Thursday 24 January 2008

হারিয়ে যাওয়া দৃশ্যাবলী, হাতড়ে বেড়াই, ছুঁতে পারি না, ফিরে আসে না ...

০১। পাঠ্যবইয়ের তলায় লুকিয়ে গল্পের বই পড়া
০২। নতুন ফ্রিজ কেনার পর দুধ-চিনি দিয়ে মিশিয়ে আইসক্রীম বানানোর বিরামহীন চেষ্টা
০৩। প্রচন্ড গরমের দুপুরে ফ্যান ফুলস্পিডে চালিয়ে ঠান্ডা ফ্লোরে গাল ঠেকিয়ে শুয়ে থাকা
০৪। ভাড়ায় ব্রেকহীন সাইকেল চালিয়ে পাড়া ছেড়ে বহুদূর চলে যাওয়া
০৫। দুপুরের ঘুমের পর জেগে উঠে সন্ধ্যা হয়ে গেছে দেখে এবং তাই খেলতে যেতে না পারায় নিজের উপর তীব্র রাগ
০৬। লাটিমের 'আল' লাগানোর ভালো কামারখানা খুঁজতে ভিন্ন ভিন্ন বাজার, পাড়া চষে বেড়ানো
০৭। লাল-নীল হরেক রঙের ঘুড়ি, নাটাই, মাঞ্জা
০৮। মসজিদে জুম্মার নামাজে বন্ধুদের সঙ্গে দুষ্টুমি
০৯। পুরানো খাতাবই দিয়ে কটকটি খাওয়া
১০। মা-র মার খেয়ে খাটের তলায় লুকিয়ে যাওয়া
১১। ঈদের জামাকাপড় মাথার কাছে নিয়ে চানরাতে ঘুমোতে যাওয়া
১২। মুভি অফ দ্য উইকে কিসসিন টাইপের কিছু দেখে পরদিন স্কুলে বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা
১৩। প্রথম চটিবই পড়া/ নীলছবি দেখার পর অবিশ্বাস এবং উত্তেজনা
১৪। বায়োনিক ওম্যান, সিক্স মিলিয়ন ডলার ম্যান, ম্যান ফর আটলান্টিক, টারজান, ইনক্রিডিবল হাল্ক, দ্য ফল গাই, দি এ টিম, নাইট রাইডার, থান্ডার ক্যাটস, ম্যানিমেল, স্ট্রিটহক, ম্যাকগাইভার, ড়্যাভেন
১৫। ঘুমিয়ে গেলে ঘুমের ঘোরে মা-র খাইয়ে দেয়া
১৬। জ্বর হলে মা-র বার বার জানতে চাওয়া - কিছু খেতে ইচ্ছে করে বাবা?
১৭। সেইসব বায়নাগুলো - স্ট্যাম্প, ঠাকুরমার ঝুলি, খেলনা, ফুলগাছ, ছোটবোন চাওয়া
১৮। ভালো ছেলে বানানোর সে কি প্রাণান্তকর চেষ্টা বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজনদের
১৯। পড়ার বইয়ের দিকে তাকিয়ে ভালো লাগা মেয়েটির কথা চিন্তা করা
২০। আজব আজব সব স্বপ্ন দেখা, একটাও সত্যি হলো না ..
২১। মার্বেল খেলা, ঢাই আর চুইয়া, ম্যাচ বাক্স ও সিগারেটের তাস, নাক্কিমুট খেলা, লিচুর বিচি
২২। খেলতে গিয়ে স্যান্ডেল হারিয়ে ফেলা
২৩। ভুতের ভয়, পরীক্ষার আগে ডিম না খাওয়া, রাব্বি-জিদ্দি-এলমা

Friday 4 January 2008

জনমত জরিপ @ প্রান্তিক থেকে পিরোজপুরের পথে

নীলু ঠিক দুই মিনিটের মধ্যেই ব্যাগ নিয়ে ছুটে এলো। পিছু পিছু সুমি। আমার মেজাজ চরম খারাপ। ঘড়িতে নয়টা পয়তাল্লিশ। অথচ প্রান্তিকে বাস আসার কথা ঠিক সাড়ে নয়টায়। বাসটা মনে হয় মিসই করলাম।

কোনো রিক্সা নেই। ২ নং হল থেকে প্রান্তিক মোটামুটি দূরে। প্রায় দৌড়ে চলছি তিনজনে। কোনোমতে প্রান্তিকে এসে একটা দোকানের নীচে ঠাঁই নিলাম। আমি বুঝতে পারছি না বাস চলেই গেল কিনা। দোকানের আশ্রয় ছেড়ে রাস্তায় এসে দাঁড়িয়ে রইলাম। বৃষ্টির ঝাপটা কমেছে, কিন্তু প্রচন্ড বাতাস। একটু ঠান্ডাও লাগছে।

একটা বাস এসে থামে প্রান্তিকে। খালেক এন্টারপ্রাইজের বাস দেখে আমি এগিয়ে যেতেই দেখি কন্ডাক্টরের পিছু পিছু জাহিদও নামছে। আমি নীলু আর সুমিকে জোরে ডাকলাম। সুমি দৌড়ে এলো, হাতে নীলুর ব্যাগ।

- নীলু কই?
- টুথব্রাশ কিনছে।
- টুথব্রাশ কিনছে! এখন কি দাঁত মাজবে?
- না, সকালে তো লাগবে।
- তাহলে সকালে কেনা যেত না? যত্তোসব। তুমি বাসে উঠো। এ্যাই জাহিদ ওকে সিটে নিয়ে বসা।

জাহিদ সুমিকে নিয়ে বাসে উঠতেই আমি প্রান্তিকের একটা দোকানে ঢুকলাম। মেমসাহেব তখন টুথব্রাশের রং পছন্দ করছে। জোরে একটা ধমক দিয়ে কোনোমতে একটা ব্রাশ কিনেই দৌড় দিলাম বাসের দিকে। কন্ডাক্টর তখন চিৎকার শুরু করেছে।

বাসে উঠেই আমি সিটে গা এলিয়ে দিলাম। লাস্ট কয়েক ঘন্টা ধরে এতো টেনশনের ধকল শরীরে সইছে না। একটু ধাতস্থ হতেই বাসের অন্যান্যদের খোঁজ নেয়া শুরু করলাম। সবার সঙ্গে নীলু আর সুমির পরিচয় করিয়ে দিলাম। সবাইকে আমার দুরাবস্থার কথা বললাম। তাদের কথাও শুনলাম - এই ঝড়বৃষ্টির রাতে কে কিভাবে গাবতলী পৌঁছেছে।

মালা নামে একটা মেয়ে ছিল সেই গ্রুপে। সে বাগেরহাট যাবে। প্রচন্ড ঝড়বৃষ্টি থাকলেও প্ল্যানমাফিক সে আগেই গাবতলী চলে যায়। কিন্তু কোন বাসে উঠবে বুঝতে না পেরে কাউন্টারে দাঁড়িয়ে ছিল। তখন একটা লোক এসে নাকি তাকে বারবার ইশারা করছিল। সাড়া না পেয়ে পরে সরাসরি মালার কাছে জানতে চায়, সারা রাত থাকতে হলে সে কতো টাকা নেবে? মালার নাকি তখন মরে যেতে ইচ্ছে করছিল। ঘটনা শুনে অবশ্য আমরা বেশ মজাই পেয়েছিলাম।

মালা বেশ সুন্দর গান গাইতে পারে। যেমন তেমন না, গানের উপর বহুবছরের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা আছে তার। ১২ জন হওয়ায় পুরা বাসের মালিক আমরাই হয়ে উঠি। মালাকে গান গাওয়ার অনুরোধ জানানো হয়। না না করতে করতে মালা ৩টা গান গেয়ে ফেলে। তারপর শুরু হয় অন্তক্ষরী খেলা। 'গ' দিয়ে গানের শুরু করতে হবে এমন সময় নীলু গান ধরে - গরু তুই মানুষ হইলি না। অথচ সেই সময় আমি ধরতে চাইছিলাম - গানেরই খাতায় স্বরলিপি ...

গরু নিয়ে গান শুরু হওয়ায় আমার গানের খাতার স্বরলিপি হারিয়ে গেল তৎক্ষণাৎ। সবাই হো হো করে হেসে উঠে। বাসে উঠার পর নীলু বেশ চুপচাপ ছিল। আমি ভেবেছিলাম যে রাগারাগি করেছি বলে হয়তো চুপ মেরে গেছে। অন্ত্যক্ষরী খেলাতেও সে অংশগ্রহণ করছিল না। কিন্তু হঠাৎ 'গ' এর বেলায় গরুর গান গেয়ে ফেলার কারণটা কি? নীলুর দিকে তাকিয়ে দেখি সে ততোক্ষণে সিটে হাঁটুর উপর দাঁড়িয়ে গেছে। সমানে গাইছে গান। যেহেতু কোনো দলের না তাই অক্ষর পেলেই গেয়ে ফেলছে গান ঝটপট। নীলুর গানের তোড়ে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিক্ষিত মালাও চুপ হয়ে গেছে।

ফেরি পার হবার পর মধ্যরাতে বাসের অনেকের মধ্যেই ঝিমুনি শুরু হয়ে গেছে। আমার পাশের দুইসিটে সুমি আর জাহিদ বসেছিল। ওদের মধ্যে ফরমাল পরিচয়/আলাপচারিতা শেষ হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। জাহিদ আগের সার্ভেতে অন্য গ্রুপে ছিল। কিন্তু নীলুর ঘটনা শুনে এবার সে আমার সঙ্গেই যাচ্ছে। সুমি তখনো জেগে আছে, কিন্তু জাহিদ কিছুক্ষণ পরপরই ঘুমানোর ভান করছে। হয়তো ভাবছে, নীলুর বন্ধু হিসেবে সেও যদি জাহিদের চোখেমুখে হাত বুলিয়ে দেয়। হা হা হা ...

আমি নীলুর হাত ধরে বসে আছি। পট পট করে আঙ্গুল ফুটাই। নীলু জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে অন্ধকারে কি যেন দেখতে থাকে। আমি সাহস করে একটা আঙ্গুলে কামড় দিই। নীলু হাত টেনে নেয়,

- কি কর?
- কি করলাম !

আমি হাতটা আবার টেনে নিই। নীলু কিছু বলে না। দুইহাতের মাঝে নিয়ে চাপ দিই, উল্টেপাল্টে দেখি। বেশ কিছুক্ষণ ওরকমই থাকি। বাইরে মনে হয় ভোর হতে শুরু করেছে। ধ্যাত, অন্ধকার আরেকটু থাকছে না কেন? আলো ফুটলে তো সবাই জেগে যাবে। তখন কি নীলুর হাত ধরে বসে থাকতে পারব। ঘাড় ফিরিয়ে দেখি জাহিদ আর সুমি দুজনেই বেঘোর ঘুম। আমি আরেকটু ঘন হয়ে বসি। ফিসফিস করে কথা বলতে থাকি,

- আচ্ছা তুমি যে আমার সঙ্গে যাচ্ছ, তোমার বাসায় জানে?
- না।
- হলের সবাইকে বলেছ?
- না তারাও জানে না।
- তাহলে?
- বুদ্ধু কোথাকার। হলের সবাই জানে বাসায় যাচ্ছি, আর বাসায় তো জানেই যে আমি হলে আছি।

আমি নীলুর কনে আঙ্গুলটা মটকে দেই।

- তোমার তো ভালোই বুদ্ধি।
- তবে ভাইয়া থাকলে আসতে পারতাম না।
- তিনি কোথায়?
- পড়তে গেছেন দেশের বাইরে, স্কলারশিপে।

নীলুর আঙ্গুলের ফাঁকে ফাঁকে আমার আঙ্গুলগুলো ঢুকিয়ে দিই।

- উফ যা টেনশনে ফেলেছিলে তুমি। তুমি জানতে না আমি আসব?
- হুমম জানতাম।
- তাহলে এভাবে টেনশনে ফেললে কেন? তোমাকে না পেয়ে পরে খালারা আমাকে হলের ভেতর ঢুকতে দেয়। আমার তো মনে হয় গেস্টরুমের পাশের টয়লেটে বসে ছিলাম।
- তাই নাকি?

দুইজনের তর্জনী পাশাপাশি রেখে মেলাতে থাকি কার আঙ্গুল বড়। নীলুর না আমার।

- হুমম। আমি ভাবছিলাম যে তুমি আসবে না।
- আরে আমি তো সকাল থেকেই তৈরি হয়ে বসে ছিলাম। দেখলে না তুমি বলার পরপরই কতো তাড়াতাড়ি ব্যাগ নিয়ে বের হয়ে এলাম।
- হ্যা। আর ওদিকে যদি বাস মিস হয়ে যেত।
- আরে বাবা, সেজন্যেই তো তাড়াতাড়ি চলে এলাম।

নীলুর হাতের মুঠি চাপছিলাম। এবার জোরে একটা চাপ দেই,

- এ্যাহ, তাড়াতাড়ি এলে মানে? কথা ছিল তুমি হলে থাকবে, আমি কল দিলে তবেই নামবে। বাইরে ছিলে কেন তুমি?
- কি করব? দীপু এসেছিল।
- দীপু? তুমি দীপুর সঙ্গে ছিলে?
- কি করব? ওর আজকে আসার কথা ছিল না। বিকেল থেকেই একসঙ্গে ছিলাম। আমাকে ছাড়ছিল না। কোনোমতে জোর করে এসেছি।

আমি নীলুর হাত একেবারেই ছেড়ে দিই। নীলুও হাত টেনে নেয়। বাইরে ভোর হয়ে গেছে।