পশ্চিমবঙ্গের উপন্যাসিকদের লেখা নিয়ে বাংলাদেশে প্রায় সিনেমা/ নাটক নির্মাণ হয়। এসব উপন্যাস আমাদের অনেকেরই পড়া। জনপ্রিয়তার নিরিখে এগুলোর অবস্থান প্রায় আকাশচুম্বি। আর এটারই সুযোগ নিচ্ছে বাংলাদেশের নির্মাতারা। পরিচিত জনপ্রিয় উপন্যাস আর নষ্টালজিয়াকে সুযোগ করে ব্যবসায় মুনাফা বৃদ্ধিই আসল উদ্দেশ্য। এক্ষেত্রে নির্মাতাদের কাছে 'কমিটমেন্ট' বলে কোনো শব্দের স্থান নেই। এ বিষয়ে অনেক আগে থেকেই আমার আপত্তি ছিল।
বিডিনিউজে একটি সংবাদ পড়লাম। সেখানে জানা গেল, সমরেশ মজুমদারের 'গর্ভধারিণী' উপন্যাস নিয়ে ধারাবাহিক নির্মাণ হচ্ছে চ্যানেল ওয়ান এর জন্য। এ উপন্যাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র 'জয়িতা' হবেন অভিনেত্রী তিশা। তিনি জানিয়েছেন, এমন চরিত্রে অভিনয় করা আনন্দের পাশাপাশি চ্যালেঞ্জেরও। এ কারণে জয়িতার অভ্যেস মতো তিনি ধূমপান শুরু করেছেন নিয়মিতভাবে। কারণ যে কোনো চরিত্র করার আগে তিনি চরিত্রকে নিজের করে নেন। তাই এখন থেকে তিনিই জয়িতা।
তো তিশা চরিত্রটিকে কীভাবে নিজের করে নেবেন? ও আচ্ছা গর্ভধারিণীর জয়িতা তো বাংলায় কথা বলে, তিশাও তাই। কিন্তু চরিত্র নিজের মতো করে নিতে এ সহজ সমীকরণই যথেষ্ট? জয়িতার ওই সময়ের পারিপার্শ্বিকতাকে ধরবেন কী করে তিশা? তারা তো একই সমাজ ব্যবস্থার নন। জয়িতা যেসব সমস্যার মধ্যে দিয়ে গেছেন তিশা কি সেটা অনুভব করতে পারেন?
আসলে অভিনেত্রী/ অভিনেতাদের কিছু করার নেই। এসব ক্ষেত্রে নির্মাতারাই দায়ী। জনপ্রিয় উপন্যাস নিয়ে সিনেমা/ নাটক বানানোর লোভ নির্মাতাদের মাঝে থাকেই। এমনটা আমারও রয়েছে। গর্ভধারিণী পড়ার পর আমার মনে হয়েছে এটি নিয়ে সিনেমা/ নাটক বানানো যেতেই পারে। কিন্তু তাই বলে আমি স্বপ্নেও চিন্তা করি না বাংলাদেশে সেটি বানানোর। কারণ ভুলেভালেই হোক আমার পড়া ছিল শাহরিয়ার কবীরের 'ওদের জানিয়ে দাও'। এটা নিয়ে আমার একটি ছোট স্বপ্নও আছে। আমার বিশ্বাস গর্ভধারিণীর আগেই 'ওদের জানিয়ে দাও' প্রকাশ পেয়েছে। নিশ্চিত হতে ফেসবুকে টোকা দিলাম কুলদা রায়কে। জানা গেল ৭৪ এ ধারাবাহিকভাবে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় প্রকাশ পেয়েছে শাহরিয়ার কবীরের 'ওদের জানিয়ে দাও।' গর্ভধারিণীর প্রকাশকাল সম্পর্কে তিনি আমাকে পরে জানাবেন বলেছেন।
এ দুটো উপন্যাসের মধ্যে মিল হচ্ছে এক জায়গাতেই। গর্ভধারিণীতে দেখা যায় ৩ ছেলে আর ১ মেয়ের সমাজ পরিবর্তনের আকাঙ্খা এবং পরবর্তীতে শ্রেণিশত্রু খতমের পথে নেমে পড়া। ওদের জানিয়ে দাও-তেও দেখা যায় পূরবী, দীপু, জাফর আর রাজুরও একই স্বপ্ন।
*** *** ***
তাহলে একজন বাংলাদেশী হিসেবে আমরা সিনেমা/ নাটকের জন্য কোন উপন্যাসকে বেছে নেব? কুলদা রায় জানালেন - শাহরিয়ার কবীরের উপন্যাসটি ইমম্যাচিরউড মনে হলেও নির্মাণের জন্য দেশের কাহিনিই বেছে নেওয়া উচিত। এ উপন্যাসে একটি গোপন পার্টির কর্মকাহিনি প্রকাশ পেয়েছে। একটু তরল হলেও ওই সময়ের রাজনীতি বোঝার জন্য (১৯৭৪ পর্যন্ত) উপন্যাসটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে। আর শাহরিয়ার কবীর ছাড়াও মাহমুদুল হকরাও এসব বাম আন্দোলন ও তরুণদের ওই সময়ের স্বপ্ন নিয়ে লিখেছেন।
গর্ভধারিণীর ব্যাপারে তিনি বলেন, এটি একটি বানানো কাহিনি। সমরেশ মজুমদার ওখানে হলিউডি স্টাইলে একজন মহিলাকে দেবী পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। অন্যরা সেখানে তল পায় না। কিন্তু 'ওদের জানিয়ে দাও' উপন্যাসে পূরবী কিন্তু সবটাই নয়। সে অন্যতম চরিত্র। দেবী পর্যায়ে নেওয়া হয়নি। আর সবচেয়ে বড় কথা পশ্চিমবঙ্গের লেখকদের রচনাভঙ্গি, রচনাভূগোল আমাদের মতো করে নয়।
কুলদা রায় সমাপ্তি টানেন এই বলে যে, মুগ্ধপাঠকের কাছে গর্ভধারিণী একটি জনপ্রিয় উপন্যাস হতে পারে কিন্তু প্রকৃত পাঠকের কাছে বিরক্তিকর। এর চেয়ে ওদের জানিয়ে দাও উপন্যাস হিসাবে বেশি গ্রহণযোগ্য এবং বাস্তব।
একজন সুলেখক, সাহিত্যিক হিসেবে দুটো উপন্যাসের বিষয়ে কুলদা রায়ের মতামত আমি এভাবেই জেনে নিই।
*** *** ***
হতাশা এখানেই। পরিশ্রম করার ইচ্ছে নেই। উপন্যাস লেখা আছে, একটু কাটছাট করে চিত্রনাট্য তৈরি করে নেমে পড়ো নির্মাণে। টেলিভিশন কর্তারা বসে আছেন রাক্ষস স্ক্রীণকে খাবার সরবারহ করতে। কিছু একটা হলেই হয়। আর এভাবেই নিজের কমিটমেন্টকে দূরে ঠেলে বিদেশী জিনিস নিয়ে ফালাফালি বাড়ছে।
তিশারা জানেও না, জয়িতা থেকে পূরবী শক্তিশালী। ওদের স্বপ্নও অনেক জোরালো। পূরবীর সাথে তিশার সামাজিক পরিবেশ বেশি মেলে। জয়িতা সেজে যে সংলাপ তিনি আওড়াবেন পূরবী সেজে সেটা আওড়ালে আরো বাস্তবসম্মত হয়।
নির্মাতাদের টনক নড়বে না। কারণ মিডিয়া শুধু কমিটমেন্ট না, ব্যবসার জায়গাও। তবে কি টিভি কর্তৃপক্ষ? হুম। আপাতত তারা যদি এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয় তবে নির্মাতাদের সৃজনশীলতা আমাদের দেশের ক্ষেত্রে কিছুটা ব্যয় হতে পারে।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বর্তমানে বাংলাদেশ সফরে আছেন। না জানি কাউকে 'পূর্ব পশ্চিম' গিলিয়ে দিয়ে যায়।
মোদ্দা কথা - পরবর্তী ৩ বছরের জন্য সকল ভারতীয় চ্যানেল এবং বাংলাদেশ সংশ্লিষ্ট না থাকলে পশ্চিবঙ্গের লেখকদের উপন্যাস নিয়ে আর কোনো নির্মাণ নয়।
Friday, 5 February 2010
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
2 মন্তব্য:
ভাল্লাগছে। :)
এই বিষয়ে আমার বিচিত্র কিছু অভিজ্ঞতা আছে! বিস্তারিত এখানে বলে জায়গা দখল করি না।
এইসব আঁতেলদের একটা কমন কথা, দেশে ভালো স্ক্রিপ্ট কোথায়? আমাদের দেশের আহমদ ছফার মত মানুষদের লেখা এইসব অপদার্থরা পড়েছে কিনা এতে আমার ঘোর সন্দেহ আছে।
আফসোস, এইসব চুতিয়াদের চাবকাতে পারলে খানিকটা আরাম পাওয়া যেত।
Post a Comment