Monday, 31 December 2007

যেমন গেল ২০০৭



শিরোনাম দেখেই বুঝতে পারছেন কি বলতে চাইছি। এ ধরণের লেখার চেষ্টা এবারই প্রথম। সাধারণত বছর শেষ হবার পর কয়েকটি ঘটনাকে একটু উলটে পালটে দেখে আবার ভুলে যাওয়াটাই ছিল বছর শুরুর প্রথম রুটিন। কিন্তু আজকে মনে হলো কিছু লিখি। এই ২০০৭ সালেই আমার ব্লগিং জীবন শুরু। তাই ভাবলাম অন্যান্য ব্লগারদের সঙ্গে শেয়ার করা যাক আমার ২০০৭ বছরটি।



২০০৭ সালের প্রথম দিনেই আমার লেখা ও পরিচালিত একটি নাটক অন-এয়ার হওয়া দিয়ে বছর শুরু হয়। দেশের বাইরে এই প্রথম এবং একেবারেই আনাড়ী কিছু অভিনেতা অভিনেত্রীদের দিয়ে নির্মিত নাটকটি বেশ সাড়া ফেলে। যদিও মানের বিচারে আমার পূর্ববর্তী কয়েকটি নাটকের চেয়ে এই নাটকটিকে বেশি গুরুত্ব দেই না। তবু অতি সীমাবদ্ধতার ভেতরেও কাজ উদ্ধার করতে পেরেছিলাম, যা আমার আত্মবিশ্বাস বাড়িয়েছে।



প্রথম জীবনে সাংবাদিক হতে চেয়েছিলাম। সেমতে কাজ শুরু করেও ছিটকে গেছি টিভি/ফিল্ম মিডিয়ার প্রতি দুর্বার আকর্ষণের জন্য। সাংবাদিক হবার স্বাদ কিছুটা ঘোলে মিটেছে ২০০৭ এর ফেব্রুয়ারিতে। ভাষা দিবসের শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণের বিষয় নিয়ে একটি রিপোর্ট করি। শহীদ বেদীতে ফুল ও ব্যানার সহযোগে আসা বিভিন্ন সংগঠনের বানান ভুলের বিষয়টি রিপোর্টে তুলে ধরা হয়। এসব সংগঠনগুলোর মধ্যে ছিল বাংলাদেশ হাইকমিশন, প্রথম সারির রাজনৈতিক দল ও বিভিন্ন আঞ্চলিক সংগঠন। এছাড়াও ছিল লন্ডনের আরেকটি বাংলাভাষী টিভি চ্যানেল। প্রচন্ড সমালোচিত এবং প্রশংসিত হই এ রিপোর্টের কারণে।



২০০৭ সালের মার্চ মাস আমার জীবনে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ১২ মার্চ থার্ড আই প্রথম পরিচয় করিয়ে দেয় সামহোয়ারের সঙ্গে। ভার্চুয়াল জগতে এতো বাংলা শব্দ, লেখা, মতের সমাহার পেয়ে অত্যন্ত খুশি হই। দিন/রাতের বেশ কিছু সময় ব্যয় হতে থাকে ব্লগিংয়ের পেছনে। নিজেকে লেখক কখনোই ভাবিনি, কিন্তু সামহোয়ারে লিখতে গিয়েই হোঁচট খাই। বেশ কিছু ভালো ব্লগারদের ভিড়ে ছাগুদের ম্যাতকারে বিরক্ত হয়ে বন্ধ করে দেই লেখালেখি। শুরু হয় ছাগু পোন্দানো। রাজাকার বিরোধী আন্দোলনে অনেকেরই সাথী হই, অনেককে সাথে পাই। এখনো চলছে এই রাজাকার ঠ্যাঙ্গানো এবং চলবেই। তবে এ মাসেই বহু আকাংখিত ড্রাইভিং লাইসেন্স পেয়ে যাই। রবার্ট ব্রুসের মতো কঠিন অধ্যাবসায়ে পর পর ৪ বার ফেল করে পঞ্চমবারে ড্রাইভিং লাইসেন্স মিলে। একটা গাড়িও কিনে ফেলি। সে আরেক বিরাট যন্ত্রণার ইতিহাস।



এপ্রিল মাস হলো আমার সবচেয়ে প্রিয় মাস। সারা বছর অপেক্ষা করি এই মাসের ১৪ তারিখের জন্য, পহেলা বৈশাখের জন্য। এদিন বাংলাদেশের সব মেয়েকেই আমার খুব সুন্দর লাগে। সারা দেশ আনন্দে ভাসে। আর এ অতি প্রিয় মাসেই আমি চাকরি হারাই। কারণ খুব স্পষ্ট। জামাত বিরোধীতা ও ধর্মের অতি ব্যবহারের অপকার নিয়ে কথা বলায় দ্বিতীয় স্তরের ম্যানেজমেন্টের রোষের শিকার হই। ১৪ এপ্রিল দেশে থাকার চেষ্টা করি, চাকরি হারানোয় সে প্ল্যান বাদ দেই। দেশে যাওয়া হয় না, কেননা ভিসা সেপ্টেম্বরে শেষ। তখন তো একেবারেই চলে যাব। চাকরি হারানোর মাসে গাড়ি দাবড়ে লন্ডন শহর ঘুরে বেড়াই। সহানুভূতি দেখিয়ে বন্ধুরা তেলের পয়সা দেয়। বার ২/৩ ক্যাবিং করলাম (পরিচিত গন্ডীর মধ্যেই)।



মে মাসে বাসা চেঞ্জ করার পর ১৩ তারিখ আবার চাকরি ফেরত পাই। ওইদিন লন্ডনে বৈশাখী মেলা উদযাপিত হচ্ছিল। বাংলাদেশের বৈশাখি মেলার দিন চাকরি হারিয়ে লন্ডনের বৈশাখি মেলার দিন চাকরি ফিরে পাওয়া কাকতালীয় ঘটনাটা বেশ চমকপ্রদ। কিন্তু চাকরি হারিয়ে এবং এরপরে গাড়ি সংক্রান্ত জটিলতায় আমি প্রচন্ড অর্থকষ্টে পড়ি।



জুন মাসে সচলায়তনে যোগ দেয়া ছাড়া আগস্ট পর্যন্ত আর কোনো উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেনি। লন্ডনে ১২ বছর পর খুঁজে পাওয়া স্কুলজীবনের দুই বন্ধুর সঙ্গে 'কি করা যায় না যায়' অথবা 'বাড়ি কিনব না নতুন কোনো ব্যবসা করব' এই টাইপের আলোচনায় আড্ডার সময়গুলো বেশি কেটেছে।



তবে সেপ্টেম্বর আমার জন্মমাস বলে এপ্রিলের পর এই মাসটা আমার খুব ভালো লাগে। বাংলাদেশে থাকতে সেপ্টেম্বর মাসের ওয়েদারটাও খুব ভালো থাকত। এ মাসে আমার লন্ডন থাকার ব্যবস্থা (ভিসা) পোক্ত হয়।



অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত পুরোটাই নিরামিষ গেছে। বছরের শেষে ডিসেম্বর মাস প্রচন্ড ব্যস্ততায় কেটেছে। এ বছর দেশে যাওয়ার জন্য প্রচুর প্ল্যান করেছি আবার বাতিল করেছি সময় ও পয়সা দুইটা সমন্বয় করতে না পারায়। নতুন বাসায় উঠেছি, রুম গুছিয়েছি। বন্ধু/কলিগরা দেখে আশ্বস্ত হয়েছে। বলেছে - আমি সভ্য হয়েছি।



তবে বছর জুড়েই অন্যান্য প্রবাসীর মতো আমিও বাংলাদেশ মিস করেছি। মিস করেছি সেখানকার মিডিয়াকে। নাটক বানানো ক্ষুধা বেড়েছে কিন্তু মেটানোর সময় হয়ে উঠেনি। সারা বছরই মা-র সঙ্গে ফোনালাপের একটা নির্ধারিত বিষয় ছিল 'আমার বিয়ে' সংক্রান্ত। সেটার এখনো কোনো সুরাহা হয়নি। এ বছর বাবা রিটায়ার করেছে। নিজের কাঁধে আরো একটু দায়িত্ব বেড়েছে। লন্ডনে বন্ধু বান্ধব বেড়েছে, বেশ কয়েকজন মেয়ে বন্ধুও (অন্য কোনো জটিলতা নাই) জুটেছে এবং অতি স্বাভাবিকভাবেই তাদের সঙ্গে আমার ঝগড়াটাই বেশি হয়েছে।



তবে সবকিছুর উপর আমি ব্লগকেই বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভাবছি। খুব অল্প সময়ের মধ্যে (এখনও এক বছরও হয়নি) ব্লগে এতো পরিচিত হয়ে গেছি, এতো ভালো ভালো মানুষের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি, মাঝে মাঝে অবাকই লাগে।



সবাইকে নতুন বছর ২০০৮ এর শুভেচ্ছা।

Friday, 21 December 2007

জনমত জরিপ @ পরবর্তী যাত্রার প্রস্তুতি এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

রংপুর থেকে ফিরে সেদিন আর অফিস যাইনি। বাসায় প্রশ্নপত্রগুলো আরো একবার রিচেক করে পরদিন সকালে অফিসে গেলাম। আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা আগেরদিনই বিভিন্ন জেলা থেকে চলে এসেছে। আমি কাগজগুলো জমা দিয়ে একাউন্ট্যান্টের কাছে গেলাম। রিপোর্ট করলাম আমি একদিন বেশি কাজ করেছি তই পয়সাও একদিনের বেশি দিতে হবে। এটা নিয়ে কিছুক্ষণ বাতচিত চলল। পরে চপল ভাইয়ের (সার্ভে এনালিস্ট, এখন আমেরিকায়) সহায়তায় আমি চারদিনের পয়সা পেলাম। ২৫০ টাকা প্রতিদিন করে ৪ জনের জন্য মোট ৪০০০ টাকা। টাকাগুলো হাতে পেয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম পনির আর মীরাকে তিনদিনের পয়সা দিব। শুধু নীলুকে চারদিনের পয়সা দিব।

বিভিন্ন জনের অভিজ্ঞতার কথা শোনা হলো। এরমধ্যে দুইটি গ্রুপের কথা জানা গেল যারা আদৌ সার্ভে করতে যায়নি। তারা ঢাকাতেই ছিল অথচ কাগজ পূরণ করে দিয়েছে। এইটা খুবই লজ্জাজনক একটি কাজ হয়েছে। আমি ইন্টারেস্টেড ছিলাম জানতে, যেসব গ্রুপে মেয়েরা ছিল সেসব গ্রুপে ইন্টারেস্টিং কিছু ঘটেছে কিনা। দেখলাম তেমন কোনো গল্প নাই। বরং আমার গল্প শুনে বন্ধুরা হতবাক। কেউ কেউ বলে বসল, 'দোস্ত, নীলু তোকে প্রচন্ড লাইক করেছে। প্রেম করলে কইরা ফালা।' বন্ধু জাহিদ তো বলেই বসল, 'দোস্ত নীলুকে বলিস পরের সার্ভেতে ওর কোনো বান্ধবিকে নিতে।'

আমি 'ধ্যাত' বলে ধমক দিলেও মনে মনে হালকা একটু লাড়া কিন্তু ঠিকই খেলাম। 'দূরে কোথাও' নামে একটা গল্প লিখে ফেললাম। ছাপা হলো একটি সাপ্তাহিক পত্রিকায়। নীলুর সঙ্গে যোগাযোগ হলো। টাকা পয়সা দিয়ে বললাম মীরা আর পনিরকে না জানাতে। নীলু আমার গল্প পড়ে অভিভূত হয়ে গেল। টানা একসপ্তাহ তার ডিপার্টমেন্টের নোটিশবোর্ডে গল্পটি ঝুলিয়ে রাখল।

এদিকে নীলুর সঙ্গে বেশ ভাব হয়ে গেল। প্রতি বৃহস্পতিবার আমি জাহাঙ্গীরনগর যেতে শুরু করলাম। পল্টনে অফিস হওয়াতে আমি ওসমানী উদ্যান থেকে উঠতাম। প্রথম প্রথম গেস্ট হিসেবে ৩টাকা দিয়ে যেতাম। পরে যাতায়াতের মাত্রা বেড়ে যাওয়াতে ১টাকা করে দিতে শুরু করলাম। মামুরা টের পেত কিনা জানি না, তবে কোনোদিন প্রশ্নের সম্মুখীন হইনি। এছাড়াও জাহাঙ্গীরনগরের অনেকের সঙ্গেই তখন পরিচয় ছিল।

প্রশ্ন এবং উত্তরগুলোর কোডিং শেষ করে ডাটা এন্ট্রির কাজ শুরু হয়ে গেল। সেখানেও পয়সা। প্রতিটি প্রশ্নের ডাটা এন্ট্রির জন্য ১০ পয়সা করে। কিন্তু আমার টাইপিং স্পিড খুবই বেশি হওয়াতে এখানেও আমি অনেক টাকা ইনকাম করে ফেললাম। একমাস পরে সাপ্তাহিক পত্রিকায় রিপোর্ট প্রকাশ হলো। সাংবাদিক সম্মেলনে ঘোষণা হলো নির্বাচনের ঠিক একমাস আগে আরেকটি সার্ভে শুরু হবে।

এনজিওটিতে তখন আরো অনেক ছাত্রছাত্রী বেড়েছে। তাই সিদ্ধান্ত হলো পরের সার্ভেতে জাহাঙ্গীরনগরের ছাত্রছাত্রীদের অংশগ্রহণ কমানো হবে। এটা শুনে আমি তো খুবই দুঃখিত। নীলুকে নিব কিভাবে? নীলুকে বলে রেখেছি এবং সেও যেতে আগ্রহী। বন্ধু জাহিদের পরামর্শে নীলু তার এক বান্ধবীকেও রাজি করিয়েছে।

চপল ভাইয়ের শরাণাপন্ন হলাম। চপল ভাই পরামর্শ দিলেন এমন একটা জেলা পছন্দ করতে যেখানে বর্তমান ছাত্রছাত্রীরা যেতে চাইবে না। আমার আইডিয়াটা খুবই পছন্দ হলো। নরমালি আমিও একটা ব্যকওয়ার্ড জায়গা খুঁজছিলাম যেখানে কেউই যেতে চাইবে না। লিস্ট খুঁজে আমি পিরোজপুর (মঠবাড়িয়া) পছন্দ করলাম। কেননা এর আগে যারা ওই জায়গায় যারা গিয়েছিল তারা জায়গাটার খুবই দুর্নাম করেছে। আর তাতেই আমি আরো উৎসাহী হয়েছি। নীলুকে বলতেই মুখ গোমড়া করল,

- পিরোজপুর! এতোদূরে কেন যাব?
- আরে কি যে বলো না। দূরে তো ভালোই।
- চিনি না তো। তুমি চিনো?
- আমি কি করে চিনব? গিয়েই চিনে নেব।
- না ভরসা পাচ্ছি না।
- আরে ধুর, আমি আছি না। চলো যাই।
- উহু। তুমি কি সামলাবে আমার জানা আছে।
- গেলে চলো। নাহলে নাই।
- আচ্ছা পরে জানাব।

আমি মেজাজ খারাপ করে চলে আসি ওইদিন জাহাঙ্গীরনগর থেকে। আমার উপর ভরসা করতে পারছে না। কিন্তু পরের বৃহস্পতিবারে নীলু কনফার্ম করে সে পিরোজপুর যাবে, সাথে তার আরেক বান্ধবি সুমি।

ঠিক হলো আমি, নীলু, সুমি আর বন্ধু জাহিদ যাব। একটা বড় গ্রুপ তৈরি হলো দক্ষিণাঞ্চলের জন্য। সবাই মিলে ঠিক করলাম খুলনা পর্যন্ত (বাগেরহাট আর পিরোজপুর) তিনগ্রুপ একসঙ্গে যাব। মোট ১২ জনের জন্য সম্ভবত খালেক এন্টারপ্রাইজের টিকেট কাটা হলো। সবাই রাত নয়টায় গাবতলী থেকে উঠবে। আমি শুধু নীলু আর সুমিকে নিয়ে জাহাঙ্গীরনগরের প্রান্তিক থেকে উঠব। জাহিদ আগে থেকেই বাসে থাকবে।

যাত্রার দিন ছিল প্রচন্ড ঝড়। আমি আটটার সময়ই জাহাঙ্গীরনগর চলে এলাম। ২ নম্বর হলে নীলুকে কল দিয়ে দেখি সে নাই। কই গেল? গেলাম সুমির বাসায় (টিচার্স কোয়ার্টার, প্রান্তিক ঘেষা)। সুমিকে জিজ্ঞেস করতে বলল, নীলু তো ব্যাগ গুছিয়ে রেখেছে। আছে হয়তো আশেপাশে। আপনি অপেক্ষা করেন।

আমি আবার হলগেটে ফিরে এলাম। ঝড় বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আমি আবারও কল দিলাম নীলুকে। হয়তো হলের অন্য কোনো রুমে আছে, এখন রুমে ফিরতে পারে। কিন্তু হতাশ। নীলু নেই। প্রচন্ড বাতাস আর বৃষ্টির মধ্যে আমি কোনোমতে ট্রান্সপোর্টে দাঁড়িয়ে আছি। রাত বাজে পৌণে নয়টা। সাড়ে নয়টায় প্রান্তিকে বাস আসবে।

রাত নয়টার দিকে আরেকবার গেলাম হলগেটে। গেটের কাছে দাঁড়িয়ে আছে এমন সময় কিছু খালা (হলের আয়া) হুড়মুড় করে ভেতর ঢুকতে লাগল। আমি নীলুর কথা জিজ্ঞেস করতেই বলল, আফা তো বিকালেই বাইরে গেছে। আমি টেনশন নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। এমন সময় সুমি এলো, হাতে ব্যাগ।

- নীলুর কোনো খোঁজ পেলে?
- এখনো আসেনি? আমি তো আরো ব্যাগ নিয়ে চলে এলাম।
- ভালো। তুমি একটু খোঁজ নেও তো অন্য কোনো রুমে আছে নাকি।
- দেখছি।
- আচ্ছা শোনো নীলু যদি না যায় তুমি যাবে তো?
- না ভাইয়া। নীলু না গেলে তো আমি যাব না।

আমি চরম বিপদ দেখলাম। দুইজন মিলে সার্ভে করব কেমনে? ঘড়িতে অলরেডি সোয়া নয়টা। অস্থিরভাবে পায়চারি করছি। বৃষ্টিতে প্রায় ভিজে গেছি। সিগারেটও ধরাতে পারছি না। দমকা হাওয়া আর বৃষ্টি পড়ছে মুষলধারে। লম্বা লম্বা গাছগুলো নুয়ে পড়ছে মাটিতে ঝড়ের দাপটে। আমি মনে মনে প্রার্থনা করতে থাকি গাবতলী থেকে বাস যেন দেরিতে ছাড়ে।

অনেকক্ষণ পর হলগেটের ওপাশ থেকে এক খালা বলে উঠল, আর মামা যে ভিজতাছেন, ভিতরে আইয়া বসেন।

গেট খুলে দিলে আমি ২ নম্বর হল (ফজিলাতুন্নেসা)-এ ঢুকলাম। অন্ধকার, কারেন্ট ছিল না। আমি বামের গেস্টরুমের দিকে এগোলাম। দরজা ঠাহর করে সেদিকে এগোলাম। দরজা দিয়ে ঢুকতেই হোঁচট খেলাম। একটা চেয়ার দরজার মুখেই। আমার হাতপা ব্যথা করছিল। আমি সেই চেয়ারটিতে বসে পড়লাম। অপেক্ষা করতে লাগলাম নীলুর জন্য।

সম্ভবত ঠিক পনের মিনিট পরেই একটি মেয়ে হন্তদন্ত হয়ে ঢুকল। চেঁচিয়ে বলল, খালা গেস্টরুমটা খুলে দাও। আমার আব্বা এসেছেন। শুনেই আমি তড়াক করে লাফিয়ে উঠলাম। গেস্টরুম খুলতে বলছে তাহলে আমি কোন রুমে বসে আছি?

চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই বুঝলাম এইটা সম্ভবত টয়লেট। একটা বেসিন কি দেখতে পাচ্ছি? ততোক্ষণে খালা গেস্টরুম খুলে দিল। আমিও ওই মেয়েটার বাবার সঙ্গে গেস্টরুমে গিয়ে বসলাম। পুরো মেজাজ খারাপ। খালা এসে মোমবাতি জ্বালিয়ে দিয়ে গেল। ঘড়িতে তখন সাড়ে নয়টা। এসময়টাতেই প্রান্তিকে বাস আসার কথা। কি করব? নীলুর আশা ছেড়ে দৌড়ে যাব প্রান্তিকে?

এই ভাবনার ঠিক পাঁচ মিনিট পর নীলু হলে ঢুকল। গেটের কাছে খালাকে জিজ্ঞেস করল, আমার কাছে কেউ এসেছিল? খালা আমাকে দেখিয়ে দিল। আমি তখন মেজাজ খারাপ করে বললাম, জলদি ব্যাগ নিয়ে এসো। বাস চলে আসছে।

নীলু দৌড়ে হলের দিকে চলে গেল। আমি তখন ঠান্ডায় আর টেনশনে কাঁপছি। এখন যদি গিয়ে যদি বাস না পাই? ১৯৯৬ সাল। বাসে আমাদের গ্রুপের কারোরই তখন কোনো মোবাইল ছিল না।

Saturday, 8 December 2007

জনমত জরিপ @ রংপুর থেকে ঢাকা

আগের পর্বে উল্লেখ করেছিলাম রাতেই আমরা আগমনী বাসে রংপুর থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিই। কিন্তু এখন লিখতে বসে, স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মনে হচ্ছে আসলে আমরা ভোরের বাসটিতেই রওনা দিয়েছিলাম। ওটা ধরেই লিখতে শুরু করলাম ...

এবার বাসে আমাদের সিট ছিল শেষের ৪টি। এরশাদের কল্যাণে বৃহত্তর উত্তরাঞ্চলের রাস্তাগুলো বেশ মসৃণ হওয়াতে আমাদের অসুবিধা হচ্ছিল না। কিন্তু যতোই ঢাকার দিকে এগুচ্ছিলাম, বুঝতে পারছিলাম ঝাকানাকার পরিমাণ বাড়তেই থাকবে।

আমি আর নীলু যথারীতি পাশাপাশিই বসেছিলাম। রাতের বাসে রংপুর গিয়েছিলাম বলে কিছুই দেখতে পাইনি। তাই এবার মন ভরে রাস্তার দুপাশের সৌন্দর্য্য দেখতে দেখতে যাচ্ছি। জার্নি আমার বরাবরই পছন্দ। এতে আমি কোনো ক্লান্তি অনুভব করিনা। আমি দেখেছি জার্নির সময়ই আমি অনেক ভালো ভালো চিন্তা করতে পারি। আমার মধ্য কিটিবিটি (ক্রিয়েটিভি) জেগে উঠে। অনেকের আবার টয়লেটে এ ব্যাপারটা ঘটে। কোথায় যেন পড়েছিলাম কোন এক লেখিকার নাকি সঙ্গম শেষ হবার ঠিক পরমুহূর্তেই ব্যাপারটি ঘটে।

সৌন্দর্য্য নাকি বেশিক্ষণ উপভোগ করা যায় না। তাই বোর হবার আগেই নগরবাড়ি ঘাটে পৌঁছে গেলাম। হাতপা ঝাড়তে ফেরিতে বেশ কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করলাম, ভাত-মাংস খেলাম। ইচ্ছে ছিল কান পরিষ্কার করে নিব। কিন্তু অসাবধাবশত যদি ফুটো করে দেয় সে ভয়ে আর দ্বিতীয় চিন্তা করিনি।

নগরবাড়ি থেকে বাসে আবার রওনা শুরু করলাম। বড়রাস্তায় উঠতেই পনির বলল, আচ্ছা আমাদের টাকাপয়সার হিসেব তো করা হলো না।

আমি বললাম, আমি ঢাকায় গিয়ে অফিসে রিপোর্ট করব। তারপর আপনাদের প্রতিদিনকার হিসেবে যা পাবেন তা দিয়ে আসব।
- সেটা তো দিবেই। কিন্তু আমি বলছি, আমাদের খরচের যে টাকা দিয়েছিল ওটা তো পুরো খরচ হয়নি।
- না তা খরচ হয়নি।
- গুড। তাহলে এখন ৪ ভাগ করে ফেল।
- কিন্তু খরচ তো হয়নি। তাহলে অফিসে ফেরত দিতে হবে না?
- কিসের ফেরত! হোটেলে থাকলে তো খরচ হতোই। ভাবো না কেন আমরা হোটেলেই থেকেছি।

আমি গম্ভীর ভঙ্গিতে মাথা নাড়িয়ে সায় দিলাম। তারপর বাকিটাকা গুলো ৪ভাগ করে সবাইকে দিয়ে দিলাম। আমি অবশ্য চেয়েছিলাম টাকাগুলো অফিসে ফেরত দিব। মনে হচ্ছিল জোচ্চুরি করে অফিসের টাকাটা মেরে দিচ্ছি (পরে অবশ্য এ সংক্রান্ত যাবতীয় শংকা আমার আর ছিল না, অফিসে আর কখনোই আমি জরিপ সংক্রান্ত কোনো টাকাপয়সা ফেরত দিইনি)।

ঘুম ঘুম পাচ্ছিল। মানিকগঞ্জের কাছাকাছি চলে আসছে বাস। নীলুর দিকে তাকিয়ে দেখি অহরহ পড়ছে। আমি ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। আসলে ঘুমের চেয়ে কম, তন্দ্রার চেয়ে বেশি।

বেশ কিছুক্ষণ পর টের পেলাম আমার সারা মুখেচোখে হাতের পরশ। সারাগাল বুলিয়ে ঠোঁটের কোণ ঘেষে হাত চলে যাচ্ছে চুলে। আমি চমকে উঠলাম। স্বপ্নে কোনো পরীটরী দেখছি না তো। বেশকিছুক্ষণ এই হাতের পরশ অনুভব করে আমি পরীটাকে চিনতে পারলাম, নীলু। কিন্তু কারণটা কি? আমারে এতো সোহাগ করছে কেন?

বৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু ঠান্ডা তেমন না। বাসের বেশ কয়েকটা জানালা খোলা। রংপুরের ডাইরেক্ট বাসের বেশিরভাগ যাত্রিই নির্জীব হয়ে আছে। দ্রুতগতিতে পার হয়ে যাওয়া বাইরের অতিসবুজ গাছগুলো (বৃষ্টির কারণে) বাতাসকে ঠেলে বাসের ভিতরে ঢুকিয়ে দিচ্ছে। চোখ বন্ধ করে আমি টের পেলাম নীলু যেন আরো একটু ঘেঁষে বসল আমার সাথে।

ঘটনা যাই ঘটুক, আমি চোখ খুলছি না। কিছুক্ষণ পর অনুভব করি আবার চোখেমুখেচুলে হাত বুলাচ্ছে নীলু। বাস তখন মানিকগঞ্জ ছেড়ে এসেছে এবং প্রচন্ড ঝাঁকুনি হচ্ছে। তারপরও আমি চোখ খুলছি না, যদি নীলু আর হাত না বুলায়। এভাবেই চলছিল কিন্তু হঠাৎই বাসটা চরম ঝাঁকুনি খেলো। মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল। চোখ খুলে ফেললাম। না খুলে উপায় ছিল না। এমন ঝাঁকুনিতে, খোদার কসম, খোদ শয়তানও চোখ বন্ধ করে ঘুমের অভিনয় করতে পারত না।

আমি তাকিয়ে দেখি নীলু তখনও অহরহ পত্রিকা মুখের সামনে ধরে আছে। বাতাসে তার কানের পাশের চুলগুলো উড়ছে। আমি বললাম, হাই।
- বাবা যা ঘুমালে না।
- হুম। কিন্তু বাসের ঝাঁকুনিতে তো ভেঙ্গে গেল।
- ভালোই হয়েছে আর ২০ মিনিট পরে নেমে যাব।
- ঢাকা চলে এসেছি নাকি।
- ঢাকা না। ইউনিভার্সিটি নেমে পড়ব আমরা সবাই। পনির ভাইকে জাগাও।

যা শালা। কই আমি ভাবলাম আবার একটু ঘুমানোর ভান করব। আফসোস করে পনির ভাইকে ডেকে তুললাম। নীলু কাছ থেকে হলের নাম, রুমের নম্বর সব জেনে নিলাম। প্রান্তিক আসতেই সবাই নেমে পড়ল।

গাবতলী আসার আগ পর্যন্ত আমি নীলুর এ আচরণ নিয়ে অনেক ভাবলাম। রংপুরে যে কয়দিন ছিলাম, কখনো তো নীলুকে দেখে কিছুই বুঝতে পারিনি। তবে নীলু কি আমার প্রেমে পড়েছে? মনে হয় না। কিন্তু নীলু কেন এরকমটা করল? আমি পুরো বিষয়টা ভাবতে থাকি ...

0. মাত্র বৃষ্টি হওয়াতে বাইরের প্রকৃতি ছিল খুবই সুন্দর।
0. সঙ্গে সুন্দর বাতাস বইছিল, ঠান্ডা নয়, কিন্তু ভাবটা শিহরণের।
0. বাসের ওই সময় বেশিরভাগ যাত্রীই ঘুমিয়ে ছিল। যারা জেগে ছিল তাদেরও পিছু ফিরে তাকানোর কথা না। পনির ও মীরাও ঘুমিয়ে ছিল।
0. অহরহ পত্রিকার ওই সংখ্যায় কি নারীপুরুষের ভালোবাসা সংক্রান্ত কোনো বৈজ্ঞানিক আর্টিকেল ছাপা হয়েছিল?
0. ঘুমন্ত আমাকে দেখতে কেমন লাগছিল? এটা কি নীলুকে প্রভাবিত করেছিল?
0. নাকি নীলু একটু ফান করল?

সবকিছু ভেবে আমি ধরে নিলাম এটা তেমন কিছুই না। পারিপার্শ্বিক অবস্থা, প্রকৃতি, কয়েকদিনের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের কারণে ওই সময় নীলুর মনটা তরল হয়ে গিয়েছিল। এবং ওই মুহূর্তেই তার পাশে একজন তরুণকে দেখে তার ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করছিল। হয়তো পনির-মীরার ঘনিষ্ঠতা দেখে তারও মনে একটু ইচ্ছে, অন্যরকম রসায়ন জেগেছিল। নীলু আমার প্রেমে পড়ে যায়নি। আর এ বিষয়টা আমি বেশ কিছুদিন পরে নিশ্চিত হলাম যখন জানতে পারলাম দীপুর সঙ্গে নীলুর প্রেমের সম্পর্ক অনেকদিনের।
-------------------------------------------------------
পোস্টে সবার ছদ্মনাম ব্যবহার করা হয়েছে।

Wednesday, 28 November 2007

Pls Help SIDR Victims

জনমত জরিপ @ রংপুরের পথে পথে : ০২

জীবনের প্রথম ছিল বলে প্রথমদিন বেশ কষ্ট হয়েছিল জরিপ করতে। এছাড়াও ছিল আগের রাতের জার্নির ক্লান্তি। কিন্তু একরাত ভালো করে ঘুমিয়ে এবং হালকা অভিজ্ঞতা হয়ে যাওয়ায় দ্বিতীয়দিনের কাজে তেমন কষ্ট হয়নি।

যথারীতি ঘুম থেকে উঠে আমি আর নীলু বেরিয়ে পড়লাম নতুন আরেকটা গ্রামের উদ্দেশ্যে সেই পুরোনো রিকশাওয়ালাকে নিয়ে। পনির ভাইয়ের পেটের অবস্থা আজকে বেশ ভালো। সে মীরাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। আমরা প্রায় দেড়ঘন্টা পরে গ্রামে গিয়ে পৌঁছলাম। এই দেড়ঘন্টা নীলুর সঙ্গে গল্প করে কাটল। আজকে নীলু পড়েছে ঘিয়েশাদা সালোয়ার কামিজ। সুন্দর লাগছিল তাকে।

গ্রামে পৌঁছেই আমরা আগের মতোই রিকশা ছেড়ে দিলাম। প্রথমদিন আমি বা নীলু যেই ইন্টারভিউ করেছি, আরেকজন সেটা শেষ হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতাম। আজকে ঠিক করলাম এভাবে না করে আমরা দুজনেই আলাদা আলাদা করে গ্রামে ঘুরব। এতে একই সময়ে দুইটা ইন্টারভিউ শেষ করা যাবে। ঠিক করা হলো নীলু বেশি বেশি করে মহিলাদের ইন্টারভিউ নিবে, ফাঁকে ফাঁকে পুরুষদের। দুজনে দুদিকে ছিটকে গেলাম।

পদ্ধতিটা বেশ কাজে দিল। খুব দ্রুত ইন্টারভিউ নিতে পারছি। বেশ পটু হয়ে গেছি। প্রথমদিন প্রশ্ন করে নির্লিপ্তগলায় উত্তরগুলো বলে অপেক্ষা করতাম। কিন্তু আজকে গল্পচ্ছলে প্রশ্ন করা এবং উত্তর আদায় করতে থাকলাম। এতে দেখা গেল লোকজন আন্তরিকতার সঙ্গে অংশ নিতে পারছে। কিন্তু একটা বিপদও হলো তাতে। এই গল্পচ্ছলে ইন্টারভিউ তো নেয়া যাচ্ছে, কিন্তু তা শেষ করে উঠতে চাইলে আবার বসিয়ে দিয়ে শুরু করে দেয় রাজনৈতিক কেচ্ছাকাহিনী। উঠিউঠি করলে চা-সিগারেট সাধে। সমস্যা এই পর্যন্ত হলেই হতো। কিন্তু গল্পের একপর্যায়ে আমারও মতামত জানতে চায়। তখন খুব কায়দা করে পাশ কাটাতে হয়।

এবার একটা ভয়ের ঘটনা বলি। ভয়ের ঘটনা কারণ আমি ভয় পেয়েছিলাম। গ্রামে কিছু টাউট টাইপের লোক থাকে। এদের কাজই ঝামেলা পাকানো। তো ওইদিন একটা বাড়ির পাশে গাছতলায় দাঁড়িয়ে এক কৃষকের ইন্টারভিউ নিচ্ছিলাম, হঠাৎই একটা লোক এসে আমার হাত থেকে ফাইলসহ সব কাগজ কেড়ে নিল। আমার হাত থেকে কলম পড়ে গেল। লোকটি ধমক দিয়ে বলল, এ্যাই আপনাদের কে পাঠিয়েছে?

আমি হতচকিত হয়ে গেলাম। আশেপাশে দুয়েকজন লোক দেখা যাচ্ছে। সবাই কি আমাকে মার দেবে বলে একাট্টা হয়েছে? আমি লোকটির দিকে তাকালাম। তেল চপচপে চুলে কায়দা করা সিঁথি করা হয়েছে। কিন্তু পরণের স্যান্ডো গেঞ্জিতে ছেড়া রয়ে গেছে। চেক লুঙ্গি পরা, পায়ে স্যান্ডেল। লোকটির সঙ্গে আমর কথোপকথন ছিল নিম্নরূপ,

- এ্যাই, আপনাদের কে পাঠিয়েছে?
- আমরা ঢাকা থেকে অমুক সংগঠনের পক্ষ থেকে এসেছি।
- কি কাম করতাছেন?
- এই যে সামনে নির্বাচন। এইটা নিয়া আপনাদের চিন্তাভাবনা কি সেটা জানার জন্য। পরে এটা আমরা পত্রিকায় প্রকাশ করব।
- আমারে বুঝ দেন, না? এইটা করতাছেন এরশাদরে জেলে আটকাইয়া রাখার জন্য।
- না না। কি যে বলেন আপনি।

আশেপাশের লোকজন আমাকে ততোক্ষণে সাপোর্ট করা শুরু করছে। দুয়েকজন ওই টাউট লোকটাকে ধমকও দিল আমার সঙ্গে এরকম ব্যবহার করার জন্য। সেসব দেখে একটু সাহস পেলাম। কিন্তু লোকটি তখন বলছে,

- আরে তোমরা বুঝো না। এরা আইছে এরশাদের বিরুদ্ধে রিপোর্ট দেয়ার লাইগা। ঘুইরা ঘুইরা সব জাইন্যা লইতাছে। এরশাদরে আরো জেল দিব।

লোকটার এইসব কথা আশেপাশের কারোরই বিশ্বাস হলো না। ওদের চাপাচাপিতে সে কাগজপত্র, ফাইল আমাকে ফেরত দিল। তারপর জিজ্ঞেস করল,

- আপনের লগের ওই মাইয়াডা কি আপনার বউ?
- জ্বি না। আমার বোন।
- ও আইচ্ছা। এর লাইগ্যাই চেহারায় এতো মিল।
- জ্বি।
- দেইখেন উল্টাপাল্টা কিছু কইরেন না।


লোকটা চলে গেলে সেযাত্রায় মুক্তি পেলাম। তবে আমি কিন্তু প্রথমে ভড়কে গিয়েছিলাম। অবশ্য ভবিষ্যতে এরচেয়েও খারাপ অবস্থায় পড়েছি। সেটা আরেক পোস্টে আলাপ করা যাবে।

প্রশ্নপত্রে একটা প্রশ্ন ছিল এরকম যে, আগামীকাল ভোট হলে আপনি কাকে ভোট দেবেন? এই প্রশ্ন শুনে উত্তরদাতা আমতা আমতা করত। কিন্তু প্রশ্নের উত্তর তো আমার চাই। বিশেষ করে এ প্রশ্নটায় অনেক বোঝাতে হতো। অনেক সময় উত্তরদাতার অন্যান্য উত্তর যাচাই করে একটা উত্তর ধরে নিয়ে সেটা নিশ্চিত হওয়ার জন্য আরো কিছু প্রশ্ন করে সিওর হতে হতো। কিন্তু কোনোভাবেই গলার স্বরে কোন দলের পক্ষে বিষয়টি চলে যায় কিনা সেটা খেয়াল রাখতে হতো। পরে অবশ্য খুব ভালো করেই এ প্রশ্নটার উত্তর আদায় করতে পারতাম। খেয়াল করেছি খুবই ক্যাজুয়ালি প্রশ্নটা করে ফেললে উত্তরদাতা আরো ক্যাজুয়ালি উত্তর দিয়ে দিতেন। অনেকে বলতেন, কিভাবে বলব ভাই, ভোটের আগের দিনও তো মাইন্ড চেঞ্জ হইতে পারে। সেক্ষেত্রে তাদের বলা হতো, আপনি আপনার মাইন্ড চেঞ্জ করবেন কিনা সেজন্য আপনাকে আরো ১০ মিনিট সময় দিলাম। এখন বলুন। তখন উত্তরদাতা কিছুক্ষণ চিন্তা করেই বলে দিতেন। ১০ মিনিট সময়ও নিতেন না। এরকম বিভিন্ন তরিকায় উত্তরটা জেনে নিতাম। তবে এইটার একটা বিপদও ছিল। ধরেন অনেকের মাঝে একজন উত্তর দিচ্ছেন। দেখা গেল আশেপাশে বিএনপির লোকজন বেশি থাকায় উত্তরদাতা বিএনপির নাম বলল। পরে অনেকক্ষণ পর আমাকে আরেক জায়গায় পেয়ে বলল, ভাই ওইসময় বিএনপি বলছি। আমি কিন্তু আসলে আওয়ামী লীগরে ভোট দিমু। আমরা শুধুমাত্র উত্তরদাতার নাম জানতে চাইতাম, ঠিকানা নিতাম না। তখন নাম খুঁজে শিট বের করে ঠিক করে নিতাম।

কিছু কিছু ইন্টারভিউ নেয়ার পর আমরা বাসায় গিয়ে সেগুলো ছিঁড়ে ফেলে দিতাম। কেউ কেউ ফাজলামো করার জন্য একেকটা প্রশ্নের জন্য আলতু ফালতু উত্তর সিলেক্ট করতেন। যেমন, তিনি বিএনপি সাপোর্ট করেন, পছন্দ করেন আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে কিন্তু আগামীকাল ভোট হলে জামাতকে ভোট দেবেন। এছাড়াও আলাদাভাবে কিছু লেখার জায়গা থাকলে সেখানে আজে বাজে কমেন্ট করত। আমরা সেসব প্রশ্নপত্রে খুব কৌশলে একটা চিহ্ন দিয়ে রাখতাম যেন পরে ফেলে দেয়ার জন্য সহজেই খুঁজে পাই।

তারপরও এসব ঝামেলার মাঝে বেশ জরিপ করে যাচ্ছি। গ্রামের বিশুদ্ধ বাতাসে হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে গেলে কোনো গাছের ছায়া কিংবা বাড়ির দাওয়ায় বসে জিরিয়ে নিতাম। বাংলা ফাইভের ধোঁয়া উড়িয়ে লোকজনের সঙ্গে গল্প করতাম। তখন আর জরিপ প্রসঙ্গ থাকত না, তাদের জীবনের গল্প শুনতাম। নীলু আলাদাভাবে ইন্টারভিউ করছে, মাঝে মাঝে তার সঙ্গে দেখা হতো। যে বাড়ির দাওয়ায় বসে সিগারেট খাচ্ছি, দেখা গেল ইন্টারভিউ শেষ করে ওই বাড়ি থেকে নীলু বেরিয়ে আসছে।

এবার একটা হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া ঘটনা বলি। দুপুরে আমি আর নীলু আবার একত্র হয়েছি। এক বাড়িতে নীলু তখন সবেমাত্র ইন্টারভিউ শেষ করেছে। আমরা আরেকদিকে যাব তখন গৃহকর্তা দুপুরের খাবারের কথা বলল। আমাদের তখন খাওয়ার ইচ্ছা বা সময় কোনোটাই ছিল না বলে লোকটাকে নিরুৎসাহিত করার চেষ্টা করি। কিন্তু লোকটি না শুনতে চাইছে না। তাই এড়িয়ে যাওয়ার জন্য বললাম, আচ্ছা যদি সময় পাই তাহলে খেতে আসব। মনে মনে কিন্তু সিদ্ধান্ত নিলাম আসব না।

কাজ করতে করতে কখন যে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেছে টের পাইনি। এইদিন কাজ খুব তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেল। আমরা ফিরছি রিকশা নিয়ে (রিকশা যথারীতি আগেরদিনের মতো ব্যবস্থাপনায় ছিল), ওই লোকটি আমাদের থামাল। বলল, আপনেরা খাইতে আইলেন না যে। আমি তো মুরগী রান্না করছি। আমরাও কেউ খাই নাই।

এই কথা শুনে কেউ খেতে না গিয়ে পারে? আমরাও লজ্জিত ভঙ্গিতে, ভুলে গিয়েছিলাম ভাব নিয়ে খেতে চললাম। খাওয়া দাওয়া শেষ করে নীলু আর আমি দুজনেই কুণ্ঠিত ছিলাম। বেচারা এমনিতেই গরিব। মুরগী হয়তো ওই একটাই ছিল। মেহমান খাওয়ানোর নামে দিছে জবাই কইরা। আহারে, এমন আতিথেয়তা বাংলাদেশ ছাড়া আর কোথায় মিলে?

শহুরে সভ্য আমরা দুইজন খাওয়া দাওয়া শেষ করে লোকটির হাতে বেশকিছু টাকা জোর করে গছিয়ে দিলাম। যদি পারে তবে আরেকটি ডিমপাড়া মুরগী কিনে নিক। এই ঘটনাটা আমাকে খুব তোলপাড় করেছে। 'বাংলাদেশ আতিথেয়তায় সেরা' কথাটির ব্যবহারিক প্রমাণে আমি মুগ্ধ হয়ে যাই। এই আতিথেয়তা আরো অনেক জায়গাতেই পেয়েছি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অবশ্য বাড়াবাড়ির পর্যায়েও চলে যেত।

কাজ শেষ করে আমি আর নীলু ফিরছি। সাথে ক্যামেরা ছিল না আমাদের কারোরই। তাই একটা অসম্ভব সুন্দর দৃশ্য আমি ধরে রাখতে পারিনি। কিন্তু মনের ক্যামেরায় (অবশ্য সেটা ভিডিও) আজীবন থাকবে। দৃশ্যটি হলো, একটা ধানক্ষেতের আইলে একটা গাছ, সেথায় এক বৃদ্ধ খালি গায়ে বিশ্রাম নিচ্ছে, গামছা নাড়িয়ে বাতাস করছে নিজেকে। আর পাশেই একটা বাছুর জিভ দিয়ে তার পিঠ চেটে দিচ্ছে। ওয়াও, আমরা রিকশাটা থামিয়ে দেখতে থাকি। প্রায় ৩/৪ মিনিট পর বাছুরটি কৃষকের পিঠ চাটা বন্ধ করে। মুগ্ধ হয়ে আমরা দৃশ্যটি দেখলাম।

সেদিনই আমরা ৪ জন গাইবান্ধার ধাপ এলাকায় চলে যাই। এখানেও পনির আর মীরা তাদের আরেক সহপাঠিনীর বাসা খুঁজে বের করে। ধাপ এলাকাটা আমার ভালোই লাগল। একটা রাস্তা আছে যার দুপাশে সারি সারি ফার্মেসীর দোকান। আমরা ওই রাস্তারই আশেপাশের কোনো একটা বাড়িতে ছিলাম। ধাপ থেকে একটা 'সাপ্তাহিক চলতিপত্র' (তখন মাত্র বেরিয়েছে) আর নীলুর জন্য 'অহরহ' (বিজ্ঞান পত্রিকা, এখন আছে কিনা জানি না) কিনলাম। ধাপের বাড়িটা খুব সুন্দর ছিল। মফস্বলের ছোট ছিমছাম দোতলা বাড়ি। সামনে খেলার মাঠ। আমরা বাড়িটার ছাদে আড্ডা মারলাম। নীলুর সঙ্গে সখ্যতা আরো গড়ে উঠল। এখন আমি তার হাতও ধরতে পারি। সে বাড়িতে রাতের খাবারটাও খুব ভালো হলো।

পনির ভাইয়ের কিসব থিসিস নাকি জমা দিতে হবে। তাই পরদিনই রাতের ঢাকার টিকেট কেটে ফেললাম। টিকেট পাওয়া যাচ্ছিল না এতো অল্প সময়ে। তখন দুইটা বাস রংপুর লাইনে ভালো ছিল। একটা হলো কিষাণ (যেটায় এসেছিলাম), আরেকটা আগমনী। আমরা আগমনী বাসের শেষ চারটা সিট পেলাম। ঠিক হলো পরদিন রংপুর শহরের কিছু জায়গা ঘুরে বাসে উঠে পড়ব।

তখনও বুঝতে পারিনি আগমনী বাসের এই জার্নিটা আমার জন্য কিসের আগমনী বার্তা নিয়ে আসছে।

Tuesday, 27 November 2007

জনমত জরিপ @ রংপুরের পথে পথে : ০১

আমাদের যাবার কথা ছিল পীরগঞ্জ। সংসদীয় আসনে এটি রংপুর-৬। যতোদূর মনে পড়ে এরশাদের নির্বাচনী এলাকা। অংপুরের ছাওয়াল তো এমনি এমনিই পাস করবে অথচ এই আসনটি কিভাবে মার্জিনাল হলো আমি বুঝতে পারি না।

বাসস্ট্যান্ডে নেমে প্রথমেই নাস্তা করে নিলাম। সারারাত বাসজার্নির পর সকালের নাস্তাটা ভালোই লাগে। মাংস, ভাজি আর ডিম সহযোগে পরোটা খেয়ে ফেললাম গোটা চারেক। তারপর চা-সিগারেট খেয়ে পনির ভাইকে বললাম, চলেন হোটেল ঠিক করি। পনির ভাই আশ্চর্য হয়ে বলল, কিসের হোটেল? যাব তো পীরগঞ্জে। রংপুরে হোটেলে থেকে প্রতিদিন আসাযাওয়া করতে পারব না। পীরগঞ্জ এখান থেকে অনেক দূর।

খোঁজখবর নিয়ে একটা লোকাল বাসে উঠে পড়লাম। সম্ভবত ৩০ মিনিট পরেই পীরগঞ্জ পৌঁছে গেলাম। পনির আর মীরা পীরগঞ্জেই খুঁজে পেতে বের করে ফেলল তাদের জাহাঙ্গীরনগরের এক সহপাঠীর বাসা। বাসায় সামনে যেতেই এক ভদ্রলোক সম্ভাষণ জানিয়ে ভেতরে নিয়ে গেলেন, থাকার জায়গা দেখালেন। আমি খুবই অবাক হলাম। পরে জানতে পেরেছিলাম যে, পনির ভাই আগেই জানতেন তিনি পীরগঞ্জ আসবেন আর তাই সহপাঠীকে বলে তাদের বাসায় থাকার ব্যবস্থা করে রেখেছেন। আমিও খুশি হলাম। অনেকগুলো টাকা বেঁচে যাবে।

যে কোনো আসনে যাওয়ার আগে ওই আসনের ইউনিয়নগুলো সম্পর্কে খোঁজখবর নেয়া হতো। ভোটের ব্যবধান সবচেয়ে কম হয়েছে যেসব ইউনিয়নে সেগুলোর কয়েকটা গ্রামে জরিপ করতে হবে। আমাদের মোট প্রশ্নপত্র ছিল ৪০০টি। অর্থাৎ প্রত্যেকর ভাগে ১০০টি করে। প্রথমদিনের জন্য আমরা প্রত্যেকেই ৫০টি করে প্রশ্নপত্র (কিছু এক্সট্রা) নিয়ে বের হলাম। পনির ভাই আর মীরা এক গ্রুপে এবং আমি আর নীলু আরেক গ্রুপে। পনির ভাইয়ের হাতে ৩০০ টাকা দিলাম সারাদিনের খরচের জন্য। দুইটা রিকশা আগেই ঠিক করা ছিল। আমি আর নীলু বেরিয়ে পড়লাম। রিকশায় যেতে যেতে নীলুর সঙ্গে গল্প শুরু হলো। আমার চেয়ে এক ব্যাচ সিনিয়র এবং জাবির ভূতত্ত্ব বিষয়ে পড়ছে। থাকে ফজিলাতুন্নেসা (২ নং) হলে। নীলু মোটা পাওয়ারের চশমা পড়ত। একটু খাটো ছিল সে।

নীলুও এই প্রথম সার্ভে করছে। সবচেয়ে অবাক করা যে বিষয়টি হলো বাসে উঠার আধাঘন্টা আগে নাকি পনির ভাই নীলুকে বলেছে, চল রংপুর ঘুরে আসি। অমনি নীলু রাজি হয়ে গেছে। দৌড়ে হল থেকে ছোট ব্যাগে কিছু কাপড়চোপড় নিয়ে বাসে উঠে পড়ে। এই ঘটনা শোনার পর নীলুকে একটু পাগলা কিসিমের মনে হলো। এভাবে হুট করে কেউ বেরিয়ে পড়ে নাকি! যাই হোক, আস্তে আস্তে নীলুর সঙ্গে জমে গেল। প্রথমে আপনি আপনি করলেও পরে তুমিতে নেলে এলো সম্বোধন।

সদর এলাকায় কিছু জরিপ শেষ করে আমরা গ্রামের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। রিকশা চলছে তো চলছেই অথচ গ্রাম পাচ্ছি না। রিকশাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করতেই বলে, এইতো আর একটু দূরে। প্রায় একঘন্টা পর বিরক্ত হয়ে বললাম, ভাই সত্যি করে বলেন তো আর কতোক্ষণ লাগবে?

