Friday 12 September 2008

গাড়ি বয়ান ...

জীবনের প্রথম গাড়িটা কিনেছিলাম জীবনের প্রথম নাটকের বিক্রিলব্ধ লাভের টাকা থেকে। সেটা ছিল মারুতি সুজুকি ৮০০ সিসি। ঘটনাটা তবে গোড়া থেকে খুলে বলি ...

২০০১ সালে প্রথম নাটক পরিচালনা করি। বেশিরভাগ মানুষের মধ্যে যা হয়, প্রথম কাজেই দেখিয়ে দেবার একটা প্রবণতা থাকে। আমার মধ্যেও সেটা ছিল। কিন্তু পরিণতি তেমনটা হয়নি। যা ভেবেছিলাম সেরকম করে নাটকটা বানাতে পারিনি। প্রথম কাজ হিসেবে অনেক ভুলত্রুটি রয়ে যায় (যা দেখলে এখনো বিব্রত ও লজ্জিত হই, যদিও সাধারণ দর্শকরা সেটা বুঝতে পারত না)। নাটকটি বিক্রির চেষ্টা করি এবং যথারীতি ফেল মারি। আমার মাথায় বাড়ি পড়ে ...



কারণ নাটকটি বানিয়েছিলাম স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে। লোনের পুরো টাকাতেও হয়নি, তাই পূর্বের কিছু সঞ্চয় এবং অতিঘনিষ্ঠ বন্ধুর কাছ থেকে আরো লোন নিয়েছিলাম। যদিও আমি প্রডিউসার পেয়েছিলাম তারপরও আমার সিদ্ধান্ত ছিল জীবনের প্রথম নাটকটা আমার নিজেরর টাকায় বানাব। প্রথম কাজ হিসেবে ওইসময় আমার কনফিডেন্স কিছুটা কম ছিল। ভয় আর সংশয় ছিল যে নাটক যদি বিক্রি না হয় তবে প্রডিউসার হয়তো সামনাসামনি বলবে না কিন্তু আড়ালে গালি দিবে - এ্যাহ হালার সত্যজিত হইছে, এমন নাটক বানাইছে বেচন যায় না, আমর ট্যাকটাই জলে গেল।

তাই কোনো রিস্কে না গিয়ে লোন নিয়ে নাটক বানিয়ে নিজে ধরা খেলাম। নাটক বিক্রি হলো না কিন্তু ব্যাংকে প্রতিমাসে কিস্তি দেয়া শুরু করলাম ৪০৭৫ টাকা করে। ভেবে নিলাম আমি ৪০৭৫ টাকা কম বেতন পাই। এভাবে বছর গড়িয়ে গেল। প্রথম নাটক ধরা খাওয়ায় আমি নিজেকে আরো প্রস্তুত করার জন্য সময় নিলাম। এরপর ২০০৩ এর ফেব্রুয়ারি থেকে আবার নাটক নির্মাণ শুরু করি। ২০০৪ পর্যন্ত আমার ২টি নাটক অনএয়ার হয়ে গেল। ২০০৪ এর মাঝামাঝি আমার প্রথম নাটকটা আবার বিক্রির চেষ্টা করলাম এবং অবাক হলাম টিভি কর্তৃপক্ষ অত্যন্ত খুশিমনে নাটকটি কিনে নেয়ায়। ইতিমধ্যে হালকা কিছু নামধাম হয়েছে পরিচালক হিসেবে। তাই প্রথম নাটক অনএয়ার হবে ভেবে খুশি হলেও নাটকের মান নিয়ে কে কি প্রশ্ন করে সেটা নিয়েও দ্বিধান্বিত ছিলাম। কিন্তু টাকা বলে কথা। লোন নিয়েছিলাম ৩ বছর মেয়াদী। প্রায় শোধ হতে চলল। ৭/৮ হাজার টাকা বাকি আছে এমন সময় প্রথম নাটকের বিক্রিলব্ধ টাকা পেলাম। এর আগের নাটকগুলো প্রডিউসারদের ছিল বলে টাকা কম পেতাম। কিন্তু এ নাটকের পুরো টাকাটাই তো আমার। কি করব এতো টাকা দিয়ে?

ভাবলাম হোন্ডা কেনা যাক। তখন ৭০/৮০ হাজার টাকা দিয়ে ভালো ভালো হোন্ডা পাওয়া যাচ্ছিল। বাধ সাধল এক কলিগ (আমার প্রডিউসারও বটে)। তিনি সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার পাশাপাশি টুকটাক পুরোনো গাড়ির ব্যবসা করেন। তিনি বললেন, আরে মিয়া পরিচালক হইছেন, হোন্ডা কিনা জামে বইয়া থাকবেন আর নায়িকা পাশে গাড়িতে বইসা এসি খাইব এইটা কোনো কথা হইল? গাড়ি কিনেন একটা। মাঝে মাঝে নায়িকগো বাসায় লিফট দিবেন। হোন্ডার দামেই গাড়ি মিলে। বুঝছেন তো?

আমিও মাথা নেড়ে বুঝে ফেলি যে আমার এখন হোন্ডার চেয়ে গাড়ির প্রয়োজন বেশি। আমাদের কলোনিতে এক টংদোকানি একটা টয়োটা পাবলিকা দিয়ে ড্রাইভিং শেখাতো। ওকে একটা নাটকে অভিনয়ের সুযোগ করে দিলাম, বিনিমেয় তিনদিন গাড়ি চালনার ট্রেনিং নিলাম। এদিকে প্রডিউসার আমাকে বিভিন্ন জায়গা থেকে খোঁজ নিয়ে একটা মারুতি সুজুকি ৮০০ সিসি কিনে দিলেন। তবে হোন্ডার দামে পেলাম না। টাকা গেল ১ লাখ ১৫ হাজার। মহাখালি থেকে গাড়ি চালিয়ে কাওরান বাজারের অফিসে গেলাম নিজে চালিয়ে।

আমার মারুতি গাড়ির মালিক হওয়াটা অফিসে সবার হাস্যরসের উদ্রেক ঘটালো। রাতে নিউজের ডিউটি শেষে বাড়ি ফেরার সময় সব কলিগরা গাড়িকে টিপেটুপে দেখল, আগ্রহের আতিশয্যে এক কলিগ সামনের বাম্পারে উঠে দেখতে চাইল সেটা কতোটুকু শক্ত। বেচারা বাম্পার সে ভার নিতে অস্বীকার করল তার বামপাশটা একটু ঝুলিয়ে দিয়ে।

গাড়িটা চালানোর সময় তেমন কোনো সমস্যা হয়নি আর এরপরে। তবে জাহাঙ্গিরনগর ইউনি থেকে ফেরার সময় ফ্যানবেল্ট ছিড়ে গিয়েছিল, মুন্সীগঞ্জে যেতে ফেরিতে উঠার সময় গাড়ির তলে বিশাল বাড়ি খেয়েছে, অফিসের পার্কিংয়ে টায়ার পাংচার হয়ে ৪ দিন বসেছিল। একবার পুলিশে ধরেছিল, গাড়ির কাগজ, লাইসেন্স কিছুই ছিল না জেনেও টিভির লোক বলে ছেড়ে দিয়েছিল। খুব তাড়াহুড়ো করে একদিন অফিস যেতে হবে অথচ ঠিক সার্ক ফোয়ারার কাছে গাড়ির স্টার্ট বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, বাকি রাস্তাটুকু ঠেলে আনতে হয়েছিল। এছাড়া রাস্তায় বাস-মিনিবাস হেলপাররা সাইড নেবার জন্য যখন ড্রাইভারকে বলত -উসতাদ, বামে পেলাশটিক, ডাইনে চাপান- তখন আমি কিছুই না শোনার ভান করতাম। এই ফাঁকে বলে রাখি এতোসব ঝামেলার মাঝখানে কোনো নায়িকাকে আর লিফট দেয়ার সুযোগ করে উঠতে পারিনি। তাই একদিন সন্ধ্যায় বাসায় মা-বাবাকে বললাম, আমি গাড়ি নিয়ে ঘুরছি অথচ তোমরা চড়ছ না। এটা ঠিক না, লোকে কি বলবে! তারচেয়ে একটা ড্রাইভার রাখো। আমি বেতন দিব, আব্বা আপনি গাড়িতে চড়ে অফিসে যাবেন, আর আম্মা তুমি গাড়ি নিয়ে ঘুরতে বেরোবে।

সেইথেকে রেগুলার ওই গাড়ি চালানো আমার বন্ধ হয়ে গেল। মাঝে মাঝে নিয়ে বেরোতাম তবে সবসময় আশংকা থাকতে যে এই বুঝি কোনো গড়বড় করে। অবশ্য বড়সড় কোনো বিপদে কখনো পড়িনি। মাঝখান থেকে উপকার একটা হলো আমি খুব ভালো গাড়ি চালানো শিখে গেলাম। আমি লন্ডন চলে আসার কিছুদিন পর আব্বা-আম্মা ওই গাড়ি বিক্রি করে দিলেন ৮০ হাজার টাকায়, ধারণার চেয়েও বেশি। গাড়ির বাজার থেকে কেনা হলো আরেকটা গাড়ি - টয়োটা করোলা।

লন্ডন আসার পর ড্রাইভিং পাশ করে একটা গাড়ি কিনেছিলাম। সেটার বৃত্তান্তও সবার জানা হয়তো। এরপর আর বহুদিন গাড়ির দিকে নজর দেইনি। যদিও নেট কিংবা পত্রিকায় পুরোনো গাড়িই দেখলেই একটু নজর বুলাতাম। আমার প্রিয় ব্র্যান্ড হলো ভক্সওয়াগন, আর গলফ মডেলটা সবচেয়ে প্রিয়। অথচ এই গাড়ির এতো ডিমান্ড যে আমার সাধ্যের মধ্যে কুলিয়ে উঠতে পারি না কেনার জন্য। অবশেষে সেদিন অফিস যাওয়ার পথে বাসে বসে থেকে দেখলাম একটা গাড়ি বিক্রি হচ্ছে ভক্সওয়াগনের। পরের স্টপে নেমেই গাড়ি দেখলাম। পছন্দ হলো, কিনে ফেললাম। ব্লগার বন্ধুদের সঙ্গে শেয়ার করার জন্যই এই পোস্টের অবতারণা। যে গাড়িটা কিনলাম তা হলো, Volkswagen POLO (Saloon), Blue, 1998, 5 Door, 1.6 Engine, Manual. দাম নিয়েছে 825 পাউন্ড। নিচের ছবিগুলো দেখুন।

2 মন্তব্য:

Ahmed Arif said...

হাসান ভাই, অনেকদিন দেখিনা যে আপনাকে?

admin said...

ঘুইরা গেলাম :-)