Saturday 19 November 2016

নির্মাতা : ভাই, খুব ইচ্‍‌ছা জীবনে একটা হলেও ‘ড্রিম প্রজেক্ট’ বানামু ...

নতুন কুঁড়ির মতো জনপ্রিয় রিয়েলিটি শো দেখে বড় হওয়া প্রজন্ম, স্যাটেলাইট টিভির যুগে শুধু টিভিনাটক নির্মাতাই হতে পেরে‍‌ছেন।

একুশে টিভি চালু হওয়ার সময় ভারতীয় কি‍‌ছু নির্মাতার সহায়তায় রিয়েলিটি শো তৈরি হয়ে‍‌ছিল। নতুন কুঁড়ি দেখে বড় হওয়া প্রজন্মের কেউ কেউ, সেই রিয়েলিটি শো নির্মাণে সহকারি হিসেবে কাজ করে‍‌ছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে এদের কেউই রিয়েলিটি শো নির্মাণে পুরোপুরি এগিয়ে আসেননি।
অন্যান্য স্যাটেলাইট টিভিগুলো যখন কপিপেস্ট রিয়েলিটি শো করতে শুরু করল, তখন টিভিতে কাজ কর‍‌ছেন এমন ব্যক্তিরাই ওইসব কপিপেস্ট নির্মাণে মূলত জড়িত ‍‌ছিলেন। এ‍‌ছাড়াও প্রচুর ইভেন্ট (টিভিগুলোর বার্ষিকী. উদ্বোধন, এওয়ার্ড, বিউটি কনটেস্ট ইত্যাদি) হয় যেগুলোর নির্মাতাদের মেধা বোঝা যায় ইভেন্টে সমন্বয়হীনতা দেখে।
কোনো মেধাবি তরুণ রিয়েলিটি শো নির্মাতা হতে চান বা দুর্দান্ত কোনো অনুষ্ঠানের আইডিয়া নিয়ে টিভিগুলোতে হন্যে হয়ে ঘুর‍‌ছেন, এমনটা দেখা যায়নি। কিন্তু নাটক নির্মাণ করতে চান বা নাটক নির্মাণ করে‍‌ছেন এমনটা প্রচুর দেখা যায়। একটাই কারণ— টেলিভিশনের জন্য নাটক নির্মাণ অত্যন্ত সহজ কাজ। ফলে ঢাকা শহরে কাক, ডিএসএলআর ফটোগ্রাফার, সাংবাদিক (অন-অফ-ইলেক্ট্রো) আর টিভিনাটক নির্মাতা— সংখ্যায় সমান হয়ে গে‍‌ছে।
এরা নাটক নির্মাণ ‍‌ছাড়া টেলিভিশনের জন্য অন্য কোনো অনুষ্ঠান নির্মাণ করেন না। মাঝে মাঝে শিল্পীসংকট হলে বা চমক দেখানোর উদ্দেশ্যে নাচের মেয়ে (‍‌ছেলে নয়), মডেল, গায়ক, ক্রিকেটার, ফুটবলার, ডিজে অথবা ‘যেমন খুশি তেমন সাজো’ প্রযুক্তি ব্যবহার করে ‘আপনে যেমনই তেমনই এ্যাক্টিং’ ফর্মুলার মাধ্যমে বিভিন্নজনের মধ্যে অভিনয়স্বত্ত্বার বিকাশ ঘটিয়ে নিজেদের সৃষ্টি ও সৃজনশীলতার পরিচয় প্রকাশ করেন। বর্তমান বাজারে কেউ নাটক নির্মাতা হতে চাইলে তার ইচ্‍‌ছা-টাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তবে, ইচ্‍‌ছাশক্তির পাশাপাশি ভালো সমন্বয়ক-ও হতে হয়। এজেন্সির সাথে, প্রযোজকের সাথে, টিভির অনুষ্ঠান ও মার্কেটিং বিভাগের সাথে সঠিক সমন্বয় থাকলে ভালো ক্যামেরাম্যান ও উ‍‌চুঁ-দরের আর্টিস্টের শিডিউল পাওয়া যায়। এরপর স্ক্রিপ্ট, শ্যুটিংয়ের আগের দিন হাতে পেলে অথবা না পেলেও দুইদিনে নাটক নির্মাণ করা সম্ভব।
দেশে যখন স্যাটেলাইট চ্যানেল ‍‌ছিল না, তখন নতুন কুঁড়ি দেখলেও জীবনে রিয়েলিটি শো বানানো সম্ভব হবে কিনা এমন সন্দেহ মাথায় নিয়ে সবাই ফিল্মমেকার হতে চেয়ে‍‌ছে। পরিণামে, কাওরান বাজারের এফডিসি থেকে উল্টোমুখো হয়ে কলাবাগানের শর্টফিল্ম ফোরামের অফিসে হত্যে দিয়ে বসে থাকলেন ভবিষ্যতের সত্যজিৎ, কুরোসাওয়া, মাজিদ মাজিদিরা। ‘ফিল্ম একটা বিররররাট ব্যাপার’ — বিষয়টা যখন বিভিন্ন দূতাবাসের কালচারাল সেন্টারের ‍‌ছাদ ও অডিটরিয়াম ‍‌ছাড়িয়ে আজিজ মার্কেট ও টিএসসিতে আলোচনা হতে থাকল, তখনই একুশে টিভি চলে আসে। বাংলাদেশের সত্যজিৎ, কুরোসাওয়া, মাজিদ মাজিদিরা ঝটপট টিভিপর্দায় নাটক বানিয়ে সিনেমার বানানোর জন্য হাত মকশো করা শুরু করলেন।
সেই ধারাবাহিকতায় ১৬ ব‍‌ছর পরে আজকের নির্মাতারাও, সিনেমা বানাবে বলে টিভিতে নাটক বানিয়ে প্র্যাকটিস জারি রেখে‍‌ছেন। বাজেটের নিম্নগতিও এদের রুখতে পার‍‌ছে না, এতোই প্রবল ইচ্‍‌ছাশক্তি। এসব নির্মাতারা মনে মনে স্বপ্ন দেখেন— একদিন একটা ড্রিম প্রজেক্ট বানাবে তারা। হুম ‘প্রজেক্ট’ই বটে। সিনেমা না, নাটক না— প্রজেক্ট। তো প্রজেক্টটা কী সেটা জিজ্ঞেস করলে ঋত্বিকউদাস হয়ে কনফিডেন্টলি বলে, জানি না ভাই, তবে একটা ড্রিম প্রজেক্ট বানামু এইটা শিওর।
বর্তমান বাজারে আমার দেখা চার প্রকারের নাট্যনির্মাতা আ‍‌ছে—
১. খ্যাতিমান নাট্যনির্মাতা (একটু বয়সী, নির্মাণের অভিজ্ঞতা ন্যুনতম ১২ ব‍‌ছর) : এই প্রকারের নাট্যনির্মাতার সংখ্যা খুবই কম। বাজেট স্বল্পতার কারণে ভালো নাটক নির্মাণ করা সম্ভব না এই অজুহাতে তাদের বর্তমান নির্মাণ যুৎসই না হলেও কেউ সমালোচনা করেন না। যদিও বাজেট স্বল্পতার দোহাই দিলেও এরা এজেন্সি, টিভি ও প্রযোজকদের কা‍‌ছ থেকে অন্যদের তুলনায় বেশি অর্থ পেয়ে থাকেন এবং খ্যাতনামা ও পূর্বের কি‍‌ছু ভালো নির্মাণের উদাহরণ থাকায় অভিনয়শিল্পীরা তাদের জন্য নামমাত্র সম্মানি কিংবা বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করতে বাধ্য হন। বিভিন্ন পার্বনে, উৎসবে এদের নাটক মানের চেয়ে নামের কারণে প্রচার হয়। এ প্রকারের নির্মাতার মধ্যে অভিনয়শিল্পীদের কেউ কেউ আ‍‌ছেন। সময়ের কারণে ও তরুণদের সাথে পাল্লা দিতে গিয়ে এরা গড্ডালিকায় গা ভাসালেও ভরসা করা যায় যে, এদের দিয়ে পুনরায় ভালো নির্মাণ সম্ভব। এদের কারো কারো বড়পর্দায় অভিষেকও হয়ে‍‌ছে।
২. বুঝদার, ঝানু নির্মাতা (তরুণ ও বয়সী, নির্মাণের অভিজ্ঞতা ন্যূনতম ৮ ব‍‌ছর) : এদের সংখ্যা হালকা। এরা মূলত সহকারি হিসেবে নির্মাণ কাজের সাথে যুক্ত হয়ে‍‌ছিল। ফলে এরা যথেষ্ট পাকনা ও বুঝদার। এককালে ভালো নির্মাতার সাথে কাজ করার কারণে শ্যুটিংয়ের আগে স্ক্রিপ্ট পড়ার অভ্যেস আ‍‌ছে তাদের। এরা প্রোডাকশন বোঝে, ফ্রেম বোঝে, গল্প বোঝে এবং শত ঝামেলার মাঝেও কাজ নামাতে পারে। বর্তমানে বাজারে এদের নির্মাণ সাধারণ মানের হলেও তাতেও তাদের চেষ্টাটা বোঝা যায়। এরা ডিমাণ্ড অনুযায়ী মাল (নির্মাণ) সাপ্লাই দিতে ওস্তাদ। সব বয়সী দর্শকের মেজাজ বুঝতে পারে এরা। বাজেট বাড়লে এদের কাজের মানও বাড়বে। শিল্পীদের সাথে এদের সখ্যতা থাকার কারণে বাকিতে কাজ করাতে পারে কিন্তু টেকাটুকা পরে পরিশোধ করতে হয়। অভিনয়শিল্পীদের কেউ কেউ এই ঘরানার নির্মাতা। এদের স্বপ্ন আ‍‌ছে সিনেমা নির্মাণের। তবে নাটকে এদের উপর যতোটা ভরসা আ‍‌ছে, সিনেমা নির্মাণের ক্ষেত্রে ততোটা নাই।
৩. এজেন্সি নির্মাতা (তরুণ, হালকা দাঁড়িগোফ, ন্যূনতম অভিজ্ঞতা ৪ ব‍‌ছর) : নামেই যার পরিচয়— এজেন্সি নির্মাতা। বিভিন্ন এজেন্সির আশির্বাদপুষ্ট এরা সংখ্যায় প্রচুর। এরা তরুণ, কিন্তু বড় বড় স্বপ্ন দেখে। এরা মারমুখী, জীবনমুখী, কালজয়ী, মনজয়ী সব প্রোডাকশন বানাতে সিদ্ধহস্ত। এরা নিজেরা পরষ্পরের পিঠ চাপড়ায়, বাহবা দেয়। এরা চ্যালেঞ্জ নিতে সর্বদা প্রস্তুত। প্রয়োজন পড়লে ১ দিনেও নাটক নির্মাণ করতে পারে তারা। এদের নির্মাণে সুন্দরী মেয়ে ও সুন্দর সুন্দর ফ্রেম দেখা গেলেও এ্যাক্টিং-য়ের দেখা পাওয়া যায় না। এরা গল্পের চেয়ে টেকনিকাল বিষয়গুলোতে বেশি প্রাধাণ্য দেয়। চকলেট টাইপ ও সুড়সুড়ি মার্কা নাটক হওয়ায় ইউটিউবে হিট বেশি পাওয়া যায়। এরা চমক দেখাতে সদা তৎপর থাকে তাই কারোর মধ্যে প্রতিভা টের পাওয়া মাত্রই (যে পেশারই হোক) তাকে অভিনয়ে নামিয়ে দেয়। অভিনয়শিল্পীদের কা‍‌ছে এরা দারুণ জনপ্রিয়। কারণ এদেরকে প্রেশারে রাখা যায়, চাপ দিয়ে নিজের সিকোয়েন্সগুলো আগেই করিয়ে নেওয়া যায়। এরা আজ আ‍‌ছে তো কাল নেই, তাই পেমেন্ট এ্যাডভান্স নেয়া যায়। এই নির্মাতারা প্রত্যেকেই অন্তরে ‘ড্রিম প্রজেক্ট’ ধারণ করেন। ফেসবুকে এদের ফ্যানফলোয়ার বেশি, এবং এদের কালেকশনে হতে-চাই-নায়িকার সংখ্যা প্রচুর। বাজেট সমস্যা নিয়ে এরা সবচেয়ে বেশি উচ্চকিত কিন্তু টিভিগুলো নিয়মনীতির মধ্যে চলে এলে এরাই হারিয়ে যাবে সবচেয়ে আগে।
৪. ঘর‍‌ছাড়া নির্মাতা (যে কোনো বয়সী, অভিজ্ঞতা নিষ্প্রয়োজন) : এরা নানা জায়গায় ঘোরাফেরা করে। বিভিন্ন মোড়ে, হাউজে এদের দেখতে পাওয়া যায়। এরা টিভি, এজেন্সি, প্রডিউসার, হাউজ কার কাজ করেন বোঝা মুশকিল। কুশলাদি জিজ্ঞেস করলে জানা যায়, দুইদিন পরেই তার কোনো না কোনো নির্মাণের শ্যুটিং শুরু হচ্‍‌ছে। কিন্তু এদের নির্মাণ কবে অন-এয়ার হয় সেটা জানা দুষ্কর। এদের কা‍‌ছে সব আর্টিস্টের ফোন নাম্বার থাকে, এবং সব আর্টিস্টরাও তাদের কমবেশি চেনেন। এরা বিভিন্ন সংগঠনের সাথে জড়িত ও মুখর থাকেন। নিজেদের নাট্যনির্মাতা পরিচয় দিতে স্বাচ্‍‌ছন্দ্য বোধ করলেও এরা ডকুমেন্টারি, মিউজিক ভিডিও ইত্যাদিও নির্মাণ করেন। এদের টুকটাক অভিনয় করতেও দেখা যায়।
এক মুঠো সংবাদ, এক চিমটি টকশো আর আধাসের নাটকের মাঝে গুলিয়ে ফেলা আমাদের ওরস্যালাইন টিভিগুলো এই ফর্মুলা থেকে বেরোতেই পারেনি যে টিভিতে বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান মানেই শুধু নাটক না। বাংলাদেশের মানুষের প্রথম প‍‌ছন্দ শুধু নাটকই না, তারা ইন্ডিয়ান আইডল থেকে শুরু করে কপিপেস্ট ক্লোজআপ ওয়ানে সেটা প্রমাণ করে‍‌ছে। তারপরও টিভিগুলোর অনিচ্‍‌ছায় ও সর্বোপরি একটা ভালো ইনস্টিটিউটের অভাবে নাটক নির্মাণ করা ‍‌ছাড়া অন্য কি‍‌ছু চিন্তাই করতে পারে না আমাদের ফ্রিল্যান্স নির্মাতারা। রিয়েলিটি শো বানাতে হলে, ইভেন্ট ডিরেক্টর হতে গেলে ৩-৬ ক্যামেরার কাজ জানতে হয়, অনলাইন সুইচিং জানতে হয়, টেকনিক্যালি সাউণ্ড হতে হয়, লাইভ ডিরেকশন দিতে হয়, কতো ঝামেলা। এরচেয়ে নাটক নির্মাণ করা সহজ, চাকচিক্য বিনোদনজগতের হাত‍‌ছানি পেতে তাই নাটকই মূল ভরসা।
কিন্তু নাট্যনির্মাতা ভায়ারা, সামনে দিন খারাপ হতে পারে। আন্দোলনের ডাক এসে‍‌ছে। সরকার যদি নিয়ম করেই দেয় নির্দিষ্ট সময় ব্যাতিত ইচ্‍‌ছেসময়মতো বিজ্ঞাপন প্রচার করা যাবে না, তখন কিন্তু বিজ্ঞাপনের ফাঁকে ফিলার হিসেবে চলা আপনার নাটক নেয়া বন্ধ হয়ে যাবে। কারণ তখন মানের প্রশ্ন চলে আসবে। ভালো মানের নাটক মানে প্রতিমিনিটে বিজ্ঞাপনের রেট বেড়ে যাওয়া। এজেন্সি কিংবা হাউজগুলো আর যাকে তাকে দিয়ে নাটক বানাবে না। এমনকি কয়েকটা টিভি বন্ধও হয়ে যেতে পারে। বাজেট বাড়বে সত্যি কিন্তু যে পরিমাণ নাটক এখন নির্মাণ হচ্‍‌ছে প্রতিদিন, সেই পরিমাণ কাজের ভলিউম কিন্তু পাবেন না। এখন ১০টা নাটক বানালে তখন হয়তো ৩টা নাটক বানাবেন। প্রতিযোগিতায় পড়বেন। পারবেন তো সেই চ্যালেঞ্জ নিতে?
যদি চ্যালেঞ্জ নিতে পারেন, বুক পকেটে ‘ডিম প্রজেক্ট’ নিয়ে থাক‍‌বেন কিন্তু ৩০ তারিখের আন্দোলনে*।
*FTPO-এর ৩০ নভেম্বরের 'শিল্পে বাঁচি, শিল্প বাঁচাই' শিরোনামের সমাবেশ উপলক্ষে লেখা

0 মন্তব্য: