সুশান্ত দাস গুপ্তের সঙ্গে পরিচয় সচলে থাকার সময়। তার ছাত্রজীবনের ক্যাডার লাইফ সংক্রান্ত একটি পোস্টে আমার তীর্যক মন্তব্যের সূত্র ধরে পরিচয়। পরবর্তীতে সামুতে ছাগু তাড়ানোর আন্দোলনে সহযাত্রি হিসেবেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। লণ্ডনে থাকার সুবাদে সে পরিচয় দেখাসাক্ষাতে নতুন রূপ নেয়। তবে অনেকবার তার বাসায় খাওয়ার নিমন্ত্রণ পেলেও ব্যস্ততার কারণে যেতে পারিনি। বৌদির সঙ্গে পরিচয় হয়নি, তার কন্যাদের আদরও করা হয়নি। থাকেনও আমার আবাসস্থল থেকে বেশ দূরে।
সহজসরল মানুষটি পেটে কথা রাখতে পারেন না। এজন্য তাকে ব্লগসহ বাস্তবজীবনে বিব্রত মুহূর্তগুলো সামলাতে হচ্ছে। তবে এগুলো নিয়ে তার খুব একটা সমস্যা নাই মনে হয়। আশেপাশের আমরাই শুধু বিরক্ত হই। গত সেমিস্টারে লণ্ডনে যখন বাংলাদেশী ছাত্রদের ঢল নামল তখন তার বাসাসহ পুরো অফিসটাই হয়ে গেল মেসবাড়ি। কাকে কখন কোথায় চাকরি পাইয়ে দিতে হবে, কাকে কখন অর্থনৈতিকভাবে সাহায্য করতে হবে এসব কাজেই এই পরোপকারী সুশান্ত ব্যস্ত থাকতেই পছন্দ করেন।
নিজেকে তিনি 'পলিটিক্স করা ছেলে' ভাবলেও আমার বিশ্বাস তাকে এ বিষয়ে আরও অনেক শিখতে হবে বলে আমার মনে হয়। সরলতা দিয়ে পলিটিক্স হয় না।
০০০ ০০০ ০০০
শাফায়েত অঞ্জন পড়ালেখায় আমার এক বছরের ছোট হলেও পাড়াতো সুবাদে ইয়ার দোস্ত ছিল। এসএসসির পর থেকেই ওর সঙ্গে পরিচয়। আমাদের নাস্তিকতার শুরুটা একসঙ্গে। শাহজাহানপুরের রেললাইনের পাতে বসে আমরা আল্লাহ-খোদা, সৃষ্টিকর্তা, মানবজীবন এসব নিয়ে অনেক কপচাতাম। আমার ব্র্যাণ্ড বাংলা ফাইভ আর অঞ্জনের ব্র্যাণ্ড গোল্ডলীফ দুটোই বেশ টানা হতো। অঞ্জন ভালো লিখতে পারলেও আড়ষ্টতা ছিল সেগুলো প্রকাশের। ওদিকে আমি যাযাদিতে আমার প্রথম লেখা ছাপা হওয়ার পর মতিঝিল থেকে হেঁটে শাহজাহানপুর গিয়েছিলাম ওকেই লেখাটি প্রথম পড়ানোর জন্য।
আমি একটি লিটল ম্যাগাজিন বের করতাম 'অরণ্য' নামে। মাত্র ৩টি সংখ্যা বের হয়েছিল। শাফায়েত অঞ্জন ছিল আমার সাথে। লিটল ম্যাগাজিনের জন্য বিজ্ঞাপন লাগে। আর সেটার পুরো দায়িত্ব ছিল আমার ওপর। বেশ কয়েকটি যোগাড় করার পরও সবচেয়ে দামি স্পেস (ম্যাগাজিনের শেষ কাভার) খালি রয়ে গেল। গেলাম স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা শওকত ভাইয়ের কাছে। এদিকে কলোনির কিছু রংবাজ দোস্ত (জিগরি দোস্তও বটে) দাবি করে বসল শেষ পৃষ্ঠাটি তাদের দিয়ে দিতে হবে। বিজ্ঞাপন তারা যোগাড় করবে কিন্তু পুরো পয়সা তাদের দিয়ে দিতে হবে। মজার কথা হলো এই বিজ্ঞাপন যোগাড় করার জন্য তারাও গেল শওকত ভাইয়ের কাছে। এদিকে আম্মার আওয়ামী রাজনীতির সুবিধার কারণে শওকত ভাইয়ের কাছে আমার গ্রহণযোগ্যতা ছিল। আমার