Monday 28 November 2016

ইণ্ডিয়ান চ্যানেল/ ডাউনলিংকড চ্যানেল

সাল ২০০৩। ভারতের শিলংয়ে শ্যুটিং করতে গিয়ে‍ছিল বাংলাদেশী একজন ক্যামেরাম্যান। মনোযোগ দিয়ে কাজ শুরু করলেন, কিন্তু কি‍ছুক্ষণ পরেই কাজ বন্ধ করে দিতে হলো। কারণ, শিলংয়ে তার কাজ করার অনুমতি ‍ছিল না। স্থানীয় এসোসিয়েশন তাকে অনুমতি ‍ছাড়া কাজ করতে মানা করে‍ছে। শ্যুটিং বন্ধ হয়ে গেল। বাংলাদেশী ক্যামেরাম্যান অনেক বোঝানোর চেষ্টা করল। কথা কাটাকাটি শুরু হলো, পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠল। অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটার মতো অবস্থায় চলে গেল পুরো পরিবেশ। কাজে ইস্তফা দিয়ে ফিরে এলেন বাংলাদেশী সেই ক্যামেরাম্যান। দেশে ফিরে সহকর্মী অন্যান্য ক্যামেরাম্যানদের নিয়ে মিডিয়ার শিল্পবান মানুষের কা‍ছে আর্জি জানালেন এ ঘটনার সুরাহা করার জন্য। না, ওই ক্যামেরাম্যান ভারত-বাংলাদেশের যুদ্ধ লাগাতে বলেননি। তিনিসহ সকল ক্যামেরাম্যান আর্জি জানিয়ে‍ছিলেন, বাংলাদেশে কর্মরত অনুমতিহীন ভারতীয় ক্যামেরাম্যানদেরও যেন তাদের দেশে ফেরত পাঠানো হয়।


বিনিময়ে সেই ক্যামেরাম্যানসহ অন্যান্য ক্যামেরাম্যান কী পেয়ে‍ছিলেন, জানেন? বাংলাদেশেই, শিল্পের সাথে তাদের রুটিরুজির বন্দোবস্ত, বন্ধ করে দেয়ার হুমকি। যে শিল্পবান মানুষ এই হুমকি দিয়ে‍ছিলেন,বিভিন্ন মিটিংয়ে শিল্প বাঁচাতে মরিয়া হয়ে বক্তব্য রাখতে দেয়া যায় তাকে।

একুশে টেলিভিশন চালু হওয়ার পর ভারতীয় ক্যামেরাম্যান, পরিচালক ধুমায়ে কাজ শুরু করে‍ছিল এদেশে। এদেরই সতীর্থ হয়ে‍ছিল বাংলাদেশেরই কি‍ছু দোসর। লাল নীল নানা বর্ণিল ফিল্টার ব্যবহার করে ওইসব ভারতীয়রা এদেশের শিল্পবান মানুষের মন জয় করে নিয়ে‍ছিল। আমাদের অভিনয়শিল্পীদের ঘরে তুলে‍ছিল, ‍আবার ‍ছেড়েও গিয়ে‍ছিল।

একজন শৈল্পিক মানুষ দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হন। কিন্তু আমাদের দূভার্গ্য যারা আমাদের শিল্পের নেতৃত্ব দেন তাদের অদূরদৃষ্টির অভাবে আজকে দর্শকরা দেশের টিভি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে‍ছেন। ওইসব ক্যামেরাম্যানরা বিচার পাননি, কিন্তু তারা থেমে থাকেনি। তাদের লাল নীল ফিল্টার না থাকলেও স্বচ্‍ছ কাঁচে ভ্যাসলিন মাখিয়ে ডিফিউজার বানিয়ে‍ছিল। আজকাল HD 16:9 ফুটেজের ‍ছড়া‍ছড়ি। অথচ তখন ওই ক্যামেরাম্যানরা লেন্সের ক্যাপে কালো স্কচট্যাপ লাগিয়ে সিনেমাস্কোপ বানাতো। নাটকে, সিনেমা বানানোর কী অদম্য নেশা ‍ছিল তাদের।

FTPO-র একটি দাবি হলো, এদেশে ডাউনলিঙ্কড চ্যানেলে বাংলাদেশী বিজ্ঞাপন প্রচার বন্ধ করা। খেয়াল করবেন তারা কিন্তু ডাউনলিঙ্কড চ্যানেল বন্ধ করার দাবি জানাননি। শিল্পবান মানুষ উদার হন, তাই হয়তো আকাশসংস্কৃতির এ যুগে বদ্ধ দুয়ারের বিপক্ষে তারা। কিন্তু এখন যদি FTPO–র দাবি মেনে ওইসব চ্যানেলে বাংলাদেশী বিজ্ঞাপন দেয়া বন্ধ হয় তাহলে কি দেশীয় দর্শকরা ওইসব ভারতীয় চ্যানেল ‍ছেড়ে এসে বাংলাদেশী চ্যানেলে নাটক দেখতে হুমড়ি খেয়ে পড়বে? যদি না হয়, তাহলে এই দাবির স্বার্থকতা কী? দেয়ালে পিঠ ঠেকে গে‍ছে বলে যে আর্তচিৎকার শোনা যাচ্‍ছে তাতে তো ওইসব চ্যানেল বন্ধের দাবিই ‍ছিল সবচেয়ে যৌক্তিক। এবং এ দাবি FTPO–র নেতাদের মুখ দিয়ে সরাসরি বের হওয়া দরকার ‍ছিল। এতে দর্শকদের ইচ্‍ছার বিরুদ্ধে হলেও তাদের বাধ্য করা যেত দেশীয় টিভিতে ফিরতে। কিন্তু না, সেটা সম্ভব না আমাদের কলুষিত শিল্পবানদের পক্ষে।

ওইসব চ্যানেল বন্ধের দাবি জানালে ‘যাদুর শহর ঢাকা’য় তখন ‘ক্লাসিকাল সঙ্গীত’-এর মূচ্‍‌র্ছণা কেটে যাবে। এ যাতনা সওয়া কঠিন। তখন হিসাবেও অনেক গণ্ডগোল হয়ে যাবে।

এ গণ্ডগোলের হিসেব যারা বোঝে না এবং বিদেশি কার্টুন থাণ্ডার ক্যাটস দেখে বড় হওয়া প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা যখন ডোরেমন দেখে বড় হয়, মুখে হিন্দি বোল ফুটে, তখন শিল্পের বাইরের মানুষেরা প্রতিবাদ করে। যখন পাখী ড্রেস না পাওয়ার কারণে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে তখন শিল্পের বাইরের মানুষেরা হিন্দি চ্যানেল বন্ধে আদালতে রীট করে। শিল্পের মানুষেরা সেই ফুরসতে প্রচুর এওয়ার্ড ঘরে তোলে।
 
ওদিকে সরলমনা ভাইয়া ও কোমলমতি আপ্পিরা ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েই যাচ্‍ছেন, কেন ব‍ছরে নামমাত্র দেড়লাখ টাকায় ডাউনলিংক চ্যানেল চলার পারমিশন দেয়া হল বাংলাদেশে। পাশাপাশি ভারতে বাংলাদেশী চ্যানেল চালু করতে কেন ৬ কোটি (টাকা না রুপী?) লাগে সে ব্যাপারে প্রশ্নবাণ ‍ছুঁড়‍ছেন। সময়ের এসব সাহসী সন্তানদের মনে কি একবারও প্রশ্ন জাগল না, কেন বাংলাদেশী টিভিগুলো ভারতে চলে না? নাকি ক্রমাগত ভারত বিরোধীতার সংস্কৃতিতে এ একটি নতুন পালক?

ইণ্ডিয়ান মিনিস্ট্রি অফ ইনফরমেশন এণ্ড ব্রডকাস্টিং-এর নিয়ম মতে দেশের বাইরের কোনো চ্যানেলকে (Up-linked from Aboard) ভারতে সম্প্রচার করতে হলে (down-linked in India) স্থানীয় লাইসেন্সড কোনো কম্পানির মাধ্যমে মন্ত্রণালয় থেকে অনুমতি গ্রহণ করতে হবে। ওই কম্পানির (Required Net Worth) থাকতে হবে first টিভির জন্য ৫ কোটি রুপি এবং পরবর্তী প্রতিটি additional টিভির জন্য ২.৫ কোটি রুপী। এখন যদি বাংলাদেশী ৫টি টিভি একত্রে সিদ্ধান্ত নিয়ে ভারতের কোনো কম্পানির মাধ্যমে ভারতে সম্প্রচার চালাতে চায় তাহলে প্রতিটি বাংলাদেশী টিভি অর্থ পরিশোধ করতে পারে এভাবে ৫ + (২.৫ x ৪) = ১৫/৫ = ৩ কোটি। অর্থাৎ ৬ কোটি নয়, ৩ কোটিতেই ভারতে সম্প্রচার সম্ভব যদি ৫টি বাংলাদেশী টিভি একত্রে ভারতে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়। সেক্ষেত্রে ৫টি বাংলাদেশী টিভির মাসিক খরচ পড়বে মাত্র ২৫ লাখ টাকা, দৈনিক ১ লাখ টাকারও কম। বাংলাদেশী টিভিগুলো ভারতে সম্প্রচারে তারপরও আগ্রহী হয় না কেন? এই ফাঁকে বলে রাখি, এ অনুমতি ১০ ব‍ছরের জন্য প্রযোজ্য।

তবে ভারতে ডাউনলিংক করে সম্প্রচার করতে দেশের বাইরের চ্যানেলগুলোকে দুটো ভাগে ভাগ করা হয়ে‍ছে।

1. NON NEWS and CURRENT AFFAIRS CHANNEL
2. NEWS and CURRENT AFFAIRS CHANNEL

এই দুটো ক্যাটাগরিতে যেসব ডাউনলিংকড চ্যানেল ভারতে বর্তমানে চল‍ছে, তার লিস্ট (দুটো লিংক) লেখার শেষে দেয়া আ‍ছে। আগ্রহীরা ক্লিক করে দেখে নেবেন এই দুটো ক্যাটাগরিতে আমাদের টিভি চ্যানেলগুলো ভারতে চালুর অনুমতি পাওয়ার যোগ্যতা রাখে কিনা। আমাদের টিভি চ্যানেলগুলো না পুরোপুরি NEWS চ্যানেল, না পুরোপুরি NON-NEWS চ্যানেল। তাই আমাদের এসব ওরস্যালাইন চ্যানেলগুলো আদৌ ক্রাইটেরিয়ায় পড়ে কিনা সে ব্যাপারে বিশেষজ্ঞদের মতামত জিজ্ঞাসা করা যেতে পারে।

যদি ক্রাইটেরিয়ায় না পড়ে, তাহলে ফ্রিতেও কি ভারত ভ্রমণ সম্ভব আমাদের টিভিগুলোর? তাহলে কি ইউটিউবের কুটি কুটি ভিউয়ারসই (কোন দেশ থেকে হিট পড়ে?) একমাত্র ভরসা হয়ে থাকবে আমাদের?
দেখলেন তো ইণ্ডিয়ানদের দেশপ্রেম। কতো ফ্যাকড়া করে রেখে‍ছে। তবে সবচেয়ে বড় ফ্যাকড়া কোনটা জানেন? বিজ্ঞাপন প্রচারের নিয়ম। ভারতের প্রাইভেট চ্যানেলগুলোতে ঘন্টায় ১২ মিনিটের বেশি বিজ্ঞাপন প্রচার করা যায় না (চ্যানেলের অনুষ্ঠান প্রোমো সহ)। এবং প্রতি ১৫ মিনিট পরপর বিজ্ঞাপন প্রচার করতে হয়। ব্যস এতোটকু ইনফরমেশনই আমাদের দরকার।

দর্শকদেরও একটাই দাবি— পরিমিত বিজ্ঞাপন প্রচার। কিন্তু FTPO নেতাদের দাবিতে এটা নেই। আজকে বাংলাদেশী টিভিগুলো থেকে দর্শকদের মুখ ঘুরিয়ে ফেলার মূল কারণ হলো অতিরিক্ত বিজ্ঞাপন প্রচার। বাংলাদেশে ডাউনলিংক চ্যানেলে দেশী বিজ্ঞাপন চলল কিনা সেটা দর্শকদের মাথাব্যথা নয়। তারা দেশের অনুষ্ঠান দেখতে এখনো আগ্রহী, যদি দেখার সুযোগ করে দেয়া হয়। এ দর্শকদের ফেরাতে চাইলে ডাউনলিংক চ্যানেলে বিজ্ঞাপন বন্ধ নয়, চ্যানেল বন্ধ করার দাবি তোলা যায় যেখানে ভারতে বাংলাদেশী চ্যানেলের প্রবেশের সুযোগ অত্যন্ত সীমিত,প্রায় বন্ধ। কিন্তু নেতারা এ দাবি তুললে ‘যাদুর শহর’ ঢাকার ‘ক্লাসিকাল সঙ্গীত’এর তাল লয় সুর কেটে যাওয়ার ভয় আ‍ছে।

আজকে FTPO–র সকল দাবি মেনে নেয়া হলেও সমস্যার কোনো সুরাহা হবে না, যতক্ষণ না পরিচ্‍ছণ্ন স্ক্রীণে (পপআপ, স্ক্রল, টীকার ‍ছাড়া) পরিমিত বিজ্ঞাপন প্রচার শুরু হচ্‍‌ছে। অথচ এর পরিবর্তে চ্যানেলগুলোর ডাবিং সিরিয়ালের সময় কেড়ে নিয়ে নিজস্ব স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা চল‍ছে অপসংস্কৃতি, শিল্প ও রুটি-রুজির দোহাই দিয়ে (বাধ্য হয়ে ইতিমধ্যে দুয়েকটা টিভি প্রাথমিক অঙ্গিকার করে‍ছে তারা ডাবিং বন্ধ করবে) । যেখানে টিভিগুলোর সাথে এক হয়ে এ সমস্যার সমাধানের প্ল্যান করা উচিত ‍ছিল, সেখানে টিভিগুলোকে প্রতিপক্ষ বানিয়ে ফেলা হয়ে‍ছে।

ব‍ছরে দেড় লক্ষ টাকায় ভারতীয় চ্যানেল চলা অবশ্যই বাংলাদেশ সরকারের গাফিলতি। কিন্তু এটাই কি মূল সমস্যা?

দেশের গুণী নাট্য ও চিত্র পরিচালক অনিমেষ আইচ গত ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৫ সালে তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখে‍ছেন, 
২০০৩ সালের ঘটনা, বয়সে নিতান্তই তরুণ আমি। মাথায় ভূত চাপল একটা টেলিভিশন ফিকশন বানাব। HSBC ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে ফেললাম। স্ক্রিপ্ট লেখা হলো, ‍ছাদের উপর ‍ছোট স্টুডিওতে ‍ছয়মাস চলল রিহার্সাল ও নানান পরিকল্পনা ... ... পাগলামি পাগলামি। সত্য আর সরলতা মিলেমিশে একাকার। নাটকটি/ টেলিফিল্মটি এনটিভিতে প্রচার হলো। আরো অবাক কাণ্ড হলো, ওইবার মেরিল প্রথম আলো পুরষ্কারে শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার, শ্রেষ্ঠ নির্দেশক, শ্রেষ্ঠ অভিনেতা, শ্রেষ্ঠ চিত্রগ্রাহক ইত্যাদি সকল শাখায় পুরষ্কার জেতে আমার কুফা নাটকটি।

আবারও সেই সাল ২০০৩। অনিমেষ আইচের নাটক কুফা, ইংরেজিতে তিনি লিখে‍ছেন KUFA যার আদ্যাক্ষর হলো K. পাঠকবৃন্দ, সেই ২০০৩ সালেও বাংলাদেশে আজকের মতোই ভারতীয় চ্যানেলগুলো জনপ্রিয় ‍ছিল। আপনাদের মনে থাকতে পারে K আদ্যাক্ষরের ভারতীয় সিরিয়ালগুলো (Kumkum, Kasuti zindagi ki, Kyunki saas bhi kabhi bahu thi) ‍ছাড়াও অন্যান্য হিন্দি অনুষ্ঠান জনপ্রিয় ‍ছিল। কিন্তু এগুলো সবকি‍ছু ফেলে দেশের দর্শক অনিমেষ আইচের K আদ্যাক্ষরের কুফা নাটকটি দেখে‍ছে। কারণ ওইসব ভারতীয় চ্যানেলগুলোর মাঝেও দেশের দর্শক খুবই পরিমিত বিজ্ঞাপন বিরতিতে দেশের নাটক দেখার সুযোগ পেত।

এরকম আরো অনেক অনিমেষ আইচ আমাদের ‍ছিল, আ‍ছে, যাদের পাগলামি দর্শকদের দেখতে দেয়ার সুযোগ তৈরি করে দেয়াটাই আমাদের প্রথম ও একমাত্র দাবি হওয়ার কথা ‍ছিল। বাকি সব ধইঞ্চা ...
সরলমনা ভাইয়া ও কোমলমতি আপ্পি, আপনাদের আবেগকে সম্মান করি। কিন্তু যে তরিকায় এগোচ্‍‌ছেন তাতে আপনাদের রুটিরুজি বাঁচবে, বাড়বে— কিন্তু শিল্প মরবে। ধন্যবাদ।



———————————————————


ইণ্ডিয়ান মিনিস্ট্রি অফ ইনফরমেশন এণ্ড ব্রডকাস্টিং রেফারেন্স (লিংক)

ডাউনলিংক চ্যানেলের জন্য আবেদনপত্র

গাইডলাইন

অনুষ্ঠান ও বিজ্ঞাপন কোড

Non‐News & Current Affairs TV channels Downlink into India (Uplinked from Aboard)

News & Current Affairs TV channels Downlink into India (Uplinked from Aboard)

0 মন্তব্য: