Wednesday 25 July 2007

ভারতের দিনগুলো (পর্ব ০৫) : এ.এ.এফ.টি

আমার ইনস্টিটিউট ছিল দিল্লীর নয়ডা বলে একটা জায়গায়। ধরা যাক কাওরান বাজার (দিল্লী) থেকে সাভার (নয়ডা) যতোদূর। নয়ডা ছিল একটা ফিল্ম সিটি।জি, টি-সিরিজ, ঈগল, লক্ষী সহ আরো অনেক নামীদামী স্টুডিও ছিল ওইখানে। আমার স্টুডিওটির নাম ছিল এশিয়ান একাডেমী অফ ফিল্ম এন্ড টেলিভিশন। এর প্রথম বাংলাদেশী ছাত্র ছিল ইউরেকা, তারপর আমি, তারপর কামাল (ক্যামেরাম্যান)। পরে শুনেছি আরো অনেকেই ওইখান থেকে কোর্স করে বাংলাদেশের মিডিয়ায় কাজ করছে।

ইনস্টিটিউটের প্রথম দিনেই আমি একটা সিল খাইলাম। ক্লাশ শুরুর আগে আগে আমরা হস্টেলের মোট ৭ জন মিলে চা খাচ্ছিলাম। চা খাওয়ার শেষ পর্যায়ে ক্লাশে যাবার তাগাদা আসলে সবাই তাড়াহুড়ো করে চা শেষ করল। আমাকে বলল, বিলটা দিয়ে দিতে। বলা হলো ক্লাশ শেষে সবাই আমাকে টাকা দিয়ে দিবে। প্রতিকাপ ৩ রুপী করে আমি ২১ রুপী পরিশোধ করে ক্লাশে চলে গেলাম। কিন্তু ক্লাশ শেষে ওই টাকা আর ফেরত পাইনি। আমি নিজেও কারো কাছে চাইনি। ভাই আপনার চা বাবদ ৩ রুপী পাই, দিয়ে দিন - এটা আমি জনে জনে কিভাবে বলি? তাই আমি তখনো এ ঘটনাকে সিল খাওয়া ভাবতে পারিনি। বাংলাদেশে থাকতে কতোই তো বন্ধুবান্ধবকে চা-সিগারেট খাইয়েছি নিজের পয়সায়। কিন্তু দিন পনেরো পর বুঝতে পেরেছি যে ওটা একটা সিল ছিল। এরকম চামে চামে অন্যের উপর চালিয়ে দেয়ার মানসিকতা হস্টেলের সব বন্ধুদের মাঝেই দেখেছি। একজন ছাড়া, সিমলার রজনীশ।

এডিটিং ক্লাশটা এনজয় করা শুরু করলাম। একেবারে নতুন জিনিশ। আর রাধিকার পাশে তো বসার আনন্দ আছেই। ফট ফট করে ইংরেজি বলে রাধিকা। আমার গরিবী ইংরেজি আর খায়েঙ্গা যায়েঙ্গা হিন্দি নিয়ে রাধিকার সঙ্গে সমানবেগে কথা চালিয়ে যেতে লাগলাম। দিনসাতেক পর তার উপকার পেলাম। টিফিন ব্রেকে রাধিকা আর তার স্বামীর জন্য অপেক্ষা করে না। আমরা একসঙ্গে ক্যান্টিন যাই। রাধিকা কফি বানিয়ে খাওয়ায় (ওর ব্যাগে সবসময়ই নেসক্যাফে থাকত)।

নিজের গর্ব করছি না কিন্তু দিন পনেরো পর আমিই যে সবচেয়ে ভালো এডিটিং শিখছি সেটা ক্লাশে প্রমাণ হয়ে গেল। সবাই কোনো না কোনো ভাবে আমার কাছে কিছু জানতে চাইত। ইনস্ট্রাক্টর তো বলেই ফেলল, ক্যায়া হে কাম্মু। তু তো আচ্ছা নিকলা রাহে।

আমার সঙ্গে সঙ্গে অনুরাগ টোমার (এখন জি-নিউজের রিপোর্টার) এবং রাধিকাও ভালো করতে লাগল। রাধিকার সঙ্গে সম্পর্ক আরো সহজ হয়ে গেল। আমি রজনীশ, অনুরাগ, রাধিকা মিলে একসঙ্গে আড্ডা মারতাম। ইন্ডিয়ান বিভিন্ন মিডিয়া সেলিব্রেটি আমাদের ক্লাশে আসত। তাদের কথা শুনতাম। শোলে ছবিটার কথা জানলাম। এই ছবিটা ডিরেক্টর এতোই শুটিং করেছিলেন যে তিনি সবকিছু আওলে ফেলেছিলেন। পরে তার এডিটর তাকে স্টুডিওতে আসতে মানা করে দেন। এবং নিজে এডিট করে পরে ডিরেক্টরকে খবর দেন। পরে আবার তারা দুইজন মিলে হালকা কারেকশন করে ছবিটা রিলিজ দেন।