জেদ চেপে গেল। জিগরী রংবাজ দোস্তদের সঙ্গে কোনো সংঘর্ষে যেতে ইচ্ছে করল না। কিন্তু চুপি চুপি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম ম্যাগাজিনের শেষ পৃষ্ঠা আমি খালিই রাখব। শওকত ভাইকে বললাম আপনার কাছে ওইসব বন্ধুরা বিজ্ঞাপন চাইতে এলে আপনি না করবেন না, বিজ্ঞাপনও আমাকে দিতে হবে না। আমার ইচ্ছে ছিল এরই ফাঁকে আমি ম্যাগাজিন ছাপিয়ে ফেলব। এই পুরো কাজের সঙ্গে শাফায়েত অঞ্জন আমার সঙ্গে ছিল। কী একটি কারণে (মনে নেই এখন) অঞ্জনের সঙ্গে আমার ঝগড়া লেগে গেল। ম্যাগাজিন প্রকাশ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিল অঞ্জন। আর প্রতিশোধ নিতে ওইসব রংবাজ বন্ধুদের বলে দিল যে আমি শওকত ভাইকে মানা করেছি তাদের বিজ্ঞাপন না দিতে। ওইসব বন্ধুরা খেপে গেল, সিদ্ধান্ত নিল আমাকে মারবে। কিন্তু ছোটবেলা থেকে একসঙ্গে পড়ে বড় হওয়ায় শেষ পর্যন্ত তারা আমাকে মারতে পারল না। ওইসব রংবাজ বন্ধুদের মূল হোতা আবুল কাশেম (আমরা কাশু বলে ডাকতাম) সৌদি আরব চলে যায়। আমার বিয়ের সময় বাংলাদেশে ছিল তখন। বিয়েতে এটেণ্ড করতে সিলেট থেকে রাতের ট্রেনে ঢাকায় চলে এসেছিল।
০০০ ০০০ ০০০
আমার ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ার খুব শখ ছিল। সেটি হয়নি প্রস্তুতির কারণে। আমি বিভিন্ন সংগঠন, গ্রুপ থিয়েটার, ছোটখাট চাকরি এসবে জড়িয়ে গেলাম ভালোমতো। এরমধ্যে একটি ছিল জরিপের কাজ। এর কারণে আমি বাংলাদেশের প্রচুর জেলায় ঘুরেছি। আর এই জরিপের কারণে আমার সঙ্গে পরিচয় হলো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে। সাল ১৯৯৬। এর আগে আমি কখনই জাহাঙ্গীরনগর যাইনি। আমার সঙ্গে পরিচয় ছিল ইউসুফ হাসান অর্ক (এখন নাটক ও নাট্যতত্ত্বের শিক্ষক), ইউরেকা (তৎকালীন জাহাঙ্গীরনগর ছাত্র ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট)। আর এদের মাধ্যমে পরিচয় হলো মনন (পরবর্তীতে ছাত্র ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট)সহ আরো অনেকের সঙ্গে। এদের সঙ্গে মাঝে মাঝে প্রায়ই আল বেরুনি এক্সটেনশন হলে রাত কাটাতাম। ডেমক্রেসিওয়াচের মাধ্যমে পরিচয় হয় বাংলার আরিফ, গভর্ণমেন্ট এন্ড পলিটিক্সের শাকিল, সৌরভ, কুতুবের (দারুণ পড়ুয়া, এখন বোধহয় বাংলা একাডেমীর রিসার্চার) সঙ্গে। এদের কারণে কামালউদ্দিন হলেও রাতে থেকেছি। সকালে উঠে ব্রেড এন্ড কলা দিয়ে দারুণ নাস্তাও করতাম। পরিচয় হয় মাহবুব আজীজের (যাযাদিতে একসঙ্গে ট্রেনিং করেছিলাম, সাল ১৯৯৮, শেষ পর্যন্ত জানতাম সমকালে আছেন) সঙ্গে। একবার সাইকেল চালিয়ে শান্তিনগর থেকে জাহাঙ্গীরনগর গিয়েছিলাম। পা ব্যথা করছিল দেখে রাতে থেকে গেলাম ওইখানে। সারারাত মাহবুব আজীজ, তার বউ আল্পনার সঙ্গে ক্যাম্পাসে হেঁটে বেড়িয়েছিলাম।
জরিপের কারণে পরিচয় হয় ফজিলাতুন্নেসা হলের নিপু, রুমী সহ আরো অনেকের সঙ্গে। তাদের নিয়ে ঢাকার বাইরে জরিপে গিয়েছিলাম। আমার বন্ধু অভিনেতা মিলনের বউ লুসি পড়ত নাটক বিভাগে। সে কারণে লুসির অনেক বান্ধবির সঙ্গেও পরিচয় হয়। আমার দ্বিতীয় নাটক নির্মাণের সময়ও নাটক বিভাগের অনেক জুনিয়র ছেলে প্রচণ্ড হেল্প করে আমাকে।
তাই আমিও যেন জাহাঙ্গীরনগরের ছাত্র। ১ টাকা দিয়ে অফিস ছুটির পর কলাবাগান থেকে বাসে চড়ে চলে যেতাম জাহাঙ্গীরনগরে। বাসের মামারাও জানতেন আমিও ছাত্র। কখনই ৩ টাকা চাইতেন না। ডেইরিতে আড্ডা, প্রান্তিকে চা খাওয়া, লাভলেনে ঘোরাফেরা, ট্রান্সপোর্টে বাসের জন্য অপেক্ষা, নীপুকে নিয়ে রিকশায় বিশমাইল ঘুরতে যাওয়া, রাতের গভীরে সুইমিংপুলের ধারে বসে থাকা, প্রীতিলতার সামনের খালাদের কাছে দুপুরের ভাত খাওয়া, কবীর চত্ত্বরে, ক্যাফেটেরিয়ায়, অডিটোরিয়ামের চিপায়, টিএসসিতে নাটকের মহড়া সহ দারুণ সব স্মৃতি আমাকে ভুলিয়ে দেয় ঢাকা ইউনির ছাত্র না হওয়ার দুঃখ। ওসমানী উদ্যান থেকে বাসে চড়ে ভার্সিটি যেতে হবে বলে তড়িঘড়ি করে অফিস শেষ হওয়ার আগেই ছুটতাম। অনেকেই জানত আমি জাহাঙ্গীরনগরের ছাত্র। আমিও হ্যা না কিছু বলতাম না।
০০০ ০০০ ০০০
সম্ভবত একবছর ড্রপ দিয়ে আমার বন্ধু শাফায়েত অঞ্জনও জাহাঙ্গীরনগর ভর্তি হলো। এবং সে আমূল পাল্টে গেল। মিষ্টির দোকানের বন্ধুরা তিন তাস খেলতে পছন্দ করে। দুরিফিস, টুয়েন্টিনাইন খেলে দুপুর পার করে দেয়। ক্ষিধে পেলে মনসুরের হোটেল থেকে পুরি খায়। পকেটে টাকা থাকলে ফকিরাপুলের পূর্ণিমা হোটেলে ভাত খায়। চা সিগারেট চলে টংয়ের দোকানের বাকিতে। পড়াশোনাসহ চাকরি বাকরি কোনো কিছুতেই হিল্লে করে উঠতে পারেনি তারা তখনও। দুপুরে যখন ঢাকা ইউনির বাসটা পীরজঙ্গি মাজারে এসে থামে, কোন কোন সুন্দর মেয়ে নেমে আসে উদাস দুপুরে মিষ্টির দোকানে বসে আমরা তা দেখতাম। তখন অঞ্জনও থাকত আমাদের সঙ্গে।
জাহাঙ্গীরনগরে ভর্তি হওয়ার পর অঞ্জন একেবারেই মিষ্টির দোকানের আড্ডায় আসা ছেড়ে দিল। বোধহয় বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন বন্ধু জুটেছে। অতি স্বাভাবিক ব্যাপার, তার মধ্যে ফেডারেশনে পলিটিক্স করাও শুরু করেছে, কোত্থেকে যেন চাউর হয়ে যায় সিনিয়র কোনো আপুর সঙ্গে একটু খুটখুটও শুরু হয়েছে। এরই মাঝে ফাঁকেফুঁকে মিষ্টির দোকানে আসত অঞ্জন। মিষ্টির দোকানের বন্ধুরা তখন অঞ্জনের কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের গল্প শুনতে চাইত। আর আমি জানতে চাইতাম আমার পরিচিত জায়গাগুলোতে অঞ্জন কী কী করে। অঞ্জন আমাকে বলত কিছু কিছু কিন্তু বাকি বন্ধুদের কিছুই বলত না। কারণ তারা শুধু জাহাঙ্গীরনগরের মেয়েদের কথা জানতে চাইত। তারা নাকি খালি ঝোপঝাড়ে প্রেম করে বেড়ায়, অনেকেই নাকি রতিক্রীয়ার কাজটি সারে সেখানে।
বিরক্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত নচ্ছাড় এইসব বন্ধুদের গালি দিয়ে বসল অঞ্জন - আনকালচারড। আরও বলল, তোরা তো অশিক্ষিত। তোরা কেউ ভার্সিটিতে পড়িস? ছোট থেকে বড় হওয়া এইসব বন্ধুদের সঙ্গে ল্যাওড়া ঘাটাঘাটি করে বিশ্ববিদ্যালয় পড়তে যাওয়া অঞ্জন মিষ্টির দোকানে আড্ডা মারা ছেড়েই দিল। 'আঁতেল' বলে আগে থেকেই বন্ধুমহলে পরিচিত অঞ্জনের এই আড্ডা ছেড়ে দেওয়ায় বন্ধুরা খেপে গিয়ে বলল - হ হ। আমরা তো অশিক্ষিত। ভাসসিটি যাইতাম ফারি না। তাই কিছুও বুঝি না।
আমি অঞ্জনকে সাপোর্ট দিলাম। ঠিকই তো। কারও নিজের প্রতিষ্ঠানের সম্পর্কে খারাপ কথা বললে সে সইবে কেন? বন্ধুদের অভিযুক্ত করলাম। ভার্সিটির মেয়েদের সম্পর্কে এমন ভাবিস কেন? পাশাপাশি অঞ্জনকেও একটু দুষলাম। বন্ধুরা বলেছে বলেই কি তাদের ছেড়ে যেতে হবে? তুই কেন ফাইট দিলি না। অশিক্ষিত আনকালচারড বলে সরে গেলেই হবে?
০০০ ০০০ ০০০
কিন্তু আজকাল অনেক শিক্ষিত সাহিত্যিক জাহাঙ্গীরনগরকে 'জাহাঙ্গীরজঙ্গল' বলছে। আমি নিজে জাহাঙ্গীরনগরের ছাত্র নই। কিন্তু যখন 'জাহাঙ্গীরজঙ্গল' শুনি আমার মন খারাপ হয়। প্রচণ্ডরকম মন খারাপ হয়। এর প্রত্যুত্তরে কোনো গালি আসে না এমনই মন খারাপ থাকে। সুন্দর কিছু সময় কাটাতে পেরে আমি জাহাঙ্গীরনগরের কাছে কৃতজ্ঞ। সেই কৃতজ্ঞতায় আমার মন খারাপ হয় জাহাঙ্গীরনগর নামের বিকৃতি শুনে।
শাফায়েত অঞ্জন - শুনেছি তুই এখন কোনো এডফার্মে আছিস। সচলে কয়েকটি কবিতাও লিখেছিলি। সেখানে তোর জাহাঙ্গীরনগরকে 'জাহাঙ্গীরজঙ্গল' বলা হচ্ছে। তোর জাহাঙ্গীরনগরের অনেক বন্ধুও সেখানে আছেন। তাদের কারো কোনো প্রতিবাদ দেখিনি।
তুই কি প্রতিবাদ করবি? যেমনটা করেছিলি তোর বাল্যবন্ধুদের সঙ্গে। আমি জানি ক্ষোভ জিনিসটা তোর শরীরে মারাত্মক। তাই আশা রাখি তুই এর প্রতিবাদ করবি।
Sunday, 20 December 2009
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
3 মন্তব্য:
কোথায় আর কিভাবে জাহাঙ্গীরজঙ্গল বলা হচ্ছে জানতে পারি কি?
himur personal blog royesoye.blogspot.com e dukhi gondernama series ebong sachal e sushanto (as guest) ekti post e
অলৌকিক হাসানের নাম শুনেছি ঠিকানার অভাবে আসতে পারিনি। আজ ঠিকানা পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এলাম। জাহাঙ্গীর নগরের গন্ধ পেয়ে অনেক স্মৃতি ভেসে এলো, না আমি ওখানকার ছাত্র নই তবে আমার দুই ভাই পড়েছে ওখানে আর আমার ব্যবসা ছিল পাশেই সেই সুবাদে যাওয়া আসা।
ভালোই লাগলো।
Post a Comment