Wednesday 25 July 2007

সম্ভাবনার মৃত্যু ঘটুক : ০৩ (শেষ পর্ব)

ক.
টো টো কম্পানির ম্যানজের পদটা বাগিয়ে নেয় ছেলেটি। নাটকের গ্রুপে হল্লা করে, হাতে কয়েক প্রকারের বালা পড়ে মাথায় লম্বা চুল রাখে, হেঁড়ে গলায় কোরাস গায়। কিন্তু এসবের জন্য পয়সা কোথায়? ম্যানেজারের পদটা তো অনারারি।

খ.
বাংলাদেশ চষতে শুরু করে ছেলেটি। জনমত জরিপের কাজে প্রত্যন্ত অঞ্চলের ছাপড়া ঘরে দুধের সরসহ চা, টিমটিমে ল্যাম্পোর আলোয় গ্রামের বাজারে জিলিপী, ন্যাতোনা বিস্কিট আর বাংলা ফাইভের অভাবে নাম না জানা বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে গ্রামের সহজসরল লোকগুলোর মাঝে জীবনের অন্যরকম অর্থ খুঁজে পায় ছেলেটি। গ্রামের সবচেয়ে অভাবী পরিবারটি যখন আতিথেয়তার নামে একমাত্র মুরগীটি জবাই করে ফেলে, তখন ছেলেটির জীবনে 'চাহিদা' নামক বিষয়টি গৌণ হয়ে পড়ে। গেজেটেড অফিসার বাবা বলতেন, শোন ছেলে, সরকারি বেতনস্কেলে সর্বনিম্ন বেতন (সেইসময়ে) মাত্র ৩৪০০ টাকা। তোরা তো অনেক সুখেই আছিস।

ছেলেটি মুরগীর ঠ্যাং চিবোতে চিবোত বাবার কথা ভাবে, হুমম। সর্বনিম্ন বেতনভোগীরা ঈদ করে, পোস্ট অফিসে হয়তো মাসে ৫ টাকা করে সঞ্চয়ও করে। প্রাচুর্য্যের দরকারটা কি?

গ.
৪৮টি জেলা ঘুরে ছেলেটি স্থির হয়। কোথায় তাকে পিস্তলের মুখোমুখি হতে হয়, কোথায় পাড়ার রংবাজ, কোথায় ডিসির হাত কচলানো, ত্যালোনা দেঁতো হাসি পেয়ে ছেলেটি মজা পায়। ঘর হইতে শুধু দুই পা ফেলিয়া ছেলেটি ক্ষান্ত হয় না। নৌকা, বাস, ট্রাক, টেম্পো, রিকশা, সাইকেল, হোন্ডা, মহিষ-গরুর গাড়ি, ট্রলার, স্টিমার, চান্দের গাড়ি পরিভ্রমণ করে ছেলেটি ভাবে উড়োজাহাজে চড়লে পারলে মন্দ হতো না।

ঘ.
চরমভাবে বিতর্কিত শফিক রেহমান খুব প্রিয় ছিল ছেলেটির। 'এ্যাই ছেলে, তুমি কি সপ্তাহে ২০০০ বাংলা শব্দ লিখো'? ছেলেটি না-সূচক মাথা নাড়ায়। 'তুমি কি গাড়ি ড্রাইভ করতে পার?' ছেলেটি বিষ্মিত হয়। 'তোমার গার্লফ্রেন্ড আছে?' ছেলেটি লজ্জিত হয়। 'ফ্লাট বুকিং দেবার জন্য তোমার প্রথম কিস্তি জমাতে পেরেছ?' ছেলেটি ভুরু কুঁচকে যায়। 'সাংবাদিকতা করবে, তোমার যা লেবাস, কনফারেন্স রুমে তো ঢুকতেই দিবে না।' ছেলেটি মাথা নিচু করে স্যান্ডেলের ছেঁড়া ফ্লিপটা পায়ের আঙ্গুল দিয়ে লুকোতে চায়। শফিক রেহমান বলে, দেখো, সবুজে শ্যামলা বাংলাদেশের সবুজ গাছ আর নাই। দেশের বাইরে যাও। দেখে এসো, বাংলাদেশের চেয়ে কতো সবুজ লালন করে তারা। ছেলেটির চোখ চিকমিক করে।

ঙ.
টিভি স্টেশনে চাকরি করে ছেলেটি। হ্যান্ডসাম স্যালারি। বন্ধুরা ঠ্যারে ঠ্যারে তাকায়। প্রাইভেট ইউনি পড়ুয়া বন্ধুরা (অনেকে তখনো পড়ছে) আফসোস করে। একদিন ছেলেটি একটা মারুতি কিনে ফেলে। এবার গাড়িতে করে ঢাকা শহর দেখে সে। সবকিছু ভালো লাগতে থাকে তার। ব্যাংকে পয়সা জমে। শেরাটনের মেলা থেকে হুট করে একদিন একটা ফ্লাটও বুকিং দিয়ে ফেলে ছেলেটি। পাশে থাকা মেয়েটি বলে, ৮০০ বর্গফুট তোমার আমার জন্য অনেক বড় হয়ে গেল।

চ.
৪৮টি জেলা ঘুরে যে 'চাহিদা' জিনিসটি ছেলেটির জীবনে গৌণ হয়ে পড়েছিল তা যেন একটু একটু ফিরে আসে। মধ্যবিত্ত ছেলেটি আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়ে এসবে। এটা না হলে নয়, ওটা করতে হবে। ছেলেটি মাঝে মাঝে হাঁপিয়ে উঠে। সব ছুঁড়ে ফেলতে গিয়েও বাধা পায়। মধ্যবিত্তের চাহিদার শিকল অনেক শক্ত। শরীরে দাগ বসে যায় একটু প্রতিবাদী হলেই ...

0 মন্তব্য: