ইনস্টিটিউটে বেশ ভালোভাবেই দিন কাটছে। প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত ক্লাশ করি। তারপর স্থানীয় 'আট্টা' মার্কেটে আড্ডা মারতে যাই। মাঝে মাঝে বিলিয়ার্ড খেলি, যতো না খেলার উৎসাহে, তারচেয়ে বেশি সুন্দরী মেয়েদের দেখার লোভে। কেএফসি অথবা ম্যাকয়ের মুরগীর ঠ্যাং চিবোতে চিবোতে হস্টেলে ফেরা। মঙ্গলবার হলেই তো কেল্লফতে। কমনরুম জুড়ে প্রচন্ড হল্লা করে টিভি-৬ দেখতে বসে যাওয়া।
দেবযানীকে একদম ভুলে গেছি। এখন অন্তরজুড়ে রাধিকা। খুবই সুন্দরি মেয়ে। ক্লাশের বিরতিতে একটু হাঁটাহাঁটি করা, মাঝে মাঝে হাত ধরা বেশ চলছিল। ওদিকে শ্বাশতীর পাত্তা একদমই গেছে ইনস্টিটিউটে। প্রেম-ভালোবাসার মধ্যে নেই- এরকম ঘোষণা দিয়ে শ্বাশতী ঝুলে পড়ল কাশ্মীরের ছেলে অমিতাভের গলায়। সেই থেকে শ্বাশতী হয়ে গেল সবার চক্ষুশূল। সবার একই কথা, কি দরকারটা ছিল তোর বলার প্রেম করবি না। শ্বাশতীর দোষ এই একটাই। তার সে কি প্রেম! একসঙ্গে না হলে খাবে না, অমিতাভের ক্লাশ শেষ না হওয়া পর্যন্ত শ্বাশতী কোথায় নড়বেই না। সবারই খুব বিরক্তিকর লাগছিল বিষয়টা।
সিমলার ছেলে রজনীশ ছিল আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু। দেদারসে খরচ করত। অন্যান্য ইন্ডিয়ান ছেলেদের মতো কিপটা না। আমি, রাধিকা, রজনীশ মিলে বেশ আড্ডা দিতাম। এরকম একদিন ক্যান্টিনে আড্ডা মারছি, হঠাৎই সুরেশ স্যারের ডাক পড়ল। আমার নাকি চিঠি এসেছে। অবাক হলাম, আমাকে কে চিঠি লিখবে। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ ছিল তখন।
সুরেশ স্যারের রুমে গিয়ে চিঠি নিয়ে এলাম। দেবযানী লিখেছে। সঙ্গে একটা নিউইয়ার কার্ড। চিঠি খুলে পড়তে শুরু করলাম। কাকের ঠ্যাং, বগের ঠ্যাং স্টাইলে চিঠি লিখা। দেবযানী আসলে বাংলা লিখতে পারে না। অনেক কষ্ট করে আমার জন্যই সে এ চিঠিটা লিখেছে। বারাণাসীতে আমাকে দাওয়াত দিয়েছে সে। কোনো এক ফাঁকে যেন যাই বেড়াতে। আমিও মনে মনে ঠিক করলাম যাব একদিন।
একদিন ক্যান্টিনে এক ছেলের সঙ্গে তুমুল লেগে গেল আমার। বাংলাদেশ প্রসঙ্গে কথা হচ্ছিল। কথায় কথায় সঞ্জয় বলল, বাংলাদেশ জাস্ট ফর ইন্দিরা গান্ধী। আমার তো মেজাজ সপ্তমে চড়ে গেল। তাকে বুঝাতে চাইছিলাম, ইন্ডিয়ার সহায়তার জন্য আমরা কৃতজ্ঞ, কিন্তু এটা ভাবলে চলবে না যে স্বাধীনতার জন্য আমরা তোমাদের (ইন্ডিয়া) মুখাপেক্ষী হয়ে ছিলাম। যাহোক, ঝগড়া হাতাহাতির পর্যায়ে যাওয়ার আগেই অন্যান্যরা থামিয়ে দিল।
কিভাবে যে চারমাস কেটে গেল বুঝতে পারিনি। প্রোডাকশন টাইম চলে এলো। সবাই খুব সিরিয়াসলী প্রোডাকশন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। শ্বাশতী খুব ভালো অভিনয় করেছে। সবাই তাকে এপ্রিশিয়েট করলাম। এবং যথারীতি শ্বাশতী অমিতাভের প্রোডাকশনে সবচেয়ে ভালো অভিনয়টা করল। সার্টিফিকেট যেদিন দেয়া হলো, ওইদিন রাত্রে আমরা সবাই মিলে উদ্দাম পার্টি দিলাম। মদ, গাঞ্জা, ভাঙ কোনো কিছুরই অভাব ছিল না সেদিন। রাধিকা-শ্বাশতীকে নিয়ে প্রচন্ড নাচানাচি করলাম।
পার্টি শেষ হয়ে এলো। পরদিনই হস্টেল খালি হয়ে যাবে। কে কোথায় চলে যাবে, তার কোনো ঠিক নেই, আবার কি কখনো দেখা হবে, কেউ বলতে পারে না। সবার খুব মন খারাপ। পানীয়ের কারণে অনেকেই কাঁদতে শুরু করেছে। আমি একমাত্র বাংলাদেশী ছেলে হওয়াতে সবাই আমার কাছেই বেশি আসছিল। ওদের কারো কারো হয়তো দেখা হবে, কিন্ত আমার সঙ্গে নাও হতে পারে। রাধিকা সেদিন আমাকে অনেকক্ষণ জড়িয়ে ধরে রেখেছিল। সারাক্ষণ রাধিকার সঙ্গে ছোঁক ছোঁক করা আমি ওইদিন একেবারেই নিরস হয়ে ছিলাম।
আমার প্ল্যান ছিল কোর্স শেষে বাংলাদেশ যাবার আগে নেপাল ঘুরে যাব। কিন্তু আমার নেপালী রুমমেটের দিল্লিতেই একটা চাকরি ঠিক হয়ে যাওয়াতে সে প্ল্যান বাদ দিতে হয়। কই যাওয়া যায় চিন্ত করছিলাম। তখনই ফোন করলাম দেবযানীকে। বললাম, আমি আসছি। দেবযানী বলল, চলে আয়।
পুরান দিল্লি স্টেশন থেকে মালদহ এক্সপ্রেসে দিল্লি-বারাণাসী এবং তার তিনদিনপর বারাণাসী-কলকাতা টিকেট কেটে ফেল্লাম। ট্রেনে উঠে মন খারাপ হয়ে গেল। চোখের কোণে পানি চলে এলো। এইসব বন্ধুদের সঙ্গে হয়তো আর দেখা হবে না। হয়তো কি, আসলেই তো দেখা হলো না। আমি চোখের পানি মুছে ট্রেণ ছাড়ার অপেক্ষা করতে থাকি।
দেবযানীকে জানিয়ে দিয়েছি কখন পৌছব। দেবযানী বলেছে, আমার জন্য সে স্টেশনে অপেক্ষা করবে।
Wednesday, 25 July 2007
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
0 মন্তব্য:
Post a Comment