রিকশা তখন একটা বিশাল ধানক্ষেতের (ধান ছিল না তখন) পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। রিকশাওয়ালা দূরে আঙ্গুল দেখিয়ে বলল, ওই যে। দেখলাম অঙ্গুলি নির্দেশিত দিকে অনেকগুলো বাড়িঘর দেখা যাচ্ছে। আমি রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখি রাস্তাটা অনেক দূরে গিয়ে গ্রামের সঙ্গে মিশেছে। রিকশায় চড়ে রাস্তা ধরে গেলে নির্ঘাত আরো আধাঘন্টা লাগবে। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম ধানক্ষেতের মাঝখানে দিয়ে হেঁটে গ্রামে যাব। অর্থাৎ বিষমবাহু ত্রিভুজের ছোট বাহু ধরে গ্রামে পৌঁছাব। নীলুকে বলতেই সেও রাজি হয়ে গেল। রিকশাওয়ালাকে বললাম, আপনার রিকশায় আর চড়ব না। আমরা ওই গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে হেঁটেই যাব। আপনি শুধু আমাদের খুঁজে নেবেন। না পেলে গ্রামের লোকজনদের জিজ্ঞেস করবেন।

নীলু আর আমি ক্ষেতের মাঝখান দিয়ে হাঁটছি। এবড়োথেবড়ো মাটির চাকে হাঁটতে বেশ অসুবিধা হচ্ছিল। আমার পায়ে কেডস ছিল বলে তেমন সমস্যা হচ্ছিল না, কিন্তু নীল বেশ স্লো যাচ্ছিল।

গ্রামে পৌঁছেই আমরা জরিপ শুরু করলাম। আমি কাউকে ইন্টারভিউ করতে থাকলে নীলু পাশে দাঁড়িয়ে থাকত। নীলু করলে আমি দাঁড়িয়ে থাকতাম। নীলু কোনো বাড়িতে ঢুকে মহিলাদের ইন্টারভিউ নিলে আমি ঘরের দাওয়ায় বসে থাকতাম। এভাবে হেঁটে হেঁটে, বাড়ি বাড়ি ঘুরে ইন্টারভিউ নিচ্ছিলাম। হঠাৎ দেখি দূরে একটা রিকশা দাঁড়িয়ে আছে। কাছে যেতেই রিকশাওয়ালা আমাদের দেখে হেসে বলল, আমি জানতাম আপনেরা এই রাস্তা ধইরা আইবেন। তাই আগেই আইসা বইসা আছি। আমরা বললাম, বসে থাকুন তাহলে।

জীবনের প্রথম সার্ভে করছি। পুরা গলদঘর্ম হয়ে পড়েছি। গ্রামের লোকেরা আমাদের সামনে সারাক্ষণই কথা বলছে। যখনই বলি, আসেন একটা ইন্টারভিউ নিই, তখন সরে যায়। সবাই এ ওরে ঠেলে। হয়তো কাউকে বোঝাচ্ছি, ব্যাটা তখন নীলুর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কেবলার মতো হাসছে। মহা মুসিবত। এসব করতে করতে দুপুর হয়ে গেল। পেটে প্রচন্ড খিদে। ক্রমাগত সিগারেট খেয়ে আমার বাংলা ফাইভের স্টক শেষ। বাধ্য হয়ে বিড়ি টানতে শুরু করলাম। অনেক দূর হেঁটে গ্রামের বাজার থেকে (নিতান্তই গরিবী বাজার আর ওইদিন হাটবার ছিল না বলে মাত্র ১টা দোকান খোলা ছিল) কিছু বিস্কিট আর চা খেয়ে নিলাম।

আবার কাজ শুরু হলো। এবার একটু স্পিডি হলাম। এনিহাউ দিনের মধ্যে ৫০টা পেপার শেষ করতে হবে। এদিকে আরেক মুসিবত হলো গ্রামের ছোট ছোট ছেলেপিলে। সারাক্ষণই পিছনে লেগে রয়েছে। নীলু হয়তো কোনো বাড়ির ভেতরে গেছে, আমি বসে বসে সিগারেট খাচ্ছি। নীলু বেরিয়ে এলেই চিৎকার করে উঠে, ওইত্তো মাইয়াডা আইছে। একজন আরেকজনের সঙ্গে ফিসফিস করে, অই, অরা কি জামাই-বউ? শার্ট-প্যান্ট ধরে টান দেয়। কারো হয়তো ইন্টারভিউ নিচ্ছি, কি লিখি দেখার জন্য ঝুকতে ঝুকতে পিঠেই উঠে গেল। মাঝে মাঝে খুব বিরক্ত লাগত। কিন্তু সামলে নিতাম।

এবার গ্রামটা সম্পর্কে বলি। নাম ভুলে গেছি কিন্তু খুব গরিবী একটা গ্রাম। লক্ষ্য করলাম, গ্রামের বাড়িগুলোর উঠোন কিংবা আশেপাশের কোথাও কোনো সবজির চাষাবাদ নেই, কচুঘেচুও নেই। এসব সবজি, কচুঘেচু তো ‍ফেলে দেয়া বিচি থেকে এমনিতেই হওয়ার কথা। গাছপালাও তেমন নেই। বাড়িগুলো সব মাটির তৈরি। এবং ঘরতৈরির মাটি যেখানে থেকে খুঁড়ে আনা হয়েছে সেটা যথেষ্ট গভীর হলেও কোনো পানি জমে নেই। অথচ আমার গ্রামের বাড়িতে (ফেনী) দেখেছি, সামান্য গভীর হলেই মাটির তল থেকে পানি উঠে আসে। বৃষ্টিও খুব হয় না মনে হয়। গ্রামে বাজার বলতে (আগেই উল্লেখ করেছি) একটাই। তাতে হাতে গোণা ৩/৪টা দোকান। গ্রামের মানুষগুলো সহজ-সরল। গ্রামের মহিলারা খালেদাকে রাণী বলে জানে। সেটাও মেনে নিয়েছি। কিন্তু আমি কখনো ভাবতেই পারিনি, বাংলাদেশের কাউকে হরতাল কি, এইটা বোঝাতে হবে।

প্রশ্নপত্রে হরতাল সম্পর্কিত একটা প্রশ্ন ছিল। এক বয়স্ক লোকের কাছে এটার উত্তর জানতে চাইতেই সে আমাকে পাল্টা প্রশ্ন করল, হরতাল কি? আমি একটা ধাক্কা খেলাম। সামলে নিয়ে বোঝাতে চেষ্টা করলাম, এই ধরেন বনধ কিংবা দোকান পাট বন্ধ থাকে কিংবা অনেক মিছিল হয়, ভাংচুর হয়। বয়স্ক লোকটি প্রবলভাবে মাথা নাড়িয়ে বলল, না-না। আমগো এহানে এসব কিছু হয় না। গাড়ি সবসময়ই চলে। ওই যে দেহেন চলতাছে।

তাকিয়ে দেখি দূরে দুইটা মহিষের গাড়ি যাচ্ছে। আমি লোকটার দিকে তাকাই। তার সরলতায় হাসব না কাঁদব বুঝতে পারছি না। হরতাল সম্পর্কিত প্রশ্নের উত্তরে কি লিখব এখন আমি?

আরেকটি প্রশ্ন ছিল এরকম যে, আপনার সংসদ সদস্য গত ৫ বছরে এলাকায় কি কি কাজ করেছে। এই প্রশ্নের উত্তরে কেউ হয়তো সংসদ সদস্যের ভালো ভালো কাজ বলতে শুরু করল, অমনি পাশ থেকে কেউ কেউ বলে উঠল, এ্যাহ। এইডারে ভালা কাজ কয়? হেয় যে ওইদিন এই খারাপ কামডা করল। ব্যস, গেল আমার ইন্টারভিউ, ঝগড়া শুরু হয়ে গেল দুইপক্ষে। অনেক কঠিন হয়ে যেতো এমন পরিস্থিতি সামলাতে।

সবচেয়ে অপ্রীতিকর যে প্রশ্নটির সম্মুখীন আমি আর নীলু (এবং পরবর্তীতে অন্যান্য জেলাতেও) হয়েছি সেটা হলো, আমাদের এসব করে কি লাভ? কয় টাকা পাই কিংবা আমরা কাদের হয়ে কাজ করছি? এক্ষেত্রে শুধুমাত্র রংপুরেই (যেহেতু প্রথম সার্ভে) আমার উত্তর দিতে প্রথম প্রথম জড়তা হতো। পরে অবশ্য পটু হয়ে গেছি। যাহোক, উত্তরটা এমন হতো যে, আমরা ছাত্রমানুষ, দেশে নির্বাচন আসছে। আমরা অমুক সংগঠন চাই যে আপনারাই আপনাদের প্রার্থী নির্বাচন করুন। এজন্য সঠিক তথ্য পাওয়ার জন্য সেই সুদূর ঢাকা থেকে আপনাদের কাছে ছুটে এসেছি। মাত্র নমিনেশন দেয়া হয়েছে, বাতিলের সময় আছে। তাই আপনারাই ঠিক করবেন কোন প্রার্থী কতোটা ভালো। ভোট দেয়ার জন্য আপনার সচেতন হওয়া প্রয়োজন। আমরা ছাত্রমানুষ, খাইখরচা পাই। আর এই যে দেশ ঘুরছি, আপনাদের সঙ্গে কথা বলছি এটাইতো অনেক বড় পাওনা।

হা হা হা। এসব কথা একটু গুছিয়ে বললেই সহজসরল মানুষগুলো মাথা নাড়িয়ে বলত, হ ঠিক ঠিক। আমি মনে মনে হাসি, আহারে, আর কয়দিন পরেই বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাকর্মীচ্যালাচামুন্ডা এসে, এদের আরো একবার ভেলকি দেখিয়ে যাবে।

প্রচন্ড টায়ার্ড হয়ে আমি আর নীলু প্রথমদিনের কাজ শেষ করলাম। রিকশায় উঠে বসতেই কোমরে ব্যথা টের পেলাম। রিকশা এবার আমাদের অন্য পথে নিয়ে যেতে লাগল। কিছুদূর যেতেই বিশ্বরোডে উঠে পড়লাম। বড় বড় বাসট্রাক হুশহাশ করে পাশ দিয়ে বেরিয় যাচ্ছিল। খুব ভয় করলেও প্রচুর বাতাসে রিকশা ভ্রমণ ভালোই লাগছিল। নীলুর সঙ্গে গল্প শুরু করলাম। তার হলজীবনের কথা, বন্ধুদের কথা, জাবির কথা। আমি তখনো জাবি যাইনি। ক্যাম্পাসের কথা শুনে ভালো লাগল। জানলাম পনির আর মীরা কিছুদিন পরেই বিয়ে করবে। মীরার বাবা ময়মনসিংহের জাতীয় পার্টির সাবেক এমপি। রিকশাওয়ালার সঙ্গেও গল্প করলাম। আমি আর নীলু ঠিক করলাম তার বাসায় যাব। রিকশাওয়ালাকে বলতেই সায় দিল।

সন্ধ্যা হয়ে রাত নেমে গেছে। রিকশাওয়ালার বাড়িতে গেলাম। বেড়ার ঘর। একটা ছেলে আছে তার। খুব অল্প সময় ছিলাম কিন্তু এরমধ্যেই রিকশাওয়ালা নাবিস্কো গ্লুকোজ বিস্কুট আর শরবত পরিবেশন করল। বুঝতে পারলাম সদরে ঢোকার মুখেই যে কনফেকশনারীর সামনে সে থেমেছিল, বিস্কুট কেনার অপকর্মটি তখনই সেরেছে। রিকশাওয়ালার ছেলেকে বখশিশ দিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম।

রাত ৮টায় বাসায় ফিরলাম। পনির আর মীরা আগেই ফিরেছে। বাড়ির মালিককে জিজ্ঞেস করলাম, রিকশাওয়ালাকে কতো দিব? বললেন, ৬০ টাকা দিয়ে দিন। টাকার পরিমাণ খুব কম হয়ে যায় দেখে আমি বাইরে এসে ৮০ টাকা দিয়ে বললাম আগামীকালও যেন সে আসে। বাড়ির মালিক যখন জানতে পারলেন আমি ৮০ টাকা দিয়েছি, অবাক হয়ে বললেন, কি করেছেন, আমি তো সন্ধ্যা পর্যন্ত ৪০ টাকায় ঠিক করেছিলাম। রাত করে ফেলেছেন তাই ২০ টাকা বখশিশ সহ ৬০ টাকা দিতে বললাম।

এনিয়ে আর কথা বাড়ালাম না। প্রচন্ড টায়ার্ড ছিলাম। পনির ভাইয়ের কাছ থেকে কাগজপত্র, টাকা পয়সার হিসেব বুঝে নিলাম। তার নাকি হঠাৎই ডায়রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছিল। যে বাড়িতেই গেছে একবার করে সেটার টয়লেটও পরিদর্শন করে এসেছে। এই নিয়ে সবাই বেশ কিছুক্ষণ হাসাহাসি করে রাতের খাবার খেয়ে উঠলাম। শুরু হলো দলনেতা হিসেবে আমার দায়িত্ব।

৪ জনের ২০০ টি প্রশ্নপত্র নিয়ে আমি চেক করতে শুরু করলাম। প্রতিটা প্রশ্নপত্রে আসন, থানা, ইউনিয়ন, গ্রাম লিখতে হলো। কোথাও কোনো প্রশ্ন বাদ পড়েছে কিনা চেক করতে হলো। বাদ পড়ে থাকলে তার আগে পিছের উত্তর মিলিয়ে সম্ভাব্য একটা উত্তর টিক দিয়ে পাশে ফুটনোট লেখা অথবা সেটা অমীমাংসিত প্রশ্ন হিসেবে চিহ্নিত করা ইত্যাদি হাবিজাবি করতে করতে রাত ১২টা বেজে গেল। পিঠ ব্যথা করছে। সারাজীবনেও এতো হাঁটিনি। কাগজপত্র গুছিয়ে চটজলদি ঘুমাতে চলে গেলাম।

Monday, 26 November 2007

জনমত জরিপ @ প্রারম্ভিক

একটা এনজিওতে কমপিউটার আর ইংরেজি শিখতাম। সাল ১৯৯৫। তাতে ইংরেজি তো কিছুই শিখিনি বরং কমপিউটারে গেমস খেলতে খেলতে পুরো কীবোর্ড মুখস্থ হয়ে গেল। বাংলা আর ইংরেজি টাইপিংয়ে এতো দক্ষ হয়ে গেলাম যে ১৯৯৭ সালের পর থেকে আজ পর্যন্ত ফোন নম্বর, বাড়ির ঠিকানা, ছোটখাট চিরকুট ছাড়া আর কোনো কিছুই কলম দিয়ে কাগজে লিখিনি। সেসব অন্য কথা। তো আমার এই টাইপিং স্পিডের কারণে কোর্সের শেষে আমি ওই এনজিওতে টাইপিস্টের চাকরি পেয়ে গেলাম। যেহেতু এনজিও, আদর করে বলা হলো অফিস এক্সিকিউটিভ।

তবে আজকের পোস্টের বিষয় অন্য। জনমত জরিপ। কোর্সের শেষের দিকে আমাদের বলা হলো জরিপ করতে হবে সারাদেশব্যাপী। তারই রিহার্সাল হিসেবে আমরা ঢাকা শহরে একটা সার্ভে সম্পন্ন করলাম। তখন ১৯৯৬ সাল। সারাদেশ নির্বাচনমুখী। রাজনৈতিক দলগুলো নমিনেশন দিয়ে দিয়েছে। তো আমাদের এই নির্বাচনী জরিপ করতে হবে। সে মোতাবেক, আমাদের প্রস্তুতি হিসেবে কিছু ছোটখাট ওয়ার্কশপও করানো হলো। আমরা যারা নতুন তারা খুব গম্ভীর হয়ে জরিপ সংক্রান্ত মারপ্যাঁচগুলো শেখার চেষ্টা করে গেলাম। আমি খুব কষ্ট করে কয়েকটা জিনিস মনে রাখার চেষ্টা করলাম। যেমন,

0. বয়সের ক্ষেত্রে যদি প্রথমজন ১৮-২৫ হয়, তবে দ্বিতীয়জনের বয়সশ্রণী যেন ২৬-৩৫ হয়।
0. পেশার ক্ষেত্রেও তাই, পরপর একই পেশার কাউকেই যেন ইন্টারভিউ না নেয়া হয়।
0. গ্রামে যেন ডান পাশের এক বাড়িতে ইন্টারভিউ সেরে তার ৩/৪ টা বাড়ি পর বাম পাশের কোনো বাড়ির কারো ইন্টারভিউ নিই।
0. বাজারে, চা-র দোকানে ইত্যাদি জমায়েতপূর্ণ জায়গায় যেন একটাই ইন্টারভিউ নেয়া হয়
0. প্রশ্ন বলার পর তার কখগঘ উত্তরগুলোর কোনোটাতেই যেন আলাদাভাবে জোর না দেয়া হয়।
0. কেউ সময় দিতে চাইবে না। প্রথমে এড়িয়ে যেতে চাইবে, সেটা যেন নিজ দক্ষতায় ম্যানেজ করে নিই।

যাহোক, আরো কি কি সব জানি শিখিয়েছিল, আমার কিছুই মনে নেই। তবে যে বিষয়টা আমি খুব তাড়াতাড়ি বুঝে নিয়েছি তা হলো আমাদের হাতখরচ কতো দেয়া হবে। আর অতি উৎসুক হয়ে ছিলাম এটা জেনে যে আমাদের সঙ্গে মেয়েরাও যাবে। জীবনে এই প্রথম মেয়েদের সঙ্গে ঢাকার বাইরে যাব। এর আগে শুধু ফারহানাকে মাঝে মাঝে বুড়িগঙ্গার ওপারে পৌঁছে দিতাম অথবা সদরঘাট থেকে গুলিস্তান আসার পয়সা থাকত না দেখে ইতির সঙ্গে সিদ্দিকবাজার পর্যন্ত রিক্সায় আসতাম।

এবার আমাদের জিজ্ঞেস করা হলো কে কোন জেলায় যাব। সারা বাংলাদেশের ৩০০টি আসনের মধ্যে মার্জিনাল আসনগুলো বেছে নেয়া হয়েছিল। অর্থাৎ যে আসনগুলোর মাঝে বিজয়ী ও পরাজিত প্রার্থীর মধ্যে ২০০-৩০০০ ভোটের ব্যবধান রয়েছে। সে মোতাবেক যে কয়টি আসন বা জেলা সিলেক্ট করা হয়েছে তারমধ্যে রংপুর হলো সবচেয়ে দূরবর্তী জেলা। আমি চট করে সেটাই বেছে নিলাম। ততোদিনে আমি চাকরি করি বিধায় আমার একটা আলাদা দাপট তৈরি হয়ে গিয়েছিল। আমাকে দলনেতাও নির্বাচন করা হলো। অথচ তখন পর্যন্ত জানি না আমার গ্রুপের অন্য সদস্যরা কারা? আমি জানতে না পেরে একাউন্টসে গিয়ে টাকা পয়সা তুলে রংপুর যাওয়ার ৪টা টিকেট কিনে ফেলি।

এই এনজিও-র একেবারে গোড়ার দিকে আরেকটা সার্ভে হয় সেখানে জাহাঙ্গীরনগরের ছেলেমেয়েরা অংশ নিয়েছিল। আমরা কোর্সে ছাত্রছাত্রী ছিলাম ৪০ জনের মতো। তাই এবারও জাহাঙ্গীরনগরের ছাত্রছাত্রীদের ডাকা হলো। আমার সঙ্গে পরিচয় হলো জাবি-র এক ছাত্রের সঙ্গে। অফিস থেকে বলা হলো, সেই আমার গ্রুপের বাকি ৩ জনকে ম্যানেজ করে দেবে। আমি সেই ছাত্রের (নাম ভুলে গেছি) কাছে জানতে চাইলাম আমার গ্রুপের অন্য সদস্যদের ব্যাপারে। সে আমাকে পাল্টা প্রশ্ন করল, আপনি আজ রাত্রে রওনা দেবেন না? টিকেট কেটেছেন?

আমি হ্যা বলার সঙ্গে সঙ্গে বলল, তাহলে আমাকে তিনটা টিকেট দিয়ে দিন। আপনার গ্রুপের বাকিরা প্রান্তিক থেকে উঠবে। আপনি বাস ড্রাইভারকে বলে রাখবেন জাহাঙ্গীরনগরের প্রান্তিকে যেন বাস থামায়, লোক উঠবে। আমি নলা সব বুঝে তার হাতে তিনটা টিকেট তুলে দিলাম।

কোর্সমেটরা কে কোথায় কখন যাচ্ছে, তাদের সদস্য কারা এসব খোঁজ নিতে নিতে দেখি, হায় আল্লাহ, অনেকের গ্রুপে দেখি কোনো মেয়েই নেই। তবে যে বলল, প্রতি গ্রুপেই ১জন হলেও মেয়ে থাকবে। আমার গ্রুপেও কি তাহলে ...
____________________________

রাত ৯টায় বাস ছাড়ল গাবতলী থেকে। আমি বাসের একবারে সামনের চারটা টিকেট কেটেছিলাম। প্রায় আধাঘন্টা পর বাস প্রান্তিকে থামতেই একটা ছেলে ও দুইটা মেয়ে উঠে এলো। আমি বসেছিলাম ড্রাইভারের পিছনে জানালার সিট ছেড়ে। দেখলাম, একটা ছেলে আর একটা মেয়ে গেটের কাছের সিটদুটোয় বসে গেল। আর অন্য মেয়েটা সুড়সুড় করে আমার পাশে এসে বসল। ধারণা করলাম টিকেটের গায়ে সিট নাম্বার দেখেই তারা ধারণা করে নিয়েছে। ছেলেটা সিটে সুস্থির হয়ে বসে বলল, আমার নাম পনির, আর ও হচ্ছে মীরা।
আমার পাশের মেয়েটা বলল, আমার নাম নীলু।

আমি দাঁত কেলিয়ে সবাইকে সম্ভাষণ জানালাম। জরিপের কাজটা সম্পর্কে একটু ধারণা দিতে চাইলাম। ছেলেটা বলে উঠল, ওসব আমরা অনেক করেছি। আপনি চাইলে সকালে বুঝিয়ে দিয়েন। এরপর হালকা কিছু কথাবার্তা বলে পনির আর মীরা দুজনেই ঘুমানোর আয়োজন শুরু করল। বাসের সুপারভাইজার তখন সবাইকে ফান্টা আর স্যান্ডউইচ দিচ্ছিল। আমি আর নীলু ফান্টা নিলাম শুধু। নীলুর সঙ্গে কথা বলা শুরু করলাম। কিন্তু বেশিদূর এগোনো গেল না। জড়তা রয়েই গেল।
____________________________

বাস ছুটছে আরিচার দিকে। রাত তেমন বেশি হয়নি। অথচ আশ্চর্য পুরো বাসটিই ঘুমিয়ে গেছে। পনির আর মীরা তো সেই কবেই! পাশ ফিরে দেখি নীলুও চোখ মুদে আছে। আমি ফান্টায় চুমুক দিই। শীত শীত করে উঠে। হালকা অন্ধকারে বাসের গর্জন আর বাতাসের শব্দ ছাড়া আর কিছুই নেই। আরেকবার ফান্টায় চুমুক দেই। টুং করে শব্দ হতেই খেয়াল করে দেখি নীলুর পায়ের কাছে আধখাওয়া ফান্টার বোতল। একটু দুলছে, আমি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি বোতলটার দিকে। দুলে উঠে পড়ে যেতে গেলেই যেন খপ করে ধরে ফেলতে পারি সেলক্ষ্যে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি, তাকিয়ে থাকি, তাকিয়েই থাকি ...

পরদিন সকালে রংপুর বাসস্ট্যান্ডে আমার ঘুম ভাঙ্গে।

Friday, 19 October 2007

একটি স্ব-সাক্ষাতকার

অলৌকিক হাসান। পেশায় ভিডিও এডিটর। পাশাপাশি শখের নাট্যকার ও পরিচালক। বেশ কিছু নাটক/টেলিফিল্ম পরিচালনা করেছেন। অলৌকিক হাসানের ভবিষ্যত ইচ্ছা হলো সুস্থ ও নাচ-গান-মারামারিতে ভরপুর বিনোদনমূলক চলচ্চিত্র নির্মাণের। আমরা বিশ্বাস করি তিনি নিশ্চয়ই সফল হবেন, দেশের একজন জনপ্রিয় চলচ্চিত্রনির্মাতা হিসেবে তিনি বিখ্যাত হবেন। আর তাই সচলায়তনের পক্ষ থেকে আগেভাগেই অলৌকিক হাসানের সঙ্গে মুখোমুখি সাক্ষাতকারের আয়োজন করা হয়েছে। আজকের আমরা তার ছোটবেলার কথা জানতে চাইব।

- কেমন আছেন?
- ভালো। আপনি?
- ভালো আছি। আজকে আপনার ছেলেবেলার কথা জানতে এসেছি।
- বলেন কি! আমার তো এখনো ছেলেবেলা চলছে। বড় হই, তখন না হয় ছেলেবেলার গল্প করব।
- আপনি বড়ই, তবে এসব বলে ছাড়া পাচ্ছেন না।
- হুম। যেভাবে চেপে ধরেছেন, বলতেই হবে মনে হচ্ছে।
- সেই ভালো। আপনি শুরু করুন।
- সেপ্টেম্বরের ১ তারিখ দুপুরবেলায় আমার জন্ম। যথারীতি আব্বা অফিসে। জন্মের সময় আমি দেখতে খুব কালো হওয়ায় আম্মার মন খারাপ হয়েছিল। কারণ আমার দেড় বছরের বড়ভাই ছিলেন খুবই ফর্সা। আব্বা খবর পেয়ে অফিস থেকে ফিরলেন এবং একটা মজার কান্ড ঘটালেন। ১ তারিখ ছিল বলে আব্বার বেতন হয়েছিল। নবজাতকের মুখদর্শন করেই আব্বা পকেট থেকে বেতনের সবগুলো টাকা বের করে আমার শরীরের উপর বিছিয়ে দেন। ময়-মুরুব্বিরা হায় হায় করে উঠেছিল টাকার ময়লা আমার গায়ে লেগে যাবে বলে। আপনিই বলুন, টাকার আবার ময়লা! হা হা।
- ইন্টারেস্টিং। তারপর ?
- এবার আমার জন্মের আগের দুটি ঘটনা বলি, আম্মার মুখে শোনা। যখন পেটে ছিলাম, আম্মা কোনো একদিন সন্ধ্যার সময় ছাদে হাঁটছিলেন। হঠাৎই জোর বাতাস শুরু হয়ে যায়। নিচে নামতে যাবেন এমন সময় আম্মার মনে হলো কেউ যেন তার গালে জোরে থাপ্পড় মারল। আম্মা ভয়ে একদৌড়ে নিচে নেমে আসেন। কিছুদিন পর আম্মা স্বপ্নে দেখলেন, শাদাশুভ্র-জোব্বা পরা-শ্রুশ্রমন্ডিত-লম্বা একজন হুজুর বুকে কোরাণশরীফ নিয়ে খাটের কোণায় দাঁড়িয়ে আম্মাকে ধমক দিয়ে বলছেন, এই মেয়ে, তোর ঘরে কোনো কোরাণশরীফ নেই কেন? ধমক খেয়ে আম্মা ধড়ফড় করে জেগে উঠেন। এখন পর্যন্ত আম্মার দৃঢ়বিশ্বাস তিনি মোহাম্মদ (সঃ) কে দেখেছিলেন। আমি বড় হয়ে এ বিষয়ে বার বার জিজ্ঞেস করে জানতে চেয়েছিলাম উনি দেখতে কিরকম ছিলেন। কিন্তু আম্মা উনার চেহারা মনে করতে পারেন না।
- আপনার জন্মের সঙ্গে কি এ ঘটনার কোনো যোগসূত্র আছে?
- আম্মার ধারণা, আছে। আমার জন্মের ২/৩ দিন পর দুপুরবেলায় আমি খাটে ঘুমিয়ে ছিলাম। আম্মা ছিলেন পাশে, টুকটাক আদর করছেন। হঠাৎই আমি চিৎকার করে জেগে উঠি। সঙ্গে সঙ্গে আমার চোখ দুটো উল্টে ঠেলে বেরিয়ে যাবার যোগাড় হয়। মুখ থেকে গ্যাঁজলা বের হতে থাকে। কালো শরীর আরো কালচে নীল হয়ে যায়। হাত-পা কুঁকড়ে যায়। আম্মা প্রচন্ড ভয়ে চিৎকার করে আশেপাশের লোকজন যোগাড় করে আনেন। কেউ ডাক্তার ডাকতে গেল, কেউ হাত-পা মালিশ করতে লাগল। আম্মা তখন কেঁদেকেঁটে বারবার প্রলাপ বকছেন, তোমরা কেউ একজন হুজুর নিয়া আস। আমি জানি আমার ছেলের কি হইছে। যথারীতি ডাক্তার, বৈদ্য, কবিরাজ, হুজুর, পাড়াপড়শী সবাই বাসায় চলে আসে। খবর পেয়ে বাবাও চলে আসেন। হুজুর পানিপড়া দেয়, ডাক্তার ঔষধ দেয়। বিকেলের দিকে আমার অবস্থা স্বাভাবিক হয়। আম্মা সেদিন সন্ধ্যায়ই বায়তুল মোকাররম থেকে একটা সবুজ মলাটের কোরাণশরীফ কিনে আনান। স্বপ্নের রঙ শাদাকালো হলেও আম্মা ওই হুজুরের কোরাণশরীফের মলাটের রঙ সবুজ দেখেছিলেন। এরপর আম্মা কোরাণশরীফ পড়া শিখতে শুরু করেন। বড় হয়ে জিজ্ঞেস করলে আম্মা আরো বলেছিলেন, ওইদিন সন্ধ্যায় ছাদে যখন তিনি হাঁটছিলেন, তখন হয়তো ঘরে ফেরা কোনো খারাপ জ্বিন তাকে থাপ্পড় মারে। স্বপ্নে আল্লাহ রাসূল স্বয়ং এসে সাবধান করে গেলেও তিনি বুঝেননি। আম্মার ধারণা, আমার জন্মের আগেই যদি তিনি কোরাণশরীফ কিনে রাখতেন তাহলে নিশ্চয়ই এমনটি ঘটত না। আম্মা বলেন, সেই ঘটনার পর থেকেই নাকি আমি সুস্থ স্বাভাবিকভাবে বাড়তে থাকি। আমার গায়ের রঙ ফর্সা হতে থাকে।
- ভয়াবহ ঘটনা তো?
- মোটেই না, বরং ফানি। যদিও আমি এ বিষয়গুলো নিয়ে কখনোই আম্মার সঙ্গে তর্ক করিনি। তার বিশ্বাস তার কাছেই থাকুক। তবে একটা বিষয় মোটেও ফানি ছিল না।
- কি সেটা?
- হাফ মুসলমানি। মায়ের পেটে থাকতেই নাকি আমার অর্ধেক মুসলমানি হয়ে গিয়েছিল। মর্ত্যের হাজম শুধু ফিনিশিংটা দিয়েছেন। বিষয়টা মুসলমানি হওয়ার আগে আমি নিজেও খেয়াল করেছি। হা হা হা।
- আপনি তো দেখি সাচ্চা মুসলমান।
- একদম। একবার সারা ঢাকা শহরে রব উঠল যে, বাচ্চাদের মাথায় শাদা চুল পাওয়া গেলে সে নাকি আল্লাহতায়ালার পেয়ারের বান্দা। আম্মা তখন অনেক খুঁজে পেতে কেমন করে জানি আমার মাথার চুল থেকে একটা শাদা চুল পেয়ে গেলেন। তারপর সেটা ময়ুরের পাখনার সঙ্গে কোরাণশরীফে স্থান পেয়ে গেল। আম্মা আমাকে বরাবরই স্পেশাল ভাবেন।
- আপনার বাবা, বড়ভাই এদের সম্পর্কে কিছু বললেন না।
- আব্বা ছিলেন সরকারি চাকুরিজীবী। আর আম্মা তো পুরোদস্তর গৃহিনী। আমরা তখন সাবলেট থাকতাম মধুমিতা সিনেমা হলের পেছনে বাংলাদেশ ব্যাংক কলোনিতে। তখনকার স্মৃতি আমার হালকা হালকা মনে পড়ে। আর ওই যে বললাম, আমি স্পেশাল, পয়মন্ত। আমার জন্মের পর আব্বার প্রমোশন হয়। আমরা তখন সাবলেট ছেড়ে গোপীবাগ ৫ম লেনের দুইরুম বিশিষ্ট একটা টিনের চৌচালা ঘর ভাড়া নেই, যার মেঝে ছিল মাটির।
- আপনার স্কুলজীবনের কথা বলুন।
- গোপীবাগে আসার পর আমার বড়ভাই রাশেদুল হাসান রিপনকে স্কুলে ভর্তি করে দেয়া হয়। স্কুলের নাম রামকৃষ্ণ মিশন মহাবিদ্যালয়। আমি তখনও খুব ছোট কিন্তু ভাইয়ার খাতাপত্রে, ঘরের মেঝেতে আঁকিবুঁকি করতে করতে সাড়ে তিনবছর বয়সেই আমি অ আ ক খ শিখে ফেললাম। ভাইয়া যখন স্কুলে যেত, আমিও যাবার জন্য ঘ্যান ঘ্যান করতাম। এভাবে কিছুদিন যাওয়ার পর আমার স্কুলে যাওয়ার সুযোগ হলো। হঠাৎ একদিন বাড়িতে কিছু মহিলা এলেন। তারা নতুন একটা স্কুল করেছেন কিন্তু ছাত্রছাত্রী নেই। তাই দলবেঁধে বাড়ি বাড়ি ঘুরে ছাত্রছাত্রী সংগ্রহ করছেন। আমাকে দেখে আম্মাকে খুব করে অনুরোধ করলেন যেন আমাকে ওই স্কুলে ভর্তি করে দেয়া হয়। খরচ তেমন একটা না। আম্মা সুযোগটা মিস করলেন না। আমি ভর্তি হয়ে গেলাম লিটল ডায়মন্ড কিন্ডারগার্টেন স্কুলে বেবি শ্রেণীতে। আমাকে আনা নেওয়া করতে করতে আমার স্বল্পশিক্ষিত আম্মা সে স্কুলের শিক্ষিকা হয়ে গেলেন। তখন বছর প্রায় শেষ হতে চলছিল। রামকৃষ্ণ মিশনে ভাইয়া প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হলে আমাকেও প্রথম শ্রেণীতে ওই স্কুলে ভর্তি করে দেয়া হয়। আমার বয়স তখন চার। সেই থেকে আমরা দুইভাই একসঙ্গেই পড়াশোনা করে এসেছি।
- স্কুলে যেতে আপনার কেমন লাগত? খুব দুষ্টুমি করতেন বুঝি?
- একদমই না। স্কুলে যেতে আমার ভালোই লাগত। দুইভাইকে একসঙ্গে স্কুলে নিয়ে যেতেন আম্মা। ছুটির আগ পর্যন্ত বসে থাকতেন তিনি। মিশন স্কুলকে আমি কখনোই ভুলব না। আমার জীবনে মিশন স্কুলের বিশাল ভূমিকা রয়েছে। কিন্ডারগার্টেনে আমি বড়জোর ২/৩ মাস ছিলাম। রামকৃষ্ণে আসার পর আমি খুবই খুশি হই। দুইটা বড় বড় মাঠ, পুকুর, প্রচুর কৃষ্ণচূড়া, বকুল গাছ ছিল। নিয়মিত ক্রীড়ানুষ্ঠান, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো। আমি স্কুলে বেশি কথা বলতাম না, শান্ত স্বভাবের ছিলাম, তবে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশ নিতাম, পুরষ্কারও পেয়েছি। মিশন স্কুলে ছিল বিশাল লাইব্রেরি। আমার মনে হয় না বাংলাদেশের আর কোনো মাধ্যমিক স্কুলে এতোবড় লাইব্রেরি আছে। লাইব্রেরিটা আমার মনে দাগ কেটে গেল কেন সে ঘটনাটা বলি। ক্লাস টুতে পড়ি মনে হয় তখন। আমি মাঠে খেলছিলাম। হঠাৎই আমার মনে হলো আচ্ছা সবাই ওই ঘরে (লাইব্রেরি বা গ্রন্থাগার টাইপের শব্দ তখনও আত্মস্থ হয়নি) টেবিলে বসে কি লিখে? আমি উৎসুক হয়ে লাইব্রেরিতে ঢুকলাম। ভাবলাম এদের মনে হয় বাসায় বই নেই। এখানে তারা লিখে, বাসায় নিয়ে পড়ে। সিদ্ধান্ত নেই, আমিও তাই করব। শেলফ খুঁজে একটা রূপকথার বই নিয়ে টেবিলে বসে (তখনও টেবিলে থুতনি প্রায় লেগে যায় অবস্থা) খাতায় লিখতে শুরু করি। কিছুক্ষণ পর আমার খেয়াল হয়, আরে, আমি যা যা লিখছি তা তো পড়ে ফেলছি। তাহলে বাসায় নিয়ে কি পড়ব। আমি লেখা বন্ধ করে শুধু পড়তে শুরু করি। ব্যস, এরপর স্কুলের প্রায়দিনগুলোতে আমি সারা লাইব্রেরি খুঁজে গিলতে শুরু করি শিশুতোষ রামায়ণ, মহাভারত, দেবদেবতার বীরগাঁথা। রঙিন ছবিসহ বইগুলো আমার পড়ার তৃষ্ণা বাড়িয়ে দেয়। আমার (আউট বই) পড়ার নেশা সেই থেকে।
- দুর্গাপূজার জন্য তো রামকৃষ্ণ মিশন বিখ্যাত। আপনি পূজোর সময় কি করতেন?
- আসলে পূজোর সময় স্কুল ছুটি থাকত। আমি ওই স্কুলে পড়া অবস্থায় কখনো পূজো দেখিনি। তবে হিন্দু ছাত্রদের জন্য হস্টেল ছিল। ওইখানে মাঝে মাঝে যেতাম, আমাদের প্রসাদ খেতে দিত। মিশন স্কুলে মা কালীর প্রতিমা ছিল। ওটাকে ভয় পেতাম প্রথম প্রথম, পরে অবশ্য তা কেটে গেছে। নামে হিন্দু হলেও স্কুলে ধর্মসংক্রান্ত কোনো বাড়াবাড়ি আমি কখনো দেখিনি। বরং ফ্রি হাসপাতাল ছিল, সেখানে ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে গরীবদের ফ্রি চিকিৎসা হতো। আমরা কৃষ্ণচূড়ার মুকুল দিয়ে কাটাকাটি খেলতাম, বকুল ফুল দিয়ে মালা গাঁথতাম। মাঝে মাঝে স্কুলের বড় মাঠ ছেড়ে ব্রাদার্স ইউনিয়নের মাঠে খেলতে যেতাম।
- স্কুলজীবনের দুইএকটি ঘটনার কথা বলুন।
- ভাইয়া একবার অঙ্কে একশতে একশ মার্ক পেয়েছিল। তো ছুটির পর ভাইয়া আম্মার কাছে দৌড়ে আসছে আর চিৎকার করছে, আম্মু আমি একশতে দুইশ পেয়েছি। খাতার উপর ১০০/১০০ দেখে ভাইয়া ভেবেছিল ১০০ মার্কের পরীক্ষায় টিচাররা তাকে ২০০ মার্ক দিয়েছে। বার্ষিক পরীক্ষার পর আমাদের মৌখিক পরীক্ষা হতো। তখন আমাকে জিজ্ঞেস করা হলো, বটগাছ কোথায় দেখা যায়? আমি ঝটপট উত্তর দিলাম, শিশুপার্কে। অথচ সঠিক উত্তর ছিল নদীর তীরে বটগাছ দেখা যায়। আমি ভুলে গিয়েছিলাম কারণ বার্ষিক পরীক্ষার পর আব্বা আমাদের শিশুপার্ক দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল। ওইখানে বটগাছ দেখেছিলাম। টিচাররা অবশ্য আমার উত্তর সঠিক ধরে নিয়েছিল। আরেকবার, তখন বোধহয় ক্লাশ ৩/৪ এ পড়ি। হঠাৎ করে স্কুল ছুটি হয়ে গেল। আমরা তো ব্যাপক খুশি। খবর নিয়ে জানা গেল, কোথায় জানি ইন্দিরা গান্ধী নামে কে একজন মারা গেছে। আমাদের আর পায় কে। স্কুলছুটি, সেটাই বড় ব্যাপার। মিশন স্কুলে সপ্তাহে একদিন গানের ক্লাশ হতো। আমাকেও যেতে হয়েছিল সেখানে। কচিকণ্ঠে আমরা গাইতাম, মায়াবনবিহারিণী হরিণী অথবা আলো আমার আলো ওগো। আমার চরম বিরক্ত লাগত। দল বেঁধে এই গান গাওয়ার বিষয়টা এনজয় করতাম না। তবে কিভাবে কিভাবে জানি আমি ওই গানের ক্লাশ থেকে মুক্তি পেয়েছি তা মনে করতে পারি না। এখন খুব আফসোস হয়। আমার গলায় সুর একদমই নেই। যেসব মেয়েরা আমার সঙ্গে ফোনে কিংবা মুখোমুখি ঝগড়া করে চলে গেছে, ঠিক সেইসব মুহুর্তগুলোতে আমি যদি দুয়েকটা গান গেয়ে ফেলতে পারতাম, তাহলে তারা চলে যেত না। এমনও হয়েছে, মধ্যরাতে কথা বলছি, ওপাশ থেকে গান গাওয়ার অনুরোধ এলো, আমি ইনিয়ে বিনিয়ে আরেকদিকে চলে যাই। হয়তো আরো ঘন্টা দুয়েক কথা বলার প্ল্যান ছিল, আধঘণ্টার পরেই ওপাশ থেকে বিদায়ের ঘন্টা বাজে। আচ্ছা, যে লোক গাইতে পারে না, মেয়েরা তার কাছ থেকে গান শুনতে চাইবে কেন? ভেবে দেখুন তো কি জ্বালা।
- নারীমন বোঝা ঈশ্বরেরও সাধ্যির বাইরে। যাহোক, আপনার ছোটবেলার বন্ধুদের কথা বলুন।
- রামকৃষ্ণ মিশনে ক্লাস ফোর পর্যন্ত পড়েছি। তো বন্ধু বলতে তখন ক্লাসের ছেলেরাই। তাদের অনেকের নাম, চেহারা এখন মনে করতে পারি না, একমাত্র মেহেদী ছাড়া। মেহেদী বোধহয় ক্লাস টুতে রামকৃষ্ণে এসেছিল। মাঝখানে একবছর আলাদা ছিলাম। তারপর কলেজ পর্যন্ত একসঙ্গেই পড়েছি। একেবারে ছোটবেলার বন্ধু বলতে এই মেহেদীর সঙ্গেই আমার এখন পর্যন্ত যোগাযোগ রয়েছে। ব্যাটা আমার আগে বিয়ে করেছে, এখন লন্ডনে থাকে। গোপীবাগে থাকার সময় এলাকার কারো সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব তেমন হয়নি। আম্মা ঘর থেকে বের হতে দিতেন না। এলাকায় নিত্য মারামারি লেগে থাকত। এছাড়া আমাদের বাসার আশেপাশে বস্তি ছিল। আম্মার ভয় ছিল আমি বস্তির ছেলেদের সঙ্গে মিশে খারাপ হয়ে যাব। তারপরও মাঝে মাঝে বের হলে ওই বস্তির ছেলেগুলোর সঙ্গেই খেলতাম। গোপীবাগ বাজারে বেশ কয়েকটা ক্লাবঘরে সারাদিন ক্যারাম খেলা হতো পয়সার বিনিময়ে। আমি মাঝে মাঝে সেখানে দাঁড়িয়ে খেলা দেখতাম। পরে অনেক বায়না করে বাসায় একটা ক্যারামবোর্ড কিনেছিলাম। আর স্ট্যাম্প জমাতাম। স্কুলে বন্ধুদের সঙ্গে স্ট্যাম্প অদলবদল করতাম।
- তার মানে ছেলেবেলায় আপনার বন্ধুসঙ্গ তেমন যুৎসই ছিল না?
- না ছিল। কিন্তু গোপীবাগ এলাকায় থাকতে নয়। ওই যে বললাম, বস্তির ছেলেগুলো। ঘর থেকে বের হতে পারলে ওদের সঙ্গেই ঘুরতাম। একবার হলো কি, ওদের মধ্যে অনেকেই কাগজ কুড়াতো। তারপর বিক্রি করে ২/৩ টাকা পেত। তো আমারও শখ হলো কাগজ কুড়ানোর। আমিও একদিন বেরোলাম ওদের সঙ্গে। প্রায় দুইতিন ঘন্টা কাগজ কুড়ালাম। কিন্তু আমার থলে প্রায় পুরোটাই খালি। ওরা যে দক্ষতায় ডাস্টবিন থেকে কাগজ কুড়িয়ে ফেলত, আমি সেটা পারতাম না। নোংরার ভয়ে আমি সেখানে যেতাম না। জীবনে প্রথমবার কাগজ কুড়িয়ে ৫০ পয়সা পেয়েছিলাম। এরপর থেকে বাসার পুরোনো কাগজ, পুরোনো খাতা এগুলো ফেলতাম না। সেগুলো জমিয়ে এবং কাগজ কুড়িয়ে আরেকদিন ২ টাকা পেয়েছিলাম। ওরা খায় বলে আমিও আরেকদিন ওদের সঙ্গে মুগদা ঝিলপাড় থেকে জংলী শাক তুলতে গেলাম। তবে আম্মার ভয়ে বাসায় নিয়ে যাইনি। আমাদের ওইখানে একটা মেথরপট্টি গড়ে উঠেছিল। সেখানে রেললাইনের ব্রিজের তলে নোংরা ড্রেন ছিল। আমার বস্তির বন্ধুরা ব্রিজ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে গোসল করত। আমার সাহস হতো না আম্মার ভয়ে। তবে মাঝে মাঝে মেথরপট্টিতে গিয়ে শূকর দেখে আসতাম। আমার বস্তির বন্ধুরা খুব গালাগাল দিত। আমি ভয়ে সেগুলো উচ্চারণ করতাম না। আম্মা শুনলে স্রেফ জবাই করে ফেলবে। কিন্তু একদিন আমার বড়ভাই মনের ভুলে বাসায় ‘বাল’ শব্দটি উচ্চারণ করে ফেলে। সেদিন আম্মার রুদ্রমূর্তি কে দেখে! সুই নিয়ে এলো ঠোঁট সেলাই করে দেবে বলে। এবং সত্যি সত্যিই ভাইয়ার ঠোঁটের উপর সুইঁয়ের হালকা খোঁচা দিয়ে রক্ত বের করে ফেলল। আম্মা কাজটা করেছিল যেন আমরা ভয়ে আর কখনো খারাপ কথা না বলি।
- তাহলে আপনি খেলাধুলা করার সুযোগ পাননি তেমন একটা।
- খুব পেয়েছি কিন্তু তখন পর্যন্ত না। প্রথমত বাসায় খেলার জিনিসপত্র খুব একটা ছিল না। কারণ কোনো খেলনাই বেশিদিন রাখতে পারি না। নাটবল্টু খুলে ভেঙে ফেলি। তাই আব্বা-আম্মা খেলনা কিনে দেবার ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করত। আমরা ততোদিনে টিনের ঘর ছেড়ে ওই এলাকারই একটা দোতলা বাড়ির এক রুম ভাড়া নেই। আমরা খুশি হয়েছিলাম কারণ ওই বাড়ির ছাদ ছিল। তখন প্রচুর ঘুড়ি ওড়ানো হতো। যদিও আমরা সেটা করতে পারিনি। সেইসময় ঘুড়ি ওড়াতে গিয়ে ৩টা ছেলে ছাদ থেকে পড়ে মারা গিয়েছিল। তাই ঘুড়ি সংক্রান্ত যে কোনো বিষয়ে আম্মার প্রবল আপত্তি ছিল। খেলাধুলা বলতে রামকৃষ্ণ স্কুলে টিলো-এক্সপ্রেস, ছোয়াঁছুয়ি, বোমবাস্টিং খেলতাম। আমারা বন্ধুর পুরো নাম ছিল মুন্সী মেহেদী জামান। কি মুন্সী মিলাদ পড়াইবা - বলে মেহেদীকে খেপিয়ে সারামাঠ দৌড়াতাম। সেটাও একপ্রকার খেলা ছিল। এছাড়া ঘরে ভাইয়ার সঙ্গে খেলতাম। আর আম্মা মাঝে মাঝে বেরোতে দিলে বাসার সামনে মাঠে টুকটাক ফুটবল খেলতাম। আবাহনী তখন বোধহয় কোনো কাপ জিতেছিল। ‘সালাহউদ্দিন, আবাহনী’ চিৎকারে বিশাল মিছিল হলো। আমি সেই থেকে আবাহনীর সাপোর্টার হয়ে গেলাম। যেমনটা ব্রাজিলের সাপোর্টার পেলের জীবনকাহিনী পড়ে। আর একটা বিষয় ভালো লাগত যখন খালার বাসায় বেড়াতে যেতাম। আমার স্পষ্ট মনে আছে ৫ টাকা রিক্সা ভাড়ায় আমরা গোপীবাগ থেকে অতীশ দিপংকর সড়ক (তখন এতো প্রশস্ত ছিল না, রাস্তার দুই পাশের খাদে অনেক ছাপড়া ঘর ছিল) হয়ে গোড়ান টেম্পুস্ট্যান্ড পর্যন্ত যেতাম। খুব এনজয় করতাম জার্নিটা। খালার বাসায় গেলে খালাতো ভাই কল্যাণের সঙ্গে খেলতাম, দেয়াল চড়তাম। পাশের বাসার বাথরুমে ঢিল মারা, পেয়ারা চুরি করা, খেলা বলতে এগুলোই। তবে গোপীবাগে থাকতে আমার মধ্যে একটা খারাপ বিষয় জন্ম নিল। আমি মারামারি করতে শিখে গেলাম। বন্ধুদের সঙ্গে মতান্তর হলে আমি হুটহাট মারামারি লেগে যেতাম।
- একদম খারাপ কথা। মারামারি করা মোটেই ভালো না। কি বলেন?
- অবশ্যই। কিন্তু ওইসময় এরকম মনে হতো না। গোপীবাগ থাকতে কড়া শাসনের মধ্যে থাকতাম। নিয়মিত স্কুল যেতাম। পাশের বাড়ির মহিলা হুজুরের কাছে আমপারা, সিপারা, কোরাণ পড়তে যেতাম। আমি ক্লাস থ্রিতে থাকতে প্রথম কোরাণ খতম করি। খুব ভারি ছিল বলে মাঝে মাঝে রাস্তায় কোরাণশরীফ আমার হাত থেকে পড়ে যেত। আম্মা তখন মসজিদে চাল দিত যেন আমার গুণাহ না হয়। আমাদের বাসায় টিভি ছিল না। আমরা পাশের বাসায় টিভি দেখতে যেতাম। ফ্লোরে একগাদা পিচ্চি পোলাপানদের সঙ্গে বসে বসে টিভি দেখতাম। একদিন ওই বাড়ির মহিলা খারাপ ব্যবহার করায় আম্মা জিদ করলেন টিভি কিনবেন। কিছুদিন পরেই আমাদের বাসায় শাদাকালো ফিলিপস ২০ ইঞ্চি টিভি কিনি। ছয়নয় চ্যানেল মিলিয়ে ছায়াছন্দ দেখার কি যে মজা তখন। গোপীবাগ থাকতে আমার সবচেয়ে ভালো লাগার স্মৃতি আমার মুসলামানির অনুষ্ঠান। প্রচুর গিফট পেয়েছিলাম। তারমধ্যে বিভিন্ন খেলনা, টেবিলল্যাম্প, হাতঘড়ি এসব ছিল। এরমধ্যে আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছিল কলমঘড়ি উপহার পাওয়াতে। বাড়ির ছাদের পুরোটাই প্যান্ডেল করে ৪০০ লোককে খাওয়ানো হয়েছিল। দেশের বাড়ি থেকে সমস্ত আত্মীয় স্বজন এসেছিল। সে এক এলাহী আয়োজন। ক্লাস ফোর পাস করে যখন ফাইভে উঠব তখন আমরা গোপীবাগ এলাকা ছেড়ে সবুজবাগে এসে উঠি। রামকৃষ্ণ ছেড়ে দিব, বস্তির বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হবে না। আমার মন খারাপ হয়ে যায়।
- সবুজবাগে নিশ্চয়ই প্রচুর বন্ধু হলো।
- হুম। আমার প্রচুর বন্ধুবান্ধব হতে লাগল। বন্ধুদের তালিকায় মেয়েরাও যোগ হতে লাগল। তবে নিয়তির বিধান কে বোঝে। সবুজবাগেও বস্তি ছিল। সেখানকার দুয়েকটা ছেলের সঙ্গেও আমার বন্ধুত্ব হয়ে গেল। সবুজবাগে আমাদের বাসাটা বড় ছিল। দোতলায় দুইটা রুম, বড় রান্নাঘর ছাড়াও একটা ব্যালকনি ছিল আর তার পাশ বেয়ে একটা নারকেল গাছও ছিল। আমরা দোতালায় থাকতাম। আমাদের পাশের বাড়িতে থাকত কাঁকন আর মন্টি। এছাড়াও ছিল ভোলন, সবুজ, শিপলু, বাদল, হেলেন ভাই, নান্টু ভাই, প্রবাল ভাই, লিটন ভাই। সবুজবাগে আমার খেলাধুলার নেশায় পেয়ে বসল। আমি প্রচুর ব্যাডমিন্টন, দাঁড়িচা, সাতচারা, ফুলটোক্কা, কানামাছি, লাটিম (ঘরকোপ আর বেল্লাপাড়) ফুটবল খেলতে শুরু করলাম। খেলার ফাঁকে সময় হলে দৌড়ে থান্ডার ক্যাটস দেখতে ছুটে যেতাম। পাড়ার প্রায় সবারই টিভি থাকলেও আমরা নান্টু ভাইদের বাসায় দলবেঁধে দেখতাম। আমাদের পাড়াটা ছিল কানাগলি। তাই পাড়ার সব পরিবারের মধ্যে কেমন একটা আত্মীয়ের মতো বন্ধন ছিল। আমরা ছেলেমেয়েরা একসঙ্গে খেলতাম। কেউ কিছু মনে করত না। আমগাছ, নারকেল গাছ ছিল। শবেবরাতের রাতে পাড়ার বড়ভাইরা নারকেল চুরি করত। আমরা সঙ্গ দিতাম। রিকশা নিয়ে সবুজবাগের বস্তির ছেলেদের সঙ্গে রাতে জরি মেখে ঢাকা শহর ঘুরলাম। বিশেষ বিশেষ দিনে তখন রাত ৭/৮টা পর্যন্ত বাইরে থাকার অনুমতি পেতাম। কিন্তু দুপুরবেলায় ঘুমানোর জন্য আম্মা দরজায় তালা মেরে রাখত। তখন বের হতে পারতাম না। সবচেয়ে মজা লাগত যখন কারেন্ট চলে যেত। আমরা ছেলেমেয়েরা বের হতাম পাড়ায়। হাঁটাহাঁটি করতাম, গান গাইতাম, অন্ধকারেই ছোঁয়াছুঁয়ি খেলতাম। হটপ্যাটিসওয়ালা আসত, আমরা কিনে খেতাম। ততোদিনে আহমদবাগের আদর্শ হাইস্কুলে ভর্তি হয়ে গেছি। ঝিলের পাড়ে স্কুল। বড়শি দিয়ে মাছ ধরা শিখলাম। আমার চেহারা দেখতে নাকি অনেকটা চাকমাদের মতো। আর সবুজবাগে ছিল বৌদ্ধমন্দির। ওখানে অনেক বন্ধু জুটে গেল। বৌদ্ধমন্দিরের পুকুরের ঝাপাঝাপি চলত। সকাল দশটায় পুকুরে নামতাম। এক ঘন্টা দাপাদাপি করে পরের আধাঘন্টায় রোদে দাঁড়িয়ে প্যান্ট শুকিয়ে বাসায় গিয়ে স্কুলড্রেস পরে সোজা স্কুলে। ক্লাস শুরুর আগে দাঁড়িচা খেলে তবেই স্কুলে ঢুকতাম। এছাড়াও ক্লাস ফাইভে পড়ার সময় আমরা দুইভাই পল্টনে কচিকাঁচার আসরে ছবি আঁকা শিখতে যেতাম। প্রথমে মোমের রঙে, পরে তুলি দিয়ে। প্রথম প্রথম আম্মা নিয়ে যেতেন, পরে গৃহশিক্ষক নিয়ে যেতেন। একবার হলো কি, কচিকাঁচা বিল্ডিংয়ের দোতালায় লাইব্রেরি ছিল। আমি ওইদিন ছবি তাড়াতাড়ি এঁকে কাউকে কিছু না বলে দোতালায় গিয়ে গল্পের বই পড়া শুরু করলাম। প্রায় ঘন্টাখানেক পর আমার টিচার আমাকে খুঁজে পেল। প্রচন্ড ক্ষিপ্ত হয়ে তিনি আমাকে বিল্ডিংয়ের আড়ালে নিয়ে গিয়ে মারধোর করতে থাকল। আমিও মেজাজ ঠিক রাখতে না পেরে টিচারের গালে থাপ্পড় বসিয়ে দিই।
- আপনি তো ভালোই দস্যিপনা করতেন।
- না, আমি মোটেই সেরকম ছিলাম না। দেখতে খুবই শান্তশিষ্ট ছিলাম, শুধু মারামারি একটু করে ফেলতাম। আমার মুখে অসংখ্য খামচির দাগ এখনো রয়ে গেছে মারামারির কল্যাণে। তবে ইন্টারপাস করার পর এই মারামারি করার ব্যাপারটা একদমই চলে গেছে। হয়তো মাঝে মাঝে দু’একবার করেছি। সবুজবাগে আমার আরেকটা ভাই জন্ম নেয়। কিন্তু আমার মন খারাপ হয়ে যায় ভাই জন্ম নিয়েছে শুনে। আমি খুব করে চাইছিলাম আমার যেন একটা বোন হয়।
- আপনার লেখালেখির শুরুটা কবে থেকে?
- সেটা আরো পরে। আমি তখন খুব করে পড়ছি। এলাকার হাবিব বুকস দোকানে সেবাপ্রকাশনীর বই ছাড়াও অন্যান্য গল্পের বই ১ টাকায় ভাড়া পাওয়া যেত। আমি যেন সোনার খনি হাতে পেলাম। যেনতেন প্রকারে ১ টাকা যোগাড় করা চাই। বাসায় কেউ বেড়াতে এলে আম্মার অনুপস্থিতিতে আমি লুকিয়ে আস্তে করে চাইতাম, আমাকে ১টা টাকা দিবেন? আমি গল্পের বই পড়ব। আচ্ছা বলেন, কেউ তখন টাকা না দিয়ে থাকতে পারে? টাকা পেয়েই আমি দৌড় দেই হাবিব বুকসে। গোগ্রাসে গিলতে শুরু করি কুয়াশা, বনহুর, থ্রিলার, ক্লাসিক। পুরো হাবিব বুকস পড়ে শেষ করে ফেললাম। ততোদিনে মতিঝিল মডেল হাইস্কুলে ভর্তি হয়েছি ক্লাস সিক্সে। মেহেদীও রামকৃষ্ণ ছেড়ে ওখানে ভর্তি হয়েছে। ব্যাটাও বই পড়ে প্রচুর। আমার আরেকটা সোর্স পাওয়া গেল। এছাড়াও পাড়ার নান্টু ভাইও অনেক বই পড়তেন। নান্টু ভাইয়ের বড় আপা বেবি আপা আমাকে প্রথম বড়দের (?) বই পড়তে শেখায়। অতি নির্জলা কিন্তু সেইসব প্রেমকাহিনী পড়ে আমি তখন শিহরিত হতাম। লিমা প্রকাশনীর সুইটহার্ট, মাইলাভ বইগুলো বাসায় লুকিয়ে পড়তে হয়েছিল।
- হুমম বেবী আপা। কিন্তু আপা ছাড়া আর কেউ, এই ধরেন পাড়ার ছোটবোন অথবা বন্ধু ছাড়াও আরো বেশি কিছু হতে চায়, মানে বুঝতেই পারছেন ...
- খুব বুঝতে পারছি। কিন্তু ওই সময় পর্যন্ত তেমন কিছুই ঘটেনি। ক্লাস সেভেন পর্যন্ত মেয়েদের সঙ্গে খেলাধুলা করেছি। আমার শুধুমাত্র কাঁকনের কথাই মনে আছে। আমাদের পাশের দোতালায় থাকত। তবে কোনো কোনো দিন খেলতে আসত না। এখন বুঝি কেন? ভালোবাসাবাসির কথা যদি ধরেন তাহলে ছোটবয়সের প্রথম ভালোলাগা ছিল বাঁধন নামে আমার এক দূরসম্পর্কের আত্মীয়কে। প্রেমের নির্দশন স্বরূপ আমি খাতাপত্রে, বইয়ের কোণায় খুব ছোট করে লিখে রাখতাম বাঁধন ছিড়ে পালাল পাখি। আজ পর্যন্ত মুখ ফুটে বলা হয়নি। দুই সন্তানের মা বাঁধন নিশ্চয়ই এখন খুব ভালো আছে। ছেলেমেয়ের মধ্যে প্রেম, বিয়ে, যৌনতা, জন্মরহস্য এসব বিষয়গুলো সম্পর্কে প্রথম জ্ঞানলাভ করি মাদ্রাসা পড়–য়া বন্ধু বাদলের কাছ থেকে। এর পূর্বে আমার ধারণা ছিল বাবা-মা আমাদের আল্লাহর কাছে চেয়েছেন এবং আল্লাহ রাতের বেলায় টুপ করে বিছানায় রেখে এসেছেন। বাদলই প্রথম আমার এ ভ্রান্ত ধারণা ভেঙ্গে দেয়ার চেষ্টা করে। আমি যখন কিছুতেই বিশ্বাস করছি না, তখন সে মহানবীর উদাহরণ টানে। আমার আর মানতে বাধা থাকে না। মাদ্রাসা পড়ুয়া বাদল কি আর তার (মহানবী) সম্পর্কে মিথ্যা বলবে? যাহোক, সবুজবাগে আমার মারামারির অভ্যাস আরো বেড়ে যায়। আম্মাকে এ নিয়ে প্রায় শালিশ করতে হতো। আম্মা আগে আমাদের মারতেন তারপর শালিশ করতেন। আর একটা বাজে অভ্যাস ছিল স্যান্ডেল হারিয়ে ফেলার। মাগরিবের আযান পড়ল, খেলাও শেষ। আমি স্যান্ডেল ফেলে খালি পায়ে বাসায় ফিরলাম। এইসব করতে করতে আর পড়তে পড়তে আমি প্রথম কবিতাটা লিখে ফেলি ক্লাস সিক্সে থাকতে - স্বাধীনতা নিয়ে।
- এতো বিষয় থাকতে স্বাধীনতার মতো এতো কঠিন বিষয় বেছে নিলেন কেন?
- প্রভাবটা নানার ছিল। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধের গল্প শুনতাম তার কাছ থেকে। এছাড়া আম্মা-মামারা আমাদের দুইভাইকে নানার বিভিন্ন বীরত্বগাঁথা শোনাতেন। তার মোড়লগিরি, যুদ্ধের কথা এসব শুনতে শুনতে আমি স্বাধীনতার বিভিন্ন বিষয়ের উপর আগ্রহী হই। আমার সেই বয়সের আদর্শ ছিলেন আমার নানা। ডিসেম্বরের ছুটিতে আমরা গ্রামে বেড়াতে গেলে নানার দাড়ি টেনে টেনে গল্প শুনতাম। তবে মজার কথা হলো, ওই কবিতাটাই আমার প্রথম এবং শেষ কবিতা। দ্বিতীয় আরেকটি কবিতা লিখতে চেয়েছিলাম ক্লাসে বসে বসে। তখন পাশের ছেলেটা দাঁড়িয়ে বলল, আপা, ও না কবিতা লেখছে। আপা বললেন, কবিতা লেখতে হয় গাছতলায় গিয়ে লেখো, ক্লাসে নয়। সেই থেকে কবিতা লেখা ছেড়ে দিলাম। তার বদলে পড়ার ঝোঁকটা আরো বেড়ে গেল।
- আপনি আর লেখালেখিই করলেন না?
- ছেলেবেলায় আর না। এরপরের যাবতীয় লেখালেখি আমি ইন্টারপাস করার পরে শুরু করি। ততোদিনে আমার ঘর পালানো রোগ হয়েছে। নজরুল ইসলামের জীবনী পড়ে আমি প্রচুর প্রভাবিত হই। ধরেন আম্মা মারল, আমি চিন্তা করলাম, কি লাভ এ সংসারে থেকে। ঘর পালিয়ে কই নজরুল তো মারা পড়লেন না। আমিও বেশ কয়েকবার ঘর পালালাম। সকালে রাগ করে ঘর ছেড়ে পালিয়ে দূরে দূরে চলে যেতাম। খুব ক্ষিধে পেত। একবার হাঁটতে হাঁটতে মাদারটেক ছাড়িয়ে রাজারবাগ ছাড়িয়ে কাঁচপুর ব্রিজের কাছাকাছি চলে গিয়েছিলাম। ক্ষিধের জ্বালায় বড়ই গাছে ঢিল মেরে কাঁচা বড়ই খেয়েছিলাম। প্রতিবারই আমি ঘর পালালে আম্মা আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী জড়ো করে কান্নাকাটি করতেন। আর আমি সন্ধ্যা হলে ক্ষিধের জ্বালায় পাড়ার আশেপাশে ঘুরঘুর করতাম যেন কেউ আমাকে জোর করে ধরে বাসায় নিয়ে যায়। প্রেস্টিজ বলে একটা কথা আছে না। নিজ থেকে বাসায় ফিরি কি করে। ততোদিনে সিগারেট ফুঁকতে শিখেছি, মানে মুখে ধোঁয়া নিয়ে হুশ করে ছেড়ে দেয়া, ভেতরে নিতে পারতাম না। ক্যাপস্টান বলে একটা সিগারেট ছিল। ওইটা খেয়েছি। তারপর বস নামেও একটা ছিল। সিজার খেয়েছি, ক্যানন খেয়েছি। আমার খুব একটা ভালো লাগত না। পান মুখে নিয়ে খেলে নাকি সিগারেট হেভি লাগে। ট্রাই করলাম, মজা পেলাম না। আব্বা সিগারেট খান, একদিন সেখান থেকে চুরি করে দিনের বেলায় টয়লেটে বসে সিগারেট খাচ্ছিলাম। হঠাৎ দরজায় নক। খোলার সঙ্গে সঙ্গেই কানের নিচে আম্মার বিশাল চটকনা বসিয়ে দিলেন, টয়লেটে বসে সিগারেট খাও? আমি খুব আশ্চর্য হলাম, বুঝল কিভাবে? পরে আবিষ্কার করলাম টয়লেটের জানালা দিয়ে রোদ এসে দরজার ফাঁক দিয়ে তীর্যকভাবে ঘরের মেঝেতে পড়ত। আমার সিগারেটের ধোঁয়া সেই তীর্যক রোদে একটা ধোঁয়াটে আবহ তৈরি করেছে। আম্মা টয়লেটের বাইরে থেকে ছেলের কীর্তি ধরে ফেলেছেন। অবশ্য সিগারেট আমার খুব একটা ভালোও লাগত না, তাই ছেড়ে দিলাম। শরীর রক্ষায় মনোনিবেশ করলাম। দুই ভাই মিলে প্রতিদিন সকালে কমলাপুরের ইঞ্জিন ওয়ার্কশপে জগিং, ব্যায়াম এবং বিকেলে কুংফু শেখা শুরু করলাম। যে কোনো প্রকার ডিগবাজি, রেললাইনের ফাঁকে দুই পা সমান্তরালে ছড়িয়ে দেয়া, গাছ, দেয়াল বেয়ে উঠে যাওয়া এসব কোনো ব্যাপারই থাকল না। ডিগবাজির অনেকগুলো আমি এখনও দিতে পারি।
- হা হা, কুংফুম্যান। এবার আপনার গ্রামের বাড়ির কথা তো কিছু বলেন।
- আমার গ্রামের বাড়ি ফেনী জেলার বিজয়সিংহ গ্রামে। এইটা আমার দাদাবাড়ি। নানাবাড়ি হলো লেমুয়া। আমরা প্রতিবছর খালাতো ভাইবোনসহ গ্রামে যেতাম। দাদাবাড়িতে থাকা হতো কম। দুয়েকদিন থেকেই নানাবাড়ি ছুটতাম। সবাই মিলে ডাব, সুপারি, খেজুর রস সাবাড় করতাম। নানাবাড়ি ছিল বিশাল। বিয়ের আগে মা খুব দস্যি ছিলেন। নানাবাড়ির প্রতিটা আমগাছের মা আলাদা আলাদা নাম দিয়েছিলেন। আমের ভারে গাছের ডাল ভেঙে পড়তে দেখেছি আমি নিজের চোখে। মামারা তখনো কেউ বিয়ে করেননি। তাদের সঙ্গে বাজারে যেতাম, বিভিন্ন জিনিস খেতাম। চৌধুরীর নাতি হিসেবে কিছু টাকাপয়সাও উপহার পেতাম। একবার হলো কি, দাদাবাড়িতে কোনো এক কারণে বড় ভাইয়ের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কিতে বড় ভাইয়ের হাত ভেঙে গেল। ফেনী শহরে নিয়ে চিকিৎসা করানো হলো। কিন্তু আম্মার মন তো মানে না। পরদিনই তিনি আমাদের নিয়ে ঢাকায় চলে এলেন। ডাক্তার দেখানো হলো এবং দেখা গেল ভুল প্লাস্টার করানোর কারণে ভাইয়ার ভাঙা হাতে পানি জমে গেছে। আম্মার তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্তে ভাইয়ার হাতটা বেঁচে গেল। এছাড়া নানাবাড়ির সবচেয়ে মজা ছিল কলাগাছের ভেলা বানিয়ে সেটায় চড়ে পুকুরে ভেসে বেড়ানো। নানা কলাগাছ কাটতে দিতেন না বলে হিন্দুবাড়ির কলাগাছ রাতের অন্ধকারে মামারা সহ কেটে ফেলতাম। তারপর ওইটা দিয়ে ভেলা বানাতাম। নানাবাড়ির চারপাশে সব হিন্দুদের বাড়ি ছিল। আর কোনো মুসলমান বাড়ি ছিল না। ফলে গ্রামে গেলে তাদের সঙ্গেই খেলতাম। সারাবছর অপেক্ষা করতাম ডিসেম্বর মাস এলে খালাতো ভাইবোনরা মিলে গ্রামে যাব। হরেক রকমের পিঠা, পুলি ... উপস।
- তারপর?
- এবার মতিঝিল মডেল হাইস্কুল নিয়ে কিছু বলি। ক্লাস সিক্সে আমি ও বড়ভাই এখানে ভর্তি হই। অনেক বড় স্কুল, অনেক ছাত্র। ক্লাস সিক্সে আমার শাখাটা ছিল মসজিদ ঘরের পাশে। আমার একটু নামাজ-কালামের দিকে ঝোঁক গেল। পড়াশোনাটাও সিরিয়াসলি করতে থাকলাম। আউট বই পড়ার অভ্যাস আগের মতোই রয়ে গেল, খেলাধুলাটাও। সবুজবাগ থেকে স্কুলে যাওয়াআস করতাম কমলাপুর রেলওয়ের স্টেশনের মধ্যে দিয়ে। স্কুলছুটির পর স্টেশনের মাঠে (রেললাইনগুলোর মাঝের ফাঁকা জায়গায়) ফুটবল খেলতাম। ক্লাস সিক্সে পড়াশোনায় বেশ সিরিয়াস হলেও আবাহনী-মোহামেডান ফুটবল ম্যাচের জন্য স্কুল পালিয়ে পরেরদিন প্রচুর মার খেয়েছিলাম। আমাদের হেডমাস্টার ছিলেন ইয়াকুব আলী। এরকম স্মার্ট কোনো হেডমাস্টার বাংলাদেশের আর কোনো স্কুলে কখনোই ছিল না এ ব্যাপারে আমি ড্যাম শিওর। পাতলা হোয়াইট শার্ট, ঘিয়ে রঙের প্যান্ট পরে, কালো জুতো পরে আর মাথার শাদা চুলগুলো ব্যাকব্রাশ করে যখন করিডোর ধরে হেঁটে যেতেন, আমরা ভয়ে ভয়ে নাক উঁচিয়ে পারফিউমের গন্ধ শুঁকতাম। তো ওই সিক্সে পড়া অবস্থায় আমার আরো একটা প্রতিভার সন্ধান পাওয়া গেল।
- সেটা কিরকম?
- বাংলা ক্লাসে একবার স্যারের কি মনে হলো আমাদের সবাইকে দিয়ে ‘দইওয়ালা’ রিডিং পড়ানো শুরু করলেন। কিন্তু সেটা অভিনয় করে পড়তে হবে। আমি অমল চরিত্রটা টেনে টেনে, সুর করে, ঢং করে, অভিনয় করে পড়লাম। স্যার খুশিতে আমার ডায়েরিতে ১০/১০ দিলেন। সেই থেকে অভিনয়ের প্রতি একটা সুপ্ত বাসনা আমার মনে চাড়া দিল।
- তাহলে আপনি অভিনেতা হলেন না কেন?
- সেটা অনেক কষ্টের কাজ। তাই ওপথে না গিয়ে এখন অভিনয় করাই সবাইকে।
- তারপর?
- ক্লাস সিক্সে ভালো রেজাল্ট করে আমি সপ্তম শ্রেণীতে ক শাখায় চান্স পেলাম। টিফিনে নামাজ পড়ি, ফ্রিসবি খেলি আর স্কুলছুটির পর কমলাপুরে ফুটবল খেলে বাসায় ফিরি। তখন স্কুলে বাইরে থেকে বড় বড় কিছু ছেলে আসত। তারা আমাদের বিভিন্ন নবীর জীবনী পড়তে দিত। আমি পড়তাম। এখন বুঝি তারা ছিল শিবিরের হারামি। আমার মগজ ধোলাই হয়ে গেল। আমি পারলে তাহাজ্জুদের নামাজও পড়ি। বাসায় কোরাণ আবার পড়া শুরু করলাম। পাড়ার মসজিদেও জামাতে নামাজ পড়তাম। ছেলেদের দেয়া বিভিন্ন ফর্মে সই করা শুরু করলাম। তবে এতোসব কিছুর পরও আউট বই পড়া কিন্তু ছাড়িনি। সেবা ছাড়িয়ে হুমায়ুন আহমেদ এবং পশ্চিমবঙ্গের লেখকদের বই হাতে নিতে শুরু করেছি। মাসুদ রানা, ওয়েস্টার্ণ অদম্য গতিতে এগিয়ে চলেছে। কিন্তু ধীরে ধীরে আমার পড়াশোনার ক্ষতি হতে লাগল। বলা যায় আমার আর স্কুলের পড়াশোনা ভালো লাগছিল না। বাসায় ইত্তেফাক রাখা হতো। আমি খেলার খবর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তাম। সুনীলসহ বিভিন্ন লেখকের মোটা মোটা বইগুলো পড়ে মাথা ঘুরতে লাগল। আল্লাহ, খোদা, সৃষ্টিরহস্য, ধর্ম এগুলো নিয়ে ভাবতাম। আস্তে আস্তে নামাজ পড়া কমতে থাকল। কোরাণ পড়া অর্ধেক এসে থেমে গেল। আমি পরীক্ষায় খারাপ করে অষ্টম শ্রেণীতে গ শাখায় উত্তীর্ণ হলাম।
- আপনি যেভাবে বললেন আমি ভাবলাম আপনি পরীক্ষায় বুঝি ফেল করলেন।
- ছাত্র হিসেবে ফেলনা ছিলাম না। আমি শুধু পাসের চেয়ে একটু বেশি নম্বর পেলেই খুশি। টিচাররা বলতেন, লন্ডন, আমেরিকা যাইতে পার, নোয়াখালি গিয়া থাইমা যাও কেন? অষ্টম শ্রেণীতে উঠার পর আমার আরেকটা বাতিক শুরু হলো। বন্ধু রুহুলের পাল্লায় পড়ে বাংলা ছবি দেখা শুরু করলাম। ২০/২৫ টাকা দিয়ে টিকেট কেটে ছবি দেখা খুব কষ্টের ছিল। রুহুল আমাকে সে কষ্ট থেকে মুক্তি দিল। ৮/১০ টাকা দিয়ে স্টলের টিকেট কাটতাম। পরে সুযোগ বুঝে টিকেটচেকারদের চোখ ফাঁকি দিয়ে পিছনের সিটে চলে আসতাম। ভাইজান, দায়ি কে, ছেলে কার, মাড়কশা, বজ্রমুষ্ঠী, গর্জন ... উফফ কিসব ছবি। হা হা হা। মুগ্ধ হয়ে দেখতাম। এর আগে আব্বা-আম্মার সঙ্গে ছবি দেখতে যেতাম। মনে আছে সবুজসাথী ছবি দেখে কান্না পেয়েছিল। ছোটবেলায় আংশিক রঙিন ছায়াছবিগুলোর প্রতি আমার আগ্রহ ছিল। অপেক্ষা করতাম স্ক্রিণে কখন মারামারি শুরু হবে। বাসায় ফিরে ভাইয়ার সঙ্গে সেগুলো প্র্যাকটিস করতাম। তো রুহুলকে সঙ্গে পাওয়ায় ছবির প্রতি প্রেম আবার জাগল। সঙ্গী হিসেবে পেলাম মুকুল আর দিদারকে। একবার অভিসারে ছবি দেখতে গিয়ে টাকা কম পড়ে গেল। একটা ছেলে এগিয়ে এসে ধার দিল। আরেকবার রাজমনিতে ছবি দেখব, কিন্তু সেই সমস্যা, টাকা কম। ছবি শুরু হওয়ার আগে আগে মুকুল বলল, কি আর করা। নোটবই কিনব ভেবেছিলাম। থাক, ছবিটা আগে দেখে নিই। বলেই চোরা পকেট থেকে ২০ টাকা বের করে। আমার এই বাংলা ছবি দেখার অভ্যেস লন্ডনে আসার আগ পর্যন্তও ছিল। সমালোচকরা যতোই ছবির মান খারাপ বলুক না কেন প্রতি শুক্রবার আমরা বাংলা ছবি দেখতাম। লিমা, সাবিহা, কবিতা, সোনিয়াদের ছবিও মিস হতো না। ফলাফল পরীক্ষায় আরো খারাপ। নবম শ্রেণীতে ঙ শাখায় এই মহারাজার স্থান হলো।
- এরপর নিশ্চয় বলবেন না যে আপনি এসএসসিতে ফেল করেছেন।
- তা বলব না। তবে অষ্টম শ্রেণীতে পড়ার সময় একটা খারাপ কাজ করে ফেলি। তখন আমরা কদমতলায় চলে গেছি। ফুটবল খেলি খুব ভালো। পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে ২/১ জায়গায় ম্যাচ খেলতেও গেছি। সেখানে রিজভী নামে একটা ছেলে থাকত যে কিনা আমাদের স্কুলেই পড়ত। আমরা একসঙ্গে স্কুলে আসা যাওয়া করতাম। পাড়ার ফুটবলটা পালা করে সবার বাসাতে থাকত। এই ফুটবল রাখা নিয়েই রিজভীর সঙ্গে আমার ঝগড়া লেগে গেল। আমি ঠিক করলাম রিজভীকে আমি মারব। সেদিন ওর সঙ্গে স্কুলে যাব না বলে দিলাম। কিন্তু বাসায় ফিরে স্কুলড্রেস পরে তক্কে তক্কে থাকলাম। রিজভী স্কুলে যাওয়ার জন্য রাস্তায় নামতেই আমিও তার পিছু নিলাম। কমলাপুর আসতেই আমি রিজভীকে ডেকে এককথা দুইকথায় পকেট থেকে ছুরি বের করে কানের পাশে মেরে দিই। মুহূর্তেই রিজভীর কান বেয়ে রক্ত বের হয়ে শাদা শার্ট লাল হলো। আমি ভয়ে ছুরি ফেলে স্কুলে চলে যাই। পরে রিজভী বিচার দেয়ায় ইয়াকুব স্যার আমাকে জোড়া বেত দিয়ে খুব করে মেরেছিলেন। ওই ঘটনার পর থেকে আমি বোধহয় আর কখনো মারামারি করিনি।
- মাইগড। খুব ডেয়ারিং কাজ করেছেন তো দেখি।
- হুম। একদমই ঠিক হয়নি। ওইদিন মাথার ঠিক ছিল না। সেই রিজভী এখন লন্ডনে থাকে। মাঝে মাঝে দেখা হয়। আমরা কেউই অস্বস্তিতে ওই প্রসঙ্গটা তুলি না। রিজভী - তুই যদি এ লেখা পড়িস তবে মাপ করে দে আমাকে।
- তারপর?
- নবম শ্রেণীতে সায়েন্স একটু কঠিন লাগায় পড়াশোনায় মনোযোগ দেয়া শুরু করি। তবে ফুটবলে আরো বেশি মনোযোগ চলে যেত। আমরা বাসা বদল করে মায়াকানন চলে গেলাম। সেখানে জুনিয়র কিছু ছেলেদের সঙ্গে মিলে মৈত্রী সংঘ নামে একটা ক্লাব করলাম। একটা ভাঙা দোকানঘরে লাইব্রেরির কাজ শুরু করলাম। লজেন্স কিনে বিক্রি করতাম। সাইকেল ভাড়া করে চালাতাম। মুগদা ঝিলে গোসল করতাম। এলাকাটা ছিল ডেভেলপিং। নতুন রাস্তা হচ্ছে। আমরা সেখানে মার্বেল খেলতাম। তখন দেখতাম ৭/৮ জন হুজুরটাইপের লোকজন জামাতে ইসলামীর ব্যানার নিয়ে হেঁটে যেতেন। ওই হুজুরগুলোর মধ্যে একজনের বাড়িতে পেয়ারাগাছ ছিল। আমরা পেয়ারা পাড়তে গেলে খুব হইচই করত। আমরা তিতিবিরক্ত হয়ে ভাবতাম শালা শান্তিতে একটু চুরিও করতে দেবে না। তাই বন্ধুরা সিদ্ধান্ত নিলাম ওই হুজুর ব্যাটাকে শায়েস্তা করতে হবে।
- শায়েস্তা করতে পেরেছিলেন?
- পেরেছিলাম। নতুন রাস্তা করতে গেলে প্রথমেই একগাদা বালি ফেলা হয়। মায়াকাননের এরকম একটি রাস্তায় মার্বেল খেলতাম। বন্ধুরা মিলে সেই বালির রাস্তা খুঁড়ে ময়লা এনে ভরিয়ে, উপর দিয়ে পাতলা প্লাস্টিক বিছিয়ে, তার উপর হালকা বালি দিয়ে, গর্তটার চারপাশ ঘিরে আমরা দাঁড়িয়ে থাকলাম। হুজুর ব্যাটা শাদা জোব্বা পরে যখন রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল আমাদের দেখে সোজা রাস্তার মাঝখান দিয়ে হাঁটতে থাকল। এবং কিছুক্ষণ পরেই তার এক পা ডেবে গেল সেই ময়লা পানির গর্তে। আমরা খুশিতে চিৎকার করে দৌড়ে পালিয়ে গেলাম। আপনি এটাকে জামায়াতের প্রতি আমার প্রথম আক্রমণ হিসেবে ভাবতে পারেন। যদিও ওসব কিছু না ভেবেই আমরা কাজটা করেছিলাম।
- তা না হয় ভেবে নিলাম। কিন্তু আমি খুব বোর হয়ে যাচ্ছি। এতোবড় একটা ছেলেবেলায় আপনার কোনো মেয়েবন্ধুর কথা পেলাম না।
- কবি এখানেই নিরব। আমি কলেজে উঠার আগ পর্যন্ত মেয়েদের সাথে মিশতে লজ্জা পেতাম। আমার মনোযোগ ফুটবল আর গল্পের বইয়ের প্রতি বেশি ছিল। তারপরও মায়াকাননে শম্পা নামে একটা মেয়েকে ভালো লাগত। সত্যি বলতে কি আমার খুব ঘন ঘন বিভিন্ন মেয়েদের পছন্দ হতো। আমি তাদের নিয়ে নিজের মনেই ভাবতাম। একটাতে স্থির থাকতাম না। নারী-পুরুষের কেমিস্ট্রিটা বোঝার পর আমি আসলে তাদের সামনে যেতে লজ্জাই পেতাম। নারীসংক্রান্ত আমার সমস্ত বাঁদরামি কো-এডুকেশনের কলেজে পড়ার সময় শুরু হয়। যদিও শৃঙ্গার নামে লাল মলাটের একটি মোটা বই আমি নবম শ্রেণীতে থাকা অবস্থায়ই পড়ে ফেলেছিলাম।
- বুঝেছি। কলেজে পড়ার আগ পর্যন্ত আপনি নিজের মনেই ডুবে ডুবে জল খেতেন।
- কি জানি। যেসব মেয়েদের আমার পছন্দ হতো তাদের তো সরাসরি বলার সাহস রাখতাম না। বন্ধুদের অনেকেই তখন দুয়েকটা প্রেমট্রেম করে। তাদের নিয়ে গল্পও করে। স্কুলের বন্ধুরা তো আরো অনেক ভয়ানক গল্প করত। আর মেয়েদের কাছে গেলে যে আমি পাত্তা পাব সেই আত্মবিশ্বাসও ছিল না। স্কুলজীবনে আমার চেহারা একদমই বাচ্চা বাচ্চা টাইপের ছিল। তাই ডুবে ডুবে জল খেতাম অর্থাৎ আমার ভাবনাতেই আমি মেয়েদের সঙ্গে প্রেমট্রেম যা কিছু করার করতাম। ও হ্যা, ডুবে ডুবে জল খাবার কথা যখন বললেন তখন একটা ঘটনা বলি।
- এইতো মুখ খুলতে শুরু করলেন। বলুন বলুন ...
- আরে না, এটা মেয়েসংক্রান্ত কিছু না। আমি একবার পুকুরে ডুবে গিয়েছিলাম, সেই ঘটনা।
- তাই নাকি। বলুন তো।
- মায়াকাননে একটা পুকুরে আমরা দুইভাই গোসল করতাম প্রায়ই। সাঁতার পুরোপুরি পারতাম না। সেজন্য খালি গ্যালন পেটের নিচে নিয়ে দুইহাত বৈঠার মতোন বেয়ে বেয়ে মাঝপুকুরে চলে যেতাম। মাঝে মাঝে গ্যালন ছেড়ে দিয়ে সাঁতারের চেষ্টা করতাম। না পেরে হাচড়ে পাচড়ে আবার গ্যালন ধরে ভেসে থাকতাম। ওইদিন দুপুরবেলায় মাঝপুকুরে এমন করছি হঠাৎই হাতের ধাক্কায় গ্যালন দূরে সরে গেল। আমি যতোই আঁকড়ে ধরতে চাই, গ্যালন ততোই দূরে সরে যায়। একপর্যায়ে হাতের নাগালের বাইরে চলে গেল। পুকুরে তখন আমি একা ছিলাম। আমি চিৎকার করে ভাইয়াকে ডাকি। ভাইয়া অল্পবিস্তর সাঁতার পারত। তারপরও আরেকটা গ্যালনটা নিয়ে সাঁতরে আমার কাছাকাছি আসে। আমাকে জাপটে ধরতে গেলে আমিও ভাইয়াকে জাপটে ধরি। ঢেউয়ের ধাক্কায় ওই গ্যালনটাও দূরে সরে যায়। ভাইয়া কোনোমতেই আমাকে ধরে রাখতে পারে না। জাপটাজাপটিতে দুইজনই ডুবতে থাকি। ভাইয়া আমাকে ছেড়ে দিয়ে জাফরকে চিৎকার করে ডাকতে থাকে। ও-ও আমাদের সঙ্গে পুকুরে ছিল। কিছুক্ষণ আগে উঠে সে একটু দূরে রোদে দাঁড়িয়েছিল। জাফর সম্পর্কে একটু বলে নিই। কিছুদিন হয় বাবা-মার সঙ্গে গ্রাম থেকে শহরে এসে স্যাটেল হয়েছে। আমাদের চেয়ে দ্রুত গাছ বাইতে পারে, একঢিলে আম পাড়তে পারে এবং মারাত্মক ডুবসাঁতার দিতে পারে। এগুলো আমাদের জন্য কোনো ব্যাপার না, কিন্তু ওকে হিংসার করার প্রধান কারণ হলো, ওর একটা টিউব ছিল। ও প্রায়ই মাঝপুকুরে সেই টিউব ফুলিয়ে তাতে চড়ে ভাসত। যাহোক, এদিকে আমি ডুবে যেতে থাকি, পানি খেতে থাকি, এবং ততোক্ষণে লাল-নীল-সবুজ অনেক রঙ দেখে ফেলেছি। এর পরের ঘটনা আমার ভাইয়ার মুখে শোনা। ভাইয়ার চিৎকার শুনে জাফর মুহূর্তেই ব্যাপারটা বুঝে ফেলে। প্রথমেই সে টিউবটা ছুড়ে মারে পুকুরে। তারপর নিজে ডাইভ দিয়ে ডুব সাঁতার দিয়ে পুরা মাছের মতো সাঁতরে ১ মিনিটেই আমার কাছে চলে আসে। পানির নিচে আমার জ্ঞান তখনো আছে। আমি অনুভব করতে পারি আমার চুল ধরে কেউ একজন টেনে তুলছে। জাফর আমাকে পানির উপর টেনে টিউবের উপর তুলে দিল। বলতে পারেন এখন আমি দ্বিতীয় জীবন কাটাচ্ছি।
- আপনার মা জানতেন বিষয়টা?
- মাথা খারাপ। আমরা দুইভাই কেউই বিষয়টা বলিনি। বললে পানির তলে না, আম্মার হাতের তলেই বোধহয় মারা যেতাম। তবে আব্বা একবার আমার দস্যিপনা দেখেছিলেন।
- কি করেছিলেন আপনি ?
- নব্বইয়ের গণ অভ্যুত্থান চলছে তখন। আমি ক্লাস টেনে পড়ি। আমার কাছে সেটা মুক্তিযুদ্ধ। সবুজবাগ বৌদ্ধমন্দিরের সামনের অতীশ দীপংকর সড়কে তখন আমরা ব্যারিকেড ব্যারিকেড খেলি। আর্মির জিপ এলেই ইঁদুরের মতো চিঁ চিঁ দৌড়ে গলিঘুপচিতে আত্মগোপন করি। থাকি কিন্তু তখনো মায়াকাননে। রেললাইনের কাঠের স্লিপার তুলে এনে পাড়ার বড়ভাইদের নির্দেশমতো রাস্তায় আগুন জ্বালিয়ে দিই। আগুনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করি। কনস্ট্রাকশনওয়ালা বিল্ডিং থেকে ঢালাইয়ের তক্তা খুলে সেটার পেরেকগুলো সোজা করি রাস্তায় শুইয়ে রাখি। ওপরে মাটি বা কিছু একটা বিছিয়ে দিই। উদ্দেশ্য হলো আর্মির গাড়ি এলে যেন টায়ার পাংচার হয়ে যায়। টায়ার জ্বালিয়ে দিই। সে এক ধুন্ধুমার কান্ড। একদিন মায়াকাননের সামনের রাস্তায় ব্যারিকেড দিচ্ছিলাম হঠাৎ আর্মির একটা জিপ দ্রুত চলে আসে কাছাকাছি। আমি দৌড়ে রাস্তার পাশে মেসবাড়িতে ঢুকে পড়ি। কারো একজনের রুমে ঢুকে আত্মগোপন করতে যাচ্ছি এমন সময় সবাই আমাকে ঠেলে বের করে দিতে চাইছে। আমি অবাক হয়ে কারণ জিজ্ঞেস করি। যেটা জানা গেল তা হলো, আমরা সারাদিন ধরে যেসব ব্যারিকেড দিই, ভোররাতে এসে আর্মিরা এই মেসবাড়ির লোকদের তুলে সেগুলো পরিষ্কার করায়। তাই তারা আন্দোলনকারীদের প্রতি তিতিবিরক্ত। আমাকে ঠেলে মেসবাড়ি থেকে বের করে দেয়া হলো। বেরিয়েই একটা জলপাইয়ের সামনে পড়ে যাই। সঙ্গে সঙ্গে ঘুরেই উল্টোপথে দৌড় দিই। আড়চোখে দেখি জলপাই বন্দুক তাক করেছে আমার দিকে। আমি আরো জোরে দৌড়ে ঝিলে ঝাঁপ দিয়ে পড়ি। তখন মনে হচ্ছিল এই বুঝি গুলি এসে আমার পিঠে লাগল। অল্পজানা সাঁতার আর হাঁচড়ে পাঁচড়ে কোনোমতে কবরস্থান দিয়ে বাসার দিকে যাচ্ছি দেখি আব্বা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি এমনভাব করলাম যেন হাঁটতে গিয়ে পা পিছলে ঝিলে পড়ে গেছিলাম।
- কিন্তু গুলি তো খেলেন না।
- খেলে কি আর এই ইন্টারভিউ দিতে পারতাম? অভ্যুত্থানের প্রায় শেষের দিকের দিন ছিল তখন। জলপাইরাও মানুষ মেরে ক্লান্ত হয়ে গেছিল। ওই জলপাইটা বন্দুক তুলেছিল অথচ গুলি কেন তুলেছিল জানি না। তবে আমার বড়ভাই ছিড়া গুলি না কিসব বলে ওগুলো খেয়েছিল। তার পিঠ মোটামুটি ঝাঝড়া হয়ে গেছিল। আরো একটা ঘটনা ঘটেছিল নব্বইয়ের অভ্যুত্থানের সময়।
- কি সেটা?
- তখন পাড়ার ভিডিও দোকানগুলোতে ভিডিও গেমস খেলার চল ছিল। এরকম কারফিউর সময় আমি এক বন্ধুর সঙ্গে দোকানে গেম খেলছিলাম। রব উঠল, আর্মি আইতাছে। সাথে সাথে শাটার ফেলা দেয়া হলো দোকানের। কিন্তু আর্মি ঠিকই বুঝে ফেলল দোকানটা খোলা ছিল। বাইরে থেকে শাটার তোলার আওয়াজ আসতেই আমি ডেস্কের তলে লুকিয়ে পড়ি। আর্মি সবাইকে বের করে নিল। আমার ভাগ্য ভালো ডেস্কের তলে চেক করেনি। আমার বন্ধুকেও বের করে নিল। তারপর তারা দোকানের তালা মেরে দিল। আমরা ভিতরে বসে শুনতে পাচ্ছি আর্মিদের হুংকার আর বাকি সবার আর্তচিৎকার। আমার কলিজা হিম হয়ে গেল। শালা ছুটির ঘন্টা আমার জীবনে ঘটে গেল? এভাবে ঘন্টা তিনেক কাটল। তারপর হঠাৎ বাইরে থেকে আমার বন্ধুর গলার আওয়াজ শুনি। আর্মিরা তাকে বের করতেই সে দৌড়ে পালিয়ে গিয়েছিল। পরে এই বন্ধুই ভিডিও দোকানের মালিকের কাছ থেকে ডুপ্লিকেট চাবি নিয়ে এসে আমাকে মুক্ত করেছিল।
- তারপর?
- এইতো। প্রিটেস্টে এক সাবজেক্টে ফেল করলাম। ভাবলাম পড়াশোনা সিরিয়াসলি করতে হবে। সেইসময়ে বাবা সরকারি কোয়ার্টার পেলেন আজিমপুরে। ই টাইপ-অনেক বড় বাসা। ৩/৪ টা রুম, বারান্দা। আম্মা খুব খুশি হলেও আমরা হলাম না। আজিমপুর যেতে ইচ্ছে হলো না। বাবার সরলতার কারণে ও সরকারি দীর্ঘসূত্রিতার কারণে একসময় খবর পেলাম ওই বাসা আব্বারই আরেক কলিগ নিজের নামে এলোকেশন করে নিয়েছেন। আব্বার যেন একটু আত্মসম্মানে লাগল। আমার অতিশান্ত আব্বাজান একটু খেপে গেলেন। বিভিন্ন সরকারি পর্যায়ে লেখালেখি করে কোয়ার্টার আদায় করলেন। কিন্তু আজিমপুরে নয়, মতিঝিলে। বড় বাসা নয়, এফ টাইপের ২ রুমের বাসা। আমরা সেই বাসায় উঠে গেলাম। আম্মার জন্যও সুবিধা হলো। কেননা আম্মা তখন রাজনীতি শুরু করেছেন। মতিঝিল থেকে সবুজবাগ যেতে তার কষ্ট তেমন হবে না।
- আপনার আম্মা রাজনীতি করতেন?
- আওয়ামী লীগের রাজনীতি করতেন সবুজবাগ এলাকায়। বর্তমানে মতিঝিল থানা মহিলা আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি। সেইসময় আম্মার রাজনৈতিক বক্তব্যগুলো আমি লিখে দিতাম। এতোক্ষণ তো আমার ছেলেবেলার অনেক কথাই শুনলেন। প্রায়ই আম্মার প্রসঙ্গ এসেছে। আমি আম্মা সম্পর্কে আরো একটু বলতে চাই।
- অবশ্যই। আপনি বলুন।
- আমার আম্মা ছিলেন নানার ছোটমেয়ে। খুবই দস্যি ছিলেন তিনি। হিন্দুবাড়ির মন্দির থেকে আম, কলা চুরি করা থেকে শুরু করে গাছগাছালির নামকরণ সবই করতেন তিনি। আমার বড়খালা বিয়ের পর থেকে ঢাকায় থাকতেন। সেই খালার কাছে আম্মা বিয়ের পূর্বে মাঝে মাঝে এসে থাকতেন। তখন থেকেই তার স্বপ্ন ছিল তিনিও বিয়ের পর ঢাকায় এসে সেটল হবেন। আম্মার যখন বিয়ে হলো তখন বেশ কিছুদিন দাদাবাড়িতে ছিলেন। আব্বা ঢাকায় চাকরি করতেন, ছুটিছাটায় গ্রামে যেতেন। তখন আম্মা বারবার আব্বাকে তাগাদা দিতেন ঢাকায় নিয়ে যাবার জন্য। অবশেষে বিয়ের কিছুদিন পরেই আব্বা আম্মাকে ঢাকায় নিয়ে এলেন। তখন দাদাবাড়ির অনেকেই ফোড়ন কেটেছিল, হিতি ঢাহায় কিল্লাই যাইত, আন্ডা বেক বুঝি। বাইস্কোপ চাইত আর ঘুরি বেড়াইত আরি। আন্ডা হোলাহাইন কি গ্রামে থাই মানুষ অয় ন? সবকিছুকে তুচ্ছজ্ঞান আম্মা ঢাকায় এলেন। আমার মনে আছে, ছোট দুই শিশুকে কোলে নিয়ে তিনি স্কুলে যেতেন। আমি একেবারেই হাঁটতে চাইতাম না। বারবার বলতাম, আম্মা রিক্সায় চড়ব। তখন আমাদের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না। আম্মা বলতেন, রিক্সা কেন? বাবা তুমি গাড়িতে চড়। এরচেয়ে দামি গাড়ি আর নেই। বলেই মা আমাকে কোলে নিয়ে নিতেন। বড়ভাই মাঝে মাঝে ঘ্যান ঘ্যান করত। মা তখন দুইজনকে কোলে নিতেন। রাস্তা দিয়ে একজন মহিলা দুইশিশুকে কোলে নিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন, হয়তো পথচারীরা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকত। গোপীবাগ এলাকায় প্রায়ই মারামারি হতো। স্কুল ছুটি হয়েছে, পথিমধ্যে মারামারি শুরু হয়ে গেল, আম্মা আমাদের কোলে নিয়ে দৌড়ে বাসায় ফিরতেন। হয়তো তখন শাড়িতে পা জড়িয়ে গেছে, হোঁচটও খেয়েছেন অনেক, কিন্তু আমরা টের পেতাম না। আব্বা ছিলেন উন্নাসিক, সম্পূর্ণ অবৈষয়িক একজন মানুষ। মাঝে একবার আমাদের তিনমাসের জন্য গ্রামে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। আম্মা সেখানে থেকে আবার ঢাকায় ফিরে আসেন। তার প্রচন্ড ইচ্ছা ছিল আমাদের ঢাকায় মানুষ করবে, ভালো স্কুলে পড়াবে। আম্মা তিলতিল করে পয়সা জমিয়ে আমাদের সংসারে সুখ এনেছেন। আমাদের প্রয়োজনে যেরকম শাসন করেছেন, মেরেছেন তেমনি আদর সোহাগও করেছেন। আমার আম্মা হলেন পৃথিবীর সেরা রাঁধুনি। তিনি পারেন না এমন কিছুই নেই। কি সেটা মিষ্টি, দই অথবা ঝাল অন্য কিছু। আতিথেয়তায় কখনো তার কার্পণ্য দেখিনি। আজকে বড়াই করার মতো অনেক উপাদান হাতের কাছে আছে, সবকিছুই আম্মার কারণে। ছোটবেলায় যতোই দুষ্টুমি করি না কেন কখনোই আম্মাকে জানাতে চাইনি। আমার স্বর্ণালী ছোটবেলা পুরোটাই তার হাতে তৈরি। লজ্জা পেতাম বলে আম্মাকে বলতাম, তুমি আমাদের সঙ্গে আর স্কুলে যাবা না। আমরা তো বড় হয়ে গেছি। সেই মা এসএসসি পরীক্ষার সময় আমাদের নিজে পরীক্ষাকেন্দ্রে দিয়ে এসেছেন। আমরা তখন না করতে পারিনি। দাদাবাড়িতে গেলে সবাই বলত মাস্টরের ছেলে। আর নানাবাড়িতে গেলে আমরা হয়ে যেতাম নাসিমের ছেলে। ওইটাই তখন বড় পরিচয় হয়ে যেত আমাদের। একরুমের সাবলেট থেকে তিনি তার সংসার শুরু করেছেন। মনে আছে, আইসক্রিম খাবার বায়না করতাম ঘনঘন। আম্মা কিস্তিতে ফ্রিজ কিনে ফেললেন। আমাদের আইসক্রিম বানিয়ে খাওয়াতেন। ফেনী অঞ্চলের লোকজন মধ্যপ্রাচ্যে জীবিকার উদ্দেশ্যে যাওয়া আসা বেশি করেন। আম্মা নাক সিঁটকে বলতেন, ধুর। আমার ছেলেরা লন্ডন আমেরিকা যাইব। এই লন্ডনে বসেই যখন আমার ছেলেবেলা লিখছি তখন শুধু আম্মার কথাই মনে পড়ছে। আম্মা আমাকে ভালো বুঝতেন। আমার যাবতীয় সৃষ্টিশীল কাজে তিনিই প্রথম উৎসাহ দিয়েছেন। কঠিন শাসন আর কোমল সোহাগে তিনি গড়ে দিয়েছেন আমার স্বর্ণালী ছেলেবেলা ... স্যরি, আমি বেশি আবেগী হয়ে গেলাম হঠাৎ করে।
- না না ঠিক আছে। আপনি বলতে থাকুন।
- আর কিছু বলার নেই। আমার মনে হয় আমার ছেলেবেলার কথা বলা শেষ। এসএসসি পাশ করার পরপরই ছেলেবেলা শেষ হয়ে বলেই আমার ধারণা। আমি স্টারমার্ক আর ভাইয়া প্রথম শ্রেণীতে এসএসসি পাস করি। আমরা দুইভাইয়ের একসঙ্গে পড়াশোনাও সেখানে শেষ হয়ে যায়। দুইজনে ভিন্নভিন্ন কলেজে ভর্তি হই। ঘর ছেড়ে বাহিরপানে টান বেড়ে যায় বেশি। ছোটবেলার চেয়ে আমি আরো দুরন্ত হয়ে উঠি এসএসসি পাশ করার পর।
- কি বলছেন। এতোক্ষন ছেলেবেলা শুনে তো মনে হলো আপনি তখনও কম দুরন্ত ছিলেন না।
- সেটা মনে হতে পারে। কিন্তু আমি দুষ্টুমি করলেও ক্লাস টেন পর্যন্ত অতো বেয়াড়া ছিলাম না। আমি বাসায় আম্মাকে সাহায্য করতাম। আপনি অবাক হবেন আম্মার কাছ থেকে দেখে দেখে আমি বাটিক কিংবা টাইডাইয়ের কাজ পারতাম। আম্মা কেটে রাখলে সেলাই মেশিনে আমি ব্লাউজও সেলাই করতে পারতাম। বাসায় মেহমান এলে আমি চা বানিয়ে খাওয়াতাম। সেই আমি লন্ডনে আড়াই বছর ধরে আছি, অথচ এখনো রাঁধতে পারি না। আমি ছোটবেলায় গোছানোই ছিলাম বেশ। তবে দুষ্টুমি যা যা করতাম সেটা কেউ বুঝতে পারত না। বলতে পারেন মিচকা শয়তান ছিলাম। খালাতো ভাই কল্যাণ মিলে খুব দুষ্টুমি করতাম। গোড়ানে জাকের পার্টির মাহফিল থেকে স্যান্ডেল চুরি করা অথবা ঈদের দিন শিশুপার্কে ছেড়া টিকেট দিয়ে রাইড চড়া এসব ফাজলামো করতাম। এইতো ...
- না না। এতো তাড়াতাড়ি শেষ করলে তো হবে না।
- শেষ তো করতেই হবে। আচ্ছা তবে দুটো ঘটনা বলে নিই। ঘটনাগুলো করুণ কিংবা মজার কিংবা ভয়াবহ কিংবা গুরুতর। প্রথমটা হলো, আমি একবার ম্যানহোলে পড়ে গিয়েছিলাম।
- হা হা হা। তাই নাকি? খুলে বলুন।
- আমার খেয়াল নেই। হয়তো এসএসসির আগে আগেই ঘটনাটা ঘটেছিল। আমি ও বন্ধু পারেক হেঁটে যাচ্ছি। তখন প্রায় ম্যানহোলের ঢাকনা চুরি হয়ে যেত। হাঁটতে হাঁটতে আমি সেটা খেয়াল করেছিলাম। ম্যানহোলের কাছাকাছি আসতেই আমি সেটা টপকে যেতে একটা ছোট লাফ দেই। কিন্তু মাপে ভুল হয়ে যাওয়ায় আমার এক পা ম্যানহোলে ঢুকে যেতেই আমি ব্যালেন্স করার চেষ্টা করি। কিন্তু সামলাতে না পেরে আমার দুইপা ম্যানহোলের ভিতর চলে যায়। আমি সঙ্গে সঙ্গে দুইহাত দুইদিকে ছড়িয়ে নিজেকে ঠেকাই। পরে বন্ধু পারেক আমাকে উঠায়। হোসপাইপ দিয়ে পানি ছিটিয়ে আমার শরীর থেকে সমস্ত বিষ্ঠা সরানো হয়। আমি সেদিন দুইটা লাক্স সাবান গায়ে ঘষে শেষ করেছিলাম।
- স্যরি, আমি ঘটনা শুনে বেশ মজাই পেলাম। তার মানে, পরের ঘটনাটা নিশ্চয়ই ভয়াবহ।
- বলা যেতে পারে।
- কি সেটা?
- আমি একবার গণপিটুনী খেয়েছিলাম।
- মাইগড। বলেন কি? কারো পকেট মেরেছিলেন নাকি?
- না, সেই মারামারি।
- খুলে বলুন তাড়াতাড়ি।
- তখন কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি। কলোনিতে থাকি। সেসময় সিনিয়রিটি জুনিয়রিটি নিয়ে গ্রুপে গ্রুপে মারামারি হতো। বন্ধুবান্ধবের কেউ কেউ তখন সো-কলড রংবাজ কিংবা মাস্তান। আমি এসবের ধারেকাছেও ছিলাম না। তারপরও পাকে জড়িয়ে যাই। সবুজবাগের একটা জুনিয়র ছেলে বেয়াদবি করেছে, জাস্ট মুখে একটু সাবধান করে দেয়া হবে। যেহেতু ওই ছেলের সঙ্গে আমার ভালো সম্পর্ক, তাই তার বাসা থেকে আমাকে ডেকে দিতে হবে। আমি সেই কাজটা করে দিই। কিন্তু সেদিন বোঝানোর সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটাকে একটু রগড়ে দেয়াও হয়। ঘটনার কয়েকদিন পর আমি সবুজবাগে গেলে ওই ছেলের কয়েকজন বন্ধু আমাকে ঘেরাও করে। ওই ছেলেকে মারার কারণ জানতে চাই। ছেলেগুলো জুনিয়র হয়ে আমাকে চার্জ করছে বলে আমার মেজাজ খিচড়ে যায়। আমি প্রচন্ড গালিগালাজ করি। একাই চিৎকার চেঁচামেচি করে পাড়া মাথায় তুলি। এই সবুজবাগে আমি এতোদিন থেকে গেছি, কে কি করবে আমার। ছেলেগুলো আমার তিড়িংবিড়িং দেখে চলে যায়, আমি বৌদ্ধমন্দিরে আমার বন্ধুদের কাছে যাই। ঘন্টাখানেক পরে বেরোতেই দেখি সামনে অপরিচিত পাঁচজন ছেলে। বলা নেই কওয়া নেই, ঠাস করে একটা চটকনা মেরে বলল, রংবাজি োদাও। অই তুই থাকস কই যে ছেলেটা প্রথম হিট করল আমাকে তার চেহারাটা চিনে রাখি। পাঁচজনের সঙ্গে আমার হাতাহাতি লেগে যায়। ওইদিন কমলাপুর স্কুলের এসএসসি পরীক্ষার্থীদের ফেয়ারওয়েল ছিল। আমি তাকিয়ে দেখি প্রায় ৫০/৬০ জনের একটা গ্রুপ ঢেউয়ের মতো বড় রাস্তার ঢাল বেয়ে বৌদ্ধমন্দিরের দিকে আসছে। কারো হাতে লাঠি, কারো হাতে ইট। আমি সাবধান হয়ে যাই। হাতাহাতি বন্ধ করে শরীর ঢিলা করে দেই। এবার আর আঘাত নয়, আত্মরক্ষা। আমি অন্যদের হাত-পায়ের মাইর ঠেকানোর চেষ্টা করি না। সমানে কিল-ঘুষি-লাথি-চড় খেয়ে চলছি। কিন্তু খেয়াল রাখছি কেউ আমাকে লাঠি কিংবা চেইন কিংবা ইট কিংবা অন্যকিছু দিয়ে মারে কিনা। আমি শুধু ওইগুলোই ঠেকিয়ে যাচ্ছি। শরীরের মাইর শরীর সইবে। কিন্তু অন্যকিছুর বেকায়দা আঘাত আমার জীবন শেষ করে দিতে পারে। আমার কুংফুজ্ঞান (আত্মরক্ষার কৌশল) এদিন কাজে লেগেছিল। প্রায় ১৫ মিনিট চলল এই অবস্থা। এরমধ্যে পরিচিতি সিনিয়র ভাইয়েরা এসে আমাকে ওই অবস্থা থেকে উদ্ধার করে কমলাপুর স্টেশন পর্যন্ত দিয়ে আসে। কিন্তু আমি আর সেই পাঁচজন ছেলেকে দেখিনি।
- ঘটনা তো বেশ সিরিয়াস। মুরুব্বিদের দোয়ায় আপনি তো বেঁচে ফিরেছেন।
- তা বলা যায়। পরে এই ঘটনা নিয়ে মারামারি-পাল্টা মারামারি হয়েছিল। যে ছেলেটা আমাকে প্রথম মেরেছিল তাকে আমি রেলওয়ে হাসপাতালে একদিন পেয়ে যাই। সেদিন তাকে মেরেছিলাম। ওই ছেলেদের ছোটভাইয়েরা এসএসসি পরীক্ষা দেবে। কেন্দ্র ছিল টিএন্ডটি কলেজ। ঘোষণা দেই একটারেও পরীক্ষা দিতে দিব না। পরে পাড়ার কমিশনারকে নিয়ে এসে আমাদের কাছে মাপ চেয়ে যায়।
- যাক, ভবিষ্যতে এরকম ঘটনার সম্মুখীন হবেন না আশা করি।
- তা আর বলতে। এখন আমি অনেকটাই কুল ম্যান ... হা হা হা ...
- অনেক ধন্যাবাদ অলৌকিক হাসান। আপনার মজাদার ও স্বর্ণালী ছেলেবেলা আমাদের বলার জন্য।
- আপনাকেও ধন্যবাদ। সেইসঙ্গে সচলায়তনকে ধন্যাবাদ। নিজের ছেলেবেলা বলার সুযোগ করে দেয়ার জন্য। সম্পাদক আরিফ জেবতিককে ধন্যবাদ উদ্যোগের জন্য। আর সকল ব্লগার কিংবা পাঠকদেরও শুভেচ্ছা। ভালো থাকবেন সবাই।

এটি একটি কল্পিত সাক্ষাৎকার। এবং সম্পূর্ণ লেখাটি আমার প্রিয় মা কে উৎসর্গ করা হলো।

Monday, 1 October 2007

আমার 'মাস্টর' বাবা ...

- এ্যারে, হোলা ইয়া কন রে ?
- চিনেন ন? আন্ডা মাস্ঠরের হোলা।
- হাছানি? হোলা দি বড্ডা অই গ্যাছে। তো মাস্ঠর বাইত আইছে কবে?
- কাইল্ল্যা আইছে।
- ভাতিজা কি খাইবা? ছা না পান্টা?
- জ্বি না। কিছু খাব না।

ছোট আমি লজ্জায় না বলি। ফুফাতো ভাইদের সঙ্গে টুকটুক করে বাজারে ঘুরে বেড়াই। তখনও জানি না বাবাকে মাস্টার কেন বলা হয়।

একটু বড় হয়ে বাবাকে জিজ্ঞেস করে মজার তথ্য জানি। বাবা যখন মেট্রিক পাস করে তখন গ্রামের সবাই তাকে মাস্টার ডাকা শুরু করে। বাবার আগে গ্রামে আরেকজন মেট্রিকপাস করেছিল। পরে সে গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষক হিসেবে জয়েন করে। সবাই তাকে মাস্টার বলত। সে ধারাবাহিকতায় মেট্রিক পাসের পর বাবাকেও মাস্টার ডাকার চল শুরু হয়ে যায়। অথচ এই মেট্রিকপাস করতে গিয়ে বাবাকে কম ঝামেলা করতে হয়নি।

অতো বেশি ইংরেজি কেন পড়তে হবে - এই ধারণায় বাবাকে মেট্রিক পরীক্ষা দেওয়াতে উৎসাহ দেয়া হয়নি। আমার দাদা-দাদী তখন বেঁচে ছিলেন না। তাই বাবারও কারো কাছে আব্দারের জায়গা ছিল না। বাবার ফরম ফিলাপের পয়সা জোগাড় হচ্ছিল না। কিন্তু বাবার খুব ইচ্ছা ছিল মেট্রিক পরীক্ষা দিবে। সেই সময় বাবার দূরসম্পর্কের এক খালা বাবাকে একটা বুদ্ধি দিলেন। নতুন ঘর উঠানোর জন্য তখন দাদাবাড়িতে চাচারা টিন কিনে রেখেছিলেন। বাবা একরাতে সেইগুলো চুরি করে বেচে দিয়ে সোজা চট্টগ্রামের মিরসরাই চলে গেলেন। মেট্রিক পরীক্ষা দিয়ে তবেই ফিরলেন। আমার বাবার সারাজীবনে এটাই প্রথম এবং শেষ সাহসী কর্মকান্ড।

আমার বাবা বিয়েপূর্বক খুব অল্পসময়ের জন্য প্রেম করেছিলেন। মা-র সঙ্গে বিয়ে ঠিক হবার পর বড়মামাকে বাবা পড়াতেন। তখন মা-র সঙ্গে মাত্র এনগেজমেন্ট হয়েছে। সে সময়ে মা-র সঙ্গে নাকি একটু প্রেম প্রেম সময় কেটেছিল। মা আমাদের গল্প করতেন, তোর বাবা যখন ঢাকায় চলে আসবে তখন আমি একটা বড় পেয়ারা দিয়েছিলাম যেন যাত্রাপথে খায়। তোর বাবা সেটা না খেয়ে ঢাকায় নিয়ে আসে। পরে অফিসের সমস্ত কলিগদের ছোট ছোট ভাগ করে ওই পেয়ারাটা খাইয়েছিল।

বাবা হলেন চরম শান্ত স্বভাবের একটা মানুষ। মা-র হাজারো চেঁচামেচিতে কখনো রা করতেন না। অবৈষয়িক বাবা ঘুষটাও খেতে পারেন না। তার কলিগদের বাড়ি-গাড়ি হয়ে যায় অথচ তার সরকারি কোয়ার্টারের এলোকেশন ক্যানসেল হয়ে যায়। আমার মাস্টর বাবা এসবে বিরক্ত হন না।

একবার বাবা খুব রেগে গিয়েছিলেন। পরীক্ষার আগের রাতে আমি কিশোর থ্রিলার বইয়ের তলায় লুকিয়ে পড়ছিলাম। মা-র হাতে ধরা পড়ে যাই। অমনি মা-র চিৎকার চেঁচামেচিতে সারা বাড়ি মাথায় উঠল। আমার শান্ত বাবাও খেপে গেলেন। দুমদাম মার দিলেন আর পিড়ি দিয়ে টিভিটা ভেঙে ফেললেন। ওইদিন প্রচন্ড ভয় পেয়েছিলাম।

সেই শান্ত বাবাই আরো একবার ভয় পাইয়ে দিয়েছিল আমাকে। ১২ এপ্রিল ২০০৫। ওইদিন রাত ১১টায় আমার লন্ডন ফ্লাইট। জীবনে এই প্রথম বিমানে চড়ব। ঘুম থেকে সকাল ৯টার সময় উঠে বারান্দায় গিয়ে দেখি বাবা পেপার পড়ছেন। আমি আমার রুমে চলে আসি। কিছুক্ষণ পর মা এসে বলে, দেখতো তোর বাবা জানি কেমন করছে। আমি দৌড়ে যাই। বাবা তখন বুকে হাত ঘষতে ঘষতে বলছে, আরে না। আমার কিছুই হয়নি। মা সন্দেহের সুরে বলে, হার্ট এ্যাটাক না তো? আমি তড়িঘড়ি করে বাবাকে সোহরাওয়ার্দী নিয়ে যাই।

বাবাকে হাসপাতালের বারান্দায় মাটিতে শুইয়ে রাখা হয়েছে। কোনো সিট নেই। আমি দিশেহারা হয়ে যাই। আমার বাবা মাটিতে আর আমি যাব লন্ডনে। ডাক্তাররা একগাদা পরীক্ষা করতে দিয়েছে। আমি পাগলের মতো ছুটছি। লন্ডনের মায়রে বাপ। টিকেট ক্যানসেল করতে হবে। কিন্তু কেমনে? বাবা তখনও কথা বলতে পারে। কাছে ডেকে বলে, তুই চলে যাস। আমার কিছুই হয় নাই। আমি বলি, তুমি কথা বোলো না তো।

এরপর ব্যস্ত হয়ে পড়ি আমার মোবাইল ফোন নিয়ে। নানান জায়গায় ফোন করে পরবর্তী ২ ঘন্টার মধ্যে সব সিস্টেম করি। প্রচুর আত্মীয়-স্বজন আর বন্ধুবান্ধব দিয়ে হাসপাতাল ভরে ফেলি। বাবাকে সিটে তুলি। বিকেল হয়ে যায়। ডাক্তাররা বলেন, মাইল্ড স্ট্রোক হয়েছে। মাত্র ৪টা সেল কলাপস করেছে। ঠিক হয়ে যাবে। বাবার কাছে যাই। বাবা নরম স্বরে বলে, তুই লন্ডন যা। আমি ঠিক হয়ে যাব।

গত ৯ আগস্ট ২০০৭ বাবা রিটায়ার্ড করেছেন। গতবছর বাবার হার্টের অস্ত্রোপচার হয়েছে। এখন অনেকটাই সুস্থ আছে। সারাজীবন নরম বাবা এখন আরো নরম হয়ে গেছে। ঢাকায় থাকতে বাবাকে আমি জিন্স আর রঙ্গিন টি-শার্ট জোর করে পড়াতাম। ছোটভাইকে বলেছি সবসময় বাবাকে কৌতুক শুনাতে। যেন প্রতিদিনই তিনি কিছুক্ষণের জন্য হাসেন।

বাবা একবার বলেছিলেন, সরকারি স্কেলের সর্বনিম্ন স্যালারি পাওয়া লোকেরাও ঈদ করে, পোস্ট অফিসে টাকা জমায়। কতো এমএ বিএ পাস ছেলে আমার কাছে পিয়নের চাকরি করতে আসে। তোরা কেন পড়াশোনা করস না? ঠেলাগাড়ি চালাইয়া খাইতে হইব।

বাবার এখন সময় কাটে পেপার পড়ে আর ছোটভাইয়ের সঙ্গে গল্প করে। মা-কে বলেছি বাবাকে নিয়ে মাঝে মাঝে গ্রামে যেতে। মা ঝামটা মেরে উঠে, রাখ তোর গ্রাম। তোর বাবা তো প্ল্যান করছে গ্রামে বাড়ি বানাইব।

আমি হাসি। বাবার অবস্থান বুঝতে পারি। ইংরেজি পড়তে গিয়া বাবু হয়ে শহরে স্যাটেল হয়েছে। কিন্তু বাবার সবসময় গ্রামে মন পড়ে থাকে। আমি খেয়াল করেছি বাবা গ্রামে গেলে মন ভাল থাকে। আমার ইচ্ছা আছে শেষ বয়সে বাবা যেন গ্রামে বেশ সময় কাটাতে পারে তার জন্য একটা ছোট বাংলো টাইপের বাড়ি করব। দেখি কতোদূর কি করা যায় ....

Monday, 24 September 2007

স্বপ্ন ...

১.
- লাস্ট বাস কয়টায়?
- দেড়টায়।
- তাহলে তো অনেক সময় আছে।
- হুমম।

২.
- উমমম্।
- জান একটা ...
- উমম! বাবু হয়ে গেছ তুমি?
- হুউমম।

Saturday, 1 September 2007

আমি ছাই আগেই ভালো ছিলাম ...

তারা খিলখিল করে হাসে
ভুরু নাচিয়ে কলকল করে
ঢলঢল করে ঢলে পড়ে
তারপরও তাদের ছুঁতে পারি না
ধ্যাত্তরি, আমি ছাই আগেই ভালো ছিলাম ...

আমি লেস্টারস্কয়ারের সেক্সশপ দেখি
অজানা ভাষায় হেঁটে চলা নিতম্ব
আর তাদের স্তনের গিরিখাত দেখি
দেখি আর চোখ ফিরিয়ে নিই
ধ্যাত্তরি, আমি ছাই আগেই ভালো ছিলাম ...

থিয়েটারের মেয়েটি বলত, তুমি নচ্ছার, দুষ্টু
শুধু আমার ঠোঁটই চোষো, জানো না
আমার বুকে তুমি হারিয়ে যেতে পারতে
আমি হাসি, আর তাকিয়ে থাকি
হায়, আমি তখন বেশ ভালোই ছিলাম ...

বিদেশ বিভুঁইয়ে বিভ্রান্ত এখন
খুঁজে ফিরি, খালি খুঁজে ফিরি
তুমি কানতা, আমি তখন হাসতাম
হাসতাম আর এখনো হাসি, আর ভাবি
ধ্যাত্তরি, আমি ছাই আগেই ভালো ছিলাম ...

তুমি ফোন এখনো করলে না, জানি
তুমি ব্যস্ত তাকে নিয়ে, ওরও
আজকে বিশেষ দিন, পারো না তা এড়াতে
তুমি চাও নিশ্চিত জীবন, আর আমি.
ফাজিল একটা, তাই, ধ্যাত্তরি
আমি ছাই আগেই ভালো ছিলাম ...

শোনো বাল, তোমারে আমি ভালোবাসি
হা হা হা হা হা হা হা (মাতলের হাসি)
আমার ওরে চোদার টাইম নাই
সেইটা তুমিও জানো, জানো বলেই
তুমি আপোষ করো, আর আমি
ধ্যাত্তরি, আমি ছাই আগেই ভালো ছিলাম ...

তুমি তো আমাকে ফোন করবেই
আজ নয়তো কাল, নয় পরশু, নয় তরশু
তুমি থাকতে পারবে না আমাকে ছাড়া
পারবে না তুমি থাকতে একদমই
বললাম তো, আমাকে ছেড়ে।

আমি জানি তুমি সংসার করবে
কিন্তু ভালো তো বাসবে শুধু আমাকে
হা হা হা হা হা হা হা হা (মাতালের হাসি)
আমি তাই ভেবে এখন খুব ভালো আছি।
আমি ছাই আগামীতেও ভালো থাকব ...

কারণ আমি জানি যে
তুমি নিশ্চিত জানো
আমি ছাড়া আর কেউ
তোমাকে এতো ভালোবাসেনি।
ভালোবাসবেও না.....

________________________
১ সেপ্টেম্বর, ২০০৭, শনিবার॥

Monday, 20 August 2007

বিজ্ঞাপনোষ্টালজিয়া ...

সচলায়তনে রাসেল বিজ্ঞাপন নিয়ে পোস্ট দিয়েছিল। পড়েই নষ্টালজিয়ায় পড়ে গেলাম। আহারে সেইসব বিজ্ঞাপন ...

স্মৃতি হাতড়ানো শুরু করলাম। এখন বাংলাদেশে বিজ্ঞাপনের বাজারে নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। কতো রঙের, কতো বাহারের বিজ্ঞাপন। কোনটা জিঙ্গেল বেইজড, কোনটা গল্প বেইজড। কতো মডেল, কতো স্মার্ট তারা। কিন্তু আমার মনে পড়ে গেল ম্যানোলার সেই বিজ্ঞাপন,

ম্যানোলা মানে টলমল শিশিরের লাবণ্য
ম্যানোলা মানে কমোলীন সুরভী অনন্য।

আহা! কেন যেন মনে হয় সেই মডেলের মতো সৌন্দর্য্য হাল আমলের মডেলরা ধারণ করে না।

এখন শুরু হয়েছে গল্পভিত্তিক বিজ্ঞাপন নির্মাণের ধুম। ভালোই লাগে। অথচ কেন জানি সেরা মনে হয় সেই ফিলিপসের বিজ্ঞাপন,

ও মানিক কি বাত্তি লাগাইলি ..
... মাছের রাজা ইলিশ, বাত্তির রাজা ফিলিপস।

অথবা জীবনবীমার সেই বিজ্ঞাপন। দুটো বুড়োবুড়ি পার্কে হাঁটছে। আহা, কে কবে বানাতে পেরেছে এমন প্রেমের অপরূপ দৃশ্যরূপ।

এখনকার বাংলাদেশের বিজ্ঞাপনের মডেলদের হাসি প্রাণ জুড়িয়ে দেয়। হয়তো বা। কিন্তু এই হাসি শেল হয়ে বুকে বিঁধতে পারত যদি ব্যবহার করতেন দাঁতের মাজন। সুরে সুরে পড়ে দেখুন মনে করতে পারেন কিনা,

এপি দশন চূর্ণ সেরা দাঁতের মাজন
দাঁতের মাড়ি শক্ত, করে দশন চূর্ণ
মাড়ির ব্যথায় আরাম দেবে
এপি দশন চূর্ণ

... এপি দশনচূর্ণ এখন থেকে ব্রাশেও ব্যবহার করা যাচ্ছে।

ক্রিকেটাররা এখন কমান্ডো ট্রেনিং নিচ্ছে। মডেলিংও করে আজকাল। ক্রিকেটের চাপে আজকের ফুটবলের এই তথৈবচ অবস্থা ফুটবলার সালাহউদ্দিন কি তখন ভাবতে পেরেছিলেন গোসল করার সময়?

স্বাস্থ্যকে রক্ষা করে লাইফবয়
লাইফবয় যেখানে, স্বাস্থ্যও সেখানে
লাইফবয়-য়-য়-য়

অথবা সেই টাচি জিঙ্গেল,

টাচ টাচ টাচ ... গ্যাকোটাচ ...

আজ কই গেল সেই রেক্সোনা অথবা হৃদয় খিঁচে নেয়া ঠোঁট সুরু করে বলা সেই মেয়েটি ইটস কুল...ইটস ফ্রেশ...সুপার লেমনডিউ
ডিটারজেন্টের যুগ তখন ছিল না। কিন্তু মা-দের আত্মবিশ্বাস ছিল ওই জিঙ্গেলে,

এক ঘষাতে অনেক কাচে
কোন সাবান কোন সাবান
নিরালা নিরালা, নিরালা বল সাবান

তাতেও মা-দের মন ভরে না। স্কুলশার্ট আরো শাদা করার জন্য মা-দের কি প্রচেষ্টা। ভাগ্যিস তখন ছিল ওই বিজ্ঞাপনটি,

শেষ হয় না কাপড় ধোয়া
যদি না হয় নীলের ছোঁয়া
রবিন লিকুইড ব্লু

আজকাল এনিমেটেড বিজ্ঞাপনের অভাব নেই। কিন্তু ছাড়িয়ে যেতে পেরেছে কি ওই বিজ্ঞাপন, যেখানে রাজকন্যার দীর্ঘ চুল বয়ে নিয়ে যাচ্ছে সখীরা। নেপথ্যে বাজছে,

রূপবতী সখী তোরে
কেশবতী করে দিল
এপি পনেরো কেশতেল

অথবা ইভটিজিংয়ের সেই বিজ্ঞাপনটি?

ও কেশবতী কন্যা,
ফুল নেবে গো ফুল ... নেও না চাঁপা ফুল
চুলে আমার চাঁপা মাখা ... চাই না চাঁপা ফুল

ইউরোপে এসে ইটালির বিখ্যাত চামড়ার জুতা ব্যবহার করি। কিন্তু মন টানে ওই জিঙ্গেল,

রূপসা রূপসা রূপসা
নরম নরম হাওয়াই চপ্পল রূপসা

আচ্ছা প্রথম জিঙ্গেল বেইজড বিজ্ঞাপন কোনটি? অনেকে বলে থাকে মডেল তানিয়ার ইকোনোর সেই বিজ্ঞাপনটি,

লোনলি ডেজ ... লোনলি নাইটস
ইউ আর ফার এওয়ে

আবার অনেকে বলেন সেই বিজ্ঞাপনের কথা যেখানে ওড়না ছাড়া মিতানূরকে দেখে নিয়ত শিউরে উঠতাম,

আলো আলো ... বেশি আলো
শব্দ শব্দে ... মন মাতানো
অলিম্পিক অলিম্পিক ব্যাটারি

কিন্তু আমি মনে করি প্রথম জিঙ্গেলবেইজড বিজ্ঞাপন হলো, অবিস্মরণীয় সেই বিজ্ঞাপন যা টিভি পর্দায় আসলে আমরা লজ্জা পেতাম।

এই মায়া বড়ি খেলে
.... ... ছোট সংসার
মায়া আছে এ জীবনে আপন হয়ে
জীবনের সবটুকু সুখ হয়ে

হায়। আজকের কলমের বিজ্ঞাপনে বলা হয় না ইকোনো লেখে চমৎকার ... এক কলমে মাইল পার। পায়ে নেই জাম্প, জাম্প, জাম্প, জাম্প কেডস। আমাদের বোনেরা ফর্সা হয় না হেনো হেনো লাক্স.....কমপ্লেকশন ক্রীম মেখে। লন্ডনের শীতে আমি পড়তে পারব না আজ ও আগামীকালের পোষাক ... এলিগ্যান্স। কোনো ক্লাবে, পাবে, পার্টিতে আমার স্যুট হয় না সেঞ্চুরি....দ্যাটস হোয়াট আই লাইক-এর। ডি5 টুথপেস্ট-এর সেই চেরী মুখে নেয়া নওরীনের মতো কোনো প্রিয়া আজো হাতটা চেপে ধরল না।

মনে পড়ে যায় মা কতো জোর করত অস্ট্রেলিয়া থেকে সরাসরি আমদানীকৃত ... রেডকাউ খাওয়াতে। ভাবির বাচ্চা হয়েছে, ভাই বাসায় ফিরেই গেয়ে উঠত উলে উলে পাপ্পা ... সোনাজাদুমনি লে। ব্যাগ থেকে উপহার বের করে বাচ্চার সামনে নাচায় আর বলে, চোখে পড়লে চোখ জ্বলে না, কান্নাও পায় না ... মেরিল বেবি শ্যাম্পু। আমার মনে পড়ে যায় দোকানে বাকি করতাম যতো খাও ততো মজা ... রিং চিপস-এর জন্য।

লন্ডনে কতো সুন্দরি ঘোরাফেরা করে। কেউ একবার ফিরে তাকায় না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেকে স্বান্ত্বনা দিই, এগুলো বড়দের খাবার ... তোমাদের জন্য সেরেল্যাক। চোখের সামনে কোমর জড়িয়ে চলে যায় কোনো ছেলে, যেন মনে মনে আওড়ায়, আমি তো এমনি এমনি খাই ... হরলিকস
তারপরও রঙের দুনিয়ায় গেয়ে উঠি,

দেখো দেখো দেখোরে
রঙ্গের বাহার
দেখো রোমানার বাহার।

অথবা,
রং রং রং রং রং
পেইলাক মনের মতো রঙ

আপনাদের কি মনে পড়ে মৌসুমীর কথা? শাড়ি পরে কোমরে বিছার আছড়ে পড়া সেই অবিস্মরণীয় দৃশ্য?

প্রিয় প্রিয় প্রিয়
সুন্দরি সুন্দরি সুন্দরি
প্রিয় প্রিয় সুন্দরি
সুন্দরি প্রিন্ট শাড়ি।

অনেক তো হলো। যাওয়ার আগে সুরে সুরে আপনাদের মনে করিয়ে যাই,

কোনো কোনো মা-বোনেরা কয়
শাকসব্জী খাইলে নাকি পেটের ব্যারাম হয়।
... একদম বাজে কথা।
শাক ভালো করে ধুয়ে রান্না করলে বাচ্চাদের পেটের অসুখ হয় না।

Monday, 13 August 2007

গাড়ি যন্ত্রণা ... জীবন যন্ত্রণা ...

গত প্রায় এক মাস ধরে নিজেকে খুব বিক্ষিপ্ত লাগছে। তারও দুই মাস আগে নতুন বাসাবদল, তারও ১ মাস আগে অফিসের ঝামেলা। আর গেলমাসের গাড়ি যন্ত্রণায় পুরোপুরি পূর্ণতা পেল সবকিছু।

আমার একটা হোন্ডা সিভিক গাড়ি ছিল। পুরানো গাড়ি। ৫০০ পাউন্ড দিয়ে কিনেছিলাম। ইনস্যুরেন্স করাতে হলো ১০৭০ পাউন্ডে। বাসার সামনের রাস্তায় পার্কিং পারমিট করলাম ৭০ পাউন্ড দিয়ে। লন্ডন শহরে শাদা চামড়ারাই রাস্তা চিনে না, তাই আমি একটা জিপিএস কিনে ফেল্লাম ১৬০ পাউন্ড দিয়ে। পরদিন গেলাম ব্রিকলেন। বন্ধুর অফিসে আড্ডা মেরে বেরিয়ে এসে দেখি গাড়ি নাই। পুলিশে ফোন করে নিশ্চিত হলাম ভুল জায়গায় পার্কিং করার কারণে গাড়ি উঠিয়ে নিয়ে গেছে। কি আর করা। ৫০০ পাউন্ডের গাড়ি পরদিন সকালে ৪০০ পাউন্ড দিয়ে ছুটিয়ে নিয়ে এলাম। তার একসপ্তাহ পর আবারো গাড়ি ক্ল্যাম্পড হলো। এবার দিলাম ১০০ পাউন্ড। গাড়ির রোডট্যাক্স করাতে হলো। গেলো ১৮০ পাউন্ড। MOT (আমাদের দেশে ফিটনেস) করাতে গেলাম। বের হতে থাকল গাড়ির যাবতীয় প্রবলেম। ভাবলাম এটাই শেষ খরচ এই গাড়ির পিছে। ওয়ার্কশপ চার্জসহ দিলাম ৩৫০ পাউন্ড। বন্ধু নবনীতার বাসায় গাড়ি গেল বিকল হয়ে, স্টার্ট নেয় না। ৮০ পাউন্ডে রিকভারী ভ্যান ভাড়া করে ছুটলাম গাড়ি আনতে। গ্যারেজে নিয়ে গাড়ি ঠিক করাতে লাগল তিনদিন। ১০০ পাউন্ড বিল নিয়ে ইঞ্জিনিয়ার আমাকে একটা স্ক্রু ধরিয়ে দিয়ে বলল, এই গাড়ির স্টার্ট আবারও বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তখন এই স্ক্রু দিয়ে ব্যাটারিটা টাইট দিতে হবে।

আমি স্ক্রু হাতে নিয়ে গাড়ি চালাই। আর গাড়ি থাকলে যা হয়। বন্ধুর বন্ধুর বাবা-মাকে আনতে এয়ারপোর্ট যাই, নিজের বন্ধুকে আনতে যাই। কলিগের ঘরের বাজার করে দেই।

শেষবার থার্ড আই বাংলাদেশ যাবে বলে তাকে হিথরো পৌঁছে দিয়ে এলাম। যাবার বেলায় খুব ভালোভাবেই গেলাম। ফিরে আসার পথে দেখি ড্যাশবোর্ডে ইঞ্জিন ওয়েল বাটনটা রেড-ব্লিকিং করছে। জানে পানি নাই হয়ে গেল। এই মটরওয়েতে গাড়ি বন্ধ হয়ে গেলে কি করব! তাড়াতাড়ি চালাতেও পারছি না। বিশাল জ্যাম। সবধর্মের যাবতীয় গুরুদের নাম জপতে শুরু করলাম। তাদের দোয়ায় মটরওয়ে ছেড়ে আর্লস কোট নামের একটা জায়গায় এসে গাড়িটা ঢেকুর তুলল। স্টার্ট বন্ধ হয়ে যাবার আশংকার তাড়াতাড়ি একটা গলিতে ঢুকে পার্ক করামাত্রই অক্কা পেল আমার গাড়ি।

আশেপাশে কোথাও গ্যারেজ নেই। গাড়ি লক করে আমি রাস্তায় উদভ্রান্তের মতো হাঁটি। কোথাও কোনো গ্যারেজ কিংবা মটরশপ নেই। অফিসে ফোন করে বললাম আজকে আসতে পারব না। প্রায় ২০ মিনিট হেঁটে, টিউবে চড়ে তবে একটা মটর শপে ১০ পাউন্ডে ইঞ্জিন অয়েল কিনতে পেলাম।

গাড়ির কাছে ফিরে এসে পুরো বোতলটাই ঢেলে দিলাম। কিন্তু আমি যতোই ঢালি ততোই খালি হয়ে যায়। কি ব্যাপার! পায়ে যেন কি চটচট করে লাগছে। খেয়াল করে দেখি ইঞ্জিন অয়েলে রাস্তা ভেসে গেছে। আমার গাড়ির তলা গেছে ফুটো হয়ে। মেজাজ গেল সপ্তমে চড়ে। মাত্র দুইদিন আগে কেনা ১৭০ পাউন্ডে কেনা সিডিটা খুলে নিলাম - সিদ্ধান্ত নিলাম এই গাড়ি এখানেই ফেলে দিব। সঙ্গে সঙ্গে ফোন করে, গাড়ি দিলাম স্ক্র্যাপ করে।

ড্রাইভিং পাস করেছি ৫ বার পরীক্ষা দিয়ে। গাড়ি ভাড়া ও পরীক্ষার ফি যাবত প্রতি পরীক্ষায় লাগত ১০০ পাউন্ড। ঢাকার গাড়িচালানোবিদ্যা দিয়ে এখানে কুলায় না, তাই ড্রাইভিং পরীক্ষার আগে ২০ টা লেসন নিয়েছি যার প্রতিটির ফি ১৮ পাউন্ড। এর আগে থিওরী পাস করেছি ৪৫ পাউন্ড দিয়ে।

আমার সমস্ত সেভিংস শেষ। ক্রেডিট কার্ডের বিল আছে ১৪০০ পাউন্ড। প্রতিমাসে হুদাই ২৫-৪০ পাউন্ড এক্সট্রা যোগ হতে থাকে। বাসা ভাড়া ২৫০ পাউন্ড, দুইটা ফোন মিলে ৭০ পাউন্ড, মুভি ক্লাবমেম্বারশীপ ১৫ পাউন্ড, ওয়েস্টার কার্ড বিল ৫৭ পাউন্ড। আর মাঝে মাঝে ক্লাবিং আর পাবের বিল তো আছেই। গতকালই উড়িয়ে দিলাম ৪০ পাউন্ড। আর হ্যা, জীবনধারণের জন্য খাওয়াদাওয়ার হিসাব তো দিলামই না।

এতোসবকিছুর মধ্যেও গতকাল একটা গাড়ি পছন্দ হয়েছে। ভক্সহোল আস্ট্রা জিএলএস (৯৯) ১.৮। ব্যাটা চাচ্ছে ১৬০০ পাউন্ড। আমি ১২০০ বলে থম মেরে আছি। দেখা যাক কি হয়। গাড়িটা যদি কিনি তবে ধারেই কিনতে হবে।

লোনের সমুদ্রে ডুবে আছি অথচ ফুটানি কমে না। কি যে করুম ...