকমটা করল? আমি পুরো বিষয়টা ভাবতে থাকি ...

0. মাত্র বৃষ্টি হওয়াতে বাইরের প্রকৃতি ছিল খুবই সুন্দর।
0. সঙ্গে সুন্দর বাতাস বইছিল, ঠান্ডা নয়, কিন্তু ভাবটা শিহরণের।
0. বাসের ওই সময় বেশিরভাগ যাত্রীই ঘুমিয়ে ছিল। যারা জেগে ছিল তাদেরও পিছু ফিরে তাকানোর কথা না। পনির ও মীরাও ঘুমিয়ে ছিল।
0. অহরহ পত্রিকার ওই সংখ্যায় কি নারীপুরুষের ভালোবাসা সংক্রান্ত কোনো বৈজ্ঞানিক আর্টিকেল ছাপা হয়েছিল?
0. ঘুমন্ত আমাকে দেখতে কেমন লাগছিল? এটা কি নীলুকে প্রভাবিত করেছিল?
0. নাকি নীলু একটু ফান করল?

সবকিছু ভেবে আমি ধরে নিলাম এটা তেমন কিছুই না। পারিপার্শ্বিক অবস্থা, প্রকৃতি, কয়েকদিনের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের কারণে ওই সময় নীলুর মনটা তরল হয়ে গিয়েছিল। এবং ওই মুহূর্তেই তার পাশে একজন তরুণকে দেখে তার ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করছিল। হয়তো পনির-মীরার ঘনিষ্ঠতা দেখে তারও মনে একটু ইচ্ছে, অন্যরকম রসায়ন জেগেছিল। নীলু আমার প্রেমে পড়ে যায়নি। আর এ বিষয়টা আমি বেশ কিছুদিন পরে নিশ্চিত হলাম যখন জানতে পারলাম দীপুর সঙ্গে নীলুর প্রেমের সম্পর্ক অনেকদিনের।
-------------------------------------------------------
পোস্টে সবার ছদ্মনাম ব্যবহার করা হয়েছে।