Saturday 14 July 2007

সম্ভাবনার মৃত্যু ঘটুক : ০২


ক.
লিটল ডায়মন্ড কিন্ডারগার্টেনের ক্ষুদ্র পরিসর ছাড়িয়ে একদিন মা-র কনে আঙ্গুল ধরে ছেলেটি রামকৃষ্ণ মিশন স্কুলে ক্লাশ ওয়ানে ভর্তি হয়। ছেলেটির মনে আছে দুই বছরের পিঠাপিঠি বড়ভাই এনিয়ে খুব অভিমান করেছিল। ছোট ভাইয়ের সঙ্গে একই ক্লাশে পড়া তার অহমিকায় লেগেছিল। ঘ্যান ঘ্যান করে বারবার তার মা-কে বলছিল, ও তো ছোট। আমি কেন তার সঙ্গে পড়ব? মা আমল দিত না। তাই মাঝে মাঝে চিমটি কেটে ছোটভাইকে বলত, তোর সঙ্গে আমি থাকব না দেখিস।

নিয়তির কি পরিহাস! বড়ভাই সত্যিই সঙ্গে থাকল না। সেই ঘটনার অনেক বছর পরে ২০০৫-এ ছেলেটিকে ছেড়ে চলে গেল সে। এখন সে আকাশে ভাসতে ভাসতে ছেলেটিকে উপহাস করে, দেখলি তো, তোর সঙ্গে আমি আসলেই থাকলাম না ...

খ.
ছেলেটির গল্পের বই পড়া নেশা হয়ে গেল। যা পায় তাই পড়ে ফেলে। দোকানের সাইবোর্ড থেকে শুরু করে রামকৃষ্ণ মিশনের লাইব্ররির সমস্ত কমিকস সে গিলে ফেলে। বাবা বকে, মা কান ধরে মুচড়ে দেয়, ছেলেটির পড়ার টেবিলের বিভিন্ন ঘুপচিতে কিশোর থ্রিলার আরো বেশি জমতে শুরু করে। একদিন পরীক্ষার আগের রাত্রে গল্পের বই পড়ার রেশ ধরে ছেলেটির বাবা রাগে সাদাকালো ফিলিপস টিভিটি ভেঙ্গে ফেলে।

ছেলেটি এরপর থেকে স্কুলে গিয়ে নিয়মিত জেনে নিত, কবে কোন নাটক অথবা ইংরেজি সিনেমায় কি কি দেখিয়েছিল।

গ.
তবে বেশিদিন দেরি হয় না। ন্যাশনালের রঙ্গিন টিভি চলে আসে বাসায়। পড়ালেখার পাশাপাশি ছেলেটির খেলাধূলায় প্রচন্ড আগ্রহ জন্মে। ফুটবলটা সে ভালো খেলত, তখন ক্রিকেটের চল ছিল না। স্কুলে যাবার আগে ও ছুটির পরে কমলাপুর রেলস্টেশনে প্রতিদিন সে ফুটবল খেলে। দল গঠন করে নাম দেয় 'মৈত্রী সংঘ'।

ঘ.
৪টা লেটারসহ স্টারমার্ক নিয়ে মেট্রিক পাস করে ছেলেটি। আপাত শান্ত ছেলেটি কলেজে পরিচিতি পায় দুরন্ত হিসেবে। খেলাধূলা চুলোয় উঠেছে। কো-এডুকেশন কলেজে মেয়েদের সঙ্গ এখন ছেলেটার অতিপ্রিয়। মেয়েরাও বন্ধু হিসেবে ছেলেটির উপর বেশ নির্ভর করে। আর এ সুযোগে ছেলেটিরও কখনো আইসক্রিম, বাংলা ফাইভ, গুলিস্তান পর্যন্ত আসার ভাড়া ম্যানেজ হয়ে যেত। পুরান ঢাকার বড়লোকের মেয়েগুলা আসলেই খুব ভালো ....

ঙ.
কলেজ জীবনের মাস্তির কারণে অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে মেট্রিকপাস করা ছেলেটি এবার ছয় মার্ক কম পেয়ে দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হয়। বন্ধুরা টপাটপ বিভিন্ন জায়গায় ভর্তি হয়ে যাচ্ছে। বড়লোক বন্ধুগুলো কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ করে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি, মেডিকালে ভর্তি হয়ে যাচ্ছে। তাদের সঙ্গে গিয়ে ছেলেটি নর্থসাউথ দেখে, শিকদার মেডিকেল দেখে। বন্ধুরা চা-সিগারেট খাওয়ায়। বন্ধুরা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হবে এই খুশিতে ছেলেটি ছয় নম্বর বাসের হ্যান্ডেল ধরে বাসায় ফিরে।

রাতে বাবাকে ভয়ে ভয়ে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি আইএসটি-তে ভর্তি হওয়ার ইচ্ছার কথা জানায় ছেলেটি। বাবা চিৎকার করে উঠে, কোথায় পাব চল্লিশ হাজার টাকা। যা, ঠেলাগাড়ি চালিয় খা। ছেলেটি কাঁচুমাচু করে, ম্রিয়মান হয়ে যায়।

মধ্যবিত্তের ক্ষোভ সে ঝাড়ে, ঢাকা ইউনিভার্সিটির ভর্তিপরীক্ষায় গল্প লেখে, মেডিকালের পরিবর্তে আবৃত্তি সংগঠনে।

সেই বাবা যখন ফোন করে ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করে, কেমন আছিস তুই? হার্টের অস্ত্রোপচার হওয়া বাবার মধ্যবিত্ত সন্তান তখন বলে, এই তো ভালো, তোমার শরীর কেমন ?

0 মন্তব্য: