Tuesday 19 May 2009

মাল্টিকালচারের বটিকা সেবনে বিপর্যস্ত বাংলা বৈশাখী মেলা !!

ছোটবেলা থেকে পৃথিবীর যে অঞ্চলটির কথা বেশি বেশি শুনে বড় হয়েছি তা হলো বিলেত, বড় হয়ে জেনেছি এই বিলেত হলো আমাদের সবারই প্রিয় শহর লন্ডন। যে শহরে বাঙালিরা তাদের টয়লেটে কোন রঙের বদনা ব্যবহার করবেন তা নিয়ে একেবারেই চিন্তিত হন না, সহজলভ্যতার কারণে। এ শহরেই আমাদের দাদী-নানী-চাচী-মামী সহ মুরুব্বি গোছের মাতৃকূল সুপারি কাটার যন্ত্র শীতের বিকেলে টুকটুক করে হেঁটে স্থানীয় দোকান থেকে কিনে নিয়ে আসেন। মুরুব্বী গোছের পিতৃস্থানীয়রা বড় আয়েশ করে শুঁটকি কিংবা সাতকরার মিশেলে মজাদার রান্না খেয়ে আলস্য ঢেকুর তোলেন। আর এসবই সম্ভব হয়েছে অত্যধিক সংখ্যায় বাঙালির সহাবস্থানের কারণে। বাংলাদেশ আর পশ্চিমবঙ্গের বাইরে লন্ডনই হচ্ছে পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম বাঙালি অধ্যুষিত অঞ্চল।
১৯৯৭ সাল থেকে লন্ডনে আয়োজন হয়ে আসছে বৈশাখী মেলা, বাঙালির প্রাণের মেলা। দেশে ছেড়ে আসা সেই প্রিয় মেলার স্মৃতি মনে আঁকুপাকু হয়ে যখনই চিত্তচঞ্চল করে তোলে ঠিক তখনই বিদেশবিভুঁইয়ে এরকম বৈশাখী মেলার আয়োজন মনে করিয়ে দেয় - না, বাংলা আমাকে ছেড়ে যায়নি, আমিও ছাড়ব না। এ কথার সত্যতা মেলে প্রতি বছর মেলায় বাঙালির অংশগ্রহণ বাড়তে দেখে। এবার মেলায় আগতের সংখ্যা চলে গেছে একশ হাজারের কাছাকাছি। নিজের পেশাগত কারণে এবছর সহ মোট ৫টি বৈশাখী মেলার আয়োজন ও প্রচারের সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকেছি। নানা অসঙ্গতি থাকা স্বত্ত্বেও বিগত প্রতিটি মেলাকেই আমি সফল বলতে চাই। তবে এবছরের মেলায় অসঙ্গতির পর্যায়টি ছিল চরম এবং দুঃখজনক। এবারের মেলাকে আমার বাংলা সংস্কৃতি বোধ আর বিশ্বাসের নাভিমূলে হ্যাচকা টান বিবেচনায় আমি ব্যথিত ও অপমানিত।
এবারই প্রথম টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের নিজস্ব তত্ত্বাবধান আর আয়োজনে বৈশাখী মেলা সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু অত্যন্ত আক্ষেপের সঙ্গে বলতে চাই কাউন্সিলের যেসকল কর্মকর্তা এ আয়োজনের পেছনে ছিলেন তাদের বাংলা সংস্কৃতি সম্পর্কে ধারণা খুবই দুর্বল। প্রথমেই আসা যাক র‌্যালি কিংবা মঙ্গল শোভাযাত্রা সম্পর্কে। 'বাংলা কুইন' নামক উৎকট একটা অবয়ব পুরো র‌্যালি জুড়ে চালিয়ে তারা তৃপ্তি পেলেও আমি লজ্জায় অবনত হয়েছি এই ’বাংলা কুইন’-এর সঙ্গে গ্রামবাংলার কোনো ’রাণী’-র সামঞ্জস্য না পেয়ে। লেখার এ পর্যায়ে পাঠকদের একটা প্রশ্ন করা যাক। বলুন তো, বাংলার নারীকে কোন দিনে সবচেয়ে বেশি সুন্দর লাগে? উত্তর স্বভাবতই সকলের জানা - বৈশাখের প্রথম দিনে বৈশাখী মেলায়। আর এই সৌন্দর্য্যরে প্রধাণ উপাদান বাঙালি নারীর চিরায়ত পোশাক শাড়ির সঙ্গে লাল রঙের প্রবল প্রাধান্য, যা পুরোই অনুপস্থিত ছিল এবারের বৈশাখী মেলার র‌্যালিতে। নীল আর সবুজ রঙে সাজানো বাংলা কুইন সহ ঢাকীদল ও ময়ূরবেশে নৃত্যরত সকল মেয়েকেই বিজাতীয় মনে হয়েছে। একপ্রকার ভ্রমে পড়তে হয়েছে বৈশাখী র‌্যালি আর কার্ণিভালের পার্থক্য নিরূপণে। গত চার বছরের তুলনায় এবারের র‌্যালিতে জনসাধারণের অংশগ্রহণ ব্যাপক ছিল না। জনপ্রিয় কয়েকটি সাংস্কৃতিক সংগঠনের অনুপস্থিতি চোখে ঠেকেছে। র‌্যালি জুড়ে তরুণদের উৎফুল্লতা, হর্ষধ্বনি, দোতারা হাতে গেরুয়া পোশাকধারী, নববধূর সাজ, রিক্সা, মহিলাদের নাচ প্রতিবছর দেখে দেখে চোখ সয়ে এলেও এবারের মেলায় এসবের অনুপস্থিতি দেখে চোখ রগড়ে নিয়ে ভাবতে হয়েছে এই প্রাণপ্রাচুর্যহীন র‌্যালি আয়োজনে কোন দুষ্টলোকের কোন সংকল্প কাজ করেছে। বাসন্তী ও লাল রঙহীন, পর্যাপ্ত ফেস্টুন ও অবয়বের অভাবে এই ম্যাড়মেড়ে মেলা আগতদের দেহে মনে কোনোরূপ প্রণোদনা সৃষ্টিতে ব্যর্থ হয়েছে। বৈশাখী র‌্যালিতে প্রতিবছরই নতুন নতুন থিম (কোনো বছর বাঘ, কোনো বছর হাতী) ব্যবহারের রেওয়াজ থাকলেও এবারের র‌্যালিতে গতবছরের রয়েল বেঙ্গল টাইগার আর গতবছরেই ব্যবহৃত আরেকটি অবয়বকে এবার ’বাংলা কুইন’ নামে মনগড়া ব্যাখ্যায় র‌্যালিতে চালিয়ে দেয়া হয়েছে। তাহলে র‌্যালির ক্ষেত্রে বাজেটের কি পরিমাণ অর্থ কোন খাতে ব্যবহার হলো?
এবারের মেলায় এ্যালেন গার্ডেনে একটি ও উইভার্স ফিল্ডে দুইটি মঞ্চ তৈরি করা হয়। উইভার্স ফিল্ডের দুইটি মঞ্চের একটি ছিল মূলমঞ্চ, যার অনুষ্ঠানাদি বৃটেনের জনপ্রিয় টিভি ’চ্যানেল এস’ পুরো ইউরোপজুড়ে সরাসরি প্রচার করে। মেলায় আমার সম্পৃক্ততা ওই মূলমঞ্চ ঘিরে ছিল বলেই আজকের লেখায় এই মঞ্চের কথাই থাকবে। প্রথমেই আসা যাক উপস্থাপক প্রসঙ্গে। অপরিপক্ক, বিবেচনাহীন, বাংলা ভাষা ও তার উচ্চারণ সম্পর্কে উদাসীন, রেডিও প্রেজেন্টার পরিচয়ের খোলসে উপস্থিতজ্ঞানশূণ্য, হিতাহিতভাবে আনস্মার্ট একজন উপস্থাপক মঞ্চে উপবিষ্ট হয়ে কথা শুরু করা মাত্র পুরো মেলার পরিচালনা নিয়ে দারুণ করুণার সঞ্চার হয়েছে মনেপ্রাণে। নিদারুণ ফাজলামোর চূড়ান্ত ঘটনাটি ঘটে যখন অবাঙালি আরো দুইজন উপস্থাপক মঞ্চে উঠে, ব্যাকস্টেজ থেকে মাত্র শিখে আসা দুইটি বাংলা বাক্য আওড়ে, হিন্দি গানের কলি গেয়ে উপস্থিত দর্শকদের মন জয় করার ব্যর্থ অপচেষ্টা করেন। আমার সঙ্গে সঙ্গে ভাবনায় পেয়ে যায়, আমি কি গুজরাটি কিংবা শিখদের কোনো মেলায় উপস্থাপকের দায়িত্ব পেতে পারি যেখানে ওই দুইটা ভাষার একটিও আমার দখলে নেই! এইসব অবাঙালি প্রেজেন্টারদের সাথে তাল মেলায় বাংলাদেশী আনস্মার্ট প্রেজেন্টাররাও। বাংলা নাচ শেখানোর উছিলায় কিম্ভুতকিমাকার ভঙ্গিতে দুই প্রেজেন্টার মাঠ ভর্তি দর্শকদের সামনে তাদের নিতম্বদেশের অশ্লীল প্রদর্শনের মাধ্যমে বাংলা সংস্কৃতির কোন মজাটা আমাদের পাইয়ে দিলেন সেটা ভাবতে গেলেই হতাশ হতে হয়। এইসব অর্বাচীনের অরূচিকর উপস্থাপনা ঘুরে ফিরে হজম করতে হয়েছে মাঠসহ টেলিভিশন দর্শকদের সবার। আমার ভাষার, আমার সংস্কৃতির সম্মিলনে, আমার সাথে ভাব বিনিময় করতে পারে না এমন অবাঙালি উপস্থাপক নিয়োগের সিদ্ধান্ত একেবারেই অবিবেচনাপ্রসূত। বাংলা সংস্কৃতির সঙ্গে এমন নোংরা ঠাট্টা লন্ডনের বাঙালিরা পুনরায় সইবে না, যে বাঙালি জাতির রয়েছে ভাষা রক্ষায় প্রাণ দেবার জ্বলজ্বলে ইতিহাস।
এখন আসা যাক মঞ্চের অনুষ্ঠানাদি নিয়ে। এইবার মঞ্চে প্রচুর বিদেশী মিউজিশিয়ান ব্যবহার করা হয়েছে। ’ফিউশন’ নাম দিয়ে প্রচলিত বাংলা গানগুলোকে বিকৃত করা হয়েছে। যারা ভেবেছিলেন, প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের মিলনের নামে এই ’ফিউশন’ জনগণ পছন্দ করবেন তাদের শক্ত কণ্ঠে বলে দিতে চাই, দর্শকরা আপনাদের ছুঁড়ে ফেলেছে। আপনাদের চিন্তার দৈন্যতায় একটাই কামনা - দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠুন। বিদেশ বিভুঁইয়ে পড়ে থেকে, কষ্টে যাপিত জীবনে ফল্গুধারার মতো বছরে একবার আসা বৈশাখী মেলায় বাঙালিরা শুনতে চায় বাঁশির সুর, তবলার বোল আর ঢোলের মাদল। স্যাক্সোফোন, অর্গানের সঙ্গে বাংলা গানের ফিউশন হয়তো কোনো শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত মিলনায়তনে শোনা যেতে পারে, তবে সেটা কোনোমতেই বৈশাখী মেলায় নয়। এদেশের বড় হয়ে উঠতে থাকা ভবিষ্যত প্রজন্মকে পূর্বপুরুষের সংস্কৃতিকে পরিচয় করিয়ে দেবার এইসব সুযোগগুলোকে ফিউশনের কারণে হাতছাড়া হতে দেবার চেষ্টা রুখতে হবে। ’মিলন হবে কতো দিনে’ জনপ্রিয় এ গানটিকে ফিউশনের যাঁতাকলে রীতিমতো বলাৎকার করা হয়েছে অথচ এই গানটি এতো বছর পরেও তার নিজস্ব সুরের কারণে আজো শ্রুতিমধুর। ফিউশনের জন্য যে সময়টুকু বরাদ্দ করা হয়েছিল তার স্থলে খুব আয়েশ করে স্থানীয় শিল্পীদের ও মিউজিশিয়ানদের সংকুলান সম্ভব হতো। উইভার্স ফিল্ড মেলার মূল মঞ্চ হিসেবে প্রচারের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। এ মঞ্চে স্থানীয় শিল্পীদের বেশি বেশি সুযোগ দিয়ে ফিউশনকারীদের অন্য মঞ্চে সুযোগ দেয়াটাই হতো বুদ্ধিমানের কাজ।
বৈশাখী মেলা পুরোটাই বাঙালিদের মেলা। সবাই আশা করেন এ মেলায় বাংলা আর বাঙালির সংস্কৃতির চর্চা চলবে। অথচ আয়োজনকারীদের বাংলা সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসার অভাব আর মাল্টিকালচারের বটিকা অতিরিক্ত সেবনে অসুস্থ হয়ে পড়ায় এ মেলাকে গুলিয়ে ফেলেছেন অন্যান্য মাল্টিকালচার মেলার সঙ্গে। এদের নিয়ন্ত্রণে অসুস্থ চেষ্টা হয়েছিল বৈশাখী মেলার নাম পরিবর্তন করার। গত বছরের মেলাগুলোতে দেখা গেছে, এ বছরও তার ব্যতিক্রম হয়নি - মেলা রয়ে গেছে হিন্দিযুক্ত। এ পর্যায়ে পাঠকদের কাছে সবিনয় অনুরোধ জানাচ্ছি, মাল্টিকালচারাল নয় কিন্তু নিরেট কোনো গুজরাটি কিংবা শিখদের মেলায় কোন পাঠক কবে শুনেছেন বাংলা গান বাজতে মনে করে দেখুন। অবস্থা এমন দিকে যাচ্ছে একসময় দেখা যাবে বৈশাখী মেলার স্থলে মাল্টিল্যাগুয়াল কোনো মেলা চালু হয়েছে এবং সেখানে বাংলার জন্য হয়তো ঘন্টা দুয়েক বরাদ্দ থাকবে।
এরকম কোনো অপসম্ভাবনার তৈরির আগেই সবাইকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলতে চাই বৈশাখী মেলা কোনো মাল্টিকালচারাল মেলা নয়, এটা সম্পূর্ণ বাঙালির মেলা। এ মেলায় বাঙালিরা গান গাইবেন, বাঙালিরা বাজাবেন, আমরা ভবিষ্যত প্রজন্মকে পরিচয় করিয়ে দেব এ খাঁটি ও খাদমুক্ত বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে। ঘর থেকে যার চর্চা শুরু, উন্মুক্ত খোলা মুক্তমঞ্চে তার উপস্থাপনা ভবিষ্যত প্রজন্মকে আরো উজ্জীবীত করবে। এই বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে বিজাতীয় কোনো মিশেল দেয়া নিজের সংস্কৃতির সঙ্গে বেঈমানী স্বরূপ। বাঙালিরা অতিথিপরায়ণ, তাই মেলা উপভোগকারীরা হবেন নানা জাতির, ভাষার। কিন্তু কোনোমতেই যেন তারা অন্তত এই দিনে ’ফিউশন’ এর ঘোড়া আমাদের উপর দাবড়াবেন না। মাল্টিকালচারাল শহরে বৈশাখী মেলার দিনে হতে চাই পুরোদস্তুর বাঙালি।

1 মন্তব্য:

TutorialBD said...

থাংকু ভেরি মাছ।