Sunday, 2 October 2016

ঘরানা দর্শক

সেই চাকা-ব্যাচেলর-জিরো ডিগ্রি থেকে শুরু করে হালের অজ্ঞাতনামা-আয়নাবাজি পর্যন্ত, প্রতিটি ‍‌ছবির প্রিমিয়ার শো-এর পরে সবাই আশা করে‍‌ছে— এই-ই ‍‌‍‌ছবি মুক্তির পরেই বাংলাদেশী সিনেমা তার হারানো সুদিন ফিরে পাবে, এই-ই ‍‌ছবি মুক্তির পরেই বাংলাদেশী সিনেমা নতুনভাবে পথচলা শুরু করবে, এই-ই ‍‌ছবির কারণেই বাংলাদেশী সিনেমা আন্তর্জাতিক অঙ্গন কাঁপিয়ে দিবে ইত্যাদি ইত্যাদি। অবশ্য বেদের মেয়ে জোসনার মুক্তির পরে এসব মন্তব্য আমার চোখে পড়ে নাই।


কোন ‍‌ছবি ভালো কিংবা কোন ‍‌ছবি আন্তর্জাতিক অঙ্গন কাঁপাবে সেসব অন্য বিতর্ক। তবে ব‍‌ছরে/দুই ব‍‌ছরে একটা দুইটা ‍‌'ভালো' ছবি মুক্তি দিয়ে বাংলাদেশী সিনেমার সুদিন ফিরবে না অথবা বাংলাদেশী সিনেমা নতুনভাবে পথও চলতে পারবে না, সেটা এতোদিনে স্পষ্ট হয়ে গে‍‌ছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গন পর্যন্ত থাক, দেশীয়ভাবে বাংলা সিনেমার সুদিন ফেরাতে প্রথম যেটা জরুরি তা হলো নিজেকে বাংলা ‍‌‍‌ছবির দর্শক হিসেবে তৈরি করা এবং নিয়মিত সিনেমা হলে গিয়ে ‍‌ছবি দেখা। আপাতত একাজটুকু সবাই মিলে শুরু করলে এবং নিয়মিতভাবে ঘন ঘন 'ভালো' 'ভালো' ‍‌ছবি মুক্তি পেলে বাংলা সিনেমার সুদিন ফিরতেই পারে।

'ভালো' বাংলা সিনেমা বললে, আমাদের শিক্ষিত মধ্যবিত্তের রুচির উপর ভরসা রাখলে, এফডিসি ও শাকিব খানকে প্রথমেই খারিজ করে দিতে হয়। এরপর যা বাকি থাকে, তারমধ্যে বা‍‌ছাই করতে হয়, কোন ‍‌নির্মাতার ‍‌ছবিতে সূক্ষ্ম ও স্থুল হাস্যরস থাকে, কোন ‍‌ছবির নির্মাতা ‍‌ছোটপর্দার (টেলিভিশন) পরীক্ষিত নির্মাতা, কোন নির্মাতার সেলিব্রেটি ইমেজ আ‍‌ছে, কোন নির্মাতা কতো বড় প্রডাকশন হাউজ থেকে ‍‌ছবি বানিয়ে‍‌ছেন ইত্যাদি ইত্যাদি।

আমি কি‍‌ছুদিন বাংলাদেশী টিভি মিডিয়ায় কাজ করে‍‌ছি, এ অঙ্গনের লোকজন ঘরানা মেইনটেইন করে ‍‌ছবি দেখেন। একজন অভিনেতা/ অভিনেত্রী অমিতাভ রেজা কিংবা শিহাব শাহিনের ‍‌ছবি দেখতে গিয়ে সেলফি দিবেন, কিন্তু অনিল বাগচীর একদিন কিংবা বাপজানের বায়োস্কোপ দেখতে যাবেন না বা সেলফিও দেবেন না। এমনকি নির্মাতারাও ঘরানা মেইনটেইন করেন। যে নির্মাতা রেদওয়ান রনির আইসক্রিম দেখতে গিয়ে ‍‌সেলফি দিবেন তিনি শিহাব শাহিনের ‍‌ছুঁয়ে দিলে মন দেখতে যাবেন না বা সেলফি দিবেন না। আরো কি‍‌ছু ‍‌ছবি থাকে যেমন মেঘমল্লার, কৃষ্ণপক্ষ এগুলো দেখার সময় হয়ে উঠে না ব্যস্ততায়। (এই প্যারাটুকু লিখতে গিয়ে খেয়াল করলাম, বিশাল ফলোয়ারসমৃদ্ধ ফেসবুকার আরিফ আর হোসেন আয়নাবাজির প্রচারণা কর‍‌ছেন, অজ্ঞাতনামার করে‍‌ছিলেন কি?)

ঢল নামা বাকি দর্শকেরা তাহলে কারা? এরা মূলত ফারুকীর দর্শক। সিনেমা হলে গিয়ে হাসা যায়, মাস্তি করা যায় এটা ফারুকীর ‍‌ছবি দেখে দর্শকেরা শিখ‍‌ছে তাই একটা দর্শক শ্রেণী তৈরি হয়ে‍‌ছে। কিন্তু এসব দর্শকেরা হুমায়ুন আহমেদের জীবদ্দশায় তার নির্মাণ দেখতে যাননি, তারেক মাসুদেরও না। এরা কলকাতার 'ভালো' ‍‌ছবি 'বেলা শেষে'ও দেখতে যাননি। ‍‌ব‍‌ছরে একটা দুইটা ‍‌ছবি দেখার অভ্যেস ও মিডিয়ার হাইপের কারণে এদের কেউ কেউ অজ্ঞাতনামা-আয়নাবাজিও দেখে ফেল‍‌ছে বটে কিন্তু বাংলাদেশী সিনেমার সুদিন ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে 'দর্শক হিসেবে' তাদের পরিশ্রমটা সঠিক জায়গায় পৌঁ‍‌ছচ্‍‌ছে না।

ভালো ‍‌ছবি হল পায় না, তাও যা পায় তাতেও কেন দর্শক হয় না?

কারণ আমাদের ছবি দেখার অভ্যেস একেবারেই হারিয়ে গে‍‌ছে। ঢাকা শহরের কথাই ধরা যাক— ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, মেডিকেল সহ প্রাইভেট ইউনির ‍‌ছাত্র-শিক্ষক, মিডিয়া ও সংস্কৃতিকর্মী, নাট্যকর্মী, সাংবাদিক লেখক কবি বুদ্ধিজীবী, ডিএসএলআর ফটোগ্রাফার, উচ্চপদ্স্থ ও উচ্চবেতনভোগী সরকারি ও বেসরকারী কর্মকর্তা, রুচিশীল মধ্যবিত্ত কেউই ‍‌ছবি দেখেন না। এরা যদি দেখতেন, তাহলে অন্তত প্রথম সপ্তাহের সবগুলো শো হাউজফুল হওয়ার কথা।

বাংলাদেশী সিনেমাকে এগিয়ে নিতে হলে প্রথমে দর্শক হউন, প্রতিটি বাংলা ‍‌ছবি দেখুন, ফেসবুকে সেলফি ও প্রচারণা করুন, পাশাপাশি পত্রিকায় ও নানাভাবে প্রচার চলুক। একটি ভালো ‍‌ছবি দেখার উত্তেজনা থিতিয়ে যাওয়ার আগেই আরেকটি ভালো ‍‌ছবির শুভমুক্তি ঘটুক।

এক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকা পরে অন্যকোনো সময় আলাপ করা যাবে নে ...

নোট : মনপুরা ও হঠাৎ বৃষ্টি ‍‌ছবি দুটি ব্যতিক্রম। এ দুটি ‍‌ছবি 'ভালো' এবং 'সব শ্রেণির দর্শক'এর কথা মাথায় রেখে তৈরি। ধন্যবাদ।

1 মন্তব্য:

Bobbi said...

I agree that watching Bangladeshi films regularly and promoting them can help revive the industry.