Saturday 31 January 2009

যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশী স্টুডেন্টদের সামগ্রিক অবস্থা

এই পোস্ট কারো কারো অনুভূতিতে আঘাত হানতে পারে। এক্ষেত্রে আমি কড়জোরে ক্ষমা চাচ্ছি। তবে অনুরোধ করব 'ব্যতিক্রম কখনো বিধি না' এটা স্মরণে নেয়ার জন্য। পোস্টের বক্তব্য আপনার ভাবনার সঙ্গে না মিললে সেটা অন্যের জন্য হবে না এমনটা নাও হতে পারে। ধন্যবাদ।

বিদেশে কারা পড়তে আসেন? এ বিষয়ে আমার ধারণা ছিল শুধু মেধাবী স্টুডেন্টরাই এটা করতে পারেন। এক্ষেত্রে ছোটবেলা থেকেই 'স্কলারশীপ' নামক একটা জিনিস শুনতাম। অমুক খুব মেধাবী, স্কলারশিপে বিদেশে পড়তে গেছেন এমনটাতেই অভ্যস্ত হয়ে গেছিলাম। পরে আরো শুনতে পেলাম অতো মেধাবী না হলেও টাকাপয়সা থাকলে অনেকেই বিদেশে পড়তে যেতে পারেন। তো মেধার সঙ্গে অর্থ যুক্ত হয়ে বিদেশে পড়ুয়া স্টুডেন্টদের সম্পর্কে ধারণা পাল্টালো - তারা মেধাবী (বেশি কিংবা অল্পবিস্তর) এবং অর্থসম্পন্ন।

ছাত্রছাত্রী বিদেশে পাঠায় এরকম প্রতিষ্ঠান দেখে ধারণা করতাম এরা সবাই ভুয়া প্রতিষ্ঠান। বিদেশে পড়তে ইচ্ছুক স্টুডেন্টদের ভুংভাং দিয়ে টাকা মেরে দেয়। অথচ সেই আমিও একসময় ধরা খেলাম। সম্ভবত প্রথম আলোর কোনো একটা রিপোর্টে এরকম একটা অর্গানাইজেশনের নাম জানলাম যারা ফিজিতে পড়তে ইচ্ছুক স্টুডেন্টদের নানাবিধ ব্যবস্থা ও পরামর্শ দিয়ে থাকেন। আমার বড়ভাই গ্রাজুয়েশনের পর পর্যটন থেকে ট্যুরিজমে কোর্স করেছিলেন, এছাড়াও ছোটবেলা থেকে ফটফট করে ইংরেজি বলায় পারদর্শী, তার খুব শখ হোটেল ম্যানেজমেন্টে পড়ার। আমি খোঁজখবর নিয়ে ফিজিতে তাকে পাঠিয়ে দিলাম। এবং ধরা খেলাম। বড়ভাই ফিজির এয়ারপোর্টে নেমে জানতে পারলেন তাদের ভর্তির প্রক্রিয়ায় ভুজংভাজং আছে। ইমিগ্রেশন অফিসার তাদের তিন মাসের ভিসা দিয়ে ছেড়ে দিলেন। বলে দেয়া হলো তিন মাসের মধ্যে আবার দেশে ব্যাক করতে হবে। আমার বড় ভাই তিন মাস ফিজি ঘুরে জাপান হয়ে দেশে ফেরত আসার সময় কিভাবে যেন জাপানের দুইদিনের ট্রানজিট ভিসা ম্যানেজ করে ফেললেন। বাংলাদেশে ফোন করে বললেন, আমি দেশে ব্যাক করছি না, ইলিগ্যালি জাপানে থেকে যাব। আমার পড়াশোনা করার দরকার নাই। এবার টাকা কামাই করি ...

আমার ধারণা আরো পোক্ত হলো যে বিদেশে স্টুডেন্ট পাঠানোর প্রতিষ্ঠানগুলো আসলেই ভুয়া। সেই সঙ্গে 'অর্থসম্পন্ন মেধাবী'দের জন্যই বিদেশে পড়তে যাওয়া সম্ভব ধারণাটি আরো বদ্ধমূল হলো। তবে বছর দুয়েক পরে ধারণাটির কিঞ্চিৎ পরিবর্তন ঘটে। 'ওয়ার্ক এক্সপেরিয়েন্স' বলে একটা বিষয় আছে যেটার মাধ্যমে বিভিন্ন প্রকারের কোর্সে বিদেশে ছাত্র হিসেবে যাওয়া সম্ভব। বাংলাদেশে একটি টিভি স্টেশন বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর বিদেশে পড়তে যাওয়ার ব্যাপারে আমার আগ্রহ জাগে। ধুপধাপ IELTS দিয়ে 6.0 পেয়ে আমি কানাডার ভ্যাংকুভারে এক কলেজে এ্যাপ্লাই করে দিই দশ মাসের একটি ফিল্ম কোর্সের জন্য। কিন্তু 'ইনসাফিসিয়েন্ট ব্যালেন্স' এর অভাবে ভিসা মেলে না। পড়াশোনার খ্যাতা পুরি বলে মিডিয়ায় আরো ব্যস্ত হয়ে পড়ি।

যখন লন্ডনে এলাম তখন আমি কল্পনাও করি নাই আমার চারপাশের সবাই ছাত্রছাত্রী হবেন। এদের অনেকই তেমন মেধাবী নন (এসএসসি-ইন্টারের রেজাল্ট আমার চেয়েও খারাপ), অর্থসম্পন্নও নন। বিভিন্ন ভুয়া কাগজপত্র (বিশেষত ব্যাংক ব্যালেন্স) দেখিয়ে তারা ভিসা পেয়েছেন। বাংলাদেশী (সেটলার আর ব্রন-ব্রটাপ বাঙালি ছাড়া) যাকেই জিজ্ঞাসা করি সবাই বলে তারা পড়ছেন। কিসব বড় বড় নাম তাদের কোর্সের! কেউ কেউ ৮/১০ বছর ধরে পড়ছেন, পিএইচডি করছেন। পিএইচডি শুনে আমার চোখের সামনে যে দৃশ্য ভেসে উঠে - লাইব্রেরি থেকে বের হচ্ছে কোনো ছেলে, বগলে আর হাতে বই। সকাল বিকাল টিচারের সঙ্গে মিটিং, হস্টেল রাত জেগে পড়ার টেবিলে ঘন ঘন চা খাওয়া, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা কম দেয়া। দেশি বিদেশী জার্নাল ঘাটা, ইউসিসি-বৃটিশ কাউন্সিলে ঘন ঘন আসাযাওয়া। অথচ লন্ডনের পিএইচডির স্টুডেন্টরা দেখি কলেজেও যায় না। কি মেধাবী!!!

যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের স্টুডেন্টরা পড়াশোনা করেন না। শতাংশের হিসেবে হয়তো ৫% হবে যারা সিরিয়াসলি পড়াশোনা করেন। এই সংখ্যার বাইরে অন্যান্য বাংলাদেশী স্টুডেন্টরা পড়াশোনার উদ্দেশ্যে এলেও তাদের মূল টার্গেট পড়াশোনার নামে অর্থ উপার্জন। বিভিন্ন ভিসা কলেজ (যাদের অনেকগুলোর মালিক হচ্ছেন বাংলাদেশীরা) তাদের ভর্তি করে নেয়, নির্ধারিত ফি নিয়ে ক্লাসে উপস্থিতির হার ঠিক রাখে, হোম অফিস ছাড়াও বিভিন্ন ইনকোয়ারির সময় ছাত্রছাত্রীদের সম্পর্কে ইতিবাচক ইনফরমেশন দিয়ে সন্তুষ্ট রাখে কর্তৃপক্ষকে। ওদিকে ছাত্রছাত্রীরা বিভিন্ন অডজব করে অর্থ উপার্জন করছেন।

এসব ভুয়া ভিসা কলেজে পড়তে আসা স্টুডেন্টদের বেশির ভাগেরই (ধারণা করি ৮০%) দেশে গ্রাজুয়েশন কিংবা মাস্টার্স সম্পন্ন করা আছে। দেশে চাকরি না পাওয়ার কারণ ছাড়াও পারিবারিক অস্বচ্ছলতা কাটানোর জন্য তারা বিদেশের এই 'হায়ার স্টাডি'কে বেছে নিয়েছেন। সোজা কথা হলো, কিছুটা পড়াশোনা করার কারণে, মধ্যপ্রাচ্যের শারীরিক শ্রমের কাজে লজ্জিত হয়ে, অর্থ উপার্জনের জন্য ছাত্র সেজে তারা বিদেশ পাড়ি দিয়েছেন। যাই হোক, এই গ্রাজুয়েশন-মাস্টার্স সম্পন্ন স্টুডেন্টদের পাশাপাশি কিছু বাংলাদেশী স্টুডেন্ট (ছাত্রী বেশি) আছেন যারা ইন্টার পাস করেই চলে এসেছেন অথচ পড়াশোনা করছেন না। তাদের জন্য আমার করুণা ছাড়া কোনো সহানুভূতি নেই। কারণ আমি দেখেছি এ টাইপের স্টুডেন্টদের বাংলাদেশে আর্থিক সঙ্গিত বেশ ভালো পর্যায়ে আছে। তাই তারা যখন পড়াশোনা করেন না তখন আমি তাদের ভবিষ্যত সম্পর্কে উদাসীন থাকি। পাশাপাশি যারা পড়াশোনা না করে অর্থ উপার্জন করছেন তাদের সাপোর্ট করি।

স্টুডেন্ট হিসেবে যুক্তরাজ্য কেন পছন্দের তার কয়েকটা কারণ চিহ্নিত করা যেতে পারে। (কারণগুলো বর্তমানের রিসেশনের আগে ভাবতে হবে)
  • লিগ্যাল বা সিটিজেনশীপ পাওয়ার সুবিধা। কোনোমতে সাড়ে নয় বছর কাটাতে পারলে পার্মান্যান্ট রেসিডেন্টশীপের জন্য এ্যাপ্লাই করা যায়। (শুনেছি অস্ট্রেলিয়াতে ২/৪ বছর লাগে তবে ওইখানে ভিসা কলেজের এতো ছড়াছড়ি নেই। তাই স্টুডেন্ট নামধারী হিসেবে থাকতে যুক্তরাজ্যেই সুবিধা বেশি)
  • টাকার মান ভালো। (তবে এখন ক্রেডিট ক্রাঞ্চের জন্য পর্যুদস্ত অবস্থা)
  • সহজে কর্মসংস্থানের (অডজবের) সুযোগ। বাংলাদেশী মালিকানাধীন রেস্টুরেন্টের সংখ্যা প্রায় ১৫ হাজারের মতো। (অবশ্য গত পাঁচ বছরে রেস্টুরেন্টে কাজ করতে বাংলাদেশী ছাত্রছাত্রীদের আগ্রহে ঘাটতি পড়েছে)
  • প্রচুর বাংলাদেশী। তাই দেশজ প্রভাবের মধ্যে থাকা যায়।
  • জীবনযাত্রার মান অন্যান্য পশ্চিমা দেশের তুলনায় ভালো।
স্টুডেন্ট অথচ পড়াশোনা সিরিয়াসলি করছেন না কেন জানার জন্য অনেক স্টুডেন্টদের সঙ্গে কথা বলেছি। প্রত্যেকের মনেই একটা সুপ্ত ইচ্ছা রয়েছে সুযোগ আর সাধ্য মিলিয়ে তারা একসময় পড়াশোনাটা সিরিয়াসলি করবে। তবে এখন কেন পড়াশোনা করছেন না তার প্রধান কারণ পারিবারিক অস্বচ্ছলতা হলেও আরো কিছু কারণ রয়েছে।
  • ন্যূনতম গ্রাজুয়েশন কিংবা মাস্টার্স করা আছে তাই সমাজের চোখে গ্রহণযোগ্যতাও (?) আছে।
  • প্রথম বছরে অর্থ উপার্জনের দিকে ব্যস্ত থাকায় পড়াশোনাটা ধরা হচ্ছে না। কারণ দেশ থেকে হয়তো প্রথম বছরের খরচ আনা হয়েছিল। পরের বছরের খরচ তোলার জন্য প্রথম বছরেই চাকরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়া এবং অর্থ উপার্জনের মজা পাওয়া।
  • মেইনস্ট্রিমে (নামীদামী কলেজ/ইউনি) পড়াশোনার খরচ অনেক।
  • তাই অল্প খরচে মোটামুটি মানের কলেজের ডিগ্রি নিয়ে বাংলাদেশে চাকুরি পাবার অনিশ্চয়তা। আর পেলেও দেশে অবস্থানরত বন্ধুদের সামাজিক/ প্রাতিষ্ঠানিক দারুণ অবস্থানে হীনমন্যতায় ভোগা।
  • পড়ব পড়ব বলে অনেকদিন হয়ে যাওয়ায় লিগ্যাল হওয়ার দিকে ঝোঁক যাওয়া।
  • দেশে ফেরত গিয়ে চাকুরি না করে ব্যবসা করার চিন্তাভাবনা। সেজন্য অর্থ উপার্জনের দিকে অধিক মনোযোগ।
  • ছোটখাট ডিগ্রি নেয়া হলেও পশ্চিমা নিরুদ্রপ জীবনের হাতছানিতে বাংলাদেশে ফেরত না গিয়ে স্টুডেন্ট সেজে নতুন নতুন কোর্স করা আর অর্থ উপার্জন করা।
  • পুনরায় পারিবারিক ধার-দেনা অস্বচ্ছলতা দূরীকরণের বিষয়টি।
এসব কারণ বিবেচনা করে আমারও মনে হয়েছে পড়াশোনা না চালিয়ে এই অর্থ উপার্জন খারাপ কিছু না। পরিবারে একটু সুখের জন্য, বোনের বিয়ে দেয়ার জন্য হাড় কাপানো ঠান্ডায় পত্রিকা বিলি কিংবা সারারাত জেগে টেসকো, সেইন্সবারিতে মাল টানাটানি করার পর পড়াশোনা হয়ে উঠে না। করার দরকারও নাই। বাংলাদেশে রেমিট্যান্স পাঠানোর ক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্যের পরেই বোধহয় ইউরোপ তথা ইংল্যান্ডের স্থান। এখানকার বৃটিশ বাংলাদেশী ছাড়াও বাংলাদেশী স্টুডেন্টদের বড় অবদান রয়েছে এক্ষেত্রে।

তবে যুক্তরাজ্যে ধীরে ধীরে স্টুডেন্টদের সুযোগ সুবিধা কমে আসছে। ধারণা করা হচ্ছিল ২০১২ এর অলিম্পিকের কারণে বৃটিশ সরকার আরো বেশি স্টুডেন্টদের এদেশে আসার সুযোগে ছাড় দেবে। কিন্তু বিশ্বের এই সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক মন্দায় হিসেব উল্টে গেছে। বৃটিশ সরকার হন্তদন্ত হয়ে এখন স্টুডেন্টদের দেশ থেকে তাড়ানোয় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। লন্ডনের বিভিন্ন জায়গায় চাকরুচ্যুত বৃটিশরা যে কোনো নিয়োগে তাদের কথা প্রথমে চিন্তা করার জন্য প্ল্যাকার্ড নিয়ে মিটিং মিছিল করছে। স্টুডেন্টদের ভিসা রিনিউয়ের নিয়মকানুন কঠোর হয়েছে। প্রায়ই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে রেইড দিয়ে স্টুডেন্টদের ডিপোর্ট করা হচ্ছে। গ্রাজুয়েশনের পর স্টুডেন্টদের জন্য দুইবছরের ওয়ার্ক পারমিটি যা ‘আইজিএস’ নামে পরিচিত সেটা দেয়া হয়। এর লোভে অনেকেই ভুয়া কলেজ থেকে গ্রাজুয়েশন দেখিয়ে এই আইজিএস নিয়েছিল। কিন্তু এসব বিষয়ে তদন্ত হওয়া শুরু হয়েছে। আইজিএস প্রাপ্ত অনেক বাংলাদেশী স্টুডেন্ট এতে ফেঁসে যাচ্ছেন।

যারা যুক্তরাজ্যে পড়াশোনা করতে আসতে চান তারা বিষয়গুলো বিবেচনা করবেন। আপনি যে ইউনিভার্সিটি/কলেজে ভর্তি হচ্ছেন যাচাই করে নেবেন সেটা বৃটিশ হোম অফিস কর্তৃক রেজিস্ট্রিকৃত কিনা। নতুবা এয়ারপোর্টে আপনাকে বিপদে পড়তে হবে। ইংল্যান্ডের বাজারে এখন জবের খুবই আকাল। পাউন্ডের মান পড়ে গিয়েছে। বাড়িভাড়া প্রবল কারণ মর্টগেজ তোলার জন্য বাড়ির মালিকরা ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছেন। আপনার অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থেকে সিদ্ধান্ত নিন। কেননা আপনার একটা ভুল সিদ্ধান্ত আপনার সহ পরিবারের স্বপ্নভঙ্গের কারণ হতে পারে।

0 মন্তব্য: