Friday 28 November 2008

কলকাতার উপন্যাসিকদের উপন্যাস নিয়ে বাংলাদেশে টিভি সিরিয়াল বানানোর তীব্র প্রতিবাদ করছি

সর্বপ্রথম কে কলকাতার উপন্যাসিকদের উপন্যাস নিয়ে টিভি সিরিয়াল কিংবা একক নাটক বানানো শুরু করেছিল সেটা মনে করতে পারছি না। তবে আফসানা মিমি-র কৃষ্ণচূড়া প্রডাকশনের 'কাছের মানুষ' সিরিয়ালটিই হয়তো বা প্রথম হতে পারে। সূচিত্রা ভট্টাচার্যের এ উপন্যাস নিয়ে সিরিয়াল শুরু হতে যাচ্ছে এটা প্রথম শুনতে পাই আমার প্রজাপতিকাল টেলিফিল্মের শুটিংয়ের সময়। মেকাপম্যান রবীনের কাছে কাছের মানুষের এককপি দেখতে পেয়ে জানতে পারি মিমি আপা তাকে এই বইটি পড়তে বলেছেন যেন আর্টিস্টদের মেকাপ সম্পর্কে সে আগেভাগেই একটা ধারণা করতে পারে। জানি না মিমি আপা তার অন্য কোনো সিরিয়াল নিয়ে এতোটা সিরিয়াস ছিলেন কিনা অর্থাৎ বন্ধন নাটকের সময়ও কি তিনি তার মেকাপম্যানকে স্ক্রিপ্ট পড়তে দিয়েছিলেন কিনা জানতে পারিনি।


কাছের মানুষ নিয়ে আগ্রহ ছিল। কারণ সানজিদা প্রীতি তাতে অভিনয় করেছিল, সৈনিক ক্যামেরা চালিয়েছিল। প্রীতি আমার সন্ধি নাটক করার পর ড্রিম ফ্যাক্টরির স্পর্শের বাইরে করেছিল। আমি ফাজলামো করে বলতাম, হায়রে প্রীতি, আমার সঙ্গে 'সন্ধি' করে 'স্পর্শের বাইরে' চলে গেলে, এখন আবার আরেকজনের 'কাছের মানুষ' হয়ে গেলে।

কাছের মানুষ টিভিতে কয়েক পর্ব দেখেছি। কলকাতা ঢংয়ের সংলাপগুলো যতোই বাংলাদেশিকরণ করার চেষ্টা হোক না কেন সেগুলো জুৎসই হয়নি। একটা উদাহরণ দিই। অফিসে সেরে গৃহকত্রী বাসায় ফিরেছে। তিনি এখন চা খাবেন। স্বামীকে বলছেন

গৃহকত্রী : এই শুনছ। আমি চায়ের পানি চড়াচ্ছি। তোমার জন্যও করব?

এ সংলাপটা আমার কানে খট করে লাগল। প্রচুর পরিমাণে কলকাতার উপন্যাস পড়ার ফলে আমি বুঝতে পারি এটা নিতান্তই সাদামাটা সংলাপ, কলকাতাবাসীদের জন্য। আমি হাজার চেষ্টা করেও মনে করতে পারিনি আমার এ বয়স পর্যন্ত কোনো বাংলাদেশী কাউকে 'চায়ের পানি' বেশি করে চড়াবে কিনা জিজ্ঞেস করছে। বরং এমনটাই শুনেছি যে,

গৃহকর্ত্রী : আমি চা খাব। তুমি খাবে? বানাব?

শুনেছি কাছের মানুষকে বাংলাদেশিকরণ করা হয়েছিল কিছু কিছু শব্দ পরিবর্তন করে। যেমন, জানালার কপাট লাগিয়ে দাও না বলে জানালা লাগিয়ে দাও; বাতিটা নিভিয়ে দাও না বলে লাইটটা অফ করে দাও।

পত্রপত্রিকায় আগেই পড়েছিলাম আর এই সেদিন বিডিনিউজে এই রিপোর্টটা পড়ে আরো বেশি হতাশ হয়েছি। এখন বাংলাদেশে বেশ জোরেসোরেই চলছে কলকাতার উপন্যাস নিয়ে টিভি সিরিয়াল বানানোর হিড়িক। আমি এর তীব্র বিরোধিতা করছি।

রিপোর্টে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জেগেছে যে বাংলাদেশে কি ভালো স্ক্রিপ্টের অভাব! বেশিরভাগই তা স্বীকার করেছেন। আমিও মানি। কিন্তু এর কারণে অন্য কারো দ্বারস্থ হতে হবে এতোটা অভাবগ্রস্ত আমরা নই। কলকাতার উপন্যাসগুলোর পটভূমি কি? কারা কথা বলে ওইসব উপন্যাসে? কি বলে? কতোটা বাংলাদেশের দৈনন্দিন জীবনযাপনকে ছুঁয়ে যায় সেসব?

এটিএন বাংলার অনুষ্ঠান উপদেষ্টা নওয়াজীশ আলী খান বলেছেন,
আমাদের দেশের নাটকে তাদের গল্প-কাহিনী ব্যবহারের ফলে আমাদের নাটকে কোনো প্রভাব পড়ছে না। এখন আমাদের দেশে চ্যানেলের সংখ্যা নয়টি। প্রতিদিন গড়ে নাটক প্রচারিত হচ্ছে প্রায় ২০টি। এর মধ্যে তাদের গল্প নিয়ে তৈরি নাটক খুব বেশি প্রভাব ফেলবে না। তবে আমাদের যে স্ক্রিপ্ট সংকট চলছে সেটার জন্য আরো বেশি নিজেদের মেধা-মনন, সময় এবং শক্তি দিয়ে স্ক্রিপ্ট বানানো উচিত। 
জ্বি না জনাব। তাদের গল্প-কাহিনী আমাদের উপর প্রভাব ফেলছে। যে হারে জাকজমক করে, সাংবাদিক সম্মেলন, মহরত, প্রেস কনফারেন্স করছে তাতে পরোক্ষভাবে দর্শকদের ওদের নাটক দেখানোয় উৎসাহিত করছেন। তাই ফাঁকে ফুঁকে চলছে বলে অন্য নাটকের উপর প্রভাব ফেলবে না একথা আপনি বলতে পারেন না। যে স্ক্রিপ্ট সংকট চলছে, তা মেটানোর জন্য বাংলাদেশের স্ক্রিপ্ট রাইটারদেরই আরো বেশি বেশি সুযোগ দিতে হবে।

ফাল্গুনী হামিদ বলেছেন,
এই যে বাইরের গল্প নিয়ে কাজ করি, অনেকে বলেছেন, এটা এক ধরনের নাম কামানো এবং ব্যবসা।
 একদম ঠিক বলেছেন, নাম কামানোর ব্যবসা ছাড়া এটা আর কিছুই নয়। কারণ পরের লাইনে আপনি বলছেন
আমি বলতে চাই সমরেশের একটা নাটক বানালে চ্যানেল আমাকে যে টাকা দেবে, এক্স বা ওয়াই-এর নাটক বানালেও ঠিক ঐ পরিমাণ টাকাই দেবে।
 তাহলে কেন সমরেশের জায়গায় একটা বাংলাদেশী স্ক্রিপ্ট রাইটারকে সুযোগ দিচ্ছেন না। আপনি এতো ভালো স্ক্রিপ্ট বুঝে সমরেশের উপন্যাশ হাতে নিয়ে নিচ্ছেন তো দুর্বল স্ক্রিপ্ট শক্তিশালী করুন না স্ক্রিপ্ট রাইটারের সঙ্গে বসে। আপনি নিজেই ভাবুন না, গল্প দিন না, দেখেন স্ক্রিপ্ট রাইটার কি করে।

মেজবাউর রহমান সুমন বলেছেন, 
আমাদের এখানে ভালো স্ক্রিপ্টের আসলেই খুব অভাব ... ভারতের লেখকদের লেখা নিয়ে একারণেই বেশি কাজ করা হয় যে, তাদের প্রেক্ষাপট আর আমাদের প্রেক্ষাপট অনেক কাছাকাছি। 
 সুমনের কাছ থেকে এরকম কথা আশা করিনি আমি। তাকে খুব উঁচুমানের পরিচালক ভাবি। একটি ভুল ধারণা পোষণ করছেন তিনি। ভারতীয় বাঙালি আর আমাদের সামাজিক প্রেক্ষাপট এক নয়। তাদের চিন্তাভাবনার উপায়ের সঙ্গে আমাদের মেলে না। রবীন্দ্র, নজরুল, বৈশাখ উদযাপন দিয়ে প্রেক্ষাপট একভাবার তরিকাটা খুবই দুর্বল। ওখানকার শ্রমজীবী আর আমাদের শ্রমজীবী গরিব মানুষের শরীরে ঘাম হয়তো একই রকম দেখতে হয়, কিন্তু তাদের জীবনধারা, সংলাপ সম্পূর্ণ আলাদা।

ওপার বাংলার উপন্যাস নিয়ে সিরিয়াল, নাটক, ফিল্ম বানানোর দায়িত্বটা অনেকেই নির্মাতার উপর ছেড়ে দিয়েছেন। কিন্তু আমার কথা হচ্ছে একজন নির্মাতা সুনীলের, সমরেশের, শীর্ষেন্দুর চরিত্রগুলোকে বাংলাদেশের মাঠেপ্রান্তরে কিভাবে চড়াবেন? বাতিটা নিভিয়ে দাও না বলিয়ে লাইট অফ করে দাও টাইপ সংলাপ প্রতিস্থাপন করে। তার মানে হলো আপনাদের ওদের সাহিত্যকে ঘষামাজা করতে হয়। তো এ পরিশ্রমটা এখানকারই কোনো স্ক্রিপ্ট রাইটারের সঙ্গে বসে করুন না।

আমাদের দেশের কটা নাটক ওদের টিভিতে চলে। টিভিই তো দেখায় না। এক 'বেদের মেয়ে জোসনা' রিমিক হয়েছিল, তারপর তো আর কোনো খবর পাই না। নির্মাতাদের বলি, পারলে চেষ্টা করেন বাংলাদেশী কোনো স্ক্রিপ্ট রাইটারের স্ক্রিপ্ট ওদের টিভির নাটকের জন্য কোনো ডিরেক্টরকে গছিয়ে দিতে।

আনন্দবাজারের বাজার দরকার। তাদের বই বিক্রির বাজার দরকার, সেটা তৈরি করেও নিয়েছে। এখন হাত বাড়িয়েছে টিভির দিকে। দাদাদের বলি, কষ্ট করে কলা খান। আসেন বাংলাদেশে। থাকেন টানা কয়েকমাস। তারপর বাংলাদেশী চরিত্র নিয়ে গোটা কয়েক স্ক্রিপ্ট লিখে দিয়ে যান।

এপার বাংলা-ওপার বাংলার সাংস্কৃতিক বন্ধন বলে যে মোয়াটা খাওয়ানো হচ্ছে তাতে আমাদের পক্ষে ভাগটা কমই পড়ছে। এটা সুস্থ চর্চা না। তাদের আগ্রাসনের মনোভাবটা বড়ই নির্মম।

বাংলাদেশি নির্মাতাদের প্রতি অনুরোধ, শিল্পের দোহাই দিয়ে অন্য কাউকে প্রমোট করার চেষ্টা করবেনা প্লিজ। আমাদের সংস্কৃতিতে উপাদান কম নেই। ব্লগেই ঘুরে দেখুন না, আপনার পছন্দের স্ক্রিপ্ট পেয়ে যাবেন। যদি পারেন, সমানে সমান হন। ওদের একটা নাটক বানালে আদায় করে নিন আমাদেরও কোনো সাহিত্যিকের একটা উপন্যাস ওদের দেশে নাটক হবে। যে হারে দাদাদের তোষণ করা হচ্ছে তা রীতিমতো দৃষ্টিকটু।

ছবি কৃতজ্ঞতা : বিডিনিউজ২৪.কম

4 মন্তব্য:

সেলিম হোসেন said...

akta maaaaaaaaaaaaaaal bote, ar-o photo lagan!!

Anonymous said...

eita asholey ruchi goto bapar... tension neyar kisu nai...

Anonymous said...

আপনার ভাবনা ভাল লাগল।
প্রাসঙ্গিক কিছু লেখার ইচ্ছে আছে। তাতে এই লেখাটার সূত্র উল্লেখ করতে চাই; অবশ্যই যদি আপনার কোন আপত্তি না থাকে, তবেই।

অলৌকিক হাসান said...

আমার কোনো আপত্তি নাই।