এ.এ.এফ.টিতে মোট চারটি কোর্স ছিল। এ্যাকটিং, ক্যামেরা, এডিটিং, ডিরেকশন। কিন্তু আমাদের প্রত্যেকেরই ৪/৫ দিন করে সবগুলোরই ক্লাশ করতে হয়েছিল। ইনস্টিটিউটের সবচেয়ে ভুয়া কোর্স ছিল এ্যাকটিং। পোলাপাইনের পয়সা নষ্ট হইছে বইলা আমার মনে হয়। আমার খুবই কম থিয়েটার চর্চার জ্ঞান দিয়ে বরং ওদের অনেক কিছুই শিখিয়ে দিয়েছি। আমরা হাসাহাসি করতাম যখন কিনা ওরা তলোয়ার ফাইট, ঘোড়ায় চড়া এসব শিখত। ওরা ছিল আমাদের স্নেহের পাত্র। তবে অভিনয় শিখতে আসা কলকাতার মেয়ে শ্বাশতীকে সবাই স্নেহ ছাড়াও আরো অনেক কিছুই দিতে চেয়েছিল।

শ্বাশতী থাকত গার্লস হস্টেলে। বলতে অনেক বড় শুনায় কিন্তু গার্লস হস্টেলটি ছিল দুই রুমবিশিষ্ট। তার একটি ফাঁকা আরেকটিতে শ্বাশতসহ আরো একটি মেয়ে থাকত (অফিসের স্টাফ)। দেখতে তেমন সুন্দরি না শ্বাশতী কিন্তু রাধিকার স্বামীপ্রবর থাকাতে শ্বাশতীই হয়ে উঠেছিল সবার আরাধনা। আমিও একটু হালকা চাম নিতাম। ভাবতাম বাঙালি বলে সুযোগটা বোধহয় আমারই প্রথম আসবে।

কিন্তু শ্বাশতী প্রথমেই সবাইকে ক্লিয়ার করে দিল যে এখানে প্রেম-ট্রেম করতে আসেনি। সবাই তার বন্ধু, সুতরাং প্রেম-ট্রেমের চিন্তা কারো থাকলে বাদ দিতে হবে। শ্বাশতীর এরকম ঘোষণাই ভালোই হলো। প্রেমের চিন্তা বাদ দিয়ে সবাই তার 'সবচেয়ে ভালো বন্ধু' হবার চেষ্টা কর। এরমধ্যে গুজরাটের বিশাল বেশ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

আমি একদিন হতবাক হয়ে গেলাম যখন শ্বাশতী সন্দেহের সুরে জানতে চাইল যে বাংলাদেশে হিন্দু আছে কিনা? আমি অনেক যুক্তিতর্ক ও অনেক প্রতিষ্টিত হিন্দুব্যাক্তিদের নাম শুনিয়ে বললাম এরা ছাড়াও মোট জনসংখ্যার ১৫% হলো হিন্দু। তখন শ্বাশতী জানাল সে একবার বাংলাদেশ যেতে চেয়েছিল কিন্তু তখন তার বাবা-মা মানা করেছিল এই যুক্তি দিয়ে। ওইখানে নাকি সে নিরাপদ থাকবে না। আমি সঙ্গে সঙ্গে শ্বাশতীকে আমন্ত্রণ জানিয়ে রাখলাম। বললাম, তুমি শুধু বর্ডার ক্রস করো। তারপর সেখানে থেকে তোমাকে নিয়ে যাওয়া এবং বর্ডার পৌছে দেয়া পর্যন্ত সব খরচ এবং দায়িত্ব আমার। শ্বাশতী হেসে উঠল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, বাংলাদেশ সম্পর্কে আর কি জানো ? শ্বাশতী বলল, বাংলাদেশ অনেক ধনী (কলকাতার তুলনায়)। তোমাদের লিভিং স্ট্যান্ডার্ড অনেক হাই। তোমরা অনেক খরচ কর। এই যেমন তোমাকে দেখে বুঝি। খুবই অতিথিপরায়ণ । প্রচুর মাছ পাওয়া যায় তোমাদের ওইখানে। এবং প্রচুর বন্যা হয়। এতোসব জানো কিভাবে জানতে চাইলে সে বলল, কলকাতায় বাংলাদেশী হাইকমিশনে সে নাকি মাঝে মাঝে যেতো সানন্দ পত্রিকায় ছাপানোর জন্য বাংলাদেশ সংক্রান্ত খবর কালেক্ট করতে।

শ্বাশতী আমাকে জিজ্ঞেস করল, তুমি কি জানো কলকাতা সম্পর্কে? আমি বললাম অনেক কিছুই জানি। তোমাদের দেশে আসার আগে তোমাদের অনেক রাস্তা আর মোড়ের নাম জানি। সিনেমা হলের নাম জানি। তোমাদের ভাঁড়ের চা আমরা ঢাকাতেই কল্পনা করে খেয়ে ফেলি। তোমাদের সাহিত্য আমরা অনেক পড়ি। অনেকেই এজন্যে গর্ব করে। শ্বাশতী খুশি হলো। বাহ অনেক কিছুই তো জানো।

আমি মুচকি হাসি। বলি না আরো জানি যে তোমরা খুব কিপটা। আতিথেয়তায় প্রাণ থাকে না। তোমরা স্বার্থটাই খুব বেশি বুঝো। ...

0 মন্তব্য: