প্রতিটি মানুষের জীবনেই কোনো না কোনো আফসোস থাকে৷বেঁচে থাকতে থাকতে কোনো এক পর্যায়ে এসে সেইসব আফসোসের কিছু কিছু কেউ কাটিয়ে উঠতে পারেন, কেউ নির্ভতে পুষে যান৷ কারো ছোটবেলায় স্ট্যাম্পের খাতা পুষ্ট ছিল না বলে আফসোস করেন, কেউ আফসোস করেন যদি সাহস করে মেয়েটিকে ভালোবাসার কথা বলে ফেলা যেত - আমি আফসোস করি স্কুললাইফে আমার যদি একটা বাইসাইকেল থাকত৷
আমার আফসোস করার আরো কারণ আছে৷ ভালো নাটক-সিনেমা না বানাতে পারার আফসোসটি প্রধান৷এছাড়াও অন্যান্য আফসোসগুলোর কিছু মিটিয়ে ফেলতে পারি কিন্তু সেটা জোর করেই করা হবে; এখন বাইসাইকেল হাজারটা কিনলেও মনে সুখ আসবে না৷ আবার কিছু কিছু আফসোস সারাজীবন থেকে যাবে৷চাইলেও মুছে ফেলা যাবে না৷ সেই লগ্ন, সেই ক্ষণ, সেই সময়, যাই বলি না কেন ফিরে আসবে না৷ আমার সর্বশেষ আফসোসটির নাম 'ওয়াকিং ফর জাস্টিস৷'
ফজলুল কবির তুহিন মূলত অভিনেতা৷হুমায়ুন আহমেদের জনপ্রিয় 'হিমু' চরিত্রে প্রথম রূপদানকারী হচ্ছেন তিনি৷ যারা জানেন না, তাদেরও বলে রাখি, বাস্তবজীবনে তুহিন ভাই আসলেই একজন হিমু৷ চরমভাবে অবৈষয়িক, অসাংসারিক একটি মানুষ যে কী পরিমাণ স্বপ্ন দেখতে ও দেখাতে পারেন সেটা তার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে না মিশলে বোঝানো যাবে না৷ প্রচণ্ড আড্ডাবাজ এ মানুষটির ভেতরে 'হিমু'-র সকলগুণই প্রকটভাবে রয়েছে৷ হয়তো সে কারণেই হমায়ুন আহমেদ তাকে বেছে নিয়েছিলেন৷ হিমু খ্যাত তুহিনের অনেক স্বপ্ন, অনেক প্ল্যান কখনো আলোর মুখ দেখেনি, অনেকে শুনে আড়ালে হেসেছে, কিন্তু তাতে 'তুহিমুন' (এ নামটি আমি তাকে দিলাম) এর স্বপ্নবাজি কমেনি৷হুমায়ুনের হিমু সারা শহর হেঁটে চষে বেড়ায়, আমাদের তুহিমুন স্বপ্নবাজি করতে করতে দাঁড়িয়ে গেলে পায়চারি শুরু করেন, বসে থাকলে এদিক সেদিক দোলেন৷তারপর গান ধরে বসেন, পুরাই অস্থির ...
১৯ তারিখ বিকেলে ফোন করে তুহিন ভাই জানালেন, তারা ম্যানচেস্টার থেকে লণ্ডন পর্যন্ত হেঁটে আসবে যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে৷ সেসাথে বৃটেনে অবস্থানকারী যেসব যুদ্ধাপরাধী রয়েছে, তাদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর জন্য বৃটিশ সরকারের কাছে একটি আর্জিও তারা পেশ করবেন৷তুহিন ভাই জিজ্ঞেস করলেন, কামরুল যাবা নাকি?
গ্রামের মানুষজনদের কাছে পানি চাইলে সাথে মুড়ি-বাতাসা মেলে৷ গেরস্থ কখনো শুধু পানি খেতে দেয় না পথচারিদের৷ বিষয়টি পরীক্ষা করার জন্য ৪ বন্ধু মিলে মাওয়া ঘাটের আশেপাশের গ্রামগুলোতে ঢু মেরেছিলাম৷ আসার সময় কারো পকেটে পয়সা ছিল না, মাওয়া ঘাট থেকে হেঁটে এসেছি ধলেশ্বরী ঘাট পর্যন্ত৷ জনমত জরিপের কাজে গ্রামাঞ্চলে সকাল-সন্ধ্যা হেঁটে বেড়িয়েছি৷ কলেজে পয়সা বাঁচানোর জন্য পুরান ঢাকার ভিক্টোরিয়া পার্ক থেকে মতিঝিল কলোনি কিংবা পয়সা না থাকার জন্য গ্রুপ থিয়েটারে যেতে মতিঝিল কলোনি থেকে কার্জন হল ক্যাফে পর্যন্ত হেঁটেছি নিয়মিত৷দাঁড়িয়ে থেকে রিক্সা ঠিক করতাম না, গন্তব্যের দিকে হাঁটতে হাঁটতে রিক্সা পেলে উঠে যেতাম৷পীরজঙ্গী মাজার থেকে মালিবাগ এভাবে হাঁটা হয়ে যেত মাসের অনেকদিন৷লণ্ডন শহরে অনেকগুলো 'পুরো রাত' শুধুই হেঁটেছি৷কেওকারাডাং চড়েছি, পুরো সেন্টমার্টিনের চারিপাশ হেঁটেছি, আমার হাঁটার অভ্যাস আছ৷ কিন্তু আমি তুহিন ভাইকে বললাম, নারে ভাই, যেতে পারব না৷
আমি যেতে পারিনি আমার কর্মস্থলের ব্যস্ততার কারণে, আমি যেতে পারিনি আমার সাংসারিক দায়বদ্ধতা থেকে, আমি যেতে পারিনি আমার আগের এলেবেলে জীবনের মতো আর সাহসী নই বলে, আমি যেতে পারিনি আমার বর্তমান এলেবেলে জীবনে 'ধুর বাল' বলে রিস্ক নিতে ভয় পাই বলে৷ আমি যেতে পারিনি কারণ আমি হিমু নই বলে৷
সেখান থেকেই আফসোসের শুরু৷
অথচ 'ওয়াকিং ফর জাস্টিস' অভিযাত্রী দলে রয়েছেন একজন ষাটোর্ধ্ব তরুণ আমিনুল হক বাদশা৷ সারারাত আড্ডা মেরেও যার ক্লান্তি আসে না৷ মাঝরাতের আড্ডায় যদি প্রস্তাব আসে- চলেন যাই ব্রাইটন বীচে; সর্বপ্রথম উঠে দাঁড়ান বাদশা ভাই৷জিজ্ঞেস করেন, এ জ্যাকেটে ঠান্ডা মানবে তো৷ চলো বাইরাই৷অভিযাত্রী দলে আরো আছেন মঞ্জুলিকা জামালী৷সদা হাস্যোজ্জ্বল, গান কবিতায় ভরপুর আরেক প্রিয় মানুষ৷তাই এ পদযাত্রায় তার নাম দেখে অবাক হইনি৷অভিযাত্রী দলের এ কয়েকজনকেই আমি ভালোভাবে চিনি৷আর যাকে খুব অল্প করে চিনি, লণ্ডনে আসার পরপরই যার সঙ্গে তুহিন ভাই পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি হলেন সাজ্জাদুল বা সাজ্জাদ৷'ওয়াকিং ফর জাস্টিস' এর মূল উদ্যোক্তা৷
বৃটেনে বসবাসকারী আমাদের বর্তমান প্রজন্ম আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে ভুগছে৷ তারা না হতে পারছে পুরোপুরি বৃটিশ, না হতে পারছে পুরোপুরি বাংলাদেশী৷মানুষ যদি নিজস্ব জাতিগত কালচার হারিয়ে ফেলে তখন সে তার ধর্মীয় কালচারকে আকড়ে ধরে৷ এরই শিকার হয়েছে বৃটেনে বড় হওয়া আমাদের প্রজন্ম৷আর ধর্মকে হাতিয়ার করে এদের বেপথে নিচ্ছে কিছু সাংগঠনিক ধর্ম ব্যবসায়ীরা৷অথচ এর মাঝে সাজ্জাদ যেন পদ্মফুল৷ মাত্র ৮ বছর বয়সে বাংলাদেশ ছেড়ে এসে বৃটেনে বড় হওয়া এ ছেলেটির ক্রাইসিস এখন একটাই - যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ বিচারের দাবি৷
লন্ডনে আপনার আশেপাশে কিছু বাংলাদেশী মানুষজন পাবেন যারা ছুপা ছাগু, জামাত-শিবির করে থাকে৷অথচ জিজ্ঞেস করলে উত্তরে না বলবে৷ এতোই প্রবল এদের হীনমন্যতা৷ তাদের পার্টির উত্তরসূরীর অসততা, বিশ্বাসঘাতকতা সম্পর্কে এরা পুরাই ওয়াকিবহাল৷ ৫ জন রাজাকারের নাম জিজ্ঞেস করলে উত্তর না দিয়ে আপনার সামনে বাংলাদেশের ফৌজদারি সমস্যাগুলো এনে ম্যাতকার করবে, ত্যানা প্যাঁচাবে৷এদের খপ্পরে পড়ে ধর্মের অপব্যাখ্যার বটিকা খাওয়া বৃটেনে বড় হওয়া বর্তমান প্রজন্ম তাই বাংলাদেশে স্বাধীনতার চেতনাটুকু ধারণ করতে পারছে না৷পাশ্চাত্যের মতো একটি বিজ্ঞানসম্মত দেশে বাস করে এরা বিশ্বাস করতে পছন্দ করে চাঁদে সাঈদীকে দেখা যেতেও পারে৷
অথচ সাজ্জাদও এদেশে বড় হওয়া ছেলে৷ একজন নাট্যকর্মী৷ বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ বিচারের দাবিতে সোচ্চার একজন তরুণ৷ কিছু পাওয়ার আশা না করে নিজ অব্স্থান থেকেই জানাচ্ছে তার দাবি৷ সহযাত্রীদের নিয়ে শুরু করেছে দীর্ঘ ৩০০ মাইল পদযাত্রা৷এদেশের প্রতিটি বৃটিশ-বাংলাদেশী তরুণ প্রজন্ম যদি সাজ্জাদের মতো ভাবত তাহলে ৭১ পূর্বসূরিদের চেয়েও বড় গণজাগরণ তৈরি হতো৷
সাজ্জাদ ও তার বন্ধুরা চাচ্ছে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির পাশাপাশি যেসব যুদ্ধাপরাধী লণ্ডনে আশ্রয় নিয়েছে তাদের দেশে ফেরত পাঠানোর জন্য বৃটিশ সরকারের হস্তক্ষেপ৷ এ লক্ষ্যেই তাদের অভিনব পদযাত্রা 'ওয়াকিং ফর জাস্টিস'৷ইউকের ওল্ডহ্যামে তৈরি হওয়া প্রথম শহীদ মিনার থেকে এ পদযাত্রা শুরু হয়ে শেষ হবে লণ্ডনের রিজেন্টস পার্কে গণজাগরণ ইউকে আয়োজিত সমাবেশে৷গত ২০ মার্চ শুরু হয়েছে এ পদযাত্রা, শেষ হবে ২৬ মার্চ৷ ওইদিন দুপুর ২.৩০ মিনিটে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীর ১০ ডাউনিং স্ট্রীটে এ সংক্রান্ত স্মারকলিপি পেশ করা হবে৷ইতিমধ্যে এ পদযাত্রার ৪ দিন অতিবাহিত হয়েছে৷ দলটি বর্তমানে বার্মিংহাম রয়েছে৷
এ কয়দিনে তারা ক্রমাগত হেঁটেছেন প্রবল ঠাণ্ডা, তুষারপাত অগ্রাহ্য করে৷বিভিন্ন শহরের অলিগলি, সুরু-বড় রাস্তা-মটরওয়ে পাড়ি দিয়ে পৌঁছে যাচ্ছেন পরের শহরে, রাতে ঘুমিয়েই পরের দিন হাঁটতে শুরু করেছেন পরবর্তী গন্তব্যে৷পত্রিকা-ফোন মারফত এদের খোঁজখবর রাখি৷ বিভিন্ন শহরে বেশ সাড়া পড়েছে, অনেকেই মাঝপথে তাদের সাথী হচ্ছেন, আর এদেশীয়রা আগ্রহভরে জানতে চাইলে তারা জানাচ্ছেন তাদের দাবির কথা৷ শোনাচ্ছেন মুক্তিযুদ্ধের কথা৷
আমার আফসোস বেড়েই যায়৷এদের সাহসে অভিভূত হয়ে যাই৷
আগামী ২৬ মার্চ রিজেন্টস পার্কে গণজাগরণ ইউকের সমাবেশ হবে৷ সেখানে আসবে 'ওয়াকিং ফর জাস্টিস' এর অভিযাত্রীরা৷সাজ্জাদ আমাদের কাছে একটি আর্জি জানিয়েছেন, তারা চায় তাদের প্রতি ১ কিলোমিটার হাঁটার পরিবর্তে আমরা যেন ১০ জন সেদিন সমাবেশে উপস্থিত থাকি৷
জীবনের বিভিন্ন বেলার আফসোসগুলো প্রায়ই ভাবায়৷ ইস, উস, আহ, উহ করি, কিন্তু আফসোসগুলো মিটিয়ে ফেলার আর কোনো উপায় খুঁজে পাই না৷ এবার একটি ছোট সুযোগ এসেছে৷ ওয়াকিং ফর জাস্টিসে অংশ নিতে না পারার আফসোসকে বড় করতে দিব না৷ আমি যাব সমাবেশে৷ অভিযাত্রীদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে বলব, যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি চাই৷
**** ****
ছবি কৃতজ্ঞতা britbangla24.com
আমার আফসোস করার আরো কারণ আছে৷ ভালো নাটক-সিনেমা না বানাতে পারার আফসোসটি প্রধান৷এছাড়াও অন্যান্য আফসোসগুলোর কিছু মিটিয়ে ফেলতে পারি কিন্তু সেটা জোর করেই করা হবে; এখন বাইসাইকেল হাজারটা কিনলেও মনে সুখ আসবে না৷ আবার কিছু কিছু আফসোস সারাজীবন থেকে যাবে৷চাইলেও মুছে ফেলা যাবে না৷ সেই লগ্ন, সেই ক্ষণ, সেই সময়, যাই বলি না কেন ফিরে আসবে না৷ আমার সর্বশেষ আফসোসটির নাম 'ওয়াকিং ফর জাস্টিস৷'
ফজলুল কবির তুহিন মূলত অভিনেতা৷হুমায়ুন আহমেদের জনপ্রিয় 'হিমু' চরিত্রে প্রথম রূপদানকারী হচ্ছেন তিনি৷ যারা জানেন না, তাদেরও বলে রাখি, বাস্তবজীবনে তুহিন ভাই আসলেই একজন হিমু৷ চরমভাবে অবৈষয়িক, অসাংসারিক একটি মানুষ যে কী পরিমাণ স্বপ্ন দেখতে ও দেখাতে পারেন সেটা তার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে না মিশলে বোঝানো যাবে না৷ প্রচণ্ড আড্ডাবাজ এ মানুষটির ভেতরে 'হিমু'-র সকলগুণই প্রকটভাবে রয়েছে৷ হয়তো সে কারণেই হমায়ুন আহমেদ তাকে বেছে নিয়েছিলেন৷ হিমু খ্যাত তুহিনের অনেক স্বপ্ন, অনেক প্ল্যান কখনো আলোর মুখ দেখেনি, অনেকে শুনে আড়ালে হেসেছে, কিন্তু তাতে 'তুহিমুন' (এ নামটি আমি তাকে দিলাম) এর স্বপ্নবাজি কমেনি৷হুমায়ুনের হিমু সারা শহর হেঁটে চষে বেড়ায়, আমাদের তুহিমুন স্বপ্নবাজি করতে করতে দাঁড়িয়ে গেলে পায়চারি শুরু করেন, বসে থাকলে এদিক সেদিক দোলেন৷তারপর গান ধরে বসেন, পুরাই অস্থির ...
হুমায়ুন আহমেদের আলোচিত চরিত্র 'হিমু'-র প্রথম রূপদানকারী অভিনেতা ফজলুল তুহিন |
১৯ তারিখ বিকেলে ফোন করে তুহিন ভাই জানালেন, তারা ম্যানচেস্টার থেকে লণ্ডন পর্যন্ত হেঁটে আসবে যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে৷ সেসাথে বৃটেনে অবস্থানকারী যেসব যুদ্ধাপরাধী রয়েছে, তাদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর জন্য বৃটিশ সরকারের কাছে একটি আর্জিও তারা পেশ করবেন৷তুহিন ভাই জিজ্ঞেস করলেন, কামরুল যাবা নাকি?
গ্রামের মানুষজনদের কাছে পানি চাইলে সাথে মুড়ি-বাতাসা মেলে৷ গেরস্থ কখনো শুধু পানি খেতে দেয় না পথচারিদের৷ বিষয়টি পরীক্ষা করার জন্য ৪ বন্ধু মিলে মাওয়া ঘাটের আশেপাশের গ্রামগুলোতে ঢু মেরেছিলাম৷ আসার সময় কারো পকেটে পয়সা ছিল না, মাওয়া ঘাট থেকে হেঁটে এসেছি ধলেশ্বরী ঘাট পর্যন্ত৷ জনমত জরিপের কাজে গ্রামাঞ্চলে সকাল-সন্ধ্যা হেঁটে বেড়িয়েছি৷ কলেজে পয়সা বাঁচানোর জন্য পুরান ঢাকার ভিক্টোরিয়া পার্ক থেকে মতিঝিল কলোনি কিংবা পয়সা না থাকার জন্য গ্রুপ থিয়েটারে যেতে মতিঝিল কলোনি থেকে কার্জন হল ক্যাফে পর্যন্ত হেঁটেছি নিয়মিত৷দাঁড়িয়ে থেকে রিক্সা ঠিক করতাম না, গন্তব্যের দিকে হাঁটতে হাঁটতে রিক্সা পেলে উঠে যেতাম৷পীরজঙ্গী মাজার থেকে মালিবাগ এভাবে হাঁটা হয়ে যেত মাসের অনেকদিন৷লণ্ডন শহরে অনেকগুলো 'পুরো রাত' শুধুই হেঁটেছি৷কেওকারাডাং চড়েছি, পুরো সেন্টমার্টিনের চারিপাশ হেঁটেছি, আমার হাঁটার অভ্যাস আছ৷ কিন্তু আমি তুহিন ভাইকে বললাম, নারে ভাই, যেতে পারব না৷
আমি যেতে পারিনি আমার কর্মস্থলের ব্যস্ততার কারণে, আমি যেতে পারিনি আমার সাংসারিক দায়বদ্ধতা থেকে, আমি যেতে পারিনি আমার আগের এলেবেলে জীবনের মতো আর সাহসী নই বলে, আমি যেতে পারিনি আমার বর্তমান এলেবেলে জীবনে 'ধুর বাল' বলে রিস্ক নিতে ভয় পাই বলে৷ আমি যেতে পারিনি কারণ আমি হিমু নই বলে৷
সেখান থেকেই আফসোসের শুরু৷
অথচ 'ওয়াকিং ফর জাস্টিস' অভিযাত্রী দলে রয়েছেন একজন ষাটোর্ধ্ব তরুণ আমিনুল হক বাদশা৷ সারারাত আড্ডা মেরেও যার ক্লান্তি আসে না৷ মাঝরাতের আড্ডায় যদি প্রস্তাব আসে- চলেন যাই ব্রাইটন বীচে; সর্বপ্রথম উঠে দাঁড়ান বাদশা ভাই৷জিজ্ঞেস করেন, এ জ্যাকেটে ঠান্ডা মানবে তো৷ চলো বাইরাই৷অভিযাত্রী দলে আরো আছেন মঞ্জুলিকা জামালী৷সদা হাস্যোজ্জ্বল, গান কবিতায় ভরপুর আরেক প্রিয় মানুষ৷তাই এ পদযাত্রায় তার নাম দেখে অবাক হইনি৷অভিযাত্রী দলের এ কয়েকজনকেই আমি ভালোভাবে চিনি৷আর যাকে খুব অল্প করে চিনি, লণ্ডনে আসার পরপরই যার সঙ্গে তুহিন ভাই পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি হলেন সাজ্জাদুল বা সাজ্জাদ৷'ওয়াকিং ফর জাস্টিস' এর মূল উদ্যোক্তা৷
বৃটেনে বসবাসকারী আমাদের বর্তমান প্রজন্ম আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে ভুগছে৷ তারা না হতে পারছে পুরোপুরি বৃটিশ, না হতে পারছে পুরোপুরি বাংলাদেশী৷মানুষ যদি নিজস্ব জাতিগত কালচার হারিয়ে ফেলে তখন সে তার ধর্মীয় কালচারকে আকড়ে ধরে৷ এরই শিকার হয়েছে বৃটেনে বড় হওয়া আমাদের প্রজন্ম৷আর ধর্মকে হাতিয়ার করে এদের বেপথে নিচ্ছে কিছু সাংগঠনিক ধর্ম ব্যবসায়ীরা৷অথচ এর মাঝে সাজ্জাদ যেন পদ্মফুল৷ মাত্র ৮ বছর বয়সে বাংলাদেশ ছেড়ে এসে বৃটেনে বড় হওয়া এ ছেলেটির ক্রাইসিস এখন একটাই - যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ বিচারের দাবি৷
অভিযাত্রীদের কয়েকজন |
লন্ডনে আপনার আশেপাশে কিছু বাংলাদেশী মানুষজন পাবেন যারা ছুপা ছাগু, জামাত-শিবির করে থাকে৷অথচ জিজ্ঞেস করলে উত্তরে না বলবে৷ এতোই প্রবল এদের হীনমন্যতা৷ তাদের পার্টির উত্তরসূরীর অসততা, বিশ্বাসঘাতকতা সম্পর্কে এরা পুরাই ওয়াকিবহাল৷ ৫ জন রাজাকারের নাম জিজ্ঞেস করলে উত্তর না দিয়ে আপনার সামনে বাংলাদেশের ফৌজদারি সমস্যাগুলো এনে ম্যাতকার করবে, ত্যানা প্যাঁচাবে৷এদের খপ্পরে পড়ে ধর্মের অপব্যাখ্যার বটিকা খাওয়া বৃটেনে বড় হওয়া বর্তমান প্রজন্ম তাই বাংলাদেশে স্বাধীনতার চেতনাটুকু ধারণ করতে পারছে না৷পাশ্চাত্যের মতো একটি বিজ্ঞানসম্মত দেশে বাস করে এরা বিশ্বাস করতে পছন্দ করে চাঁদে সাঈদীকে দেখা যেতেও পারে৷
অথচ সাজ্জাদও এদেশে বড় হওয়া ছেলে৷ একজন নাট্যকর্মী৷ বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ বিচারের দাবিতে সোচ্চার একজন তরুণ৷ কিছু পাওয়ার আশা না করে নিজ অব্স্থান থেকেই জানাচ্ছে তার দাবি৷ সহযাত্রীদের নিয়ে শুরু করেছে দীর্ঘ ৩০০ মাইল পদযাত্রা৷এদেশের প্রতিটি বৃটিশ-বাংলাদেশী তরুণ প্রজন্ম যদি সাজ্জাদের মতো ভাবত তাহলে ৭১ পূর্বসূরিদের চেয়েও বড় গণজাগরণ তৈরি হতো৷
সাজ্জাদ ও তার বন্ধুরা চাচ্ছে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির পাশাপাশি যেসব যুদ্ধাপরাধী লণ্ডনে আশ্রয় নিয়েছে তাদের দেশে ফেরত পাঠানোর জন্য বৃটিশ সরকারের হস্তক্ষেপ৷ এ লক্ষ্যেই তাদের অভিনব পদযাত্রা 'ওয়াকিং ফর জাস্টিস'৷ইউকের ওল্ডহ্যামে তৈরি হওয়া প্রথম শহীদ মিনার থেকে এ পদযাত্রা শুরু হয়ে শেষ হবে লণ্ডনের রিজেন্টস পার্কে গণজাগরণ ইউকে আয়োজিত সমাবেশে৷গত ২০ মার্চ শুরু হয়েছে এ পদযাত্রা, শেষ হবে ২৬ মার্চ৷ ওইদিন দুপুর ২.৩০ মিনিটে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীর ১০ ডাউনিং স্ট্রীটে এ সংক্রান্ত স্মারকলিপি পেশ করা হবে৷ইতিমধ্যে এ পদযাত্রার ৪ দিন অতিবাহিত হয়েছে৷ দলটি বর্তমানে বার্মিংহাম রয়েছে৷
তুষারপাত অগ্রাহ্য করে হেঁটে চলছে অভিযাত্রী দল৷ |
এ কয়দিনে তারা ক্রমাগত হেঁটেছেন প্রবল ঠাণ্ডা, তুষারপাত অগ্রাহ্য করে৷বিভিন্ন শহরের অলিগলি, সুরু-বড় রাস্তা-মটরওয়ে পাড়ি দিয়ে পৌঁছে যাচ্ছেন পরের শহরে, রাতে ঘুমিয়েই পরের দিন হাঁটতে শুরু করেছেন পরবর্তী গন্তব্যে৷পত্রিকা-ফোন মারফত এদের খোঁজখবর রাখি৷ বিভিন্ন শহরে বেশ সাড়া পড়েছে, অনেকেই মাঝপথে তাদের সাথী হচ্ছেন, আর এদেশীয়রা আগ্রহভরে জানতে চাইলে তারা জানাচ্ছেন তাদের দাবির কথা৷ শোনাচ্ছেন মুক্তিযুদ্ধের কথা৷
আমার আফসোস বেড়েই যায়৷এদের সাহসে অভিভূত হয়ে যাই৷
আগামী ২৬ মার্চ রিজেন্টস পার্কে গণজাগরণ ইউকের সমাবেশ হবে৷ সেখানে আসবে 'ওয়াকিং ফর জাস্টিস' এর অভিযাত্রীরা৷সাজ্জাদ আমাদের কাছে একটি আর্জি জানিয়েছেন, তারা চায় তাদের প্রতি ১ কিলোমিটার হাঁটার পরিবর্তে আমরা যেন ১০ জন সেদিন সমাবেশে উপস্থিত থাকি৷
জীবনের বিভিন্ন বেলার আফসোসগুলো প্রায়ই ভাবায়৷ ইস, উস, আহ, উহ করি, কিন্তু আফসোসগুলো মিটিয়ে ফেলার আর কোনো উপায় খুঁজে পাই না৷ এবার একটি ছোট সুযোগ এসেছে৷ ওয়াকিং ফর জাস্টিসে অংশ নিতে না পারার আফসোসকে বড় করতে দিব না৷ আমি যাব সমাবেশে৷ অভিযাত্রীদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে বলব, যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি চাই৷
**** ****
ছবি কৃতজ্ঞতা britbangla24.com
3 মন্তব্য:
আমি আপনার ব্লগে নতুন। আপনার ব্লগ গুলো এতো সুন্দর এবং আয়নার মত। সামনে দাড়ালেই নিজের ছবি ফুটে উঠে।
ধন্যবাদ, অনেক কিছু জানার ছিল। আমরা অনেকে অনেক কিছুই জানি না। আপনা এই পোস্টটি দ্বারা অনেকে কিছু তথ্য জানতে পারবে।আমি আপনাকে কোন প্রকার অফার করছি না। ছোট একটি তথ্য আপনার উপকারে আসতে পারেflat for rent
Nice Article sir, Keep Going on... I am really impressed by read this. Thanks for sharing with us. Bangladesh National Flag Images.
Post a Comment