Wednesday 25 July 2007

ভারতের দিনগুলো (পর্ব ০৩) : কালকামন্থন

ঝিকঝিক ঝিকঝিক গান বাজিয়ে পুরো কম্পার্টমেন্টকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে ট্রেনটি। উহ-আহ শব্দে পাশ ফিরে আবার ঘুমিয়ে পড়ার মতো কিছু হকারের 'এই চায়ে, কফি' ছাড়া কোনো আওয়াজ ভেসে আসছে না। এমনকি জানালার পাশের বার্থে গুটিশুটি মেরে শুয়ে থাকা দেবযানী নাকও ডাকছে না। হিমহিম ভাব, শীত লাগছে। রোমেলের দিকে তাকালাম। বেচারা তার বন্ধুর পায়ের কাছে ঝিমুচ্ছে। আমি হালকা ধাক্কা দিয়ে জাগানোর চেষ্টা করলাম। উঠল না। থাক, ঘুমাক। আমি একটু ঘুমিয়ে নিই। ঘন্টা ২/৩ পরে নাহয় আমার বার্থে রোমেলকে ঘুমাতে পাঠাব-এই ভেবে সবচেয়ে উপরে আমার বার্থে উঠে পড়লাম।

কিন্তু ঘুম আসছে না। ঠাণ্ডা লাগছে। ব্যাগ থেকে লুঙ্গিটা বের করে চাদরের মতো করে জড়িয়ে নিলাম শরীরে। ভাবতে শুরু করলাম ভবিষ্যতের কথা। এডিটিং যে শিখতে যাচ্ছি, জীবনে কতোদূর যাব তা নিয়ে? ফিক করে হেসে ফেললাম আপন মনেই। বাবা-মার কথা মনে পড়ল। সায়েনেস পড়ুয়া ছেলে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হবে এমনটাই আশা ছিল তাদের। কিন্তু ছেলে কিনা এডিটিং শিখছে! মজা লাগল ভেবে বাবা-মা কস্মিনকালেও ভাবেনি ছেলে এরকম একটা পেশা বেছে নিতে পারে। পুরোনো সব কথা মনে পড়তে লাগল ...

ইন্টারের রেজালট খারাপ ছিল না। কিন্তু মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষার দিন - ৭ বছর পড়াশোনা করে, ২ বছর ইন্টার্নি করে, পাড়ার ফার্মেসীতে প্রতি সন্ধ্যায় নিয়ম করে বসে দুই-চার-সাত রোগী মেরে অথবা ভালো করে ৪০ বছর বয়সে অর্থ-যশ-খ্যাতি আসে-এটা যখন আমার এক বন্ধু মনে করিয়ে দিল তখন মেডিকেলের পরীক্ষা না দিয়ে আবৃত্তি সংগঠনের পরীক্ষা দিয়ে বাসায় ফিরলাম। বুয়েটে ঢুঁ মারা আমার কপালে নাই (অতো মার্ক আবার ছিল না)। তাই ঠিক করলাম ভর্তি হতে না পারি তবে মাঝে মাঝে আহসানউল্লাহর কেন্টিনে গিয়ে খেয়ে আসব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা খুবই খারাপ হলো। হুমায়ুন আহমেদের কাছে স্বরচিত গল্প লিখেও যখন এডমিশন রেজালেট নিজের নাম দেখলাম না তখন একটু মুষড়ে পড়লাম। ইস...ইন্টারের পরের তিনমাস জীবন চিনতে না গিয়ে যদি একটু বইয়ে মুখ গুঁজে থাকতাম .... একপর্যায়ে ভাবলাম কম্পিউটার সায়েনস পড়া যেতে পারে সিলেটের শাহজালালে। কিন্তু সিলেটে মাছের দাম বেশি এই যুক্তিতে বাবা-মা আমার সিলেটগমন ঠেকিয়ে দিলেন। এদিকে আমি কোনো হেজিপেজি কলেজে 'অমুক বিষয়ে অনার্স করছি' এইরকম দম্ভ করতে পারব না ভেবে একপর্যায়ে ঠিক করলাম তবে আর পড়াশোনাই বা করি কেন ?

দিলাম পড়াশোনা ছেড়ে। এদিক ওদিক ঘুরি। বন্ধুদের প্রচুর সময় ও পরামর্শ দিই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুদের কাছ থেকে জেনে নিই ওদের বান্ধবিদের কথা। রাতে বাসায় ফিরে তাদের কথা নিজের কল্পনায় সুন্দর করে লিখি। লেখাগুলো গল্প হয়ে উঠে। পাশের বিলিডংয়ের রবিকে পড়তে দিই। বন্ধু রবি খুব উৎসা হ দেয়, বাহ! খুব সুন্দর লেখা তো - তোকে দিয়েই হবে - এরকম লেখা কিন্তু খুব বেশি লেখা হয়নি - চালিয়ে যা দোস্ত, তুই সেরা লেখক হবিই। রবির প্রশংসায় আমি লজ্জিত হই না। যেন জানি এরকমটাই হওয়া উচিত। আমি লেখালেখি বাড়িয়ে দিই। ব্যস্ত হয়ে ঢুকে পড়ি গ্রুপ থিয়েটার চর্চায়।

ইন্টার থেকেই যায়যায়দিন রেগুলার পড়া হতো। ভাবলাম লেখালেখির একটা নিয়মিত জায়গা দরকার। সাংবাদিক হলে কেমন হয়? আমার গ্রুপ থিয়েটারের কমর্ী নদীও তার প্রিয় পত্রিকা যায়যায়দিন পড়ে। আমি আর নদী একসঙ্গে লেখা পাঠাই। আমারটা ছাপা হয়, নদীর হয় না। আমি যেন আরো উৎসাহী হই। নদীর চোখে সেরা পুরুষ হবার জন্য আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি যায়যায়দিনের-ই-ই-ই সাংবাদিক হবো। নদী আমাকে নিয়ে গর্বিত হবে, নদীর বান্ধবিরা আমার জন্য নদীকে ঈর্ষা করবে (হায়রে সে দিনগুলো) ...

এই চায়ে, কফি - হকারের ডাকে কালকাগর্ভে ফেরত আসি। চাররুপী দিয়ে কফির পেয়ালা হাত বাড়িয়ে নিই। চুমুক দিতেই শীত যেন আরো বেড়ে গেল। লুঙ্গিটা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে দেবযানীর দিকে তাকাই। আচ্ছা এই মেয়েটার সঙ্গে কি আমার প্রেম হয়ে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা আছে ? ধ্যাত....আপন চিন্তাই ফিরে যাই আবার।

যায়যায়দিনে হঠাৎই চোখে পড়ে ডেমক্রেসিওয়াচের বিজ্ঞাপন। স্মাট হবার আশায় ইংলিশ-কমপিউটার শিখতে শুরুকরি। কিন্তু যায়যায়দিনের সাংবাদিক হওয়া আর হয়ে উঠে না। লাইফস্টাইল ক্লাসে পৃথিবীর বিভিন্ন মুভির কথা বলেন শফিক রেহমান। কিন্তু তার সাপ্তাহিক আর দৈনিক হয় না। তবে ডেমক্রেসিওয়াচে চাকরি হয়। অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে আয়োজন করে ফেলি গণতন্ত্র উৎসব। গণতান্ত্রিক ধারায় আয়োজন করে ফেলি যায়যায়দিনের প্রথম লেখক সম্মেলনও। শফিক রেহমানকে জিজ্ঞেস করি, স্যার কবে হবে দৈনিক ? শফিক রেহমান পালটা প্রশ্ন করে, ডিগ্রি পাস করেছ? তাছাড়া তোমার যে লেবাস প্রেসিডেন্টের ইন্টারভিউর জন্য পাঠালে তো তোমাকে ঢুকতেই দিবে না।

সায়েনেসর ছাত্র আমি চটজলদি ডিগ্রি পাসকোর্সে ভর্তি হয়ে যাই। এফসিএ শফিক রেহমান দুইদিন খুব করে ডেবিট-ক্রেডিট বুঝিয়ে দেন। ওনার মুখে পড়াশোনার কথা শুনতে ইচ্ছা করে না দেখে বন্ধুদের সঙ্গে একাউন্টিংয়ে ব্যাচ পড়ি। এলিফ্যান্ট রোড থেকে ১৫০০ টাকার জুতো দরদাম করে ৪৫০ টাকায় কিনে বুক ফুলিয়ে ডেমক্রেসিওয়াচে বাবার টাই পড়ে অফিস করি। কিন্তু মালা খুব রাগ করে। জুতোটা পড়লে নাকি আমি ওর চেয়ে একটু বেশি লম্বা হয়ে যাই।

আমরা মোট১৩ জন বন্ধু ডিগ্রি পরীক্ষা দিয়েছিলাম। অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে একমাত্র আমি তৃতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হই। (বাকি ১২ জন ফেল করে)। কিন্তু ওদিকে অপেক্ষার বাপ ভেঙ্গে যেতে থাকে। বন্ধু মানিকের পরামর্শে ফোরামের কোর্স করা শুরু করি। কাজ নেই সাংবাদিক হওয়ার। এরচেয়ে ভালো ফিল্মমেকার হই। কিন্তু তাতেও বোর হয়ে যাই। চষতে শুরু করি সারা বাংলাদেশ। ডেমক্রেসিওয়াচের সার্ভেতে নিয়মিত হয়ে যাই। বেঁধে দেয়া পয়সা বাঁচিয়ে নৌকা ভ্রমণ করি, দিনাজপুরের আম কিনি, চাপাইনবাবগঞ্জের রেলস্টেশনে ফেনিস খাই, ক্লান্ত হয়ে বাসে নিপুর কাঁধে ঘুমিয়ে ঢাকা ফিরে আসি, বাসের ছাদে বসে গোপার উড়ে যাওয়া চুল আবার গুছিয়ে দিই, খাগছড়ির পাহাড়ের বাংলোয় মধ্যরাতে জেগে বসে থাকি যদি পাশের রুমে একা থাকা আরজু ডাক দেয় । কিন্তু না হই সাংবাদিক, না হই ফিল্মমেকার। ওদিকে নদীও কোনো যোগাযোগ করে না। অরূপ নামে একটি ছেলের সঙ্গে তার বিয়ের কথা চলছে।

ইউরেকার সঙ্গে পরিচয় হয়। জাহাঙ্গীরনগরের ছাত্র ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট ছিল সে। ভালো বক্তা। একদিন আমাকে সুন্দর করে বুঝিয়ে বলল, এবার চলেন এডিটিং শিখি। আমি গোঁধরে থাকি ক্যামেরাম্যান হব বলে। আমার কমপিউটার দক্ষতা আর কালারসেনস ভালো বলে সার্টিফিকেট দিয়ে ইউরেকা বলে, বিয়ে বাড়ির ভিডিওকরা কমে গেছে। কারণ সবাই প্যাকেজ নাটক শুটিং করছে। কিন্তু সেগুলো জোড়া দেবার লোক নেই। এমনিতেই শেষ ট্রেনের যাত্রী আমরা। তাড়াতাড়ি ইন্ডিয়া চলেন। আমি রাজি হয়ে যাই।

যায়যায়দিন তখন দৈনিক হচ্ছে। সাংবাদিকদের ওয়ার্কশপ চলছে। আমি প্রতিদিন ওয়ার্কশপ এটেন্ড করি আর দিন গুণতে থাকি ইন্ডিয়া যাবার। পরিচয় হয় মাহবুব আজীজ (সমকাল) আর ফাহিমের (এনটিভি) সঙ্গে। ভালো এই দুই বন্ধুকে ফেলে আমি একাই রওনা দিই। ডেমক্রেসিওয়াচের কলিগ এলানা হান্টার আমার হাতে বিয়ার তুলে দেই। বন্ধু মিলন (অভিনেতা) পথ এগিয়ে দেয় অনেকটা ...

...ট্রেনের কম্পার্টমেন্টে মৃদু আলো। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি অন্ধকার কাটতে শুরু করছে। রোমেলের কথা চিন্তা করে জলটি নেমে আসি। ঘুম থেকে জাগিয়ে রোমেলকে পাঠিয়ে দিই আমার বার্থে। দেবযানীর দিকে তাকাই। চাদরের ফাঁক দিয়ে ওর মুখের একপাশ দেখা যাচ্ছে। মন্দ লাগছে না। সকালে ওর সঙ্গে জম্পেশ করে আড্ডা দিতে হবে। ভোর ছয়টা বাজে। কালকা এক্সপ্রেস তখনো সমান তেজে চলছে। স্মৃতিরোমন্থন করতে করতে সময় গুণতে ভুলে গেছিলাম। স্মৃতি রোমন্থন ? থাক, এর নাম দিলাম আমি কালকামন্থন।

0 মন্তব্য: