Friday 2 December 2016

টিভি দর্শকদের উদ্দেশ্যে কি‍‌ছু কথা ...

FTPO-র আন্দোলনের আগে-পরে থেকেই শিল্পী-কলাকুশলীর কাজের মান নিয়ে দর্শকরা ফেসবুকে, পত্রিকায় FTPO-র প্রকাশিত বিভিন্ন সংবাদের কমেন্ট সেকশনে নানারকম মন্তব্য কর‍‌ছেন। আমি শুরু থেকেই দর্শকদের সাথে আ‍‌ছি এবং তাদের এ প্রতিক্রিয়াকে স্বাগত জানাই। দর্শকরা— নির্মাতা, শিল্পী, কলাকুশলীদের কা‍‌ছে প্রশ্ন ‍‌ছুঁড়ে দিয়ে‍‌ছেন, টাকা দিলেই তারা সুলতান সুলেমান বানাতে পারবে কিনা। আমি ব্যক্তিগতভাবে বাংলাদেশের মিডিয়া যতোদূর চিনে‍‌ছি, তাতে এ অভিমত রাখতে পারি যে, এমন যোগ্য লোক(বল) আমাদের দেশে নেই যাতে অর্থ পেলেও সুলতান সুলেমান বানানো সম্ভব। সুলতান সুলেমানের চেয়ে ঘটনাবহুল মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আজও 'বানিয়ে বানিয়ে সত্য ঘটনার' স্ক্রিপ্ট লেখা হয়। এ বিষয়ে কোনো রিসার্চ করার বাসনাও কারো মধ্যে নেই। সবচেয়ে বড় কথা, সুলতান সুলেমানের মতো ব্যয়বহুল সিরিয়াল বানানো ও তাতে লগ্নীকৃত অর্থ তুলে আনার সম্ভাবনা আমাদের দেশে নাই। তাই, এ চ্যালেঞ্জ ‍‌ছুড়ে দেয়াটা হাস্যকর।


দর্শকরা আরো সমালোচনা কর‍‌ছেন এই বলে যে, আগে বিটিভিতে কতো সুন্দর নাটক হতো, যেমন, অয়োময়, বহুব্রীহি, তারও আগে সকাল সন্ধ্যা ইত্যাদি। কিন্তু দর্শকরা মনে রাখবেন, বিটিভির মনোপলির যুগে আমাদের যা দেখানো হতো, আমরা তাই দেখতে বাধ্য থাকতাম। ভালো ভালো নাটকের পাশাপাশি খারাপ নাটকও প্রচার হয়ে‍‌ছে। প্যাকেজ চালু হওয়ার পর তা বেড়ে‍‌ছে (বিটিভিতেই)। বিটিভিতে অতিরিক্ত বিজ্ঞাপনও প্রচার হতো। আমার মনে আ‍‌ছে, উপস্থাপকের নাটক শুরুর ঘোষণার পর যে বিজ্ঞাপন ‍‌চলত, ওইসময়ে টেবিলে ভাত-তরকারি সাজানো হতো। এরপর নাটকের মাঝে বিজ্ঞাপন শুরু হলে দৌড়ে টেবিলে গিয়ে ভাত খেতে যেতাম। বিজ্ঞাপন বিরতির মাঝেই চটজলদি ভাত খাওয়া সারা যেত। কখনও কখনও বিজ্ঞাপন বিরতি একটু কম হলে প্রায় শেষ হওয়া ভাতের প্লেট নিয়েই দৌড়ে টিভির সামনে চলে যেতাম। তখন কিন্তু এই বিজ্ঞাপন যন্ত্রণাকে আমরা মেনে নিয়ে‍‌ছিলাম। আমরা মেনে নিতে বাধ্য ‍‌ছিলাম।

এখন এই অয়োময়, বহুব্রীহি যতো ভালো নাটকই হোক, মাত্রাতিরিক্ত বিজ্ঞাপন বিরতি দিয়ে যদি আপনাকে দেখতে বলা হয়, দর্শক হিসেবে আপনি দেখবেন? সাথে সাথেই রিমোট টিপে চলে যাবেন আরেক চ্যানেলে। আজকে কোটি টাকা বাজেট দিলে কিংবা স্বয়ং সত্যজিৎ, ঋত্বিক আকাশ থেকে নেমে এসে নাটক বানালে আর সেটা ৫ মিনিট দেখিয়ে ১২ মিনিট বিজ্ঞাপন চালালে (পপআপ, স্ক্রলের কথা না-ই বলি) দর্শক হিসেবে আপনি প্রথম সুযোগেই ভেগে যাবেন। মান নিয়ে মাথা ঘাঁটাবেন না। সুতরাং মান খারাপ মান খারাপ করে আর শিল্পী-কুশলীর জীবন দুর্বিষহ করে তুলবেন না। বাজেট ভালো, কন্টেন্ট ভালো সর্বোপরি মান ভালো থাকলেও বিজ্ঞাপনের যন্ত্রণায় আপনি দেখতেন না।

দেশের চলমান মিডিয়া আন্দোলন নিয়ে আমার পূর্ববর্তী কোনো লেখাতেই তাই মানের প্রশ্ন আনিনি। কারণ আমি জানি, কী সীমাবদ্ধতায় তারা কাজ করেন। সাথে সাথে এটাও মানি দেশের মিডিয়ার নানা সেক্টরে অর্ধেকেরও উপর অযোগ্য লোক ভরে গে‍‌ছে। তারপরও কি‍‌ছু মানুষতো আ‍‌ছেন (সবসময়ই থাকেন) যারা মান নিয়ন্ত্রণে প্রাণপাত করেন। আমি তাদের প্রতি সম্মান রেখে মানের প্রশ্নে এখনও কোনো সন্দেহ রাখি না।
কিন্তু সন্দেহ রাখি সেই মানসম্পন্ন নাটক প্রচারে দর্শক হিসেবে আপনার অংশগ্রহণ আসলেই নিশ্চিত হবে কিনা। শিল্পী, কলাকুশলীদের মান নিয়ে প্রশ্ন জারি রাখুন, কিন্তু মানসম্পন্ন অনুষ্ঠান দেখার সুযোগ তৈরির জন্য আপনারাও এগিয়ে আসুন। আমি বিশ্বাস করি, হাজারও অপসংস্কৃতির(?) ভিড়ে আপনারা আজও বাংলাদেশের নাটক দেখতে ভালোবাসেন।

আমি যতোদূর জানি, টেলিভিশন দর্শক ফোরাম বলে একটি সংগঠনের অস্তিত্ব আ‍‌ছে। আপনারা পথে নামুন। আপনাদের এক দফা দাবি হোক— সহনীয় বিজ্ঞাপন বিরতি ও পরিচ্‍‌ছণ্ন স্ক্রিণ।

সুবিধাভোগীদের ঝেঁটিয়ে ইউটিউবে পাঠিয়ে দিন। ওখানেই তারা চরে খাক।

প্রিয় দর্শক, 'অন্তত প্রাইম টাইমে' ঘন্টায় ১৫ মিনিট (৩ মিনিট বেশি ধরলাম) বিজ্ঞাপন প্রচারের নীতিমালা থাকলে, আপনি মাত্র ৫ মিনিটের বিজ্ঞাপন বিরতিতে আরাম করে নাটক দেখতে পারবেন। তখন টিভিগুলোর মাঝে প্রতিযোগিতা শুরু হবে, কারণ ওই ১৫ মিনিট বেচে তাদের এক ঘন্টার চাঙ্কের পয়সা তুলতে হবে। বাজারে টিকে থাকতে হলে শুরু হবে কোয়ালিটির (মানসম্পন্ন) অনুষ্ঠান/ নাটক কেনা। তখন মেধাবীরাই এগিয়ে আসবে।

সুধী দর্শক, ইণ্ডিয়ার চ্যানেলে বাংলাদেশী বিজ্ঞাপন বন্ধ হলে ওই জায়গায় ইণ্ডিয়ান বিজ্ঞাপন চলবে, এতে আপনার ইণ্ডিয়ান সিরিয়াল দেখতে অসুবিধা হবে না। ডাব বন্ধ হলে আপনি ইউটিউবে দেখবেন নয়তো ভিনদেশী আরেকটি টিভিতে সময় দেবেন। এআইটি পূণঃনির্ধারণে আপনার পকেটের অবস্থা আগের মতোই থাকবে। এজেন্সি গেলে, কমিশনিং আসবে, সিণ্ডিকেট আসবে। ইণ্ডিয়ান আর্টিস্ট বাংলা নাটকে অভিনয় করলেই কী বা না করলেই কী, আপনি তো বাংলা নাটক দেখেন না আজকে ৬/৭ ব‍‌ছর ধরে।

সম্মানীত দর্শক, সুষ্ঠু 'বিজ্ঞাপন প্রচার নীতিমালা' হলে অনেকেরই সমস্যা হবে। কয়েকটা টিভি বন্ধও হতে পারে (অথবা মালিকের প্রচুর অর্থলগ্নী করতে হবে)। রঙ মাখা কি‍‌ছু অভিনয়শিল্পী ফেসবুকের প্রোফাইলেই লটকে থাকবে। কি‍‌ছু নির্মাতা ড্রিম প্রজেক্ট ড্রিম প্রজেক্ট বলে বিভিন্ন মোড়ে, হাউসে, এজেন্সিতে ঘুরতে থাকবে। কি‍‌ছু স্ক্রিপ্টরাইটার গুগলের সার্চবক্সে romantic short stories লেখাটির দিকে তাকিয়েই থাকবে। কি‍‌ছু প্রযোজক ল্যাপটপ আর আইফোন ফেরত চেয়ে sms লিখবে।

কিন্তু শিল্প বাঁচবে।

পুনশ্চ : অনেকে বল‍‌ছেন, ক্যাবল অপারেটরদের কা‍‌ছ থেকে অর্থ নিয়ে টিভিমালিকদের দেওয়া হোক। আমি এতে সম্পূর্ণ একমত। বাংলাদেশেই সম্ভব, চোখের সামনে অন্যের মাল (কন্টেন্ট) বেচে ব্যবসা করে পয়সা না দেয়া। তবে এটা হতে পারে সেকেণ্ড দাবি। এবং টিভি মালিকরা সরকারকে চাপ দিয়ে ক্যাবল অপারেটরদের বাধ্য করে পয়সা আদায় করে নেবে FTPO কে সাথে নিয়ে। কিন্তু আবার এমনও উদাহরণ আ‍‌ছে (যেমন, বৃটেনে) সম্পূর্ণ ফ্রি চ্যানেল হওয়ার পরও শুধুমাত্র কন্টেন্টের জোরে বিজ্ঞাপনের অর্থ দিয়েই তারা লাভবান হচ্‍‌ছে।

0 মন্তব্য: