Monday 21 July 2008

ভারত, বিডিআর, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আর কিছু কথা

জরিপের কাজে আমি বাংলাদেশের অনেক জায়গাতেই ঘুরেছি। ইন্টারভিউয়াররা যখন হামলে পড়ত সিলেট, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার যাওয়ার জন্য তখন আমি কোণে পড়ে থাকা পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া, রংপুরের পীরগঞ্জ, খাগড়ছড়ির দীঘিনালা, পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ, ভোলার মনপুরা কিংবা বরিশালের গৌরনদী তুলে নিতাম। আমার লজিক ছিল বাংলাদেশের বিখ্যাত জায়গাগুলোতে কোনো না কোনোদিন যাওয়া হবেই। তাই এই ফাঁকে অখ্যাত অঞ্চলগুলোতেই বরং যাই। তাই ঘটেছে। বন্ধুদের সঙ্গে গিয়েছি কক্সবাজার-সেন্টমার্টিন, বান্দরবানের চিম্বুকে-কেওকারাডংয়ে, সিলেটের জাফলংয়ে। আমার বরাবরই সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলো বেশ পছন্দের ছিল। কি সেটা নদীপথের, পাহাড়ের কিংবা সমতলের।


একবার বৃষ্টি দেখতে গিয়েছিলাম সিলেটের জাফলংয়ে। ঝুমবৃষ্টির মধ্যেই আমরা ছোট ডিংগি নৌকায় নদী পার হয়ে একটা ছোট চাবাগানে যাই। এদিক সেদিক ঘোরাঘুরির পর একজন বিডিআর সদস্যকে দেখতে পেয়ে কাছে যাই। আমরা তো আনন্দে বৃষ্টিতে ভিজছি কিন্তু সেই বিডিআর রাইফেল কাঁধে ঝুলিয়ে ফুটো হয়ে ছাতায় বৃষ্টি আগলে দাঁড়িয়ে দূরে তাকিয়ে আছেন। বয়স হয়তে ৪০-৪৫ হবে। কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করি,

: আপনি কি দেখেন?
: ইন্ডিয়া। মানুষ।
: কই কিছুই তো দেখি না। খালি তো পাহাড়।
: আমি দেখি। ওই যে ওইদিকে দেখেন।

বিডিআরের নির্দেশিত দিকে আমি আঙ্গুল তুলে বলি,

: ওই দিকে ?
: আরে কি করেন। হাত নামান। হাত তুইলা দেখাইয়েন না।
: কেন? গুলি মারবে?
: মারতেও পারে।
: আচ্ছা ওরাও কি আপনারে দেখে?
: হ দেখে। ওরা দূরবীন দিয়া দেখে বাংকারে বইয়া।
: আপনের দূরবীন কই?
: আমি আল্লাহর দূরবীন দিয়া দেখি।

আমি লোকটার চোখে তাকাই। ভ্রু কুঁচকে ক্রমাগত চোখ এপাশ ওপাশ করে কি যেন খুঁজছেন। কাঁধ থেকে ঝুলে থাকা রাইফেলটা শক্ত হাতে চেপে ধরে আছেন। আল্লাহর দেয়া দুই দুরবীন তখন চকচক করছে।

: আচ্ছা কাদের অস্ত্র বেশি আধুনিক? বিডিআরের না বিসিএফের?
: আমাগো বন্দুকগুলা ভালো।
: কিরকম?
: ওরা তো একটা গুলি মাইরা মুইতা ঠান্ডা কইরা আবার গুলি মারে। আমরা ততক্ষণে অনেকগুলা গুলি করতে পারি। চাইনিজ মাল তো।
: তাইলে পেপারে যে এতো পড়ি বিএসএফ খালি বিডিআর মারে।
: কারণ ওগো সিস্টেম ভালো।
: কিরকম সিস্টেম?
: হাত তুইলেন না। আমি যেদিকে কই হেদিক তাকান। দেখছেন ওই যে গাছের নিছে একটা ছোট ঘর। ওইটা একটা ওয়াচক্যাম্প। ওইখানে কমপক্ষে ৪টা বিএসএফ আছে। তারপর ডানদিকে দেখেন আধামাইলও হইব না আরেকটা। দেখছেন?
: না।
: আরে বড় গাছটার আড়ালে। ওইখানে আরো ৪/৫ জন আছে। ওগো ক্যাম্পগুলার মধ্যে চলাচলের লাইগা গাড়িও আছে। এহন যদি আমারে গুলি মারে তাইলে একলগে কয়টা মারতে পারব চিন্তা করেন। আমি যদি বাঁইচাও যাই, নদী পার হইয়া ক্যাম্পে যাইতে পারুম না। কারণ গুলির শব্দে সব মাঝিরা নৌকা নিয়া ঘাটে যাইব গা ভয়ে। আমার কাছে ওয়ারল্যাসও নাই যে ক্যাম্পে খবর পাঠামু।
: তাইলে আপনারা এভাবেই ডিউটি করেন? ভয় লাগে না?
: কিয়ের ভয়? আমার কোনো ডর ভয় নাই।

ডরভয়হীন অকুতোভয় এই সীমান্তরক্ষীরে আবারও একলা ফেলে আমরা চলে যাই। অহেতুক আত্মতৃপ্তি নিয়ে ফিরি - আমাগো চাইনিজ মাল, ওগো বন্দুক দিয়া গুলি বাইরাইলে মুইতা ঠান্ডা করতে হয়। কিন্তু ভাবি না ওই ‘সিস্টেম’-এর কথা। আল্লাহর/ ভগবানের দুরবীন দিয়া সীমান্ত পাহারায় পাঠিয়ে দিই হান্নান আর কৃষ্ণপদদের।

* * * * * * * * * * * * *

আমি ইন্ডিয়ায় ছিলাম টানা চারমাস। অম্লমধুর অনেক অভিজ্ঞতা সেখানে হয়েছিল। ইন্সটিউটের অনেকের সঙ্গেই বাংলাদেশ প্রসঙ্গে আলাপ হয়েছিল। দুয়েকজন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, তুমি পাসপোর্ট নিয়ে এসেছ কেন এখানে? ইন্ডিয়ায় আসতে কি তোমাদের পাসপোর্ট লাগে? কই নেপালী কারো তো লাগে না।

এই অজ্ঞতা অবশ্য ইনস্টিউটের সবার ছিল না। কিন্তু বাংলাদেশ নিয়ে সবারই একটা তাচ্ছিল্যভাব এবং আগডুম বাগডুম কল্পনা ছিল। এমনকি কলকাতা ইউনিভার্সিটি থেকে ইংরেজিতে পাশ করা শ্বাশতীও তার কলেজ পর্যন্ত জানত বাংলাদেশে হিন্দুদের শুধু সীমান্তবর্তী কয়েকটি গ্রামেই দেখতে পাওয়া যায়। অনেকে এমন ভাব করত যে, নেপাল আর বাংলাদেশ ইন্ডিয়ারই স্টেট। শুধু দেশ হিসেবে এদেরকে দেখা হচ্ছে আরকি। অনেকই বিশ্বাস করত, আইএসআই-এর আরেকটা সদর দপ্তর বাংলাদেশে আছে। তাদের এ ধারণা যে ইন্ডিয়ার মিডিয়ার তৈরি সেটা আর বলাবাহুল্য।

ইন্সটিউটে আমার একবার হাতাহাতি হয়েছিল একজনের সঙ্গে। ‘বাংলাদেশ - ইট ইজ জাস্ট ফর ইন্দিরা গান্ধী’ এই বাক্যটার বিরুদ্ধে আমার যুক্তিতর্ক সে মানতে পারে নাই। আমাকে সেদিন সে ‘পিটাই’ করত যদি আশেপাশের কেউ না ঠেকাতো। ‘পড়াই কে লিয়ে’ আসার পর আমি বাংলাদেশ নিয়ে এতো কথা কেন বলি?

* * * * * * * * * * * * *

সম্প্রতি বিএসএফ কর্তৃক বিডিআর নিহত হওয়ার ঘটনায় আমি অবাক হই না। পাশ্ববর্তী দেশ হিসেবে ইন্ডিয়ার এই দাদাগিরি নতুন কিছু নয়। বাংলাদেশকে অলমোস্ট নিজের বাজারে পরিণত করে নিয়েছে। বাংগালি জাতিকে আমি সবসময়ই বিপণনবিমুখ একটি জাতি হিসেবেই দেখি। তার উপর খাড়ার ঘা হিসেবে রয়েছে দুর্নীতি। আর তারই সুযোগে প্রতিবেশি এই দেশটি দাদাগিরি ফলাচ্ছে। টেলিভিশনে ইন্ডিয়ান সংস্কৃতি আর পাকিস্তানি ইসলামি জোশের ঠেলায় হারাতে বসেছি বাংগালি কালচার। মুক্তিযুদ্ধ সাহায্য করেছে বলে এদেশীয় কিছু সুশীলের আনন্দবাজারীয় দালালি আর মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত কুত্তার বাচ্চাদের পাকিস্তানি পদলেহনে অস্থির হয়ে গেছে পুরো বাংলাদেশ। আর এসবের গ্যাড়াকলে পড়ে হান্নান আর কৃষ্ণপদেরা ঈদ-পূজায় দেশে যেতে পারে না ….

…. মেজাজ হঠাৎই খারাপ হয়ে গেছে। আর লিখলাম না ….

0 মন্তব্য: