Monday 20 August 2007

বিজ্ঞাপনোষ্টালজিয়া ...

সচলায়তনে রাসেল বিজ্ঞাপন নিয়ে পোস্ট দিয়েছিল। পড়েই নষ্টালজিয়ায় পড়ে গেলাম। আহারে সেইসব বিজ্ঞাপন ...

স্মৃতি হাতড়ানো শুরু করলাম। এখন বাংলাদেশে বিজ্ঞাপনের বাজারে নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। কতো রঙের, কতো বাহারের বিজ্ঞাপন। কোনটা জিঙ্গেল বেইজড, কোনটা গল্প বেইজড। কতো মডেল, কতো স্মার্ট তারা। কিন্তু আমার মনে পড়ে গেল ম্যানোলার সেই বিজ্ঞাপন,

ম্যানোলা মানে টলমল শিশিরের লাবণ্য
ম্যানোলা মানে কমোলীন সুরভী অনন্য।

আহা! কেন যেন মনে হয় সেই মডেলের মতো সৌন্দর্য্য হাল আমলের মডেলরা ধারণ করে না।

এখন শুরু হয়েছে গল্পভিত্তিক বিজ্ঞাপন নির্মাণের ধুম। ভালোই লাগে। অথচ কেন জানি সেরা মনে হয় সেই ফিলিপসের বিজ্ঞাপন,

ও মানিক কি বাত্তি লাগাইলি ..
... মাছের রাজা ইলিশ, বাত্তির রাজা ফিলিপস।

অথবা জীবনবীমার সেই বিজ্ঞাপন। দুটো বুড়োবুড়ি পার্কে হাঁটছে। আহা, কে কবে বানাতে পেরেছে এমন প্রেমের অপরূপ দৃশ্যরূপ।

এখনকার বাংলাদেশের বিজ্ঞাপনের মডেলদের হাসি প্রাণ জুড়িয়ে দেয়। হয়তো বা। কিন্তু এই হাসি শেল হয়ে বুকে বিঁধতে পারত যদি ব্যবহার করতেন দাঁতের মাজন। সুরে সুরে পড়ে দেখুন মনে করতে পারেন কিনা,

এপি দশন চূর্ণ সেরা দাঁতের মাজন
দাঁতের মাড়ি শক্ত, করে দশন চূর্ণ
মাড়ির ব্যথায় আরাম দেবে
এপি দশন চূর্ণ

... এপি দশনচূর্ণ এখন থেকে ব্রাশেও ব্যবহার করা যাচ্ছে।

ক্রিকেটাররা এখন কমান্ডো ট্রেনিং নিচ্ছে। মডেলিংও করে আজকাল। ক্রিকেটের চাপে আজকের ফুটবলের এই তথৈবচ অবস্থা ফুটবলার সালাহউদ্দিন কি তখন ভাবতে পেরেছিলেন গোসল করার সময়?

স্বাস্থ্যকে রক্ষা করে লাইফবয়
লাইফবয় যেখানে, স্বাস্থ্যও সেখানে
লাইফবয়-য়-য়-য়

অথবা সেই টাচি জিঙ্গেল,

টাচ টাচ টাচ ... গ্যাকোটাচ ...

আজ কই গেল সেই রেক্সোনা অথবা হৃদয় খিঁচে নেয়া ঠোঁট সুরু করে বলা সেই মেয়েটি ইটস কুল...ইটস ফ্রেশ...সুপার লেমনডিউ
ডিটারজেন্টের যুগ তখন ছিল না। কিন্তু মা-দের আত্মবিশ্বাস ছিল ওই জিঙ্গেলে,

এক ঘষাতে অনেক কাচে
কোন সাবান কোন সাবান
নিরালা নিরালা, নিরালা বল সাবান

তাতেও মা-দের মন ভরে না। স্কুলশার্ট আরো শাদা করার জন্য মা-দের কি প্রচেষ্টা। ভাগ্যিস তখন ছিল ওই বিজ্ঞাপনটি,

শেষ হয় না কাপড় ধোয়া
যদি না হয় নীলের ছোঁয়া
রবিন লিকুইড ব্লু

আজকাল এনিমেটেড বিজ্ঞাপনের অভাব নেই। কিন্তু ছাড়িয়ে যেতে পেরেছে কি ওই বিজ্ঞাপন, যেখানে রাজকন্যার দীর্ঘ চুল বয়ে নিয়ে যাচ্ছে সখীরা। নেপথ্যে বাজছে,

রূপবতী সখী তোরে
কেশবতী করে দিল
এপি পনেরো কেশতেল

অথবা ইভটিজিংয়ের সেই বিজ্ঞাপনটি?

ও কেশবতী কন্যা,
ফুল নেবে গো ফুল ... নেও না চাঁপা ফুল
চুলে আমার চাঁপা মাখা ... চাই না চাঁপা ফুল

ইউরোপে এসে ইটালির বিখ্যাত চামড়ার জুতা ব্যবহার করি। কিন্তু মন টানে ওই জিঙ্গেল,

রূপসা রূপসা রূপসা
নরম নরম হাওয়াই চপ্পল রূপসা

আচ্ছা প্রথম জিঙ্গেল বেইজড বিজ্ঞাপন কোনটি? অনেকে বলে থাকে মডেল তানিয়ার ইকোনোর সেই বিজ্ঞাপনটি,

লোনলি ডেজ ... লোনলি নাইটস
ইউ আর ফার এওয়ে

আবার অনেকে বলেন সেই বিজ্ঞাপনের কথা যেখানে ওড়না ছাড়া মিতানূরকে দেখে নিয়ত শিউরে উঠতাম,

আলো আলো ... বেশি আলো
শব্দ শব্দে ... মন মাতানো
অলিম্পিক অলিম্পিক ব্যাটারি

কিন্তু আমি মনে করি প্রথম জিঙ্গেলবেইজড বিজ্ঞাপন হলো, অবিস্মরণীয় সেই বিজ্ঞাপন যা টিভি পর্দায় আসলে আমরা লজ্জা পেতাম।

এই মায়া বড়ি খেলে
.... ... ছোট সংসার
মায়া আছে এ জীবনে আপন হয়ে
জীবনের সবটুকু সুখ হয়ে

হায়। আজকের কলমের বিজ্ঞাপনে বলা হয় না ইকোনো লেখে চমৎকার ... এক কলমে মাইল পার। পায়ে নেই জাম্প, জাম্প, জাম্প, জাম্প কেডস। আমাদের বোনেরা ফর্সা হয় না হেনো হেনো লাক্স.....কমপ্লেকশন ক্রীম মেখে। লন্ডনের শীতে আমি পড়তে পারব না আজ ও আগামীকালের পোষাক ... এলিগ্যান্স। কোনো ক্লাবে, পাবে, পার্টিতে আমার স্যুট হয় না সেঞ্চুরি....দ্যাটস হোয়াট আই লাইক-এর। ডি5 টুথপেস্ট-এর সেই চেরী মুখে নেয়া নওরীনের মতো কোনো প্রিয়া আজো হাতটা চেপে ধরল না।

মনে পড়ে যায় মা কতো জোর করত অস্ট্রেলিয়া থেকে সরাসরি আমদানীকৃত ... রেডকাউ খাওয়াতে। ভাবির বাচ্চা হয়েছে, ভাই বাসায় ফিরেই গেয়ে উঠত উলে উলে পাপ্পা ... সোনাজাদুমনি লে। ব্যাগ থেকে উপহার বের করে বাচ্চার সামনে নাচায় আর বলে, চোখে পড়লে চোখ জ্বলে না, কান্নাও পায় না ... মেরিল বেবি শ্যাম্পু। আমার মনে পড়ে যায় দোকানে বাকি করতাম যতো খাও ততো মজা ... রিং চিপস-এর জন্য।

লন্ডনে কতো সুন্দরি ঘোরাফেরা করে। কেউ একবার ফিরে তাকায় না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেকে স্বান্ত্বনা দিই, এগুলো বড়দের খাবার ... তোমাদের জন্য সেরেল্যাক। চোখের সামনে কোমর জড়িয়ে চলে যায় কোনো ছেলে, যেন মনে মনে আওড়ায়, আমি তো এমনি এমনি খাই ... হরলিকস
তারপরও রঙের দুনিয়ায় গেয়ে উঠি,

দেখো দেখো দেখোরে
রঙ্গের বাহার
দেখো রোমানার বাহার।

অথবা,
রং রং রং রং রং
পেইলাক মনের মতো রঙ

আপনাদের কি মনে পড়ে মৌসুমীর কথা? শাড়ি পরে কোমরে বিছার আছড়ে পড়া সেই অবিস্মরণীয় দৃশ্য?

প্রিয় প্রিয় প্রিয়
সুন্দরি সুন্দরি সুন্দরি
প্রিয় প্রিয় সুন্দরি
সুন্দরি প্রিন্ট শাড়ি।

অনেক তো হলো। যাওয়ার আগে সুরে সুরে আপনাদের মনে করিয়ে যাই,

কোনো কোনো মা-বোনেরা কয়
শাকসব্জী খাইলে নাকি পেটের ব্যারাম হয়।
... একদম বাজে কথা।
শাক ভালো করে ধুয়ে রান্না করলে বাচ্চাদের পেটের অসুখ হয় না।

Monday 13 August 2007

গাড়ি যন্ত্রণা ... জীবন যন্ত্রণা ...

গত প্রায় এক মাস ধরে নিজেকে খুব বিক্ষিপ্ত লাগছে। তারও দুই মাস আগে নতুন বাসাবদল, তারও ১ মাস আগে অফিসের ঝামেলা। আর গেলমাসের গাড়ি যন্ত্রণায় পুরোপুরি পূর্ণতা পেল সবকিছু।

আমার একটা হোন্ডা সিভিক গাড়ি ছিল। পুরানো গাড়ি। ৫০০ পাউন্ড দিয়ে কিনেছিলাম। ইনস্যুরেন্স করাতে হলো ১০৭০ পাউন্ডে। বাসার সামনের রাস্তায় পার্কিং পারমিট করলাম ৭০ পাউন্ড দিয়ে। লন্ডন শহরে শাদা চামড়ারাই রাস্তা চিনে না, তাই আমি একটা জিপিএস কিনে ফেল্লাম ১৬০ পাউন্ড দিয়ে। পরদিন গেলাম ব্রিকলেন। বন্ধুর অফিসে আড্ডা মেরে বেরিয়ে এসে দেখি গাড়ি নাই। পুলিশে ফোন করে নিশ্চিত হলাম ভুল জায়গায় পার্কিং করার কারণে গাড়ি উঠিয়ে নিয়ে গেছে। কি আর করা। ৫০০ পাউন্ডের গাড়ি পরদিন সকালে ৪০০ পাউন্ড দিয়ে ছুটিয়ে নিয়ে এলাম। তার একসপ্তাহ পর আবারো গাড়ি ক্ল্যাম্পড হলো। এবার দিলাম ১০০ পাউন্ড। গাড়ির রোডট্যাক্স করাতে হলো। গেলো ১৮০ পাউন্ড। MOT (আমাদের দেশে ফিটনেস) করাতে গেলাম। বের হতে থাকল গাড়ির যাবতীয় প্রবলেম। ভাবলাম এটাই শেষ খরচ এই গাড়ির পিছে। ওয়ার্কশপ চার্জসহ দিলাম ৩৫০ পাউন্ড। বন্ধু নবনীতার বাসায় গাড়ি গেল বিকল হয়ে, স্টার্ট নেয় না। ৮০ পাউন্ডে রিকভারী ভ্যান ভাড়া করে ছুটলাম গাড়ি আনতে। গ্যারেজে নিয়ে গাড়ি ঠিক করাতে লাগল তিনদিন। ১০০ পাউন্ড বিল নিয়ে ইঞ্জিনিয়ার আমাকে একটা স্ক্রু ধরিয়ে দিয়ে বলল, এই গাড়ির স্টার্ট আবারও বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তখন এই স্ক্রু দিয়ে ব্যাটারিটা টাইট দিতে হবে।

আমি স্ক্রু হাতে নিয়ে গাড়ি চালাই। আর গাড়ি থাকলে যা হয়। বন্ধুর বন্ধুর বাবা-মাকে আনতে এয়ারপোর্ট যাই, নিজের বন্ধুকে আনতে যাই। কলিগের ঘরের বাজার করে দেই।

শেষবার থার্ড আই বাংলাদেশ যাবে বলে তাকে হিথরো পৌঁছে দিয়ে এলাম। যাবার বেলায় খুব ভালোভাবেই গেলাম। ফিরে আসার পথে দেখি ড্যাশবোর্ডে ইঞ্জিন ওয়েল বাটনটা রেড-ব্লিকিং করছে। জানে পানি নাই হয়ে গেল। এই মটরওয়েতে গাড়ি বন্ধ হয়ে গেলে কি করব! তাড়াতাড়ি চালাতেও পারছি না। বিশাল জ্যাম। সবধর্মের যাবতীয় গুরুদের নাম জপতে শুরু করলাম। তাদের দোয়ায় মটরওয়ে ছেড়ে আর্লস কোট নামের একটা জায়গায় এসে গাড়িটা ঢেকুর তুলল। স্টার্ট বন্ধ হয়ে যাবার আশংকার তাড়াতাড়ি একটা গলিতে ঢুকে পার্ক করামাত্রই অক্কা পেল আমার গাড়ি।

আশেপাশে কোথাও গ্যারেজ নেই। গাড়ি লক করে আমি রাস্তায় উদভ্রান্তের মতো হাঁটি। কোথাও কোনো গ্যারেজ কিংবা মটরশপ নেই। অফিসে ফোন করে বললাম আজকে আসতে পারব না। প্রায় ২০ মিনিট হেঁটে, টিউবে চড়ে তবে একটা মটর শপে ১০ পাউন্ডে ইঞ্জিন অয়েল কিনতে পেলাম।

গাড়ির কাছে ফিরে এসে পুরো বোতলটাই ঢেলে দিলাম। কিন্তু আমি যতোই ঢালি ততোই খালি হয়ে যায়। কি ব্যাপার! পায়ে যেন কি চটচট করে লাগছে। খেয়াল করে দেখি ইঞ্জিন অয়েলে রাস্তা ভেসে গেছে। আমার গাড়ির তলা গেছে ফুটো হয়ে। মেজাজ গেল সপ্তমে চড়ে। মাত্র দুইদিন আগে কেনা ১৭০ পাউন্ডে কেনা সিডিটা খুলে নিলাম - সিদ্ধান্ত নিলাম এই গাড়ি এখানেই ফেলে দিব। সঙ্গে সঙ্গে ফোন করে, গাড়ি দিলাম স্ক্র্যাপ করে।

ড্রাইভিং পাস করেছি ৫ বার পরীক্ষা দিয়ে। গাড়ি ভাড়া ও পরীক্ষার ফি যাবত প্রতি পরীক্ষায় লাগত ১০০ পাউন্ড। ঢাকার গাড়িচালানোবিদ্যা দিয়ে এখানে কুলায় না, তাই ড্রাইভিং পরীক্ষার আগে ২০ টা লেসন নিয়েছি যার প্রতিটির ফি ১৮ পাউন্ড। এর আগে থিওরী পাস করেছি ৪৫ পাউন্ড দিয়ে।

আমার সমস্ত সেভিংস শেষ। ক্রেডিট কার্ডের বিল আছে ১৪০০ পাউন্ড। প্রতিমাসে হুদাই ২৫-৪০ পাউন্ড এক্সট্রা যোগ হতে থাকে। বাসা ভাড়া ২৫০ পাউন্ড, দুইটা ফোন মিলে ৭০ পাউন্ড, মুভি ক্লাবমেম্বারশীপ ১৫ পাউন্ড, ওয়েস্টার কার্ড বিল ৫৭ পাউন্ড। আর মাঝে মাঝে ক্লাবিং আর পাবের বিল তো আছেই। গতকালই উড়িয়ে দিলাম ৪০ পাউন্ড। আর হ্যা, জীবনধারণের জন্য খাওয়াদাওয়ার হিসাব তো দিলামই না।

এতোসবকিছুর মধ্যেও গতকাল একটা গাড়ি পছন্দ হয়েছে। ভক্সহোল আস্ট্রা জিএলএস (৯৯) ১.৮। ব্যাটা চাচ্ছে ১৬০০ পাউন্ড। আমি ১২০০ বলে থম মেরে আছি। দেখা যাক কি হয়। গাড়িটা যদি কিনি তবে ধারেই কিনতে হবে।

লোনের সমুদ্রে ডুবে আছি অথচ ফুটানি কমে না। কি যে করুম ...

Friday 3 August 2007

কেন খুলেছ তোমার ওই জানালা ...


শখের বশে একসময় টিউশনি করতাম। অংকটা আমার বেশ ভালোই আসে। সেই অংক করাতে হবে ক্লাস ফাইভের আর ক্লাস এইটে পড়ুয়া দুইভাইবোনকে। আমরা সেসময় থাকতাম মতিঝিল কলোনিতে। আমার ছাত্রছাত্রীরাও একই বিল্ডিংয়ের কোণার একতলায় থাকত।

পড়ানোর সময় পেছনের দরজাটা খোলা থাকত। সেখান দিয়ে দেখা যেত মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলের টিচার্স কোয়ার্টার (ছবিতে দেখুন)। বেশ কিছুদিন পর আমি খেয়াল করলাম টিচার্স কোয়ার্টারের তিনতলার জানালায় একটা মেয়ের ছায়া।

পরদিন বন্ধুদের ঘটনাটা জানিয়ে সবাই মিলে খোঁজ নিতে শুরু করলাম। খবরে মিলল, মেয়েটির নাম পপি। আইডিয়াল স্কুলের এ্যস্টিস্ট্যান্ট হেডুর একমাত্র মেয়ে। ছোটভাই আছে, নাম রাফি। দুজনেই আইডিয়াল স্কুলে পড়ে। তবে এদের কাউকে কখনো স্কুলের বাইরে দেখা যায়নি। টিচার্স কোয়ার্টারে থাকার কারণে ভেতরের পথ দিয়েই স্কুল আসা-যাওয়া করে তারা।

আমি বেশ খুশিই হলাম। আদর্শ ফ্যামিলি, বাবা স্কুলটিচার। অভিযান শুরু হলো। প্রতিদিনই জানালার নিচে বন্ধুদের নিয়ে দাঁড়ানো, দরজার ফাঁক দিয়ে চিঠি, কার্ড এগুলো পাঠানো তো চললই।

একদিন জানালার নিচে ছোট টং দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ মেয়েটি জানালায় এসেই একটা কাগজ মুঠো করে নিচে ফেলল। আমি দৌড়ে কাগজটা তুলে আনি। খুলে দেখি দুই পৃষ্ঠায় Rice রচনা লেখা। পুরো রচনাটা পড়ে ফেললাম। ভেবেছিলাম, মেয়েটি হয়তো খুলে বলতে লজ্জা পাচ্ছে। তাই হয়তো রচনাটির মাঝে কোথাও i কোথাও হয়তো love ‍কোথাও you লিখেছে। পরীক্ষার জন্য কখনোই Rice রচনা এতোবার পড়িনি যতোবার I love you খুঁজতে গিয়ে ওই রচনাটি পড়েছি। কিন্তু খুঁজে পেলাম না কিছুই।

এভাবেই দিন চলতে থাকে। ছাত্র পড়ানোর সময় পপি সবসময়ই জানালায় থাকত। কোনো কোনো রাতে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টিতে আমি জানালার নিচে দাঁড়িয়ে থাকতাম। মেয়েটা একঝলক এসে হেসে চলে যেত। আমি মুচকি হেসে বাসায় ফিরতাম। বন্ধুদের আড্ডা ছোট টং দোকানের সামনে নিয়মিত হয়ে গেল। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকেও যখন মেয়েটার দেখা পেতাম না, তখন বন্ধুরা রাফি (মেয়েটার ছোটভাই) বলে চিৎকার দিত। মেয়েটা তৎক্ষণাৎ জানালায় এসে হেসে আবার চলে যেত। আমরা খুশিতে বাংলাফাইভ ধরিয়ে ফেলতাম। বিলটা অবশ্য আমিই দিতাম।

মেয়েটার সঙ্গে কেমন যেন জমে গেল। একটা নির্দিষ্ট সময়ে দুজনের দেখা হতে লাগল। পপি জানালায় এসে দাঁড়াত, আমি টং দোকানের সামনে। কখনো আগে চলে এলে, রাফি বলে জোরে ডেকে উঠতাম, পপি জানালায় চলে আসত। আমি গুণগুণ করতাম, কেন খুলেছ তোমার ওই জানালা, কেন তাকিয়ে রয়েছ জানি নাতো ...

>এর অনেকদিন পর। আইডিয়াল স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎই দেখি পপি। আমি প্রথমে চিনতে পারিনি। অবাক হয়ে দেখি আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। বন্ধুরা বলে, এই তো চান্স, কিছু একটা কিনে এখনই গিফট কর। আমি তাকিয়ে দেখি পপি লাইব্রেরি দোকানটায় বান্ধবিসহ ঢুকেছে। আমিও চটজলদি ঢুকে পড়লাম। তখন বেশ সুগন্ধিসহ ডিজাইন করা কলম পাওয়া যেত। আমি দোকানদারকে বললাম সেরকম একটা কলম দিতে। কলম নিয়ে আমি কাগজে এঁকে দেখি কালি আসে না। আরেকটা বদলে নিয়ে দেখি এটাতেও কালি নেই। আমি বিরক্ত হয়ে ক্রমাগত কাগজে কলম ঘষছি, কোনোটাতেই কালি আসে না। বন্ধুরা তাড়া দেয়, তোর কালির কি দরকার। কলম হলেই তো হলো ...

আমার মাথায় কিছুই ঢুকছে না। কালি ছাড়া কলম কেমনে গিফট দেয়! আমি কাগজে কলম ঘষতেই থাকি। ওদিকে পপি বেরিয়ে যায়। আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। এই প্রথম দেখা হলো। কলম দেয়ার ছুতোয় নিশ্চয়ই আঙ্গুলগুলো ছুঁয়ে দেয়া যেতো। ধ্যাত ...

সোনালী রংয়ের ছোট ত্রিভুজাকৃতির একটা কানের দুল পড়ত পপি। স্কুলছুটির পর একই পোশাকের একদঙ্গল মেয়েদের কারোরই মুখের দিকে আমি আর তাকাই না। সবার কানে আমি সেই ত্রিভুজাকৃতির কানের দুল খুঁজি। মিলে গেলে চেহারার দিকে তাকাই। কিন্তু পপিকে আর পাই না। পকেটে হাত দিয়ে কলম (এবার কালিসহ) চেপে আবার টং দোকানে গিয়ে বসে থাকি।

জানালার পর্দাটা একটু নড়ে উঠে। আমি উঠে দাঁড়াই, এখনই পপি উঁকি দেবে। কিন্তু আমাকে অবাক করে সম্পূর্ণ বয়স্ক একজন মহিলাকে জানালায় দেখা যায়। আমার দিকে চোখ পড়তেই ত্রাহি চিৎকার করে উঠে,ওই সুন্দুর গুন্ডা। তুই আমার পোলারে ডাকস কেন?

আমি হতভম্ব হয়ে যাই। আমাকে বলছে? উপরে তাকাতেই আবার মহিলাটি চিক্কুর দিয়া উঠে, প্রতিদিন আমার পোলাটারে ডাকে। পোলাটা ভয়ে খেলতে যায় না। ওই সুন্দুর গুন্ডা তোরে আমি পুলিশে দিমু।

আমি অপ্রস্তুত হয়ে সেখান হতে সরে আসি। ঘটনা কি বুঝতে পারি না। পরে বন্ধুদের কাছ থেকে জানি, প্রতিদিনই আমার বন্ধুরা দয়াপরবশ হইয়া কলোনিতে ঢোকার আগে ও পরে প্রতিবারই রাফি বলে ডাক দিত। পপি ডাক শুনে জানালায় এলে বন্ধুরা মাথানিচু করে চলে যেত। আমি শুনে তো অবাক। আমার অবর্তমানে বন্ধুরা চামে চামে মজা লইছে। বন্ধুত্বের নিকুচি করি।

এরপর গঙ্গা-বহ্মপুত্রে অনেক জল বয়ে যায়। পপি আমাকে বই গিফট করে ওর বান্ধবির মাধ্যমে। আমিও প্রত্যুত্তরে চারটি বই গিফট করি। রাত ২/৩টা পর্যন্ত জানালার নিচে দাঁড়িয়ে থাকি। আমাদের মাঝে আর কখনো দেখা বা কথা হয়নি। কিন্তু জানতাম একদিন তো হবেই।

একদিন কলোনিতে পুলিশী রেড পড়ল। আইডিয়াল স্কুলের মাথায় দুইটা লরি দাঁড়িয়ে আছে। অসংখ্য পুলিশ। বাজারের ব্যাগ হাতে আমার এক বন্ধু আমাকে ডেকে বাইরে আনে। লুঙ্গি পড়ে আমিও বের হয়ে আসি। হেঁটে স্কুলের গেটের সামনে আসি। কি মনে করতেই উপরে তাকিয়ে দেখি, পুরা ফ্যামিলি তিনতলায় দাঁড়িয়ে আছে। আমি মুগ্ধ দৃষ্টিতে পপির দিকে তাকিয়ে থাকি। হঠাৎই কানে আসে, ওই কুত্তা। উপরে তাকাইয়া আছস কেন?

কিছু বুঝে উঠার আগেই আবার কানে আসে, কুত্তা কোথাকার। তোরে আমি পুলিশে দিমু। তুই খাড়া আমি আইতাছি।

এতোক্ষণে বোধগম্য হয় পপির বাবা আমাকে গালি দিচ্ছে। তারপর আমারও এক সেকেন্ড দেরি হয় না। তুবড়ি ছোটাতে থাকি আমি। আমার গালির তোড়ে পুরা বারান্দা খালি হয়ে যায়। আমি হাঁপ ছেড়ে তাকিয়ে দেখি দুই লরি ভর্তি পুলিশ আমার দিকে তাকিয়ে আছে। বন্ধুকে খুঁজতে গিয়ে দেখি সে নাই। আমি একটু ভয় পাই। কোনোমতে সেখান থেকে চলে আসি।

এরপর থেকে পপির সঙ্গে আর কোনোরূপ যোগাযোগ নাই। জানালার নিচে অনেক দাঁড়িয়েছি তারপরও দেখি মিলেনি। পপি এভাবেই হারিয়ে যায়। তবে একদিন তিনতলায় উঠে গাল মেঝেতে ঠেকিয়ে অনেক কষ্টে দরজার ফাঁক দিয়ে একজোড়া পায়ের পাতা দেখেছিলাম। ঠাহর করি ওইটা পপিই ছিল।

২০ ফেব্রুয়ারি রাত। একুশে ফেব্রুয়ারির জন্য রাস্তায় আল্পনা আঁকছিলাম বন্ধুরা মিলে। কাজ অর্ধেক শেষ করে সবাই মিলে সিগারেট খাচ্ছি, হঠাৎই মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি চাপে। পপিদের বারান্দায় তাকাই। বন্ধুদের বলতেই তাদের উৎসাহ মিলে। আমি চটজলদি বানর হয়ে যাই।

তরতর করে গ্রিল, দেয়াল বেয়ে পপিদের বারান্দায় উঠে পড়ি। অন্ধকারে ইতিউতি তাকিয়ে কিছুই দেখি না। নেমে যাব, এমন সময় হঠাৎই বারান্দায় ঝুলে থাকা একটা কামিজের দিকে চোখ পড়ে। হাত বাড়াই ...

নেমে এসে বন্ধুদের দেখাতেই সবাই হেসে গড়িয়ে পড়ে। এখন এই জামাটাকে নিয়ে কি করা যায়? আমাদের এলাকায় মাঝে মাঝে পুরান জামাকাপড় কিনে নেয় এমন হকার আসে। সিদ্ধান্ত নেয়া হলো এই জামাটা বিক্রি করে তা দিয়ে চা-নাশতা খাওয়া হবে। কেউ কেউ বুদ্ধি দিল এটাকে পার্সেল করে পপির বাপের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হোক। সঙ্গে চিরকটু থাকবে এরকম, চাইলে তোমার মেয়েকেও উঠিয়ে নিয়ে যেতে পারি।

বন্ধুদের নিরাশ করে আমি জামাটা শার্টের তলে কোমরে গামছার মতো করে বেঁধে ফেলি। আল্পনার বাকি কাজটুকু শেষ করে বাসায় ফিরেই সটান বিছানায়। জামাটায় নাক ডুবিয়ে লম্বা ঘ্রাণ নিয়ে বালিশের তলায় রাখি। গভীর ঘুমে তলিয়ে যাই।

সকাল ১১টায় ছোটভাইয়ের ডাকে ঘুম ভাঙ্গে। চোখ মেলেই জামাটার কথা মনে পড়ে। বালিশের নিচে হাত দিয়ে দেখি সেখানে নেই। কি ব্যাপার! ছোটভাইকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারি ভয়াবহ ঘটনা ঘটে গেছে।

আমি ছিলাম ভয়াবহ ঘুমে। সকালে আম্মা ছোটভাইকে জাগাতে এসে দেখে নীল রঙের শাদা বলপ্রিন্টের মেয়েদের একটা জামা আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। আম্মা নাকি চিৎকার করতে গিয়েও থেমে যায়। দ্রুত ছোটভাইকে জাগিয়ে জিজ্ঞেস করে। ছোটভাইয়ের মতে, জামাটি নাকি এমনভাবে আমাকে জড়িয়ে ছিল, যেন আমি সত্যিই কোনো মেয়েকে জড়িয়ে শুয়ে আছি। এমন ভাবার কারণ হলো আমি সবসময়ই কোলবালিশ নিয়ে ঘুমাই যেটা লম্বায় প্রায় আমার সমান। পপির জামা কোলবালিশ ও আমাকে জড়িয়ে একটা বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা তৈরি করে। সব ঘটনা শুনে আমি অবাক হই। ভাবতে থাকি, বালিশের তলা থেকে জামাটা বের হয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরল কিভাবে!

আম্মা তখন বাইরে ছিল। ছোটভাইকে জিজ্ঞেস করি, জামাটা কই? ছোটভাই বলে, আম্মা ফেলে দিয়েছে। আমার সন্দেহ হয়। পুরা ঘর তন্নতন্ন করে খুঁজি। আমাদের বাসায় পুরোনো পেপার বিক্রি করা হয় ৫/৬ মাস পরপর। তো সেই জামাটা আমি পুরোনো পেপারের সবচেয়ে নিচে খুঁজে পাই। তাড়াতাড়ি বের করে আমার ওয়ারড্রোবে তালা মেরে রেখে দিই।

বি.দ্র. : লেখাটা অনেক বড় হয়ে গেল। শেষ করে দিই। তবে শেষ করার আগে আরেকটা জিনিস জানাতে চাই। ওই ঘটনাটি ঘটেছিল ১৯৯৬ সালে। আজ পর্যন্ত জামাটা আমার ওয়ারড্রোবেই রয়েছে। পপির সঙ্গে কোনো যোগাযোগই নেই। তবে একবার ঈদে ফোন করে বলেছিলাম যে আমিই তার জামাটা চুরি করেছি। সেটা আরেক ইতিহাস।