Wednesday 28 November 2007

জনমত জরিপ @ রংপুরের পথে পথে : ০২

জীবনের প্রথম ছিল বলে প্রথমদিন বেশ কষ্ট হয়েছিল জরিপ করতে। এছাড়াও ছিল আগের রাতের জার্নির ক্লান্তি। কিন্তু একরাত ভালো করে ঘুমিয়ে এবং হালকা অভিজ্ঞতা হয়ে যাওয়ায় দ্বিতীয়দিনের কাজে তেমন কষ্ট হয়নি।

যথারীতি ঘুম থেকে উঠে আমি আর নীলু বেরিয়ে পড়লাম নতুন আরেকটা গ্রামের উদ্দেশ্যে সেই পুরোনো রিকশাওয়ালাকে নিয়ে। পনির ভাইয়ের পেটের অবস্থা আজকে বেশ ভালো। সে মীরাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। আমরা প্রায় দেড়ঘন্টা পরে গ্রামে গিয়ে পৌঁছলাম। এই দেড়ঘন্টা নীলুর সঙ্গে গল্প করে কাটল। আজকে নীলু পড়েছে ঘিয়েশাদা সালোয়ার কামিজ। সুন্দর লাগছিল তাকে।

গ্রামে পৌঁছেই আমরা আগের মতোই রিকশা ছেড়ে দিলাম। প্রথমদিন আমি বা নীলু যেই ইন্টারভিউ করেছি, আরেকজন সেটা শেষ হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতাম। আজকে ঠিক করলাম এভাবে না করে আমরা দুজনেই আলাদা আলাদা করে গ্রামে ঘুরব। এতে একই সময়ে দুইটা ইন্টারভিউ শেষ করা যাবে। ঠিক করা হলো নীলু বেশি বেশি করে মহিলাদের ইন্টারভিউ নিবে, ফাঁকে ফাঁকে পুরুষদের। দুজনে দুদিকে ছিটকে গেলাম।

পদ্ধতিটা বেশ কাজে দিল। খুব দ্রুত ইন্টারভিউ নিতে পারছি। বেশ পটু হয়ে গেছি। প্রথমদিন প্রশ্ন করে নির্লিপ্তগলায় উত্তরগুলো বলে অপেক্ষা করতাম। কিন্তু আজকে গল্পচ্ছলে প্রশ্ন করা এবং উত্তর আদায় করতে থাকলাম। এতে দেখা গেল লোকজন আন্তরিকতার সঙ্গে অংশ নিতে পারছে। কিন্তু একটা বিপদও হলো তাতে। এই গল্পচ্ছলে ইন্টারভিউ তো নেয়া যাচ্ছে, কিন্তু তা শেষ করে উঠতে চাইলে আবার বসিয়ে দিয়ে শুরু করে দেয় রাজনৈতিক কেচ্ছাকাহিনী। উঠিউঠি করলে চা-সিগারেট সাধে। সমস্যা এই পর্যন্ত হলেই হতো। কিন্তু গল্পের একপর্যায়ে আমারও মতামত জানতে চায়। তখন খুব কায়দা করে পাশ কাটাতে হয়।

এবার একটা ভয়ের ঘটনা বলি। ভয়ের ঘটনা কারণ আমি ভয় পেয়েছিলাম। গ্রামে কিছু টাউট টাইপের লোক থাকে। এদের কাজই ঝামেলা পাকানো। তো ওইদিন একটা বাড়ির পাশে গাছতলায় দাঁড়িয়ে এক কৃষকের ইন্টারভিউ নিচ্ছিলাম, হঠাৎই একটা লোক এসে আমার হাত থেকে ফাইলসহ সব কাগজ কেড়ে নিল। আমার হাত থেকে কলম পড়ে গেল। লোকটি ধমক দিয়ে বলল, এ্যাই আপনাদের কে পাঠিয়েছে?

আমি হতচকিত হয়ে গেলাম। আশেপাশে দুয়েকজন লোক দেখা যাচ্ছে। সবাই কি আমাকে মার দেবে বলে একাট্টা হয়েছে? আমি লোকটির দিকে তাকালাম। তেল চপচপে চুলে কায়দা করা সিঁথি করা হয়েছে। কিন্তু পরণের স্যান্ডো গেঞ্জিতে ছেড়া রয়ে গেছে। চেক লুঙ্গি পরা, পায়ে স্যান্ডেল। লোকটির সঙ্গে আমর কথোপকথন ছিল নিম্নরূপ,

- এ্যাই, আপনাদের কে পাঠিয়েছে?
- আমরা ঢাকা থেকে অমুক সংগঠনের পক্ষ থেকে এসেছি।
- কি কাম করতাছেন?
- এই যে সামনে নির্বাচন। এইটা নিয়া আপনাদের চিন্তাভাবনা কি সেটা জানার জন্য। পরে এটা আমরা পত্রিকায় প্রকাশ করব।
- আমারে বুঝ দেন, না? এইটা করতাছেন এরশাদরে জেলে আটকাইয়া রাখার জন্য।
- না না। কি যে বলেন আপনি।

আশেপাশের লোকজন আমাকে ততোক্ষণে সাপোর্ট করা শুরু করছে। দুয়েকজন ওই টাউট লোকটাকে ধমকও দিল আমার সঙ্গে এরকম ব্যবহার করার জন্য। সেসব দেখে একটু সাহস পেলাম। কিন্তু লোকটি তখন বলছে,

- আরে তোমরা বুঝো না। এরা আইছে এরশাদের বিরুদ্ধে রিপোর্ট দেয়ার লাইগা। ঘুইরা ঘুইরা সব জাইন্যা লইতাছে। এরশাদরে আরো জেল দিব।

লোকটার এইসব কথা আশেপাশের কারোরই বিশ্বাস হলো না। ওদের চাপাচাপিতে সে কাগজপত্র, ফাইল আমাকে ফেরত দিল। তারপর জিজ্ঞেস করল,

- আপনের লগের ওই মাইয়াডা কি আপনার বউ?
- জ্বি না। আমার বোন।
- ও আইচ্ছা। এর লাইগ্যাই চেহারায় এতো মিল।
- জ্বি।
- দেইখেন উল্টাপাল্টা কিছু কইরেন না।


লোকটা চলে গেলে সেযাত্রায় মুক্তি পেলাম। তবে আমি কিন্তু প্রথমে ভড়কে গিয়েছিলাম। অবশ্য ভবিষ্যতে এরচেয়েও খারাপ অবস্থায় পড়েছি। সেটা আরেক পোস্টে আলাপ করা যাবে।

প্রশ্নপত্রে একটা প্রশ্ন ছিল এরকম যে, আগামীকাল ভোট হলে আপনি কাকে ভোট দেবেন? এই প্রশ্ন শুনে উত্তরদাতা আমতা আমতা করত। কিন্তু প্রশ্নের উত্তর তো আমার চাই। বিশেষ করে এ প্রশ্নটায় অনেক বোঝাতে হতো। অনেক সময় উত্তরদাতার অন্যান্য উত্তর যাচাই করে একটা উত্তর ধরে নিয়ে সেটা নিশ্চিত হওয়ার জন্য আরো কিছু প্রশ্ন করে সিওর হতে হতো। কিন্তু কোনোভাবেই গলার স্বরে কোন দলের পক্ষে বিষয়টি চলে যায় কিনা সেটা খেয়াল রাখতে হতো। পরে অবশ্য খুব ভালো করেই এ প্রশ্নটার উত্তর আদায় করতে পারতাম। খেয়াল করেছি খুবই ক্যাজুয়ালি প্রশ্নটা করে ফেললে উত্তরদাতা আরো ক্যাজুয়ালি উত্তর দিয়ে দিতেন। অনেকে বলতেন, কিভাবে বলব ভাই, ভোটের আগের দিনও তো মাইন্ড চেঞ্জ হইতে পারে। সেক্ষেত্রে তাদের বলা হতো, আপনি আপনার মাইন্ড চেঞ্জ করবেন কিনা সেজন্য আপনাকে আরো ১০ মিনিট সময় দিলাম। এখন বলুন। তখন উত্তরদাতা কিছুক্ষণ চিন্তা করেই বলে দিতেন। ১০ মিনিট সময়ও নিতেন না। এরকম বিভিন্ন তরিকায় উত্তরটা জেনে নিতাম। তবে এইটার একটা বিপদও ছিল। ধরেন অনেকের মাঝে একজন উত্তর দিচ্ছেন। দেখা গেল আশেপাশে বিএনপির লোকজন বেশি থাকায় উত্তরদাতা বিএনপির নাম বলল। পরে অনেকক্ষণ পর আমাকে আরেক জায়গায় পেয়ে বলল, ভাই ওইসময় বিএনপি বলছি। আমি কিন্তু আসলে আওয়ামী লীগরে ভোট দিমু। আমরা শুধুমাত্র উত্তরদাতার নাম জানতে চাইতাম, ঠিকানা নিতাম না। তখন নাম খুঁজে শিট বের করে ঠিক করে নিতাম।

কিছু কিছু ইন্টারভিউ নেয়ার পর আমরা বাসায় গিয়ে সেগুলো ছিঁড়ে ফেলে দিতাম। কেউ কেউ ফাজলামো করার জন্য একেকটা প্রশ্নের জন্য আলতু ফালতু উত্তর সিলেক্ট করতেন। যেমন, তিনি বিএনপি সাপোর্ট করেন, পছন্দ করেন আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে কিন্তু আগামীকাল ভোট হলে জামাতকে ভোট দেবেন। এছাড়াও আলাদাভাবে কিছু লেখার জায়গা থাকলে সেখানে আজে বাজে কমেন্ট করত। আমরা সেসব প্রশ্নপত্রে খুব কৌশলে একটা চিহ্ন দিয়ে রাখতাম যেন পরে ফেলে দেয়ার জন্য সহজেই খুঁজে পাই।

তারপরও এসব ঝামেলার মাঝে বেশ জরিপ করে যাচ্ছি। গ্রামের বিশুদ্ধ বাতাসে হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে গেলে কোনো গাছের ছায়া কিংবা বাড়ির দাওয়ায় বসে জিরিয়ে নিতাম। বাংলা ফাইভের ধোঁয়া উড়িয়ে লোকজনের সঙ্গে গল্প করতাম। তখন আর জরিপ প্রসঙ্গ থাকত না, তাদের জীবনের গল্প শুনতাম। নীলু আলাদাভাবে ইন্টারভিউ করছে, মাঝে মাঝে তার সঙ্গে দেখা হতো। যে বাড়ির দাওয়ায় বসে সিগারেট খাচ্ছি, দেখা গেল ইন্টারভিউ শেষ করে ওই বাড়ি থেকে নীলু বেরিয়ে আসছে।

এবার একটা হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া ঘটনা বলি। দুপুরে আমি আর নীলু আবার একত্র হয়েছি। এক বাড়িতে নীলু তখন সবেমাত্র ইন্টারভিউ শেষ করেছে। আমরা আরেকদিকে যাব তখন গৃহকর্তা দুপুরের খাবারের কথা বলল। আমাদের তখন খাওয়ার ইচ্ছা বা সময় কোনোটাই ছিল না বলে লোকটাকে নিরুৎসাহিত করার চেষ্টা করি। কিন্তু লোকটি না শুনতে চাইছে না। তাই এড়িয়ে যাওয়ার জন্য বললাম, আচ্ছা যদি সময় পাই তাহলে খেতে আসব। মনে মনে কিন্তু সিদ্ধান্ত নিলাম আসব না।

কাজ করতে করতে কখন যে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেছে টের পাইনি। এইদিন কাজ খুব তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেল। আমরা ফিরছি রিকশা নিয়ে (রিকশা যথারীতি আগেরদিনের মতো ব্যবস্থাপনায় ছিল), ওই লোকটি আমাদের থামাল। বলল, আপনেরা খাইতে আইলেন না যে। আমি তো মুরগী রান্না করছি। আমরাও কেউ খাই নাই।

এই কথা শুনে কেউ খেতে না গিয়ে পারে? আমরাও লজ্জিত ভঙ্গিতে, ভুলে গিয়েছিলাম ভাব নিয়ে খেতে চললাম। খাওয়া দাওয়া শেষ করে নীলু আর আমি দুজনেই কুণ্ঠিত ছিলাম। বেচারা এমনিতেই গরিব। মুরগী হয়তো ওই একটাই ছিল। মেহমান খাওয়ানোর নামে দিছে জবাই কইরা। আহারে, এমন আতিথেয়তা বাংলাদেশ ছাড়া আর কোথায় মিলে?

শহুরে সভ্য আমরা দুইজন খাওয়া দাওয়া শেষ করে লোকটির হাতে বেশকিছু টাকা জোর করে গছিয়ে দিলাম। যদি পারে তবে আরেকটি ডিমপাড়া মুরগী কিনে নিক। এই ঘটনাটা আমাকে খুব তোলপাড় করেছে। 'বাংলাদেশ আতিথেয়তায় সেরা' কথাটির ব্যবহারিক প্রমাণে আমি মুগ্ধ হয়ে যাই। এই আতিথেয়তা আরো অনেক জায়গাতেই পেয়েছি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অবশ্য বাড়াবাড়ির পর্যায়েও চলে যেত।

কাজ শেষ করে আমি আর নীলু ফিরছি। সাথে ক্যামেরা ছিল না আমাদের কারোরই। তাই একটা অসম্ভব সুন্দর দৃশ্য আমি ধরে রাখতে পারিনি। কিন্তু মনের ক্যামেরায় (অবশ্য সেটা ভিডিও) আজীবন থাকবে। দৃশ্যটি হলো, একটা ধানক্ষেতের আইলে একটা গাছ, সেথায় এক বৃদ্ধ খালি গায়ে বিশ্রাম নিচ্ছে, গামছা নাড়িয়ে বাতাস করছে নিজেকে। আর পাশেই একটা বাছুর জিভ দিয়ে তার পিঠ চেটে দিচ্ছে। ওয়াও, আমরা রিকশাটা থামিয়ে দেখতে থাকি। প্রায় ৩/৪ মিনিট পর বাছুরটি কৃষকের পিঠ চাটা বন্ধ করে। মুগ্ধ হয়ে আমরা দৃশ্যটি দেখলাম।

সেদিনই আমরা ৪ জন গাইবান্ধার ধাপ এলাকায় চলে যাই। এখানেও পনির আর মীরা তাদের আরেক সহপাঠিনীর বাসা খুঁজে বের করে। ধাপ এলাকাটা আমার ভালোই লাগল। একটা রাস্তা আছে যার দুপাশে সারি সারি ফার্মেসীর দোকান। আমরা ওই রাস্তারই আশেপাশের কোনো একটা বাড়িতে ছিলাম। ধাপ থেকে একটা 'সাপ্তাহিক চলতিপত্র' (তখন মাত্র বেরিয়েছে) আর নীলুর জন্য 'অহরহ' (বিজ্ঞান পত্রিকা, এখন আছে কিনা জানি না) কিনলাম। ধাপের বাড়িটা খুব সুন্দর ছিল। মফস্বলের ছোট ছিমছাম দোতলা বাড়ি। সামনে খেলার মাঠ। আমরা বাড়িটার ছাদে আড্ডা মারলাম। নীলুর সঙ্গে সখ্যতা আরো গড়ে উঠল। এখন আমি তার হাতও ধরতে পারি। সে বাড়িতে রাতের খাবারটাও খুব ভালো হলো।

পনির ভাইয়ের কিসব থিসিস নাকি জমা দিতে হবে। তাই পরদিনই রাতের ঢাকার টিকেট কেটে ফেললাম। টিকেট পাওয়া যাচ্ছিল না এতো অল্প সময়ে। তখন দুইটা বাস রংপুর লাইনে ভালো ছিল। একটা হলো কিষাণ (যেটায় এসেছিলাম), আরেকটা আগমনী। আমরা আগমনী বাসের শেষ চারটা সিট পেলাম। ঠিক হলো পরদিন রংপুর শহরের কিছু জায়গা ঘুরে বাসে উঠে পড়ব।

তখনও বুঝতে পারিনি আগমনী বাসের এই জার্নিটা আমার জন্য কিসের আগমনী বার্তা নিয়ে আসছে।

2 মন্তব্য:

মাজেদুল ইসলাম said...

ভাইয়া আমি রংপুরে থাকি।আপনার লেখা গুলো খুবই ভাল লাগছে।আপনি রংপুরের গ্রামের এত সুন্দর বর্ননা দিয়েছেন পড়ে অভিভুত হলাম।আসলে গ্রামের মানুষদের আতিথেয়তা তুলনাহীন।আপনি এখন কথায় থাকেন?

Ahir said...

Nice Article sir, Keep Going on... I am really impressed by read this. Thanks for sharing with us.. Happy Independence Day India WhatsApp SMS in English, Latest Government Jobs. List of Top 10 Free Classified Ad Posting Sites of India